একটুখানি_প্রেম ❤️ #পর্বসংখ্যা_১০

0
294

#একটুখানি_প্রেম ❤️
#পর্বসংখ্যা_১০

“আমার বাবা মlরে গেছে!”–কথাটা কোথায় গিয়ে আঘাত হানলো? বুকের গভীরে? না অন্য কোথাও? কায়সার মাহমুদের হৃদয়ে রlক্তক্ষরণ শুরু হলো। তার জীবনে এ কেমন দিন এলো, যখন তার নিজের ছেলের মুখে নিজের মৃlত্যু সংবাদ শুনতে হচ্ছে?

কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললেন,

— “এসব তুই কি বলছিস বাপ? আমি মরে গেছি মানে?”
— “কেন, মানে বুঝতে পারছেন না? নাকি বুঝতে পেরেও না বোঝার ভান করছেন?”

ঝাঁঝিয়ে উঠলো কাহন। কায়সার মাহমুদ হতভম্ব হয়ে গেলেন,

— “কাহন!”
— “কি কাহন? কেন দাড় করিয়েছেন আমাকে? কে আপনি? আমার সাথে আপনার কি সম্পর্ক? অহেতুক আমার রাস্তা আটকিয়ে কি লাভ আপনার?”

মেজাজ সপ্তমে উঠেছে ওর। কখনো রাগ না দেখানো ছেলেটা, যে কিনা সর্বদা মুখ বুঁজে থাকে, সবকিছু মেনে নেয় নীরবে, সে আজ মুখ খুলেছে। রেগে আগুন হয়ে গেছে যেন!

— “আমি তোর বাবা! তুই আমার সাথে এমন করছিস কেন?”

— “তো কেমন করবো বলে ভাবেন? আপনাকে মাথায় নিয়ে নাচবো? শুনুন, আমি আপনাকে চিনি না। কোনদিন দেখি নি। আর দেখতেও চাই না। বারোটা বছর আপনি নিখোঁজ ছিলেন। আমি চাই আপনি সারাজীবন নিখোঁজ থাকুন। কখনো আমাদের সামনে না আসুন!”

বলেই গটগট করে হেঁটে বিদায় নিল সে। কায়সার মাহমুদ তখনো বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে। আজকের এই বলিষ্ঠ যুবা পুরুষটির সঙ্গে বারো বছর আগের সে কিশোরের কি কোনো মিল রয়েছে? যে ছিল বাপের ন্যাওটা, সারাটাদিন ‘ বাবা, বাবা ‘ করে মুখে ফ্যানা তুলতো; সেই ছেলেটা কি আজকের এই ছেলে? যে বাপের সামনে দাড়িয়ে বলতে পারে, “কখনো আমাদের সামনে না আসুন!”
__

দিনগুলো কাটছিল গতানুগতিক ধারায়। কোনো ভিন্নতা নেই, কোনো পরিবর্তন নেই। কেমন ক্লান্তি মাখা একঘেয়ে জীবন। আলস্য ভরা দিনগুলোর একটিতে হঠাৎ করে খালামণির উদয় হলো বাড়িতে। খালামণি আর অর্পি এলো বেড়াতে। দু ‘ দিনের জন্য। হিয়া ভারী অবাক হলো তাতে। অর্পি উচ্চ মাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষের, বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী। এসময়টায় তার লেখাপড়ার চাপ অনেক বেশি। দম নেবারও ফুসরত নেই। আর তখন অর্পি এলো বেড়াতে?

এবার খালামণির ব্যবহারেও বেশ পরিবর্তন এসেছে। সব সময়ই ওরা ওকে ভালোবাসে, আদর করে; কিন্তু এবার যেন সেটা বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে গিয়েছে। মৌসুমীর সাথে-সাথে থেকে রান্নাবান্না শিখে ফেলেছিল হিয়া। খালামণিকে তাই নিজের হাতের রান্না খাওয়ালো। তাতে খুশিতে যেন বাকবাকুম হয়ে গেলেন তিনি। হিয়ার চিবুক ছুঁয়ে বারবার আদর করে দিতে লাগলেন। চুমু খেলেন কপালে। ভালোবেসে নিজের আঙুলের আংটি খুলে পরিয়েও দিলেন ওর হাতে। হিয়া এবার বিস্ময় চাপতে পারলো না। কারণ খালামণির ওই আংটিটা তার বৌ-মাকে মানে ফুয়াদ ভাইয়ের স্ত্রীর জন্য গড়িয়ে রেখেছেন তিনি। সেটা কেন ভাগ্নিকে দেবেন? হিয়া বাঁধা দিলো,

— “না, না। খালামণি কি করছেন? এটা দিচ্ছেন কেন?”
খালামণি ভ্রু-কুটি করলেন সামান্য। মুখ থেকে হাসি সরলো না তবুও,
— “কেন? খালামণির আংটি পছন্দ হচ্ছে না? অন্য একটা বানিয়ে দিবো?”
— “না! সে কথা নয়। আংটিটা তো সুন্দর–”
— “তবে?”
এবার একটু কষ্টই পেলেন বোধ হয়। হিয়ার খারাপ লাগলো তাকে উপেক্ষা করতে,
— “মানে– আসলে– আপনি তো বলেছিলেন এটা ফুয়াদ ভাইয়ার বৌয়ের জন্য রেখেছেন। সেই আংটি আবার আমাকে—”

হিয়া কথা শেষ করলো না। করতে পারলো না নিজের অস্বস্তি আর বিব্রত বোধের জন্য। খালামণির উচ্ছাস কমে গেল হঠাৎ। অভিমান করে বললেন,

— “সে ওর বৌয়ের কথা পড়ে হবে। আগে আমার ভাগ্নি। আমি খালামণি হয়ে তোকে কিছু দিতে পারবো না? নাকি তুই নিতে চাইছিস না?”
— “আপনি বুঝছেন না। মা দেখো তো, খালামণি কেমন পাগলামি করছেন!”

অসহায় হয়ে মায়ের দিকে তাকালো হিয়া। মৌসুমি চোখের ইশারায় উপহার গ্রহন করতে অনুমতি দিলেন। মা-মেয়ের কান্ড দেখে হাসলো হিয়ার খালামণি। ভাগ্নির চিবুক ধরে আদর করলেন,

— “ওরে পাগলী, মায়ের অনুমতির জন্য আমাকে উপেক্ষা করছিস? ধুর! আমি আমার ভাগ্নিকে কিছু দিলে মৌসুমি বলবে কি? নে তো, মা। আঙুলটা এগিয়ে দে।”

বলে নিজেই হাত টেনে ওর অনামিকা আঙুলে আংটিটা পরিয়ে দিলেন। হিয়া অনিচ্ছা সত্ত্বেও সেটা গ্রহন করলো। হাসলো একটু। খালামনি উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন,

— “ও মৌসুমী দেখ! তোর মেয়ের হাতটা কতো সুন্দর। আংটিটা কি মানিয়েছে! অবশ্য হাত সুন্দর হবে না কেন! মেয়ে তো পুরোটাই সুন্দর। আমার ছেলের সাথে মানাবে দারুণ!”

মুখের হাসি মিলিয়ে গেল হিয়ার। বড় বড় চোখ মেলে তাকালো খালামণির দিকে, আর একবার মায়ের দিকে। খালামণি আপনমনে নানান কথা বলছেন। সেসব কিছুই হিয়ার মাথায় ঢুকছে না। সে নিস্পলক আমি চেয়ে আছে মায়ের দিকে। মৌসুমি গম্ভীর হয়ে মাথা নাড়িয়েছেন কেবল! কিছু বলেন নি। অথচ হিয়ার চোখে তখন সহস্র প্রশ্নের মেলা বসেছে!
___

মোড়ের দোকানে দাড়িয়ে সিগারেট টানছিল কাহন। দোকান থেকে একপাশে সরে গিয়ে। আপনমনে। হাওয়ায় মিশে যাচ্ছিল এক-একেকটা ধুম্রজাল। হঠাৎ কী হলো কে জানে। খুক-খুক করে কেশে উঠলো। একেবারে দম আটকে আসবার মতো অবস্থা। ঠিক সে সময়ই একটা মেয়েলি সুর কানে বাজলো,

— “যেটা সহ্য করতে পারেন না, সেটা করেন কেন?”

আড়চোখে তাকালো কণ্ঠের অধিকারিনীর দিকে। কান্তার বান্ধবী, কি যেন নাম মেয়েটার? হিয়া? বুকের উপর দু’ হাত ভাঁজ করে দাড়িয়ে আছে। চেয়ে আছে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে। কাশটাকে দমিয়ে কোনমতে বললো,

— “মানে?”

— “সিগারেট আপনি সহ্য করতে পারছেন না, তবুও নির্দিধায় টেনে যাচ্ছেন। কেন?”

গলায় অধিকারবোধ স্পষ্ট। যেন জবরদস্তি করে প্রশ্নের উত্তর নিয়ে ছাড়বে। কাহন হাসলো তাচ্ছিল্য ভরে। যে হাসিতে কোনো শব্দ হয় না, ঠোঁট দু’টো বেঁকে যায় খানিক, চেহারায় ফুটে ওঠে নিদারুণ কষ্ট! অন্য দিকে তাকিয়ে বললো,

— “কষ্টও তো আমার সহ্য হয় না, তবুও কেন সহ্য করছি বলো তো?”

একমুহূর্তের জন্য কি যেন হয়ে গেল হিয়ার। চোখে জল জমলো। অস্পষ্ট স্বরে আওড়ালো,

— “আপনার কীসের এতো কষ্ট?”

মুখ ঘুরিয়ে দাড়িয়ে আছে কাহন। সেভাবে থেকেই সিগারেটটা ঠোঁটের কোণে চেপে ধরলো। হিয়ার প্রশ্নের জবাব দেয়ার প্রয়োজন নেই। আপনমনে লম্বা একটা টান দিয়ে, গোল গোল রিং ছড়ালো ধোঁয়ার। মুখে হাত দিয়ে একটু কেশে উঠলো হিয়া। কাহন তাকে পাত্তা দিচ্ছে না কেন?

খানিক বাদে ফিরে তাকালো কাহন। হাতের সিগারেট শেষ হয়ে এসেছে প্রায়। শুধালো,

— “এখানে কেন এসেছিলে?”

হঠাৎ প্রশ্নে সামান্য চমকালো হিয়া। পরক্ষণেই স্বাভাবিক হয়ে জানালো,

— “আপনার সাথে কিছু কথা আছে।”
— “বলো।”

হিয়া আশেপাশে চেয়ে নিলো একপল। মোড়ের এই দোকানটায় সবসময়ই মানুষ গিজগিজ করে। নানান বয়সী, নানান শ্রেণীর মানুষ সর্বদা হৈ-চৈ করে। চা-পান খেতে খেতে উচ্চস্বরে কলরব তোলে। এরমধ্যে দাড়িয়ে কি মনের কথা বলা যায়? ইতস্তত করে বললো,

— “এখানে নয়। একটু সাইডে আসুন।”
— “এখানে বলতে কি সমস্যা?”

সরু চোখে তাকালো। হিয়ার বিব্রতবোধ বাড়লো বৈ কমলো না। কোনমতে বললো,

— “সমস্যা আছে। আপনি সাইডে আসুন। আমরা হাঁটতে হাঁটতেও কথা বলতে পারি!”

শেষের কথাটা অদ্ভুত জোড়ালো মনে হলো। ঠোঁট কামড়ে কি যেন ভাবলো কাহন। শেষ হয়ে আসা সিগারেটে আরেকটা টান দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলো সেটাকে। হিয়া তখনো আগ্রহী চোখে চেয়ে।

— “শোনো, হিয়া। তোমার সাথে আমার এমন কোনো কথা থাকতে পারে না যা এই রাস্তায় দাড়িয়ে বলা সম্ভব নয়! আড়ালে গিয়ে যা বলা যায়, সামনেও সেটাই বলা যায়।”

— “না, যায় না। আপনাকে আমি..”

প্রতিবাদ করতে চেষ্টা করলেই হাত উঁচিয়ে বাধা দিলো কাহন। কড়া গলায় বললো,

— “তোমার সঙ্গে আমার কোনো কথা নেই, মেয়ে! তুমি চলে যাও!”
— “আপনি আমার কথাটা তো–”
— “আমি শুনতে চাই না। তুমি চলে যাও, প্লিয!”

অনড় হয়ে দাড়িয়ে রইলো হিয়া। চোখের কার্নিশ বেয়ে তখন উপচে পড়েছে জল। টপটপ ফোঁটায় অবিরাম ঝরছে তারা। আটকানোর বিন্দু মাত্র প্রচেষ্টা নেই ওর। কাহন অন্য দিকে ফিরলো। আহ্লাদী মেয়েটার কান্নভরা চোখ দেখবার সাধ্য বা ইচ্ছে কোনোটাই ওর নেই। হাঁটতে শুরু করবার আগে জানিয়ে দিয়ে গেল,

— “রাজকন্যা আর রাখালের মধুর সংসার শুধুমাত্র কল্পনাতেই মানায়, বাস্তবে তার ঠাঁই নেই!”
__

হিয়াকে ফেলে নিজে চলে এলো কাহন। মেয়েটার হাবভাব দেখেই ওর মনের কথা ধরে ফেলেছে সে। বুঝে নিয়েছে ওর অপ্রকাশিত ভালোবাসা, অব্যক্ত অনুভূতি! যার পর থেকেই নিজেকে অসহায় লাগছে। কেন এই মেয়েটা ওকে ভালোবাসলো? কেন চাইলো ওকে? পৃথিবীতে এত এত সফল মানুষ থাকতে ওই মেয়েটির কেন তার মতো ছন্নছাড়াকেই ভালো লাগলো? অনির্দিষ্ট-অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ যার?

তাই এড়িয়ে গিয়েছে ওই হাস্যময়ী, আদুরে বালিকাকে। যার সামনে দাড়ালে ওর বুক কাঁপে, হৃদস্পন্দন দ্রুত হয়, যার চোখের দিকে তাকালে ভুবন দুলে ওঠে, আহ্লাদী মুখটা দেখলে মনে হয় বুঝি সর্বনাশ হয়ে এলো; তাকে এড়ানো ছাড়া উপায় কি! এই চালচুলোহীন কাহনের সাথে তার কি মানায়?

— “কাহন!”

চকিতে ফিরে তাকাতেই দেখা মিললো কায়সার মাহমুদের। রাস্তার একপাশে দাড়িয়ে হাত নাড়ছেন তিনি। পেছনেই পার্ক করে রাখা তার দামী কার। লোকটা যদিও তার বাবা, কিন্তু তবুও তাকে দেখে ভয়ানক বিরক্তিতে ছেয়ে গেল ওর মন। এই মানুষটিকে সে দেখতে চায় না, একটুও না। তবুও লোকটা বারবার তার সামনে চলে আসে। কেন?

সেদিন ব্যাংক থেকে ফিরবার পর আরও বহুবার কায়সার মাহমুদের মুখোমুখি হতে হয়েছে তাকে। লোকটা এতো বছর প্রায় নিখোঁজ ছিলেন, ওদের কোনো খোঁজ নেয় নি। আর এখন হঠাৎ কি হলো কে জানে! নিয়ম করে ছেলের সামনে এসে হাজির হচ্ছে। এমন নয় যে কাহন ছাড়া তার কেউ নেই। আছে, তার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী-সন্তান আছে। তবুও কাহনের কাছে তিনি কেন আসেন? লোকটাকে যে সে কিছুতেই সহ্য করতে পারে না!

এগিয়ে এসে তীব্র গলায় বললো,

— “কেন এসেছেন? কি দরকার?”
— “তোর সাথে আমার কথা বলার দরকার ছিল, কাহন! আমার কথাটা একটু শোন। প্লিজ? আমি বাপ হয়ে তোর কাছে মিনতি করছি!”

লোকটা সত্যি সত্যিই করজোড়ে মিনতি করতে লাগলো। আশেপাশে তাকিয়ে বিব্রত বোধ করলো কাহন। ভরা রাস্তা এটা; কৌতূহলী মানুষের কি অভাব আছে? কিন্তু এই লোককে তার উপেক্ষা করবার ক্ষমতা নেই। তিনি বারবার ফিরে আসেন। হাজির হন সামনে। তাই নির্জীব কণ্ঠে উচ্চারণ করলো,

— “বলুন!”
— “এখানে না। আমার সাথে চল? আমি সঙ্গে গাড়ি নিয়ে এসেছি।”

দামী গাড়িটাকে ইশারা করে দেখালেন। কাহন আড়চোখে দেখলো। রোলস রয়েলসের রাজকীয় গাড়ি। লোকটা বড় সুখেই আছে, তাই না? তাকে আর তার মাকে ফেলে বহুৎ আনন্দেই দিনযাপন করছে! তবে এই আনন্দিত প্রহরে কাহনের মতো দুর্ভাগা যুবকের কাছে কেন এলেন?

চলবে___

#মৌরিন_আহমেদ

[ বি‌: দ্র: এখন থেকে একদিন পরপর আপলোড করা হবে। পাঠকদের জ্ঞাতার্থে জানিয়ে দেয়া হলো ❤️]

[আমার প্রথম ই-বই ‘বাতাসে বহিছে প্রেম’ পাওয়া যাচ্ছে বইটই অ্যাপে। পড়তে চাইলে ঝটপট কিনে ফেলুন মাত্র ত্রিশ টাকা দিয়ে! লিংক কমেন্টে… ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here