একটুখানি_প্রেম ❤️ #পর্বসংখ্যা_০৫

0
358

#একটুখানি_প্রেম ❤️
#পর্বসংখ্যা_০৫

রাতের খাবার খেয়ে সবে ঘরে ঢুকেছেন মুজাহিদ সাহেব। টেবিলের উপর থেকে হিসাবের খাতাটা নিয়ে পা তুলে বসলেন বিছানায়। চৌরাস্তার মোড়ে তার বড় একটা দোকান আছে। সংসারের যাবতীয় জিনিসপত্র যেমন তেল-নুন যা যা লাগে সবই বিক্রি হয় সেখানে। মোড়ের সবাই তাকে একনামে চেনে ‘ মুজাহিদ দোকানদার’, কান্তা স্টোরের মালিক। দোকানের অবস্থা আল্লাহর দয়ায় ভালোই রমরমা, তাই দিনে তেমন একটা বাড়িতে থাকবার সুযোগ নেই। এখন রাতের বেলাতেও সেই দোকানের বেচাকেনার হিসেব করতে হচ্ছে!

পান চিবোতে চিবোতে ঘরে প্রবেশ করলেন রাহেলা খানম। হাতে স্বামীর জন্য সাজিয়ে আনা পান। সেটা তার মুখে ঢুকিয়ে দিলেন। তারপর আহ্লাদের সাথে বললেন,

— “এই রাতের বেলাতেও তোমার এতো কাজ গো? একটু বিশ্রাম করতে পারো না?”
— “কি করবো বলো? কাজ যে শেষ হয় না–”

হাসলেন তিনি। রাহেলা খানম এবার একটু বিরক্তি নিয়ে বললেন,

— “সে তো তোমার কোনোদিনও শেষ হবে না। কাজের বাহানা দিয়ে বাড়ির খোঁজ-খবরও নেবে না। সব দায় তো আমার!”

— “আহ্ হা। রাগছ কেন বলো তো? আমি তো এই সংসারের জন্যই এতো কিছু করছি। আর খোঁজ-খবর নেব না কেন? সব কিছুর খবরই আমার কাছে আছে।”

— “তাহলে বলো তো, তোমার গুণধর পুত্র পবনের কি খবর? বাপ হয়ে জানো কিছু?”

তেঁতে উঠলেন রাহেলা। পরিস্থিতি ক্রমশ উষ্ণ হচ্ছে; বুঝতে বাকি রইলো না তার। স্ত্রীর কথায় নরম হয়ে শুধালেন,

— “কেন? সে আবার কি করলো?”
— “গাছ থেকে পড়ে ঠ্যাং ভেঙেছে! পেয়ারা গাছে চড়েছিল দুপুরে; আর তোমার পাগলী বোন কি কি যেন ভয় দেখিয়েছে।”

মুজাহিদ সাহেব গম্ভীর হয়ে গেলেন হঠাৎ। রাহেলা খানম তার স্বভাবসুলভ বলে চলেছেন,

— “আমি বুঝি না, বাপু। এই পাগল বোনটাকে তুমি এখনও কেন টানছো? স্বামী ছেড়ে দিয়েছে যাকে, তাকে পালবার কি দরকার? ভালো হলে তাও একটা কথা ছিল। কিন্তু এত বদ্ধ-উন্মাদ! আজ পবনকে ভয় দেখাচ্ছে, কাল পরাগকে মারছে, পরশু নিজের ছেলের গলা চেপে ধরে ‘খুন করবো!’ বলছে–এরকম লোককে কেউ বাড়ি রাখে? হঠাৎ সাংঘাতিক কিছু একটা হয়ে গেলে?”

— “তুমি কি বলতে চাইছো?”

শান্ত গলায় বললেন। রাহেলা খানমের চটপট জবাব,

— “আমি আর কি বলবো? আমার কিছু বলবার আছে? এ সংসারে এসে আমি তো নিজের সবকিছুই বর্জন করেছি। নিজের শখ-আহ্লাদ সব ছেড়েছুঁড়ে দিয়ে এখন ছেলেমেয়ে গুলোকে মানুষ করতে চাই। কিন্তু এখন তো এই বাড়িতেও ওরা নিরাপদ না। তোমার পাগল বোন–”

— “রেবু তো সবসময় ঘরবন্দীই থাকে, রাহেলা। তোমরা তো ওকে কখনো বাইরে বের করতে দাও না! তাহলে এতো ভয় কীসের? একটু এড়িয়ে চললেই হয়!”

মুজাহিদ সাহেব নিজের স্ত্রীকে বুঝানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু রাহেলা খানম পরোয়া করলেন না। ক্ষেপে গেলেন হঠাৎ,

— “এড়িয়ে চললে হয়, মানে? কতক্ষণ এড়িয়ে চলবো? একটা মানুষ বাড়িতে থাকবে-খাবে; তাকে এড়িয়ে চলবো কি করে? আচ্ছা আমি নাহয় বুঝলাম। কান্তাও বুঝলো। কিন্তু আমার ছোট ছোট দু’টো ছেলে, ওরা কি বুঝবে? ওই পাগল ডাকলেই দু’জন ছুটে যায় জানালায়। আর তোমার বোন–”

— “রেবু এবাড়ির মেয়ে, রাহেলা! এটা ওর বাবার বাড়ি। আমি তাকে এখান থেকে বের করতে পারি না। দয়া করে তুমি আর এ প্রসঙ্গে একটি কথাও বলবে না।”

হুট করেই রেগে গিয়েছিলেন। তাই রাগটাকে সামাল দেবার জন্যই কিছু কড়া কথা শোনানো। বলা শেষ করেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। রাহেলা খানম তখন গজর-গজর করছেন,

— “হ্যাঁ, আমার কথা তো শুনতেই চাইবে না। মূল্যই দেবে না। এবাড়িতে তো তেনার একলারই হক আছে। আর কারো নেই। আমরা বানের জলে ভেসে এসেছি, না? তারই তো–”

উঠোনে নামতেই দমকা হাওয়া ছুঁয়ে দিলো তাকে। হিম শীতল ঠাণ্ডা এই বাতাসে পরাণ জুড়ালো যেন। চোখ তুলে আকাশের দিকে তাকালেন। আম-কাঁঠালের গাছ কয়েকটার ঘন কালচে ঝোপ আকাশটাকে ঢেকে দেয়ার আপ্রাণ চেষ্টায় মত্ত। তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিজেকে প্রকাশে ব্যস্ত আকাশের চাঁদখানা। মেঘগুলোর সঙ্গেও লুকোচুরি চলছে তার।কাছে-পিঠেই কোথাও রলটস ঝিঁ-ঝিঁ পোকা ডেকে চলেছে একটানা। এই পরিবেশে দাড়িয়ে হঠাৎ নিজের ছেলেবেলার কথা মনে পড়লো মুজাহিদ সাহেবের। আগেকার গ্রাম্য সন্ধ্যাগুলোর কথা! উঠোনের মাঝে বসে দাদির কোলের কাছে গুটিশুটি মেরে বসে চাঁদের বুড়ির গল্প শোনার কথা। আহা! কতো পুরোনো, কতো মধুময় সেইসব স্মৃতি!

স্মৃতিকাতর হয়ে একের পর এক হাতড়ে বেড়ালেন নিজের শৈশব, কৈশোর আর যৌবনের কথা। ছোট বোনটার কথা মনে পড়লো খুব। ধীর পায়ে হেঁটে উঠে গেলেন অন্য পাশের বারান্দায়। রেবেকার জানালার কাছে। ঘুট-ঘুটে অন্ধকারে নিমজ্জিত ঘর। কিছু চেয়ে দেখা যায় না, রেবু কি জেগে আছে? কোমল-লঘু স্বরে ডাকলেন,

— “রেবু?”

ভেবেছিলেন রেবেকা ঘুমিয়ে গেছে। কিংবা আপন খেয়ালে মগ্ন। ডাকের সাড়া পাওয়া যাবে না। তাই অপেক্ষা না করে চলে যাচ্ছিলেন কিন্তু একটু পরেই চিকন স্বরে পিছু ডাকলো কেউ,

— “ভাইজান!”

চট করে ফিরে তাকালেন। জানালার গ্রিল আঁকড়ে ধরে আছে দু’টি লিকলিকে হাত। নিষ্পাপ শিশুর ন্যায় মায়াময় চোখে চেয়ে আছে রেবেকা, তার ছোট বোন। আবেগ ঘন কণ্ঠে বললেন,

— “আমায় চিনতে পারছিস, রেবু?”

সহসা সে কথার জবাব দিলো না রেবেকা। কিছুক্ষণ নির্নিমেষ চেয়ে রইলো। তারপর চোখের দৃষ্টি পাল্টে গেল হঠাৎ। অবিচল কাঠিন্য নিয়ে থেমে থেমে উচ্চারণ করলো,

— “তোমরা আমায় ভালো থাকতে দিলে না কেন, ভাইজান?”

কি উত্তর দেবেন মুজাহিদ সাহেব? বলার মতো কিছু আছে? ভাগ্যের উপর তো কারো হাত নেই। ত্রস্ত পায়ে ফিরে যেতে চাইলেন। পাগলী তখন ক্ষেপে উঠেছে পুরোপুরি। গ্রিল ধরে প্রবল ঝাঁকানি দিচ্ছে। চেঁচাচ্ছে তারস্বরে; হিংস্র-রুক্ষ ভাবে,

— “মেরে ফেলবো! একদম মেরে ফেলবো! আমাকে যন্ত্রণা দেয়া, না? একদম–”

উঠোনে ফিরে এলেন মুজাহিদ সাহেব। বারান্দায় পা ঝুলিয়ে বসলেন নিরিবিলিতে। দেখতে লাগলেন চাঁদটাকে। আনমনা হয়ে পড়লেন অতীতের স্মৃতির মুখোমুখি হতে!

রেবেকা ছোট থেকেই হাসি-খুশি, প্রানবন্ত ছিল। ভদ্র-নম্র মেয়েটিকে অতি অল্পবয়সেই বিয়ের পীড়িতে বসিয়ে দেন মুজাহিদ সাহেবের বাবা। ছেলে ভালো চাকরী করে, খানদানি বংশ, আচার-ব্যবহার মার্জিত– মেয়ে জামাই হিসেবে আর কি চাই?

সবকিছু ঠিকই চলছিল। রেবেকার উনিশ বছর বয়সে জন্ম হয়েছিল কাহনের। অল্প বয়সের সন্তান। নানান জটিলতার সৃষ্টি হলো। প্রচুর টাকা-পয়সা খরচা হলো। তারপরও রেবেকার স্বামী কায়সারের আচরণ ছিল অমায়িক। তার মধ্যে কোনো বিরক্তি কিংবা ক্রোধের দেখা মেলে নি। ছেলেকে সে কোলে-পিঠে মানুষ করেছে। ভীষণ আদরে, আহ্লাদে। আদর্শ বাবা, আদর্শ স্বামীর ভূমিকা পালন করেছে!

চমৎকার সুখী পরিবারটির মধ্যে হঠাৎ করেই ফাঁটল ধরলো। পরিবর্তন হতে লাগলো রেবেকা-কায়সারের। ঝগড়া-ঝাটি একটা নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাড়ালো। প্রায়শই ছেলেকে সাথে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে আসতে লাগলো রেবেকা। বলতো, সংসার করবে না। ফিরে যাবে না শ্বশুরালয়ে। মুজাহিদ সাহেবের পিতা নিজের মেয়েকে বুঝানোর জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করতেন; কিন্তু লাভ হতো না। রেবেকা-কায়সারের সম্পর্কে চিড় ধরে গিয়েছিল ততদিনে। এরমধ্যেই হঠাৎ একদিন ব্যাগ-ট্যাগ নিয়ে হাজির হলো রেবেকা। কায়সার দ্বিতীয় বিয়ে করেছে!

কোনোরূপ আইনি বিচ্ছেদ হয় নি; কিন্তু রেবেকা আর ফিরে গেল না। স্ত্রীকে ফেরাবার চেষ্টাও করে নি কায়সার। শুধু ছেলেকে চেয়েছিল। কাহন নিজ ইচ্ছেয় থেকে গেছে মায়ের কাছে। পরিবার রেবুর দ্বিতীয় বিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলেও ফায়দা হয় নি। সে বদলে যাচ্ছিল দ্রুত। সবসময় উদাসী চাল-চলন; কিছু বললে খিটখিটে মেজাজ; নিজের ভাবী রাহেলার সঙ্গে ক্রমাগত ঝগড়া– এত্তো পরিবর্তন হলো! মানসিক ভাবে ভেঙে গিয়েছিল রেবেকা। আর তখনই দ্বিতীয় ধাক্কা হিসেবে যোগ হলো পিতার মৃlত্যু! দুঃখ-কষ্ট-শোক আর পরিবারিক টানাপোড়নে মানসিক ভারসাম্য রাখা আর সম্ভব হলো না!

অতীতের কথা ভাবতে ভাবতে দীর্ঘশ্বাস বেরলো একটা। এই রেবেকা, এই কাহন, এই কায়সার– ওদের সাজানো জীবনটা কেমন ছিল, আর কেমন হয়েছে? কাচের গ্লাসের মত ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে সব। নিজের স্ত্রী, নিজের পুত্রের জন্য একসময় কতো মায়া, ভালোবাসা পুষে রেখেছিল কায়সার অথচ এই মানুষটাই সময়ের পালাবদলে বদলে ফেললো নিজেকে!
___

কয়েকটা দিন পেরিয়ে গেল। তাতে কিছুই বদলায়নি। হিয়া রোজ রোজ কলেজে গিয়ে কান্তার সঙ্গে ঘ্যান-ঘ্যান করছে। কাহনকে কি করে মনের কথা বলবে এই নিয়ে ভাবছে। হাজারটা চিন্তা তার মাথায়! কাহন কি মেনে নেবে ওকে? ভালোবাসবে? যদি না করে দেয়? হিয়া তখন কি করবে? কি করে মানাবে তার প্রাণনাথকে? অবশ্য ওর এসব কথার কোনো পাত্তা দেয় না কান্তা। উল্টো ধমক দিয়ে বলে,

–“সামনে পরীক্ষা। পড়ায় মন দে!”

হিয়ার এত্তো রাগ হয়! তিরিক্ষি মেজাজ নিয়ে বলে,

— “এতো পড়ালেখা করে জীবনে কি করবো? সংসারের ঘানি টানা ছাড়া? তুই লেখাপড়া শিখে ব্যারিস্টার হ আর যাই হ, সংসার তো তোকে করতেই হবে!”

কান্তাও রাগ করেছে তাতে,

— “তাহলে উচ্চ মাধ্যমিকের আশায় বসে আছিস কেন? এখনই বিয়ে করে ফ্যাল।”
— “করবো। তোর ভাইকে রাজি কর!”

এমন নির্লজ্জ স্বীকারোক্তির পর আর কিছু বলে নি কান্তা। বুঝে গিয়েছে, হিয়া নামক বালিকাটি এখন কাহন নামক ছন্নছাড়া এক যুবকের প্রেমে উন্মাদ!

চলবে___

#মৌরিন_আহমেদ

[আমার লেখা প্রথম ই-বই ‘বাতাসে বহিছে প্রেম’ পাওয়া যাচ্ছে বইটই অ্যাপে। পড়তে চাইলে মাত্র ত্রিশ টাকা দিয়ে ক্রয় করে নিতে হবে বইটি! লিংক কমেন্টে… ❤️]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here