শেষ বিকেলের রোদ-২৪ তম পর্ব

0
1533

শেষ বিকেলের রোদ-২৪ তম পর্ব
©শাহরিয়ার

সোহান:- এই ফুলটুসি কোন দিকে যাচ্ছিস?

— সোহানের ডাকে তাকিয়ে দেখি আমি ডাইনিং ছেড়ে অনেকটা দূর এগিয়ে গিয়েছি। কিছুটা লজ্জা নিয়ে আবার পেছন দিকে ফিরে এসে ডাইনিং এ ঢুকলাম। সকলে নাস্তা শুরু করে দিয়েছে আমরা দু’জন ও তাদের সাথে যোগ দিলাম। নাস্তার টেবিলে সকলে হাসি খুশি কথাবার্তা বলছে।

ফুপু:- তোর শরীর কেমন এখন?

— জ্বি ফুপু ভালো, টুকটাক কথা বলতে বলতে নাস্তা করছি, হঠাৎ আপুর এক কাজিন বললো গান বাজছে নাচ হবে না? ঠিক সেই মুহুর্তে আপুর দু’জন বান্ধবী রুমে ঢুকতে ঢুকতে বললো নাস্তা শেষ হলেই নাচ শুরু হবে। আপনারা এতো গুলো মানুষ শহর থেকে এসেছেন আপনাদের নাচতো দেখবোই।

ফুপু:- আসো আসো তাড়াতাড়ি নাস্তা করে নাও।

— সকলে এক সাথে নাস্তা শেষ করে ডাইনিং থেকে বের হলাম।

রুমি:- আফরিন তোর সব কাজিনদের নিয়ে উঠানের ঐ দিকে আয়, নাচ গান সেখানেই করবো।

আফরিন:- কিন্তু ঐ দিকটাতো ভেজা,

রুমি:- আরে কিছু হবে না একটু ঝাড়ু দিয়ে দিলেই হবে। আর কাদার ভিতর নাচ গানইতো মজা।

আফরিন:- আচ্ছা তোরা দু’জন যা আমি সবাইকে নিয়ে আসছি।

— আপু এসে আমাদের সবাইকে বাড়ির উঠানে ডেকে নিয়ে আসলো। বিশাল উঠান এরই মধ্য আপুর বান্ধবীরা ঝাড়ু দিয়ে অনেকটাই পরিষ্কার করে ফেলেছে। মোটামুটি ভালোই পরিষ্কার অবস্থা পানি জমা নেই কোথাও তবে কাদা মাটি ঠিকই বুঝা যাচ্ছে। আর এটাও বুঝা যাচ্ছে যে বা যারাই নাচানাচি করবে পরে যাবার সম্ভাবনা একশো ভাগই থাকছে। যে পরবে না এই কাদামাটিতে লাফিয়ে সেই ভাগ্যবান/ভাগ্যবতী। আমি শিউর এই কাজটা আপুর বান্ধবীরা ইচ্ছে করেই করছে। যেন দু’চার জন পিচ্ছিলেয়ে পরে সবাই কে বিনোদন দিতে পারে সেজন্যই।

আফরিন:- ইকরা ভুলেও কিন্তু এই কাদা মাটিতে লাফাতে যাবি না। এমনিতেই তোর শরীরের অবস্থা ভালো না পরে গেলে শেষে কোমড়টা ভেঙে বসে।থাকতে হবে ঘরে।

— না না আমার পক্ষে নাচা সম্ভব নয়। তোমরাই নাচানাচি করো আমি বরং বসে বসে দেখবো। এমন সময় দুম করে আবারো সাউন্ড বক্সে বেজে উঠলো,
“হলুদ বাঁটো, মেন্দি বাঁটো, বাঁটো ফুলের মৌ,
বিয়ার সাজে সাজবে কন্যা নরম নরম ব’রে
হলুদ বাঁটো, মেন্দি বাঁটো, বাঁটো ফুলের মৌ,
বিয়ার সাজে সাজবে কন্যা নরম নরম ব’রে
সুরমা-কাজল পরাও কন্নার ডাগর নয়নে,
আলতা বিছপ রাঙা দুটি, রাঙা চরণে
ভরা কলস ছলাৎ ছলাৎ ডাঙা এ নিতল ।
হলুদ বাঁটো, মেন্দি বাঁটো, বাঁটো ফুলের মৌ,
বিয়ার সাজে সাজবে কন্যা নরম নরম ব’রে”

— সকলের চেহারাতেই আনন্দের ছাপ, সকলেই গানের তালে তালে হাত পা নাড়াচ্ছে, আপুর দুই বান্ধবী গানের তালে তালে নেচে চলেছে, এদিকে আশে পাশের বাড়ি থেকে ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা আসতে শুরু করেছে নাচ দেখার জন্য। রুমি আপু আপুর কয়েকজন কাজিনের হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো কাদার মাঝে নাচার জন্য, তারাও কোন রকমে হাত পা ছুড়ে নাচার চেষ্টা করছে। সেদিকে তাকিয়ে দেখতে দেখতে কিছু সময়ের জন্য সোহানের দিক থেকে নজর কিছুটা সরে গিয়েছিলো। হঠাৎ করে গাঢ়ে কারো স্পর্শে চমকে উঠলাম। ঘুরে তাকিয়ে দেখি সোহান? ইশারায় জিজ্ঞাসা করলাম কি?

সোহান:-নাচবি নাকি তুই?

— মাথা নেড়ে তুমি যেয়ে নাচো, আমার এতো সখ নেই।

সোহান:- ঠিকতো শেষে আবার হিংসা করিস না,

— আমার বয়েই গেছে তোমার সাথে হিংসে করতে।
সোহান হাসতে হাসতে চলে গেলো আমিও নাচ দেখায় মনোযোগী হলাম। হঠাৎ করে সোহান আপুর দু’জন ছেলে কাজিন আর এলাকার ছোট ছোট ছেলে গুলোকে নিয়ে সেখানে নাচতে শুরু করলো। ওদের নাচ দেখে আস্তে আস্তে আপুর বান্ধবীরা থেমে গেলো। এবং এক সময় তারাও এসে সাইডে দাঁড়িয়ে সোহানদের নাচ দেখতে শুরু করলো। এর আগে গ্রামের বিয়ে কখনো দেখিনি শুধু শুনেছি যে অনেক মজা হয় আজ তা অনুভব করছি সত্যিই উপভোগ্যময়, দীর্ঘ সময় সকলে নাচ গান করে পুকুরে চলে গেলো, ছেলেরা এক পাশে আর মেয়েরা একপাশে গোসল করতে শুরু করলো, ছোট বেলার কথা মনে করিয়ে দিলো, কতই না পুকুরে লাফিয়ে লাফিয়ে গোসল করছি, মন চাইলেও আজ পুকুরে নামতে পারছি না। গোসল শেষে সবাই মিলে এক সাথে খেতে বসেছি উঠানে। এরপর শুরু হলো নানান আয়োজন সন্ধ্যায় বর পক্ষের লোকজন আসবে আপুকে গায়ে হলুদ দিতে। সকলে মিলে হলুদ, মেহেদী বাটতে শুরু করেছে। সত্যিই মুগ্ধ হচ্ছি এতো সুন্দর পরিবেশ দেখে, মনে মনে লজ্জা লাগছে যখন ভাবছি আমার বিয়েতেও এমনটা হবে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে আসছে, আকাশ ভাইয়াদের বাড়ি থেকে ফোন এসেছে তারা অলরেডি রওনা হয়ে গেছে হয়তো আর কিছুক্ষণের ভিতর তারা চলেও আসবে। এদিকে সোহানকে আজ বড্ড বিজি দেখাচ্ছে নানান রকম কাজে সবাইকে সাহায্য করছে আমার সাথে কথা বলার মত সময়ও কি ওর বের হয়না। ভাবতে ভাবতে আকাশ ভাইয়াদের বাড়ির লোকজন বাড়ির ভিতর ঢুকে পরলো। মুরুব্বিদের সাথে আকাশ ভাইয়ার ছোট বোন, আরমান, নীলা আরও অনেক অল্প বয়সী ছেলে মেয়েরা এসেছে। ছোট করে একটা স্টেজ সাজানো হয়েছে সেখানেই হলুদের শাড়ি পরে আপু বসে আছে। আকাশ ভাইয়ার বাড়ি থেকে আসা সকলেই হলুদের ড্রেস পরে আসছে। বেশ লাগছে একে একে সকলে আপুর মুখে হলুদ দিয়ে যাচ্ছে, হঠাৎ পেছন থেকে,
আরমান:- বলে উঠলো কেমন আছেন? মন খারাপ নাকি?

— এইতো ভালো আছি আপনি কেমন আছেন। মন খারাপ না শরীরে কিছুটা জ্বর।

আরমান: ওহ আচ্ছা ডাক্তার দেখান নি? আমরাও সকলে ভালো আছি।

— হ্যাঁ ডাক্তার দেখিয়ে ঔষধ খাচ্ছি, টুকটাক কথাবার্তা হচ্ছে এর মাঝে সকলকে নাস্তা খাবার জন্য ডাক দিলো, আরমানকে বললাম যেয়ে নাস্তা খেয়ে নিন।

আরমান:- হ্যাঁ আসুন আপনিও খেয়ে নিবেন।

— আপনারা খেয়ে নিন, আমি পরে খাবো। আরমান উনার আত্মীয়দের সাথে নাস্তা খাবার জন্য চলে গেলো। আমিও কিছুক্ষণ পর মেহমানদের খাবার ঠিক মত দেয়া হয়েছে কিনা দেখার জন্য সেদিকে গেলাম।

ফুপু:- কিরে মা তুই ও খেয়ে নে হালকা নাস্তা।

— না ফুপু আমার খিদে নেই, এর মাঝে বাহির থেকে বাবার ডাক শুনে ছুটে গেলাম। বাবা মা, চাচা চাচী সকলে চলে এসেছেন। আমি ছুটে যেয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরলাম। সকলে মিলে বাড়ির ভিতর ঢুকলাম। সবাইকে রুমে রেস্ট নিতে বলে আমি বের হয়ে ফুপুকে ডাক দিয়ে বললাম বাবা মা এসেছে।

ফুপু:- তুই এই দিকটা দেখ, আমি যেয়ে সকলের সাথে দেখা করে আসছি।

— ফুপু চলে যেতেই আমার নজর গেলো সোহানের দিকে। সোহান সকলকে খাবার পরিবেশন করছে। আমি ওর দিকে এগিয়ে যেতেই

সোহান:- জিজ্ঞাসা করলো কিছু বলবে?

— ঢাকা থেকে সবাই চলে এসেছে, তুমি কি দেখা করবে না?

সোহান:- দেখা করবো না কেন? মেহমান যাক তারপর দেখা করে আমরা ঐ বাড়িতে যাবো। তুই অপেক্ষা কর খাওয়ার পর্বটা শেষ হোক।

— আমিও এদিক সেদিক ঘুরে দেখছি কারো কিছু লাগবে কিনা। কিছুক্ষণের ভিতর মোটামুটি নাস্তার পর্ব শেষ হয়ে গেলো। মেহমানরা বের হতে শুরু করলো। সকলে বাড়িতে যাবার জন্য রেডি হলো, আরমান আমার কাছে এসে বললো আপনিও চলুন আমাদের সাথে। আপনারা যান আমরা পরে আসবো।

আরমান:- আমাদের সাথে গেলে আপনার ভালো লাগবে।

— সমস্যা নেই আপনারা যান আমরাও কিছু সময় পর আসছি, আর ঢাকা থেকে বাবা মা এসেছে এখনো ঠিক মত কথা বলা হয়নি।

আরমান:- ওহ আচ্ছা আপনার বাবা মার সাথে পরিচয় করিয়ে দিবেন না?

— আরমানের কথায় কিছুটা লজ্জাবোধ হলো, আমি বললাম উনারাতো রেস্ট নিচ্ছে বের হয়নি এখনো, চলুন পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। এমন সময় নীলা আরমানকে ডাক দিলো বের হবার জন্য।

আরমান:- আচ্ছা এখন থাক পরে এক সময় পরিচিত হবো, এখন সকলে যাবার জন্য অপেক্ষা করছে, আপনারও তাড়াতাড়ি ঐ বাড়িতে চলে আসুন।

— হ্যাঁ অবশ্যই, আরমান বিদায় নিয়ে চলে যেতেই আমি বাবা মায়ের রুমে ছুটে আসলাম। এসে দেখি সোহান আগে থেকেই সকলের সাথে কথা বলছে। আমি যেতেই বড় চাচা রেগে আমাকে বলতে শুরু করলো।

বড় চাচা:- তোদের কি আমরা কিছু লাগি না নাকি?

— কেন এমন করে বলছো তোমরাইতো আমাদের দু’জনের সব।

বড় চাচা:- তাহলে কি তোরা এমনটা করতে পারতি, অসুস্থ হলি দু’জনে অথচ একটি বারের জন্যও জানানোর প্রয়োজন মনে করলি না। সোহানের কথা বাদ দিলাম কিন্তু তুই কি করে পর করে দিলি?

— আমি ছুটে বড় চাচার বুকের উপর মাথাটা লাগিয়ে দিয়ে এমন করে বলতে পারলে তুমি।

বড় চাচা:- আমি বললেই দোষ আর তোরা অন্যায় করলে কোন ক্ষতি নেই তাই না?

— থাকবে না কেন একশো বার থাকবে হাজার বার থাকবে কিন্তু তোমরা কেন বুঝনা, তোমরা দূর থেকে চিন্তা করবে আমরা কি করে সামান্যতেই তোমাদের চিন্তায় ফেলে দেই বলো?

বাবা:- হয়েছে বেশ বড় হযে গিয়েছিস দু’জন দেখতে পাচ্ছি।

— কথা বলতে বলতে আফরিন আপু ঢুকে বলতে শুরু করলো তোরা এখনো তৈরি হলি না? সকলে তোদের জন্য অপেক্ষা করছে, তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে তুই আর ভাইয়া। আমি আর সোহান বাবা মাকে বলে বের হয়ে এলাম। সোহান নিজের রুমে আর আমি আমার রুমে চলে আসলাম। তাড়াতাড়ি হলুদেে জন্য নিয়ে আসা জামা কাপড় গুলো বের করে পরতে শুরু করলাম। খুব সুন্দর করে সেজেছি তবুও কি যেন কম কম মনে হচ্ছে ভাবতে ভাবতে বাহির হতেই। পেছন থেকে কেউ হাত ধরে টান দিতেই ফিরে তাকালাম।

সোহান:- কানের কাছে চুলে গোলাপ ফুলটা গেথে দিতে দিতে বললো এটা না দিলে মানাবে না। সাথে এই ফুলের মালাটা খোপায় দিতে হবে তবেই পারফেক্ট লাগবে।

— আমি অবাক হয়ে সোহানের দিকে তাকিয়ে রইলাম। সত্যিই আমি মনে মনে ঠিক এই ফুল গুলোয় খুঁজতে ছিলাম। কি বলবো ঠিক বুঝতে পারছিলাম না।

সোহান:- এই ফুলটুসি কোথায় হারালি?

— তোমার ফুলের মাঝে হারিয়ে গিয়েছি, হারিয়ে যেতে চাই এখন তোমার হাতে হাত রেখে দূর বহু দূর। বলেই সোহানের দিক হাত বাড়িয়ে দিলাম।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here