প্রাণহন্ত্রী (৪)

0
166

#প্রাণহন্ত্রী (৪)
রুগ্ন দেহে উঠে বসে দীপ্তি।সন্ধ্যার আজান পড়েছে সবে। তাই কল পাড় থেকে অযু করে আসে। ধীর পায়ে মায়ের সাথে বসে নামাজে। আজ বহু দিন পর নামাজের পাটি তে বসেছে ওহ। নামাজ পড়ে মনের মধ্যে শান্তি অনুভব হয়। সালাম ফিরিয়ে রুমানা বলেন ” অসুস্থ শরীরে বসে বসে নামাজ পড়লে ও হতো। ”

” সমস্যা নেই আম্মা।” একটু থেমে ফের বলে ” আজকে বড় সড়কে যাবে?”

” তোর শরীরটা ভালো নেই। আজ আর যাবো না। ”

” তাহলে আজকে পড়াশোনা না করলে হয় না?”

ভাবনায় পরে যায় রমানা। পড়াশোনায় ফাঁকি দেওয়ার মেয়ে নয় দীপ্তি। নিশ্চয়ই শরীর অসুস্থতার জন্যই পড়তে চাইছে না। হাসি মুখে সম্মতি জানায় রুমানা। দীপ্তি বলে
” আব্বা আর মায়ের ক’ব’র জিয়ারত করতে যাইবা আম্মা? ”

” এই রাতের বেলায় যাবি। ”

” হ আম্মা যাই না। ”

রুমানার ইচ্ছে করে না বারন করতে। দীপ্তি কখনোই কোনো কিছু নিয়ে জোড় করে না। তাহলে আজ যেহেতু বলছে নিশ্চয়ই ভেবেই বলছে। কুপি বাতি নিভিয়ে হারিকেন জ্বালায়। মাথায় এক হাত ঘোমটা তুলে বলেন
” মাথায় ঘোমটা দে দীপ্তি। কব/রস্থানের রাস্তাটা বেশ অন্ধকার। ”

” কিছু হবে না আম্মা। ”

ভীতু দীপ্তির মুখে এমন কথা শুনে ভারী চমকে উঠেন রুমানা। হঠাৎ করেই দীপ্তি যেন অনেক বড় হয়ে গেছে। একটু একটু করে সাহস জমেছে বুকের ভেতরে। ভূতের ভয় কোনো কালেই ছিলো না ওর। তবে মানুষ রূপী জানো/য়ার গুলোর ভয় ছিলো প্রচুর। আজ সেসবের লেশ মাত্র নেই। রুমানা বলেন ” তোর ভয় করছে না। ”

” না। ”

” দীপ্তি , তোর কি হয়েছে বল তো। ”

” কিছু না আম্মা। চলো না যাই। ”

” আয়। ”

দরজায় কপাট লাগিয়ে বেরিয়ে আসে রুমানা আর দীপ্তি। কোনো শব্দ ছাড়া পথ আগায়। চোখে মুখে উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছি। দীপ্তি যেন র/ক্ত মাং/সে গড়া মানুষ নয়। হেঁটে পথ আগায় দুজনে। যন্ত্রমানবী দীপ্তির দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকায় তিনি। প্রগাঢ় দৃষ্টিতে এগিয়ে যায় দীপ্তি। মনোযোগ অন্য জায়গায় হওয়াতে পায়ে কাঁটা ফুটে যায় রুমানার। আর্তনাদ করে উঠেন তিনি। পেছন থেকে আওয়াজ আসতেই ঘোর ভাঙে দীপ্তির। ছুটে আসে রুমানার কাছে। মাটিতে বসে পরেছেন তিনি। জুতোর ভেতর দিয়ে বেল কাঁটা ঢুকেছে। দীপ্তি বলে ” বাসায় চলো আম্মা। ”

” না , এতো দূর এসেছি ফিরে যাবো না আর। ”

” কিন্তু আম্মা। ”

” কোনো কথা নয়। ”

দীপ্তির চোখে মুক্ত দানার মতো পানি চিক চিক করে। মায়ের ব্যাথাতুর স্থানে নরম হাতে স্পর্শ করে। র/ক্তে পা মেখে গেছে রুমানার। বুকের ভেতর তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করে মেয়েটা। রুমানাকে জড়িয়ে ধরে বলে ” বাসায় ফিরা যাই না আম্মা। ”

” এতো অল্প তেই ভয় পেয়ে গেলি মা? আমার এই সামান্য ব্যথা কিছু নয় রে। অনেক যন্ত্রনা আছে বুকে। ”

” কিসের কথা কইতেছো তুমি। আমি কিছুই বুঝতেছি না। ”

” এখন চল তো। ”

দীপ্তির হাত ধরে এগিয়ে যায় রুমানা। খড়া মাটিতে তরল র/ক্তের ছোপ ছোপ দাগ। নিঃসন্দহে ভয়ার্ত কোনো অশ/রীরীর মতো দেখাচ্ছে। যে কেউ ভয় পেতে বাধ্য। দীপ্তির গা গুলিয়ে আসে। পথ যতো আগায় ভয় ততো বাড়ে। কখনো ভূত নামক ভয় ছিলো না ওর। তবে আজ ভয় হচ্ছে , খুব বেশি ই ভয় হচ্ছে।

কব/রস্থানের কাছে আসতেই গাঁয়ের প্রতিটি শিরা কেঁপে উঠে। র/ক্তে যেন ঠান্ডা তরল স্রোত নেমে যায়। গা ঝমঝমিয়ে উঠে। রুমানাকে খামচে ধরে দীপ্তি। আশ্বস্ত করে বলে ” ভয় পাচ্ছিস কেন? কব/রস্থান হলো পবিত্র। এখানে শুয়ে আছে আমাদের আপন জন। ”

” আমার ভয় করছে আম্মা। ”

মৃদু হাসেন রুমানা। দীপ্তির হাতে হাত রেখে বলে ” আয় তো আমার সাথে। ”

কব/রস্থানের ভেতরে ঢুকে দোয়া পাঠ করে দীপ্তি ও রুমানা। হঠাৎ করেই অনুভব হয় দু চোখে নেমেছে নোনা জলের ফোয়ারা। তীব্র যন্ত্রণা হয় হৃদয়ে। যেন কেউ সুচ দিয়ে একটু একটু করে আঘা/ত করে চলেছে। মৃদু আর্তনাদ করে উঠে দীপ্তি। মেয়েকে জড়িয়ে কেঁদে উঠেন রুমানা। থমথমে মুখে বলেন ” কান্না করতে নেই মা। দোয়া করতে হয়। ”

” আমার খুব কষ্ট হচ্ছে আম্মা। খুব কষ্ট হচ্ছে।”

বুকে পাথর চাঁপা দিয়ে কান্না আটকায় রুমানা। ভেঙে পরলে চলবে না। দীপ্তির কান্নার শব্দ কব/রস্থানের চারপাশে নিস্তব্ধতাকে ও থমকে দেয়। করুণ আওয়াজে খেকশিয়াল জেগে উঠে। ওর সাথে সাথে খেক শিয়াল ও ডেকে উঠে। সমস্ত করুণ আওয়াজ ভুতু’ড়ে পরিবেশ বিরাজ করায়। মৃদু স্বরে ডাকেন রুমানা। চিকন ঘামে ভিজে গেছে দীপ্তির শরীর। এভাবেই কেঁটে যায় বেশ অনেকক্ষণ। পরিবেশ তখন একদম ই শান্ত। নিশ্বাসের শব্দ গোনা যাবে খুব সহজেই। কব/রস্থান থেকে বেরিয়ে আসে দুজনে। গ্রামের পথ ধরে আসে ফসলি জমির ধারে। এই দিকটা বরাবর ই শান্ত। আশে পাশে বহু দূর অবধি কোনো মানুষের বাস নেই। দীপ্তির মাথায় হাত রেখে উঠে দাঁড়ায় রুমানা। চোখের কার্নিশ বেয়ে নেমে যাওয়া অশ্রুকে বাড়তে না দিয়ে বলেন ” দীপ্তি তোর মনে অনেক প্রশ্ন তাই না?এতদিন ধরে কৌতুলী মনকে দমিয়ে রেখেছিস? ”

” তুমি কি করে বুঝলা! ”

” তোর চোখ মুখ আমাকে অনেক কিছু বলে। তোর প্রশ্নের উত্তর আজ দিবো আমি। ”

” আম্মা আমার কোনো প্রশ্নের উত্তর চাই না। ”

” জানতে হবে দীপ্তি। জানতে হবে তোকে , ভয়ে গুটিয়ে থাকলে চলবে না। ”

সাধারন কথাটাই টগবগে কিশোরীর মনে উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। জাগ্রত হয় উৎকণ্ঠা। ভেজা নেত্র পল্লব মেলে তাকিয়ে থাকে রুমানার দিকে। চন্দ্ররজনীর দিকে তাকিয়ে রুমানা বলেন” তোর বাবার সাথে আমার বিয়ে হয় যখন তখন আমি সতেরো তে পা দিয়েছি মাত্র। বাবা তখন উপায় না পেয়েই তোর বাবার সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন। একজন ভালো মানুষের সন্ধান করেছেন। তোর বাবার সাথে পরিচয় ছিলো আগেই। সুন্দরী হওয়াতে চার পাশের হা/য়নার নজর পরেছিলো। বাবা কে মা/র খেতে হয় বহুবার। পড়াশোনা স্থগিত হয়েছে দুই বছর। কোনো মতে নবম শ্রেনিতে আসলাম। ইচ্ছে ছিলো বড় পুলিশ অফিসার হওয়া। তবে হা/য়নার দলেরা আমাকে সে সুযোগ দেয় নি। কেড়ে নিয়েছিলো আমার কিশোরী মনের ইচ্ছা। বাবার পায়ে ধরেছিলাম যাতে আমায় বিয়ে না দেন। তবে শুনেন নি সে কথা। জোর করেই তোর বাবার সাথে বিয়ে দিয়ে দেন। যখন শুনি সে ছিলো বিবাহিত তাছাড়া চার বছরের একটি মেয়ে ও আছে তখন আমার কি অবস্থা হয়েছিলো আমি নিজে ও জানি না। প্রথম প্রথম তোর বাবা কে ঘৃনা হতো। কি করে পারলো এতো ছোট এক মেয়েকে বিয়ে করতে। তবে ধীরে ধীরে মানিয়ে নিতে শিখি। তোর বাবা সত্যি ই ভালো মানুষ ছিলেন। স্বল্প আয়ে পুরো সংসার চালাতেন। তবে হঠাৎ করেই নেশাগ্রস্ত হয়ে পরলেন। ধার দেনা হলো, শেষে তোকে বিয়ের জন্য জোড় করলো। সেদিন আমি তোর মাঝে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখেছিলাম। বুকের ভেতর কষ্ট অনুভব হয়েছিলো। সেই দিন ই আমি নিজের মাঝের মাতৃত্বকে দেখতে পাই। তোর বাবার প্রতি রাগ থেকেই সন্তান গ্রহন করি নি আমি। তবে সেদিন অনুভব করেছিলাম আমার মেয়ে আছে। আমার সন্তান তুই। গর্ভে ধারন না করলে ও তুই আমার মেয়ে , আমার প্রতিচ্ছবি। আমি তোর সাথে অন্যায় হতে দিবো না। সেদিন নিজের মায়ের শেষ চিহ্ন টা বিক্রি করে তোর বাবার সমস্ত ধার দেনা পরিশোধ করি। আগলে নেই তোকে। ভেবেছিলাম ছোট্ট একটা সংসার গড়বো। তোকে অনেক বড় করে তুলবো। কিন্তু আমার কপালে সেটা হলো না।ছয় মাস যেতেই তোর বাবা মা/রা গেলেন। জানিস সেদিন আমি ভেঙে পরি নি। কারন আমি অনুভব করেছিলাম তোর জন্য আমায় শক্ত থাকতে হবে। আমার স্বপ্নের জন্য শক্ত থাকতে হবে। আমি জানি তুই মনের ভেতর কোনো ইচ্ছে রাখিস নি। আমার ইচ্ছেটা পূরন করবি তো তুই। আমি মজা করে সেদিন তোকে অফিসার হওয়ার কথা বলি নি। আমি সত্যি তোকে বলেছিলাম পুলিশ অফিসার হওয়ার কথা। পারবি না মা? আমার স্বপ্ন পূরন করবি তো আম্মা। বল দীপ্তি , আমাকে কথা দে তুই। ”

কথা গুলো বলার সময় অঝোরে কাঁদেন রুমানা। দীপ্তি যেন পাথর হয়ে গেছে। মেয়ের দিকে তাকিয়ে থমকে যান তিনি। হালকা আলোতে দীপ্তির মায়াবি মুখ নিজের কৈশোরের কথা মনে করায়। ছুটে আসেন রুমানা। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে ঝমঝমে কাঁদেন। বলেন ” কথা দে দীপ্তি। ”

” কথা দিলাম আম্মা। তোমার সব স্বপ্ন পূরন করবো আমি। দুষ্টু লোকের হিং/স্র থাবাকে ধ্বংস করবো। আমি তোমার মেয়ে আম্মা। হিং/স্রকে বি/নাশ করবো। ”

পর পর কয়েক খানা চুমু খান রুমানা। দীপ্তির চোখ থেকে কোনো পানি পরে না। সে বলে” আম্মা। আমি একটা কথা লুকাইছি তোমার থেকে। ”

” কি কথা?”

” মন্টুর অবস্থার জন্য আমি দায়ী। আমি লাঠি দিয়ে মাথায় আঘা/ত করেছি। ”

দু হাত পিছিয়ে যান রুমানা। দীপ্তির বাহু চেপে ধরেন। আশে পাশে তাকিয়ে সতর্ক হোন। অজানা ভয়ে র/ক্ত শীতল হয়ে যায়। দীপ্তির জীবন আশংকায় ভাবতেই গাঁয়ে কাঁটা দেয়। র/ক্ত চক্ষু ধারন করে রুমানার আঁখি পল্লব। দীপ্তিকে বাঁচাবে কি করে?

চলবে….
কলমে ~ ফাতেমা তুজ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here