#হৃদয়_পথে_এ_কার_ছায়া (পর্ব ৪)
নুসরাত জাহান লিজা
“সাপের ওঝারা তাদের কাজে হাইলি স্কিলড হয়। আপনার দ্বারা সেই কর্ম সম্ভব নয়।”
“আমি হতেও চাইনি। না হতে পারলে বেঁচে যাই।”
“আমি মনে হয় মরে যাচ্ছি আপনাকে বিয়ে করার জন্য? বাই দ্যা ওয়ে, আমরা এখানে এসেছি বিয়ে ভাঙার প্ল্যান করতে। আপনার জন্য এখনো আলোচনাই শুরু করতে পারলাম না।” প্রায় খেঁকিয়ে উঠল নওমী।
“আমার জন্য মানে? আপনি আগে আমারে দামড়া বলসেন। এত বুদ্ধি মাথায় জমে আছে বলেই মেমোরি সেল ড্যামেজ হয়ে গেসে আপনার।”
“আপনার তো ফুল মগজটাই ড্যামেজ। এখন ওই গোবরে পদ্মফুল আই মিন, ড্যামেজ মগজ থেকে ঝটপট একটা ঝাকানাকা আইডিয়া বের করেন তো, যেটা দিয়ে আমাদের বিয়ে ভেস্তে দেয়া যায়।” কথা শেষ করে স্যুপ মুখে তুলল নওমী।
“আমারটা নাহয় ড্যামেজ মগজ, আপনারটা তো সুপার ইন্টেলিজেন্ট মগজ থেকে একটা সুপার ইফেক্টিভ আইডিয়া বের করতে পারেন নাই কেন? নাকি আপনার মগজে পোকা ধরেছে?”
“আমি আপনার মতো নোংরা নই, ইয়াক!”
“ইয়াক মানে? আর কোন দিক থেকে আমাকে নোংরা মনে হইসে?”
“সব দিক থেকেই। আর ইয়াক হলো অশ্ব ডিম্ব আ…”
কিছুক্ষণের জন্য তাদের কথোপকথনে ভাটা পড়ল, কারণ নওমী ওর ভাই নীরবকে রেস্টুরেন্টে ঢুকতে দেখল। ছানাবড়া চোখে সেদিকে তাকিয়ে মেনু কার্ড দিয়ে নিজেকে আড়াল করল সে।
মিফতা প্রথমে স্বাভাবিক মনে করলেও নওমীকে মেনু কার্ড আলতো নামিয়ে চোখ বের করে সামনে দেখে আবার মুখ ঢেকে ফেলায় সন্দেহ হয়। সে প্রশ্ন করে,
“কী সমস্যা আপনার? কী হইসে?”
“এত কথা কেন বলেন আপনি, একটু চুপচাপ বসে থাকুন না। আর নয়তো অন্য টেবিলে গিয়ে বসুন।” নিজের মুখ একপাশে ঢেকে অন্যপাশ অনাবৃত করে মিফতার দিকে চোখের ইশারায় সাথে মুখেও ফিসফিস করে বলল নওমী।
মিফতা আশেপাশে তাকিয়ে নীরবকে দেখে হেসে বলল, “বাব্বাহ, আপনিও তাহলে ভয় পান?”
“ভয় পেতে যাব কোন দুঃখে। তবে ভাইয়া সবসময় সবকিছুতে আমার পেছনে লেগে থাকে, আমিও যেমন লাগতাম। আপনার সাথে আজ আমাকে এখানে দেখে ফেললে সারাজীবনের হাতিয়ার জোগাড় হয়ে যাবে আমাকে জ্বালানোর।”
“এটা তো তাহলে হাতছাড়া করাই উচিত না আমার। উনি আমার ডিপার্টমেন্টের বড় ভাই। আবার তার বোনের সাথে বিয়ের কথা চলতেসে। একটা সাক্ষাৎকার তো নিতেই হয়।”
নওমী দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “আপনি চাইলে খাল কেটে কুমির আনতেই পারেন। ও যদি আজ একবার আমাদের একসাথে দেখে, আমারা সুপার গ্লু দিয়ে এঁটে যাব আজীবন মেয়াদ সমেত। এমনভাবে আটকে যাব, নো ছাড়াছাড়ি। এটা চান বুঝি?”
মিফতা এবার নিজের গরজে ক্যাপটা মাথায় পরে মুখ উল্টো দিকে ঘুরিয়ে নিল। কী সাংঘাতিক ব্যাপার! এরা ভাই-বোন দুটোই ডাকাত নাকি বংশটাই ডাকাতের বংশ!
একটু পরে উঁকি দিয়ে দেখল নীরব যেখানে বসেছে, সেখান থেকে ঘাড় না ঘুরালে ওদের দেখা যাবে না। এই সুযোগে উঠে কোনোমতে বিল মিটিয়ে বেরিয়ে এলো দুজনে। বিল দেয়া নিয়ে এক দফা ঝামেলা দুটোতে হতো, কিন্তু নীরবের উপস্থিতিতে বাঁচোয়া। বাইরে এসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল দু’জনেই।
স্বস্তিটা অবশ্য নওমীর জন্য দীর্ঘস্থায়ী হলো না দুটো কারণে।
প্রথম কারণটা হলো, নওমী এত দ্রুত বাড়ি ফিরতে পারবে না। এতক্ষণ একা একা কী করবে সেটা নিয়েই ভাবছিল। পরে তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত নিল মিফতাকে কিছুক্ষণ সাথে রেখে দেবে। কিন্তু ব্যাটা রাজি হচ্ছিল না। পরে গাইগুই করে বলল,
“যদি বলেন, এখন বাসায় গেলে কী সমস্যা তাহলে থাকতে পারি।”
“আরে, আমি বেরিয়েছি ইরার বাসায় যাবার কথা বলে। ইরার বাসায় গেলে সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকা হয়। এখনই বাসায় ফিরলে মা সন্দেহ করতে পারে।”
“তাহলে এখন যান ইরার বাসায়।”
“ইরা বাসায় নাই। ওর খালার বাড়ি গেছে। এটাই সমস্যা।”
“এতে সন্দেহ করার কী আছে? সবসময় যে টাইম ডিউরেশন কাঁটায় কাঁটায় মিলিয়ে বান্ধবীর বাসায় থাকতে হবে এর তো কোনো মানে নেই। আপনি বেশি ভাবতেসেন।”
নওমী হাঁটতে হাঁটতে বলল, “জানেন না, চোরের মনে সারাক্ষণ ধরা পড়ার ভয় থাকে।”
“ধ্রুব সত্য। চোরের মন পুলিশ পুলিশ।” দাঁত দুই পাটি বের করে হেসে বলল মিফতা।
“খোঁচা দিয়ে লাভ নাই। এটাকে সাবধানতা বলে।”
“যাই বলুক, এর সাথে আমার এখানে থাকার সম্পর্ক কোথায়?”
“আপনার সাথে দেখা করতে এসে ঝামেলায় ফেঁসেছি। তাই আপনি আরও কিছুক্ষণ আমার সাথে সাথে থাকবেন। এরপর যার যার রাস্তায় সে সে। মনে আছে, মাথায় প্ল্যান এলে কী করতে হবে?”
“আপনার সাথে শেয়ার করে সেই প্ল্যান এক্সিকিউশনের চেষ্টা করতে হবে। আপনার মাথায় আগে এলেও কিন্তু তাই।”
“হ্যাঁ, মিশন বিবাহ ভাঙা যেভাবেই হোক সফল করতেই হবে।”
নওমী কথাটা শেষ করতে পারল না, সাথে সাথে ওর বাম পায়ের স্যান্ডেল ছিঁড়ে গেল। এটা ওর বিরক্তির দ্বিতীয় কারণ। মিশন সফল করার প্রতিজ্ঞাকে ভালোই স্বাগত জানিয়েছে স্যান্ডেল।
পার্ক সংলগ্ন ফুটপাত ধরে দুজনে হাঁটছিল। তখনই এই অঘটনটা ঘটল। খালি পায়ে হাঁটা সম্ভব নয় একা একা। আশেপাশে লোক সমাগম বেশ। কারণ অফিস ফেরত লোকজনের আনাগোনা বাড়ছে। ঘরে ফেরার বা জরুরি অন্য কাজে যাবার তাড়া তাদের মধ্যে।
এরমধ্যে একটা মেয়ে খালি পায়ে স্যান্ডেল হাতে নিয়ে হাঁটছে, বিষয়টা লোকের কাছে দৃষ্টিকটু লাগতে পারে। হয়তো কেউ ভাবল না, কিন্তু নিজের কাছে ঠিকই খারাপ লাগবে।
সে দুটো স্যান্ডেলই খুলে বাম হাতে তুলে নিল, এরপর মিফতার দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনিও স্যান্ডেল হাতে নিয়ে হাঁটুন।”
“আপনার স্যান্ডেল ছিঁড়সে, আমারটা তো না। আমি খামাখা কেন জুতা হাতে নিয়ে হাঁটতে যাব।”
“একটা মেয়ের সাথে রাস্তায় হাঁটছেন। মেয়েটা খালি পায়ে স্যান্ডেল হাতে করে হাঁটছে। আপনার লজ্জা লাগছে না?”
“আশ্চর্য, এতে লজ্জা লাগার কী আছে?”
“লজ্জা লাগবে না? মানবিকতা নামের একটা বস্তু আছে। সেটা গুলে ক্যাপসুল বানিয়ে খাবেন তিন বেলা ভাত খাবার আগে।”
“আপনি স্যান্ডেল ফেলে দিন। তাহলে আর হাতে করে হাঁটতে হবে না।”
“এটা আমি এক সপ্তাহ আগে কিনেছি মাত্র, এগারো শো টাকা দিয়ে। সেটা এগারো দিনও পরব না? ফেলে দেব?”
“তাহলে আপনি যা খুশি করুন, আমাকে এর মধ্যে টানছেন কেন?”
নওমী এবার হাঁটার গতি শ্লথ করে বলল, “একটা ছেলে আর একটা মেয়ে যখন রাস্তায় হাঁটবে, তখন ওই ছেলের উচিত মেয়েটাকে সমস্ত প্রিভিলেজ দেয়া। এটা মেয়েদের জন্মসূত্রে পাওয়া মৌলিক অধিকার। জানেন না আপনি? এটা না জেনেই বিয়ের জন্য পাত্রী খুঁজতে চলে এসেছেন? আপনার তো বিয়ের বয়সই হয়নি দেখতেসি।”
“আপনি কি মৌলিক অধিকার নিজে সংবিধানে যোগ করেছেন নাকি?”
“এটা অলিখিত মৌলিক অধিকার। কিন্তু ভীষণ ভীষণ এসেনশিয়াল। থাকা, খাওয়া, পরার মতোই এসেনশিয়াল।”
“আগে লিখিত সংবিধানে আসুক, তারপর মানা যাবে। আমার বুদ্ধি কম তো, ক বললে ক-ই বুঝি, কমলা না-কি কচুরিপানা সেটা খুঁজি না।”
নওমী আচমকা হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল। এই ছেলেকে কেন যে সাথে রাখতে গেল। চলে যেত তার মতো। রাগ হয়েছে ওর।
পেছন থেকে মিফতার হঠাৎ কী মনে হলো সে জানে না, একটা সুন্দরী মেয়ে সেজেগুজে স্যান্ডেল হাতে হাঁটছে, বিষয়টা ওর কাছে অমানবিক মনে হলো। মেয়েটাকে সঙ্গ দিতে ইচ্ছে হলো। সে কী মনে করে নিজের পায়ের স্যান্ডেল খুলে হাতে নিল। এরপর দ্রুতপায়ে নওমীর পাশাপাশি এসে বলল,
“মৌলিক অধিকার তো মানুষের নাগরিক অধিকার। সেটা হরণ করা ঠিক নয়। একবার অন্তত প্রিভিলেজ পেলেনই না-হয়।”
এই পর্যন্ত বলে মনে হলো কী বলছে এসব। এই মেয়ের সাথে ওমন মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে লাভ কী! তাই তাৎক্ষণিকভাবে সাথে যুক্ত করল,
“বলা তো যায় না, মৌলিক অধিকার না পেয়ে রাস্তায় রাস্তায় বাটি হাতে ঘুরতে হয় কি-না।”
নওমী ওর দিকে ঘুরে কঠিন চোখে তাকাল।
………
ক্রমশ
‘অতঃপর তাহারা’ আর ‘বৃষ্টিদিনের আগন্তুক’ পড়েছেন তো? পড়ার আমন্ত্রণ রইল।