#হৃদয়_পথে_এ_কার_ছায়া (পর্ব ৩)
নুসরাত জাহান লিজা
“এই দুনিয়ায় কি আর কোনো পাত্রী নাই নাকি! সবাই কি বিয়ে করে ফেলসে না মরে গেসে? বিবাহবয়স্কা কেউ নাই জগতে?”
মায়ের দিক থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে মিফতা আবারও বলল, “তুমি আর বাবা এই মেয়ের সাথে বিয়ে দেয়ার জন্য উষ্টা খায়ে পড়সো ক্যান বুঝলাম না।”
মালা মিফতার ঘর গুছিয়ে দিতে এসেছেন, ছেলের কথায় তেমন গা করলেন না। বিছানা একেবারে এলোমেলো, চাদর কুঁচকে আছে, একপাশ মেঝে স্পর্শ করেছে, আরেকপাশ প্রায় খাটের উপরেই। টেবিলে ল্যাপটপ খোলা, তাতেই মিফতা একটা মুভি দেখছিল। টেবিলে কিছু কাগজ কলম ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। চায়ের কাপটা হাতের ধাক্কা লাগলেই টপাক করে পড়ে যাবে, সেদিকে ছেলের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।
“ঘরটা একটু গোছায়ে রাখতে পারিস না? এত এলোমেলো, গরুর গোয়ালঘরও পরিষ্কার থাকত যদি গরুরা নিজে গুছাইতে পারত। তুই তার চেয়েও অধম।”
ঘাড় ঘুরিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে মিফতা বলল, “মা, আমি ঘর গুছাইলেও মানুষ, না গুছাইলেও তাই থাকব। সবার কেন পারফেকশনিস্ট হতে হবে? আমি নাহয় এলেবেলেই থাকলাম। যার পোষায় সে সঙ্গ দেবে, যার পোষাবে না সে টাটা বাই বাই বলে সুড়ুৎ।”
মালা চাদরটা তুলে টানটান করে বিছিয়ে দিতে দিতে বললেন, “তোর এসব ভুংভাং দেখি কদ্দিন চলে! আমি আর তোর ঘরে উঁকি দেব না। দেখি এই ঘরে কয়দিন টিকতে পারিস।”
“সবকিছুতে ব্ল্যাকমেইল করো কেন? আমি সোজা সরল তাই?”
“তোরে আমি পেটে রাখসি, জন্ম দিসি। এত বড় করসি। তোর ওষুধ আমি জানি।”
“ভালো, এই দেখো, মেডিকেলে না পড়েও তুমি ডাক্তার হয়ে গেছ। কার জন্য? আমার জন্য। এই যে প্রেসক্রিপশন দিলা, ফি নিবা না?”
“নিবো, এই বিয়েতে মত দে, এইটাই আমার ফি।”
“মা, তুমি তো ভর সন্ধ্যায় ডাকাতি করতে চাইতেসো। প্রেসক্রিপশন দিলা দুই টাকার, আর ফি হিসেবে চাইতেসো আমার স্বাধীনতা। টোটালি ইনজাস্টিস আমার সাথে।”
“ঢং বন্ধ কর। তোর এইসব আজাইরা ঢং দেখার মতো টাইম আমার নাই। আর রেস্টুরেন্ট, লন্ড্রি সব ঠিকঠাক করে রাখিস, মত না হইলে।”
“ও মা,..” ছেলের পিছুডাকে তিনি আর সাড়া দিলেন না মালা, বেরিয়ে চলে গেলেন দ্রুতপায়ে।
মিফতা কিছুক্ষণ অসহায়ের মতো বসে রইল। এরপর গুগলে সার্চ করল বিয়ে ভাঙা রিলেটেড কোনো মুভি আছে কিনা। কলা কৌশল রপ্ত করতে হবে কী করে এই ফাঁড়া কাটানো যায়।
***
নওমী আর মিফতা আজ আবার এসেছে রেস্টুরেন্টে। এবার নিজেরা যোগাযোগ করে, পরিবারকে না জানিয়ে এসেছে। মিফতা অফিস থেকে এসেছে। বুদ্ধি করে নওমীকে কল করেছে। প্রথমে দেমাগের চোটে কথা-ই বলতে চায়নি। পরে বিয়ে ভাঙার কথা বলতেই সুড়সুড় করে রাজি হয়েছে।
নওমী বান্ধবীর বাসায় যাবার কথা বলে বেরিয়েছে। কী মনে করে বেরোবার আগে সে খানিকটা সাজগোজ করেছে।
মিফতা আজও সতেরো মিনিট দেরিতে এসেছে। ঘেমে-নেয়ে একাকার। জ্যামে আটকে ছিল প্রায় পঁচিশ মিনিট। নওমী কল করে বলেছে,
“আমি আর পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করব, এরমধ্যে না এলে চলে যাব।”
মিফতার জন্য এই মিটিং ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ, মেয়েটা ঘাড়ত্যাড়া, যা বলে তাই করে। মুখে লাগাম নেই। শিষ্টাচার জানে না, যদি সত্যিই চলে যায়! এই ভয়ে বাকি রাস্তা সিএনজি থেকে নেমে প্রায় দৌড়ে এসেছে। রীতিমতো হাঁপাচ্ছিল।
স্বাভাবিক দুই চারটা কথা শেষে একটু ধাতস্থ হয়ে মিফতা সবে বোতলের ছিপি খুলে এক ঢোক পানি গলায় ঢেলেছে, তখনই নওমীকে বলতে শুনল,
“আপনি এত বড় দামড়া হইসেন কী খালি হাত দিয়ে নাক খোঁটার জন্য? একটা গার্লফ্রেন্ড বানাইতে পারেন নাই?”
“আমার গার্লফ্রেন্ড নাই এতে আপনার প্রবলেম কই বুঝলাম না। এত অফেন্সিভ কথাবার্তা বলছেন কেন?” রীতিমতো গায়ে লেগেছে কথাটা।
“খুশিতে খুশিতে এসব বলি। অনেক সুখ তো আমার তাই। বোঝেন না, কেন বলি?”
“না, সব জ্ঞান তো আপনার মাথায়। আমার মাথায় তো বুদ্ধির ব নেই। আপনার ভাষ্যমতে। তাহলে আপনিই বলেন দেখি।”
নওমী অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে শীতল গলায় বলল, “সেটা তো ধ্রুব সত্য কথাই। আপনি যদি জীবনে একটা প্রেম করতেন, তাইলে আপনার গার্লফ্রেন্ড থাকত। গার্লফ্রেন্ড থাকলে তার সাথে আপনার বিয়ে হতো। আমাকে এই গ্যাঁড়াকলে ফাঁসতে হতো না।”
“ও এই কেস। সেটা আমিও আপনাকে বলতে পারি। সারাজীবন জ্ঞান না জমিয়ে সেই জ্ঞান কাজে লাগিয়ে একটা প্রেম করলে আমাকে এর মধ্যে ফাঁসতে হতো না। আপনাকেও সাপের মতো ফোঁস করে ফণা তোলে ঘুরতে হতো না। তার গলায় ঝুলে পড়তেন, আমি থাকতাম আমার রাস্তায়। জীবনে একটা ভদ্রশিষ্ট মেয়ে পেয়েই যেতাম। এখন জুটতেসে সাপিনী। নিজেকে সাপের ওঝা হয়ে সারাজীবন ঘুরতে হবে। আমার জীবনে এমন ট্র্যাজিডি ঘটতে যাইতেসে আপনার একটা বয়ফ্রেন্ড থুড়ি ওঝা না থাকার কারণে।”
নওমী অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে পুরো কথা শুনল ধৈর্য ধরে। এরপর দাঁতে দাঁত চেপে ধীর গলায় বলল,
“সাপিনী, তাই না? ওদের বিষদাঁত থাকে জানেন নিশ্চয়ই। ছোবল খেয়ে মরতে না চাইলে আল্লাহর ওয়াস্তে আপনার রেডিওটা বন্ধ করেন।”
………..
(ক্রমশ)
এই দুই ঝগড়ুটে নিয়ে কী করা যায় বলেন তো?
ছবি কৃতজ্ঞতাঃ প্রিয়া রহমান আপু