শেষ বিকেলের রোদ-২৭ তম পর্ব

0
1696

শেষ বিকেলের রোদ-২৭ তম পর্ব
©শাহরিয়ার
— এই কি বলতে চাও তুমি হ্যাঁ, আমি কখনোই এমনটা চাইনা বুঝলে এমনটা তোমার মনের মাঝে আছে। দু’জন ঝগড়া করছি এমন সময় বাহিরে গাড়ির হর্ণ বাজতে শুরু করলো, বর যাত্রী চলে এসেছে ঝগড়া থামিয়ে দৌড়ে চলে গেলাম গেটের সামনে।

–সবাই মিলে বিয়ে বাড়ির গেট আটকিয়ে ধরলাম।
সেখানে অনেক রকম দুষ্টমি আর গেটে বর ঢোকার সকল আয়োজন শেষে বরযাত্রী বাড়ির ভিতর ঢুকলো। একদিকে খাওয়া দাওয়ার আয়োজন চলছে আরেক দিকে বিয়ে হচ্ছে অবশেষে দু’জন কবুল বলার মাধ্যমে স্বামী স্ত্রীর মর্যাদা লাভ করলো। সন্ধ্যার আকাশ আলোকিত হয়ে গেছে নানান রকম আতশ বাজিতে। মুগ্ধ হয়ে সে আকাশ দেখছি। হঠাৎ হঠাৎ বাজির শব্দে মাঝে মাঝে চমকে উঠছি। চারিদিকে সকলে হাসি খুশি ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমার দু’চোখ সোহানকে খুঁজে ফিরছে কিন্তু কোথাও সোহানকে দেখতে পাচ্ছি না। কোথায় গেলো কি করছে, এমন সময় হঠাৎ পেছন থেকে হাত ধরে টান দিতেই ঘুরে তাকাতেই সোহানকে দেখতে পেলাম।

সোহান:- ফুলটুসি কি খুঁজতেছিস?

— তোমাকে খুঁজতেছি আর কাকে খুঁজবো?

সোহান:- চল ঐদিক থেকে হেঁটে আছি।

— বলেই হাতটা বাড়িয়ে দিলো, আমি হাত ধরে হেঁটে চলেছি, দু’জন হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা দূর হেঁটে চলে আসলাম। ওর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম কোথায় যাচ্ছি আমরা?

সোহান:- আবার পেছনে ঘুরে কোথাও না, ইচ্ছে হলো হাঁটার তাই হাঁটতে আসলাম। এখন ঐখানে কান্নাকাটি শুরু হবে তাই একটু ফ্রেস হাওয়া খেতে আসলাম বুঝলি।

— তোমার যত সব ঢং চলোতো তাড়াতাড়ি সবাই আবার খুঁজবে। দু’জন কথা বলতে বলতে আবার বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করলাম। বাড়িতে তখন সত্যিই থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে, আপুর বিদায়ের মুহুর্ত চলছে। কম বেশী বাড়ির সকলেরই মন খারাপ আপু সকলের কাছ থেকে কেঁদে কেঁদে বিদায় নিচ্ছে, আপুর কান্না দেখে নিজের চোখের কোনেও জল জমে গেছে। না অসহ্য লাগছে নিজের কাছে সত্যিই এতো দিনের মায়ার বাঁধন ছিন্ন করে চলে যাওয়ার চাইতে বেদনার আর কোন মুহুর্তই হতে পারে না। আপু আমাদের সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলো, নতুন ঠিকানায় স্বামীর বাড়ির উদ্দেশ্যে। আস্তে আস্তে বাড়ি খালি হতে শুরু করলো। এক সময় দাওয়াত খেতে আসা সকল আত্মীয় স্বজনরা চলে গেলো। বাড়িতে এখনো নানান রকম বাতি জ্বলছে শুধু যার জন্য এতো আয়োজন সেই মানুষটাই নাই। ফুপুর ঘরের এক কোনে বসে কান্না করছে। ফুপা ফুপুকে বুঝানোর চেষ্টা করছে মেয়েদের বিয়ে হবে স্বামীর বাড়ি যাবে এটাই নিয়ম। বাড়িতে শুধু আমরাই আছি যারা ঢাকা থেকে এসেছি, রুমে এসে কেমন জানি একটা শূন্যতা অনুভব করলাম। এ কয়দিন আপুর সাথে ঘুমিয়েছি আজ আর আপু নেই, সেই শূন্যতায় এই মূহুর্তে অনুভব হচ্ছে বুঝতে পারছি। নানান রকম চিন্তা করতে করতে এক সময় ঘুমিয়ে পরলাম। সকালে আম্মুর ডাকে ঘুম ভাঙলো।

মা:- কিরে কত ঘুমাবি তাড়াতাড়ি উঠে ফ্রেস হয়ে নে নাস্তা করবি। আজ আবার আফরিনদের বাড়িতে যেতে হবে অনুষ্ঠানে।

— আমি উঠে ফ্রেস হয়ে নিলাম, ডাইনিং যেতেই দেখি সকলে বসে আছে। এক সাথে নাস্তা খেতে বসলাম। ফুপা ঐ বাড়িতে আমরা কতজন যাবো তার একটা লিষ্ট করলো। আমরা বাড়িতে যারা আছি তারা আর আশেপাশের আর কয়েকজন মুরুব্বি যাবে। এর ভিতর ফুপু বলতে শুরু করলো সে যাবে না।

বাবা:- কেন তোর আবার কি হলো?

ফুপু:- সবাই বাড়ি ছেড়ে চলে গেলে, ওদের সাথে করে নিয়ে আসলে বাড়ি ঘর গুছিয়ে রাখবে কে?

বড় চাচা:- তাও ঠিক তাহলে তোর ভাবিও থাকুক তোর সাথে।

বড় চাচী:- হ্যাঁ আমার কোন সমস্যা নেই তাহলে আমরা ননত ভাবি দু’জন থাকছি তোরা যেয়ে নিয়ে আয়।

— যেমন কথা তেমন কাজ আমরাই দুপুরে রওনা হলাম সে বাড়ির দিকে। দুপুর দুইটার ভিতর আমরা সে বাড়িতে পৌঁছে গেলাম। আমরা সকলে আপুর কাছে চলে গেলাম। আপুর সাথে নানান রকম গল্প করলাম। রুমি আপু নানান রকম দুষ্টমি করছে আপুর সাথে। আকাশ ভাইয়া সেখানে আসতেই সকলের দুষ্টমি বন্ধ হয়ে গেলো।

আকাশ:- কি নিয়ে আলোচনা হচ্ছিলো আপনাদের?

রুমি:- সব কি আপনাকে বলতে হবে নাকি? আমাদের বান্ধবির সাথে কত রকম কথা হতে পারে তা আপনার শুনতে হবে কেন?

আকাশ:- বুঝছি আপুরা জিজ্ঞাসা করে খুব অন্যায় করে ফেলছি এখন মাফ করেন আমি যাচ্ছি আর আপনারাও তাড়াতাড়ি যেয়ে খেয়ে নিন।

— আকাশ ভাইয়া রুম থেকে বের হতেই আবার সকলের হাসির আওয়াজে সে রুম ফেটে যাবার উপক্রম হলো।

রুমি:- তুইতো খুব ভাগ্যবতীরে আফরিন এমন বোকা বর পাইছিস, তবে হ্যান্ডসাম বলতেই হবে। আমাদের ভাগ্যে যে কি আছে আল্লাহ জানে।

আফরিন:- তোদের ও ভালোই হবে যা এবার লাঞ্চ করে নে সকলে এক সাথে যেয়ে।

— তুমি যাবে না খেতে আপু?

আফরিন:- পরে যাচ্ছি তোর ভাইয়া আসুক এক সাথে যাবো।

রুমি:- বুঝছি বুঝছি খুব শিগ্রই ডজন খানিক বাচ্চা কাচ্চার জননী হও দোয়া করে দিচ্ছি।

— সকলে হাসতে হাসতে রুম থেকে বের হতেই দেখতে পেলাম সোহান নীলার সাথে কথা বলছে। মেজাজটা গরম হয়ে গেলো। নিজেকে যতটুকু সম্ভব সংযত রেখে সেখান থেকে হাঁটা শুরু করলাম। নিজেকেই নিজে বলতে শুরু করলাম একজন মানুষ আরেক জন মানুষের সাথে কথা বলতেই পারে। আমিও তো কথা বলি। ভাবতে ভাবতেই এগিয়ে চললাম লাঞ্চের জন্য। সকলের সাথে খেতে বসতেই সোহানও চলে আসলো আমার সামনা সামনি বসেই কিরে ফুলটুসি খেতে পারছিস না? দেখ কিভাবে খেতে হয়। বলেই খাওয়া শুরু করলো এমন ভাবে খাচ্ছে দেখে মনে হচ্ছে কতদিন না খেয়ে আছে, মনে মনে প্রচণ্ড রকম হাসছি আর সোহানের খাওয়া দেখছি। খাবার টেবিলেই আরমান এসে সবাই কে সালাম দিয়ে আমাদের পাশে বসলো। এবার সোহানের রিয়াক্ট দেখার জন্য আমি ওর দিকে তাকালাম। সোহানের কোন রকম রিয়াক্ট দেখতে পেলাম না ও সেই আগের মতই খেয়ে যাচ্ছে। সোহান আমার দিকে আড় চোখে তাকাচ্ছে আর কথা বলে চলছে।
খাওয়া শেষ হতে সকলে টেবিল থেকে উঠে পরলাম।

আরমান:- সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললো চলুন না আমাদের বাড়ি থেকে ঘুরে আসবেন।

সোহান:- হ্যাঁ ঘুরে দেখা যায়,

— বলেই আমার দিকে তাকালো, যাও তোমরা ঘুরলে ঘুরে আসতে পারো আমি আপুর রুমে যাচ্ছি, যেয়ে দেখি আপু রেডি হলো কিনা।

আরমান:- আরে আসুন না দু মিনিট লাগবে আমাদের বাসায় যেতে।

— সবাই যাচ্ছে যাক অন্য আরেকদিন যাওয়া যাবে। বলেই আপুর রুমের দিকে হাঁটা শুরু করলাম। আরমান সবাইকে নিয়ে ওদের বাড়ির দিকে রওনা হলো। আপুর রুমে যেয়ে নক করতেই আপু ভিতরে ঢুকতে বললো। ভিতরে ঢুকে আপুকে বললাম খেয়েছো কিনা?

আফরিন:- হ্যাঁ তোর ভাইয়া খাবার রুমে নিয়ে আসছিলো দু’জনে এক সাথেই খেলাম।

— বাহ বাহ এতো ভালোবাসা জমে গেছে দু’জনের মাঝে এই একদিনে।

আফরিন:- হুম অনেক অনেক ভালোবাসা।

— আচ্ছা কি কি নিবে নিয়ে রেডি হও। সবাই আসলেই আমরা রওনা হবো, তা না হলে অনেক রাত হয়ে যাবে।

আফরিন:- আচ্ছা গুছিয়ে নিচ্ছি, তুই ও আমাকে সাহায্য কর।

— দু’জনে মিলে আপুর আর আকাশ ভাইয়ার জামা কাপড় গুছিয়ে নিলাম একটা ব্যাগের ভিতর। প্রায় ত্রিশ মিনিট পর সকলে আরমানদের বাড়ি থেকে ঘুরে আসলো। সবাই আসার কিছুক্ষণ পরেই আমরা রওনা হলাম ফুপুদের বাড়ির উদ্দেশ্যে। রাত আটটার দিকে ফিরে আসলাম এ বাড়িতে। রাতের খাবার শেষ করে সকলে গল্প করতে শুরু করলাম। আপুর সব বান্ধবীরাও এসেছে, দারুণ সময় কেটে যাচ্ছে গল্পে গল্পে। নানান রকম গল্প হচ্ছে ছোট বেলার গল্প প্রেমের গল্প। গল্প করতে করতে অনেক রাত হয়ে গেলো।
হঠাৎ করেই আপু বলে উঠলো তোর ভাইয়া খুব সুন্দর গান গাইতে পারে।

সোহান:- তাই নাকি তাহলেতো গান শুনতেই হবে। বলো বলো সকলে আজ তোমার গান শুনি।

আকাশ:- না ভাইয়া আজ না প্লীজ অনেক রাত হয়ে গেছে।

— ভাইয়া প্লীজ প্লীজ শুনান না একটা গান, সকলের অনুরোধে আকাশ ভাইয়া গান শুরু করলো। সকলে মুগ্ধ হয়ে গান শুনছি। এতো সুন্দর কণ্ঠ মুহুর্তেই সকলে মুগ্ধ শ্রোতা হয়ে গেলাম। গান শেষ হতেই সকলে তালি দিয়ে বলে উঠলাম বাহ বাহ।

সোহান:- ভাই আমাকেও একটু শিখিয়ে দিওতো গান গাওয়াটা। যদি প্রেমিকাকে গান শুনিয়ে মন জয় করতে পারি।

আকাশ:- ভাইয়া কি যে বলেন না। আপনি অনেক স্মার্ট আর এতো সুন্দর করে কথা বলেন যে সব মেয়েরা ফিদা হয়ে যাবে মুহুর্তেই।

— ঠিক বলছেন ভাইয়া আমিও তাই বলে যে কোন মেয়েরা ফিদা হয়ে যায় মুহুর্তেই। যেখানে যায় সেখানেই মেয়েরা ঘিরে ধরে। এই যে আজ আপনাদের বাড়িতেও দেখলাম, মেয়েরা এমন ভাবে ঘিরে ধরেছিলো যে আমাদের সময় দিতেই পারছিলো না। এমন কি আপনাদের রুমেও গেলো না একটি বারের জন্যও।

সোহান:- দেখ এমন সব মিথ্যা কথা বলবি না খবরদার। কোন মেয়েরাই আমাকে ঘিরে ধরেনি।

— মিথ্যা বইলো না, আমার চোখ এড়াতে পারবে না।

সোহান:- তোর চোখে সমস্যা হয়েছে বুঝতে পারছি ঢাকায় নিয়ে যেয়ে ডাক্তার দেখাতে হবে।

— কথা বলতে বলতে ফুপা এসে বললো অনেক রাত হয়েছে সকলে ঘুমিয়ে পরো যার যার রুমে যেয়ে। আকাশ ভাইয়া আর আপু নিজেদের রুমে চলে গেলো। আমিও হাঁটা শুরু করলাম আম্মুর সাথে ঘুমাতে তার রুমের দিকে। হঠাৎ পেছন থেকে সোহান ডাক দিয়ে বললো তোর সাথে আমার কিছু কথা আছে। চল পুকুর ঘাটে যাই। আমি মাথা নেড়ে বললাম না যাবো না তোমার সাথে আমার কোন কথা নেই।

সোহান:- বিশ্বাস কর আমার সাথে জোড় করে নীলা কথা বলছে।

— তাতে আমার কি আমি তোমাকে কিছু বলিনি। কিংবা তার জন্য তোমাকে কোন প্রশ্নও করিনি।

সোহান:- কিন্তু তুই রাগ করেছিসতো।

— আমি রাগ করবো কেন? আমার রাগ করার কোন অধিকারই নেই বলেই হাঁটা শুরু করতে সোহান পেছন থেকে শাড়ির আঁচল ধরে টান দিলো।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here