#হৃদয়_পথে_এ_কার_ছায়া (পর্ব ৭)
নুসরাত জাহান লিজা
গত দু’দিন ধরে মিফতা প্রবল জ্বরে নাকাল হয়ে বিছানায় পড়ে আছে। মালার যাবার কথা ছিল ভাইয়ের বাসায়, তিনি কী যেন স্বপ্ন দেখেছেন। তাই সব ভাইবোনকে ডেকেছেন। কিন্তু মিফতাকে এভাবে রেখে মালা যেতে পারলেন না।
তার ছেলেটা ভারি মুখরা ধরনের হয়েছে। যতটুকু বোঝে, বলে তার দ্বিগুণ। কাজের বেলায় অবশ্য খানিকটা অকর্মণ্য ধরনের। ঠিক অকর্মণ্য অবশ্য বলা যায় না, কারণ মন দিয়ে করলে সে ঠিকঠাক মোটামুটি অনেককিছুই পারে, কিন্তু বড্ড অলস। এই অলসতাই ওর শত্রু।
আগে যখন পড়তে বসত, বড়জোর এক ঘণ্টা টেবিলে থাকত। এরপর ঘ্যানঘ্যান করেও বসানো সম্ভব হতো না। তবে পরীক্ষা যখন দরজায় কড়া নাড়ত, তখন আটঘাট বেঁধে মরিয়া হয়ে পড়ত। রেজাল্ট চোখ ধাঁধানো না হলেও কখনো খারাপ হয়নি। তাই তারা তেমন চাপ দেননি।
মিফতার আগে তার একটা সন্তান হয়েছিল। সেই শিশুকে তিনি জন্মের আঠারো দিনের মাথায় হারিয়ে ফেলেছিলেন। তারপর প্রায় দুই বছর কেটে যাবার পরে মিফতা পেটে আসে। কত চোখের জলের বিনিময়ে তিনি নতুন করে মাতৃত্বের স্বাদ পেয়েছিলেন। সেই থেকে তিনি ছেলের প্রতি প্রায় অন্ধই বলা যায়।
জামিল খানিকটা কঠিন হবার চেষ্টা করলেও তিনি মিফতার মাথায় তার স্নেহের আঁচল বিছিয়ে ছায়া দিয়ে এসেছেন চিরকাল। প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয়ও দিয়েছেন। ছেলের সব কাজ নিজের হাতে করতে পছন্দ করতেন। ছেলের স্কুলের ইউনিফর্ম থেকে শুরু করে ব্যাগ গুছিয়ে দেয়া, মুখে তুলে খাইয়ে দেয়া, ঘর গুছিয়ে দেয়া, কাপড় ধুয়ে দেয়া সব তিনি নিজে করতেন। শুধুমাত্র গোসলের পরে নিজের কাপড়টা নিজে ধোয়া হয়।
এভাবে বড় হতে হতে একসময় অভ্যস্ততা এমন বেড়ে যায় যে কিছুই আর নিজে করতে পারে না কিংবা করতে চায় না। এই ছোটখাটো কিছু বদ অভ্যাস বাদ দিলে এমন ছেলে কয়টা হয় ভেবে ভেতরে ভেতরে তার বুকটা চওড়া হয় গর্বে।
মিফতা বড়দের সাথে কখনো বেয়াদবি করেনি, বন্ধুদের সাথে ভীষণ প্রাণোচ্ছল, পরিবার অন্তঃপ্রাণ, বাজে সঙ্গ নেই, ধূমপানের অভ্যাস নেই। অলসতায় অগোছালো স্বভাব আর বেশ খানিকটা হামবড়া ভাব এই তো। একদিন ঠিক কেটে যাবে।
তিনি মনে প্রাণে চান নওমীর সাথেই মিফতার বিয়েটা হোক। মেয়েটার সাথে কথা বলে মালার মনে হয়েছে, ওর ভেতর বাইরে এক রকম। কপটতা নেই। তবে দুটোই খানিকটা রগচটা। তবে তিনি যেন মনে মনে জানেন এরা রাজযোটক।
একটু খুঁনসুটি না হলে আবার সংসার হলো না-কি! তার আর জামিলের মধ্যেও তো প্রায়ই খটমট লাগে। তাতে তো তাদের মধ্যে দূরত্ব আসে না, বরং মনে হয় নতুন করে ভালোবাসা প্রগাঢ় হয়।
মিফতার মাথায় পানি ঢালতে ঢালতে ছেলেকে নিয়ে আদ্যোপান্ত ভেবে চলেছেন মালা। হঠাৎ জ্বর বাঁধানোয় তার ভালো লাগছে না৷ ওদিকে ছেলে মুখে কুলুপ এঁটেছে। আজ জ্বর একটু নেমেছে, এই স্বস্তি।
***
নওমী দু’দিন আগে শেষবার মিফতার সাথে কথা বলেছে। আর কথা হয়নি। মাথায় একটা জবরদস্ত পরিকল্পনা এসেছে। অনিচ্ছা সত্বেও ওই ঝগড়াটে স্কন্ধকাটা ভূতের সাথে শেয়ার করতে হবে। কারণ এই প্ল্যান একা একা এক্সিকিউট করা সম্ভব নয়।
শতভাগ গ্যারান্টি যুক্ত আইডিয়া। তবে একটা রিস্ক ফ্যাক্টর আছে। ওই ব্যাটাকে সে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছে না। এতটা সুবোধ বালক মিফতা নয়।
কিন্তু কল কেন ধরছে না! নওমীর বরাবরই ধৈর্য একটু কম। কোনোকিছু মাথায় এলেই হলো, তা বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত স্বস্তি পায় না। তৃতীয়বারের চেষ্টায় সফল হলো।
“ফোন ধরছেন না কেন? জরুরি কথা আছে।”
এরপরও ওপাশ থেকে সাড়া না পেয়ে সে বলল,
“হ্যালো..”
“তুমি নওমী না?”
সর্বনাশ, ওই ব্যাটা তার মা’কে দিয়ে কল ধরিয়েছে। একবার ভাবল কল কেটে দেবে কি-না। কিন্তু সেটা ঠিক হবে না। উনি চিনে ফেলেছেন। এখন কথা না বলে কেটে দিলে বিশ্রী একটা ব্যাপার হবে।
“জ্বি আন্টি। আসলে… ”
“মিফতার সাথে কথা বলতে চাও তো? ওর ভীষণ জ্বর। ঘুমিয়ে আছে।”
“ও, ঠিক আছে আন্টি।”
“কলার আইডি দেখে কিন্তু আমি ভিরমি খেয়েছি। আমি ভাবতেসি, ভূত প্রেতের সাথে আবার মিফতার বন্ধুত্ব হলো কবে। তাও যে সে ভূত না, স্বয়ং মহারানী এলিজাবেথের ভূত।” কথা শেষ করে হেসে ফেললেন মালা।
নওমীর মনে মিফতার জ্বর শুনে যেটুকু সহানুভূতি তৈরি হয়েছিল, নিমিষেই তা ভেসে গেল প্রবল স্রোতে।
মনে মনে বলল, “মিফতার যদি কোফতা না বানাই তো আমার নাম নওমী না।”
নওমী সরল মনে নম্বর সেভ করেছিল ‘মিফতা’ নামেই। কিন্তু এবার সে কন্টাক্ট লিস্টে গিয়ে এডিট করে নামটা কেটে লিখল, ‘স্কন্ধকাটা ভূত’।
পরক্ষণেই মনে হলো, এটা হবে না। ওই ব্যাটার আইডিয়ার সাথে মিললে হবে না, সাথে ভূতে ভূতে সমগোত্রীয়।
সে ভাবতে লাগল এমন একটা নাম, যা দিয়ে প্রতিশোধ পূরণ হয়। ভাবতে ভাবতে পেয়েও গেল। নতুন করে নামটা সেভ করে পৈশাচিক আনন্দ পেল।
এরপর সহসা মনে হলো, মিফতার শরীর কতটা খারাপ জিজ্ঞেস করা দরকার ছিল। আবার কল করবে! নাহ্, থাক। কী ভাববেন আন্টি!
……..
(ক্রমশ)
মিফতার নামটা কী দিয়ে সেভ করতে পারে নওমী?
(পর্ব ছোট হচ্ছে বলে আন্তরিকভাবে দুঃখিত। গরম আর লোডশেডিং মিলিয়ে অবস্থা খুব খারাপ।)
দাবদাহ কমে যাক এই দোয়া করি সকলেই। জনজীবনে স্বস্তি ফিরুক। আমীন।