#একটুখানি_প্রেম ❤️
#পর্বসংখ্যা_০৩
রাহেলা খানম থমকালেন, চমকালেন। বিস্মিত চোখে বললেন,
— “মানে?”
— “আপনি মাকে খাবার দেন না? মা ক্ষুদার চোটে আমার উপর হামলে পড়েছিল!”
নিষ্প্রাণ কণ্ঠে বললো কাহন। কথাগুলো তার তেজের সহিত বলা উচিৎ ছিল; কিন্তু সে তেজ তার নেই। রাহেলা খানম হঠাৎ কি জবাব দেবেন ভেবে পেলেন না। একটু সময় নিলেন উত্তর দিতে। তারপরেই কর্কশ স্বর তুলে বললেন,
— “কেন দেব না? কিন্তু তোর মা কি ভালো মানুষ? যে চুপচাপ খেয়ে নেবে? খাবার দিলে হাজারটা কথা। গোশত ছাড়া সে খায় না। প্লেট ছুঁড়ে মারে। বলি, তোর মামার কি টাকার গাছ আছে? যে রোজ-রোজ গোশত রাঁধা হবে বাড়িতে? মাছ দিয়ে ভাত দিলে পাগলী খায় না। আমার কি ঠ্যাকা পড়েছে ওকে খাবার নষ্ট করতে দেয়ার? চাল কিনতে টাকা লাগে না? নাকি এমনই এমনই দেয়—”
রাহেলা খানম তার বক্তব্য শেষ করেন নি। এতো দ্রুত তা শেষ হবেও না। কাহনের বুকে ব্যথা শুরু হলো। জীবনের নির্মম সত্যতা আরেকবার অনুধাবন করলো, এক অভাগা সন্তান সে। যে তার উন্মাদিনী মায়ের দায়িত্ব নিতে অক্ষম। দায়িত্ব নিবে কি সে নিজেই এখনও মামার ঘাড়ে বসে খায়! একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে কোনমতে বলে,
— “মাকে একটু খাবার দেয়ার ব্যবস্থা করুন, মামী। তার বোধ হয় ক্ষিদে পেয়েছে!”
বলেই আর দাড়ালো না। দ্রুত পায়ে হেঁটে চলে এলো নিজের ক্ষুদ্র কক্ষে। নিজেকে নিয়ে তার হতাশার শেষ নেই। আচ্ছা, জীবন এমন নিষ্ঠুর কেন?
___
ছোট দুই ভাইকে সাথে নিয়ে কলেজে যাচ্ছে কান্তা। বিষয়টা এমন নয় যে ওর কলেজ যাওয়ার পথেই ওদের স্কুলটা। বরং ওদের স্কুলটা সম্পূর্ণ উল্টো দিকে। পবন-পরাগ ক্লাস ফোরে পড়ে। একা একা স্কুলে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট বড় তবুও ওদের একা ছাড়ে না কান্তা। মার কড়া নিষেধ আছে। মায়ের ধারণা ওদের একা ছাড়া হলেই পবন কিছু একটা অকাজ করবে। যা বিচ্ছু এই ছেলে! পরাগ বোকাসোকা বলে ওকে বিপদেও ফেলতে পারে। তাই রোজ রোজ ওদের স্কুলে পৌঁছে দিয়ে নিজে কলেজে যায় কান্তা।
দুই ভাই গল্প করতে করতে এগোচ্ছে। কথা বলছে পবনই বেশি। ডানপিটে ছেলেটা মায়ের কথা অগ্রাহ্য করে সারাদিন এলাকায় টই-টই করে বেড়ায় বলে সবকিছু খুব ভালো চেনে। নানান অভিজ্ঞতাও আছে তার। সেই নিয়েই গল্প করে করে পরাগকে তাক লাগিয়ে দিচ্ছে! ঘরকুনো পরাগ সেই গল্পগুলো হা করে গিলছে,
— “তারপর কি হলো জানিস? গাছের মগডালে দেখলাম পাখিটাকে। এত্তো সুন্দর পাখি! ইচ্ছে করলো চট করে ওটাকে ধরে রোস্ট করে খাই। পকেটে বাঁটুল ছিল। একটা গুলটি নিয়ে তাক করলাম পাখিটার দিকে। গুলটিটা ঠিকই লেগেছিল ওর গায়ে কিন্তু তারপরেও পাখিটা কীভাবে জানি উড়ে গেল, বুঝলি? বাঁটুল ছিল বলে মারা হয় নি। একটা বন্দুক থাকলে—”
এমনই আরও গল্প চলে ওদের। কান্তা এসময় কিছু বলে না। চুপচাপ শুনে যায়। গল্পের অনেককিছু সত্য হলেও যে তা রং-চং-মশলা মাখিয়ে পবন উপস্থাপন করে এবং পরাগ যে সব অন্ধের মতো বিশ্বাস করে– এটা দেখে ওর হাসি পায়।
খানিক দূরে এগোনোর পর রহমত চাচার দোকানটাকে চোখে পড়লো ওদের। দোকানের ঝাঁপি সবে খুললেন। আর সঙ্গে সঙ্গেই দেখা মিললো ভেতরের “igloo ice-cream” এর স্টিকার লাগানো ডিপ ফ্রিজটার। ওরা জানে ডিপ ফ্রিজটা ভর্তি আছে হরেক রকমের আইসক্রিম দিয়ে। এই গরমে যেটা ভীষণ লোভনীয় ওদের কাছে। পবন হঠাৎ করেই বলে উঠলো,
— “আইসক্রিম খাবি, পরাগ?”
— “খেতে তো ইচ্ছে করছে। কিন্তু টাকা? তোর কাছে আছে?”
— “না নেই।”
মাথা নাড়লো পবন। পরাগ বোকা বনে বললো,
— “তবে?”
— “আরে আপা আছে না? কান্তা আপা টাকা দিবে!”
দাঁত বের করে হাসলো পবন। পরাগ উৎফুল্ল চোখে তাকালো। খুশিতে চোখমুখ ঝিকমিক করছে। কিন্তু খুশি হতে পারলো না কান্তা। আঁতকে উঠলো,
— “এই! আমি কোথা থেকে টাকা দিবো? আমার কাছে কিছু নেই।”
— “মিথ্যে বলিস না তো। আমি জানি তোর কাছে টাকা আছে। আমাদের এখন আইসক্রিম খাওয়া!”
— “ইসস। বললেই হলো? আমার কাছে কোনো টাকা নেই।”
অপারগতা প্রকাশ করলো। পরাগ এবার মুখ খুললো। বড় বোনের হাত ধরে বায়না ধরলো,
— “এই আপা! আইসক্রিম খাওয়া না?”
— “আপা! প্লিজ?”
দুই ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে অসহায় হয়ে গেল কান্তা। তার কাছে টাকা নেই কথাটা সত্যি নয়। তার ব্যাগের প্রথম পকেটেই একটা পঞ্চাশ টাকার নোট আছে। কিন্তু সে তো এই টাকাটা এখন খরচ করতে পারবে না। টিফিনের টাকা এটা। সেটা খরচা করলে ও চলবে কি করে? কিন্তু ছোট ভাইয়ের আবদারের কাছে হার মানতে বাধ্য হলো সে। বললো,
— “আচ্ছা। চল।”
অনুমতি পাওয়া মাত্রই ছুটে গেল পবন-পরাগ। অতি দ্রুততার সাথে দুজন দুটো চকবার কিনে ফেললো। তার দাম মেটাতে কান্তার পঞ্চাশটি টাকাই বেরিয়ে গেল ফুস করে!
___
ক্লাস বিরতি চলছে। ঘণ্টা বাজার সঙ্গে সঙ্গেই ক্লাসের অর্ধেক ছাত্র-ছাত্রী ছুটেছে ক্যান্টিনের দিকে। হিয়াও যাওয়ার জন্য তাগাদা দিলো কান্তাকে,
— “কি রে, টিফিন কিনতে যাবি না?”
— “না। খেতে ইচ্ছে করছে না।”
মিথ্যে বললো কান্তা। কারণ আপাদত তার হাতে কোনো টাকা-পয়সা নেই। ক্ষিদে লাগে নি তা নয়, কিন্তু ক্যান্টিনে গিয়ে কিছু খাওয়া সম্ভব না। হিয়া ভ্রু কুঁচকে তাকালো,
— “কেন? অন্যান্য দিন না ক্লাস শেষ না হতেই ক্যান্টিন যাওয়ার তাড়া ধরিস? এখন যাবি না কেন?”
— “ভালো লাগছে না রে। তুই যা কিছু খেয়ে আয়!”
ক্লান্ত চোখে তাকালো। হাসলো একটু। কিন্তু হিয়া ছাড়লো না,
— “তুই না গেলে আমি যাবো না। চল তো।”
— “আর-রেহ!”
— “আমি খাওয়াচ্ছি তো।”
গরুর মত টেনে নিয়ে যেতে লাগলো হিয়া। কান্তা বড় অসহায় হয়ে পড়লো। মেয়েটা এতো জেদি কেন? নিজে যা বলবে সেটা ছাড়া আর কিছুই শুনবে না। ক্যান্টিন থেকে দু’জন দু’টো চিকেন বিরিয়ানির প্যাকেট নিয়ে বের হলো। কান্তা হাসলো আনমনে,
— “হঠাৎ বিরিয়ানি খাওয়াচ্ছিস? তোর মতলব কি বল তো?”
— “মতলব তো আছেই।”
দাঁত বের করে হাসলো হিয়া। কান্তা ভ্রু নাচালো,
— “কি সেটা?”
— “এই যে তুই আমার হবু ননদ। তোর ভাইয়ের কাছাকাছি যেতে হলে তো তোকে পটাতে হবে, তাই না?”
— “আমাকে পটিয়ে ভাইয়াকে পটাবি? কীভাবে?”
বোকার মত তাকালো। হিয়া রহস্যময় ভঙ্গিতে হাসলো। কান্তা প্রসঙ্গ বদলালো,
— “তুই এখনও কাহন ভাইকে নিয়ে ভাবা বন্ধ করে দে, হিয়া। সামনে আমাদের নির্বাচনী পরীক্ষা। উচ্চ মাধ্যমিকেরও বেশি দিন বাকি নেই!”
চটে গেল হঠাৎ,
— “তোদের সমস্যা কি, বল তো? সবকথায় পড়ালেখা টেনে আনিস কেন? প্রেমের সাথে পড়ালেখার কি সম্পর্ক?”
— “কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু জীবনে পড়ালেখা হলো অত্যাবশ্যক। প্রেম কোনো জরুরী বিষয় নয়!”
— “কে বলছে তোকে? বিখ্যাত মণীষীদের মতে, প্রেমহীন জীবন হলো অর্থহীন। আর যে জীবনে কাহন নেই সে জীবন নিয়ে হিয়া কি করবে বল তো?”
— “তোর কি মনে হচ্ছে না, তুই পাগলামি করছিস? কাহন ভাই তোকে নিয়ে একটুও ভাবে না, হিয়া। সে তোকে ঠিকঠাক চেনেও না। সেখানে—”
— “এখন চেনে না। কিন্তু চিনবে। আচ্ছা, কান্তা? তুই আমার জন্মদিনে তোর ভাইকে সাথে নিয়ে আসতে পারিস না? তাহলে আমাদের জানাশোনা হবে!”
— “আমি? কি করে? কেন?”
অবাক হলো যেন। হিয়া বুঝিয়ে বললো,
— “কেন নয়? বলবি, তোর বান্ধবীর জন্মদিনে দাওয়াত। সাথে পবন-পরাগকেও আনবি।”
— “সেটা সম্ভব নয়। কাহন ভাই কখনো আসবে না। আর এটা ভালো দেখায়ও না।”
— “কেন? কেন ভালো দেখায় না?”
ভ্রু কুঁচকে তাকালো। কান্তা যুক্তি দেখালো,
— “কারণ কাহন ভাই আমার বড় ভাই। বান্ধবীর জন্মদিনে ছোট ভাইকে সাথে আনা যায় কিন্তু বড় ভাইকে কি করে— তাছাড়াও সে আমার আপন ভাই না। ফুপাতো ভাই। আমাদের থেকেও সে দূরে-দূরে থাকে। আমরাও খুব একটা মিশতে পারি না। কেননা মা এটা পছন্দ করে না।”
হিয়ার মন খারাপ হয়ে গেল মুহূর্তেই। এমন দূরত্ব হতে থাকলে কাহনের কাছাকাছি সে যাবে কি করে?
___
টিউশনিতে এসেছে কাহন। ছাত্র নবম শ্রেণীতে পড়ছে। নাম প্রান্তিক। কাহন তাকে পড়ায় ইংরেজী। এক্কেবারে গাধা টাইপের ছেলে একটা। কিচ্ছু পারে না। ফেল করতে করতে জনম শেষ। সামান্য একটা রিডিং পড়তেও তার হাজার জড়তা! দশ লাইনের প্যারাগ্রাফ পড়তে ছেলের দাঁত খুলে হাতে আসবার অবস্থা হয়। কাহন ভেবে পায় না যে ছেলে সাধারণ এই ইংরেজী রিডিং পড়তে পারে না সে কি করে ক্লাস নাইনে ওঠে? আশ্চর্য!
কদিন ধরে ট্রান্সফরমেশনের ‘ভয়েস চেঞ্জ’ শিখাচ্ছে তবুও তার মাথায় কিছু ঢুকে না। সে যতই রুলস বুঝাক, নিয়ম শিখাক যে লাউ সেই কদুই থেকে যায়। আজ তাই সহজ সহজ কিছু করতে দিয়েছে। তাও যদি ছেলের উন্নতি হয়!
কিন্তু আধঘণ্টা ধরে প্রান্তিক সেই যে কলম কাlমড়াতে শুরু করেছে সেটা আর থামে নি। অনবরত কলমের ক্যাপ কাlমড়ে-কাlমড়ে আর হাজারটা কাটাকুটি করবার পর প্রান্তিক নিজের খাতাটা এগিয়ে দিলো,
— “স্যার! আর পারতেছি না। নেন, এ কয়টাই দ্যাখেন।”
— “কয়টা করেছ?”
— “পাঁচটা!”
গম্ভীর হলো মুখশ্রী। দশটা সহজ সহজ ভয়েস দিয়েও সেটা করতে পারে নি প্রান্তিক। গৃহশিক্ষক হিসেবে কি ওর খুশি হওয়া উচিৎ? তথাপি কিছু না বলে খাতা দেখতে বসলো। কিন্তু প্রথম উত্তরটা দেখেই মাথায় হাত পড়লো ওর! ‘I have eaten rice’ – এর প্যাসিভ ফর্ম প্রান্তিক লিখেছে, ‘Rice have been eaten me.’ কতবড় আহাম্মক হলে কেউ এই ভুলটা করতে পারে?
— “এটা কি করেছ তুমি, প্রান্তিক? ভাত তোমাকে খেয়ে ফেলেছে?”
প্রান্তিক দাঁত বের করে হাসলো। বললো,
— “না, না। স্যার। ভাত আমারে খাবে ক্যান? আমি ভাত খাইছি!”
— “কিন্তু তুমি যা লিখছ তাই কি ঠিক?”
কোনমতে রাগ সংবরণ করে বললো কাহন। প্রান্তিক একটু অবাক হলো,
— “কেন? হয় নাই?”
— “খাতাটা দেখো। দু’টো ভুল আছে।”
আঙুল দিয়ে টোকা মেরে এগিয়ে দিলো খাতাটা। প্রান্তিক খাতা নিলো বটে কিন্তু ভুল বের করতে পারলো না। বারবার বলতে লাগলো তার কোনো ভুল নেই। রাগ বাড়তে লাগলো কাহনের। তবুও বললো,
— “এটা ভুল হয়েছে। খাতা দাও। ঠিকটা লিখে দেই।”
একই জিনিস আরও একবার বুঝিয়ে দিয়ে পড়ানো শেষ করলো কাহন। বাসা থেকে বেরিয়ে আসার সময় হঠাৎ তার মনে হলো, নতুন একটা টিউশনি জোগাড় করতে হবে। এখানে আর তার বেশিদিন নেই! কিন্তু বললেই কি আর হয়ে যায়? এতো কোনো সোজা বিষয় নয়!
চলবে___
#মৌরিন_আহমেদ
[খাপছাড়া লিখেছি। মন বিক্ষিপ্ত। একটু টেনশনে আছি। পরবর্তী পর্বে ভালো কিছু লিখার চেষ্টা করবো, ইনশাল্লাহ্]