#একটুখানি_প্রেম ❤️
#পর্বসংখ্যা_০৬
আধো ঘুম, আধো জাগ্রত অবস্থায় বিছানায় শুয়ে আছে হিয়া। নিদ্রা দেবী তাকে ছাড়ে নি। আবার আঁকড়েও ধরে নি। সারা গায়ে আলস্য মাখিয়ে দিয়েছে মাত্র। কানের কাছে কেউ ফিসফিস করে বললো হঠাৎ,
— “শুভ জম্মদিন, মা! অনেক অনেক শুভেচ্ছা তোমায়!”
চকিতে চোখ মেলে তাকালো হিয়া। মৌসুমী হাসছেন। ঠিক সঙ্গে সঙ্গেই ঘরের দরজা দিয়ে প্রবেশ করলেন কেউ। একটি দীর্ঘদেহী মানব। ফুলের তোড়া নিয়ে এগিয়ে এলেন, দরাজ গলায় বললেন,
— “হ্যাপি বার্থডে টু ইয়্যু! হ্যাপি বার্থডে টু ডিয়ার, হিয়া!”
— “বাবা!”
আহ্লাদে লাফিয়ে উঠলো সে। ফর্মাল পোশাক পরিহিত মানুষটি হাসলেন। কাছে এসে ফুলের তোড়াটা মেয়ের হাতে ধরিয়ে দিলেন। হিয়ার বাবা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন গর্বিত সদস্য। সার্জেন্ট মনজুর আলম। চাকরী সূত্রে বর্তমানে ঢাকা সেনানিবাসে কর্মরত আছেন। কয়েক মাস পর পর বাড়ি আসেন।
— “কখন এসেছো তুমি?”
— “কাল রাতে, মামণি।”
মাথায় হাত বুলিয়ে জবাব দিলেন মনজুর সাহেব। হিয়া গাল ফুলালো,
— “আমাকে ডাকো নি কেন?”
— “অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল, মা। তাই তোমাকে জাগাতে চাই নি!”
উত্তরটা দিলেন মৌসুমি। হিয়ার অভিমান কমলো না। গাল ফুলিয়েই রইলো। মনজুর সাহেব ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলেন,
— “এতো রাগ করতে হবে না আর! জলদি তৈরি হয়ে নাও। তোমার খালামণিরা আসবেন। কেক কাটা হবে।”
— “জো তুমহারি মার্জি।”
হেসে সায় দিলো হিয়া। বাবা-মা চলে গেলে ঝটপট বিছানা ছেড়ে উঠলো। ঘর গুছিয়ে ছুটলো ওয়াশরুমে। গোসল করে একেবারে তৈরি হয়ে বেরোবে। আজ তার জীবনের বিশেষ দিন। তার জন্মদিন!
___
তৈরি হয়ে ঘর থেকে বেরোনোর পর দেখা হয়ে গেল অর্পির সঙ্গে। অর্পি হিয়ার খালাতো বোন। একবছরের ছোট ওর। ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে। পিঠা-পিঠি বলে দুজনের মধ্যে মিল রয়েছে খুব। গলায় গলায় ভাব। হিয়াকে দেখেই ছুটে এলো সে,
— “হিয়াপি!”
ঝড়ের বেগে এসে জাপটে ধরলো ওকে। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গেল হিয়া। তারপরেই অর্পির উচ্ছাস দেখে হাসলো। ওর পিঠে হাত বুলিয়ে বললো,
— “অর্পি সোনা, কাম ডাউন।”
একটুপর অর্পি ছেড়ে দিলো ওকে। সোল্লাসে চেঁচিয়ে উঠলো,
— “কত্তদিন পর দেখা! একই শহরে থাকি অথচ তোর সাথে দেখাই হয় না। তুই আসিস না কেন বল তো?”
— “এমনি। প্রাইভেট, কলেজ-টলেজ নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। সেকেন্ড ইয়ার। তুইও তো আসিস না!”
কিছু না বলে ঠোঁট টিপে দাড়িয়ে রইলো অর্পি। সে নিজেও লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকে। দেখা করবার সময় কই? আসলে ব্যস্ততা এমন একটা বিষয় যার কাছে আমরা মানুষেরা অসহায়। এই ব্যস্ততায় কতো কতো সম্পর্কের ইতি ঘটে, স্মৃতিরা ফ্যাকাসে হয়ে আসে– হিসেব নেই!
খালা-খালুর সঙ্গে দেখা হলো। আর দেখা হলো একজন মানুষের সঙ্গে যাকে হিয়ার পছন্দ নয়। মানুষটি হলো অর্পির বড় ভাই, ফুয়াদ। অত্যন্ত ভালো ছেলে, মেধাবী। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্কিটেকচারে পড়ছে।গম্ভীর স্বভাবের কারণেই বোধ হয় কথা কম বলে। এই ছেলেটিকে হিয়ার একটুও পছন্দ নয়। কোনো কারণ ছাড়াই!
ফুয়াদ ড্রইং রুমের সিঙ্গেল সোফায় বসে ছিল। হাতে একটা ম্যাগাজিন। এ-মাসের ‘কিশোর আলো’। ওকে ম্যাগাজিন পড়তে দেখে হিয়া ভ্রু কুঁচকে তাকালো। ফুয়াদ কিশোর নয়, তবে ‘কিশোর আলো’ পড়ার কি আছে? ভদ্রতার খাতিরে সেটা নিজের মধ্যে চেপে গিয়ে সালাম দিলো,
— “আসসালামু আলাইকুম, ভাইয়া।”
কিআ বন্ধ করে সরাসরি ওর দিকে তাকিয়ে জবাব দিলো,
— “ওয়ালাইকুম আসসালাম। কেমন আছো?”
— “জ্বি, আলহামদুলিল্লাহ্। আপনি?”
— “হুম। ভালো।”
মাথা নাড়লো ফুয়াদ। কিআ পুনরায় খুলে বসলো। হিয়া চুপ করে দাড়িয়ে রইলো। তার কি চলে যাওয়া উচিৎ? ফুয়াদ আর কিছু বলবে বলে মনে হয় না। ফিরে যাবার জন্য পা বাড়িয়েছে তখনই ফুয়াদ হঠাৎ করে বললো,
— “শুভ জম্মদিন, হিয়া। তোমার উপহার মার কাছে আছে। মা দিয়ে দিবে।”
— “ধন্যবাদ।”
মাথা হেলিয়ে সায় দিলো। তারপর চলে গেল সেখান থেকে। কিছু মানুষকে আমরা পছন্দ করি না। বিষয়টা এমন নয় যে সে আমাদের কোনো ক্ষতি করেছে, পাকা ধানে মই দিয়েছে! তবুও আমরা পছন্দ করি না। স্রেফ পছন্দ করি না! ফুয়াদকেও হিয়ার অকারণেই পছন্দ নয়!
___
বেলা তিনটা। দিবাকর মশাইয়ের প্রচুর দেমাক হয়েছে আজকাল। রোজ রোজ ধরণীবাসীকে নিজের উত্তাপের খেল দেখাচ্ছেন। তেজে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছেন সবকিছু। বেলা তিনটার সময়ও তার উষ্ণ তাপের একটুও কমতি পড়ে নি।
প্রান্তিককে পড়াতে যাবার কথা। দু’ দিন পর ছেলেটার পরীক্ষা। শুরুই হবে ইংরেজী দিয়ে। অতএব কাহনের উপর এখন বেশ চাপ। এমনিতে সপ্তাহে তিনদিন পড়িয়ে যায়। কিন্তু এখন ব্যাপার অন্য। প্রান্তিককে পাশ তো করাতেই হবে। তাই নিজ গরজেই রোজ-রোজ যাচ্ছে।
মামার বাড়ি থেকে প্রান্তিকদের বাড়ি বেশ দূরে। সরাসরি অটোয় চড়ে যাবার উপায় নেই। রিকশায় গেলে ভাড়া ত্রিশ টাকার নিচে আসবে না। কিছু কিছু রিকশাওয়ালা তো চল্লিশ টাকাও চেয়ে বসেন! তাদের সাথে ঝগড়া বাঁধিয়ে লাভ নেই জানে কাহন। তাই বাধ্য হয়েই অর্ধেক রাস্তা হেঁটে আর অর্ধেক রাস্তা অটোয় যাতায়াত করে। আজকের দিনটা আরও খারাপ!
রাস্তায় একখানা অটোও নেই। যেগুলো আছে সেগুলো অন্য রোডে যাচ্ছে। হাত ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে নিলো কাহন। তিনটা দশ বাজছে। প্রান্তিককে বলে রেখেছে সাড়ে তিনটায় যাবে। সময় নেই একটুও। এই পথটা অটোয় গেলেও বাকি রাস্তা হাঁটতেই সময় চলে যাবে! আর প্রান্তিকের মা যে মহিলা! কাহন কেন দেরি করেছে এই অপরাধে হাজারটা কথা শুনাবেন,
— “টাকা দিয়ে মাস্টার রেখেছি। মাগনা তো নয়। তা বাপু পড়াতে আসতে এতো অনীহা কেন? দেরী করে আসবে, এসে হাজার বাহানা বানাবে..”
মাঝে মাঝে খুব রাগ হয় কাহনের। দু’টো জবাব দিতে ইচ্ছে করে মহিলার। তবে দেয় না। মাস গেলে যে হাজার তিনেক টাকা আসে সেটা ওর জন্যে অনেক। হাতছাড়া হয়ে গেলে মহা মুশকিল!
অগত্যা আজ রিকশা নিতে বাধ্য হলো। রিকশা ভাড়া চাইছে আজ চল্লিশ টাকা। কিছুতেই কমবে না। বহুৎ দরদাম হাঁকার পর পঁয়ত্রিশ টাকায় রাজি হলেন। কাহন আর কিছু বললো না। দ্রুত পৌঁছানো দরকার। রিকশাওয়ালা সিগারেট ফুঁকছিলেন। প্যাডেল চাপবার দরকার ছিল না, মেশিন চালিত। অতএব সেভাবে থেকেই নিয়ন্ত্রণ করছিলেন রিকশা।
কাহনের ভালো লাগছিল না। মন আনচান করছিল। রিকশাওয়ালা ছেলেটা অল্পবয়সী। বয়স কাহনের চেয়ে কমই হবে। চোখেমুখে উদাসীনতা। অদ্ভুত ভাবে চালাচ্ছিল রিকশা। কাহন তাড়া দিলেও তার হেলদোল নেই!
বারবার ঘড়িতে সময় দেখছিল কাহন। সময় গড়াচ্ছে, পথ ফুরাচ্ছে না। বিরক্ত লাগছে খুব। বারংবার ঘড়ির দিকে তাকাতে তাকাতেই হঠাৎ ওর মনে হলো ঘড়িতে নতুন বেল্ট লাগানো উচিৎ। বেল্টের চামড়া পুরোনো হয়ে ছিঁড়ে-ছিঁড়ে গেছে। দেখলেই বোঝা যায় কতকাল পুরোনো! অথচ ঘড়ির বেল্ট বদলানোর চেয়ে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে ওর। সেজন্যে টাকা নেই। হিসেব করে দেখলো, আজ প্রান্তিকের মাস শেষ হবে। বেতন পাবার ক্ষীণ আশা করা যায়! কারণ মাস শেষ হলেই যে সে বেতন দেবে এমন কোনো কথা নেই!
অবশেষে পথ শেষ হলো, গন্তব্যে পৌঁছলো সে। ভাড়া মিটিয়ে প্রান্তিকের বাসায় ঢুকলো। কলাপসিবল গেট পেরিয়ে নিচতলার প্রথম ফ্ল্যাটটাই ওদের। নক করতেই একটা ধাক্কা খেল কাহন। কারণ দরজা খুলে যিনি বেরিয়ে এলেন তিনি প্রান্তিক বা ওর কেউ নন। একজন পুরুষ। ওকে দেখে বললেন,
— “কাকে চাই?”
— “প্রা-প্রান্তিক?”
কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল ওর। লোকটাকে খুব বিরক্ত মনে হলো। বললেন,
— “এখানে প্রান্তিক বলে কেউ থাকে না।”
— “কিন্তু আমি পরশু দিনও এসেছি! ওরা এই ফ্ল্যাটে..”
লোকটার মুখের ভাব পরিবর্তন হলো না,
— “অহ্!.. ওরা চলে গেছে। আমি আজ সকালে উঠেছি। এখনো বাড়িঘর অগোছালো। আপনি যান!”
মুখের উপর দরজা আটকে দিলো। কাহনের মন-মস্তিষ্ক জুড়ে তখন ভিন্ন এক চিন্তা ডালপালা মেললো। না, প্রান্তিকরা তাকে না জানিয়ে বাসা বদলেছে, নতুন বাসার ঠিকানা অবধি দেয় নি, সে এতো ঝক্কি ঝামেলা পোহানোর পর এখানে এসে শুনেছে প্রান্তিক নেই— সেসব কিছুই ওর চিন্তার বিষয় ছিল না। ও শুধু ভাবছিলো, চোখের দেখায় কি ভুল হয়েছে তার? যে লোকটাকে সে এইমাত্র দেখলো সে কি আসলেই সেই লোক?
কাহন হঠাৎ অনুভব করলো তার বুকে ব্যথা করছে। অনেক পুরনো একটা ব্যথা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চাইছে যেন। বারো বছর আগের সেই বেদনা যা সে এতদিন ধরে বুকে পুষে রেখেছে!
___
জম্মদিন মানেই বিরাট কিছু। উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত সব মানুষেরই কাছে এটা বেশ আনন্দের দিন। উদযাপনের ধরণ যেমনই হোক জম্মদিন তো! মা-খালাদের আয়োজনের বহর দেখে চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল হিয়ার। রমরমা ব্যবস্থা! কেক-টেক এনে একেবারে হুলস্থুল। সারাটাদিন খুব আনন্দেই কাটবার কথা। কাটলোও, কিন্তু মনের ভেতর কেমন যেন ছটফট করতে লাগলো হিয়া। আজ বাড়ি থেকে বেরোনোর উপায় নেই। তবে কি এই বিশেষ দিনটায় কাহনের দেখা মিলবে না?
চলবে___
#মৌরিন_আহমেদ
[আমি অসুস্থ ছিলাম। তার’ পরে চশমার পাওয়ার চেঞ্জ হয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই ফোন ইউজ করার রেস্ট্রিকশনে আছি। আর পাঠকের রেসপন্সের যা অবস্থা। তাতে তো লিখতে ইচ্ছে করারই কথা না। আমি হাজার শব্দের একেকটা পর্ব লিখতে পারি অথচ তারা দু’ তিন শব্দের বাক্য লিখতে পারেন না। আবার দু’ দিন দেই নি এই নিয়ে কৈফিয়ত চাইতেও কসুর করে না! 😑]