হৃদয়_পথে_এ_কার_ছায়া (পর্ব ৮)

0
346

#হৃদয়_পথে_এ_কার_ছায়া (পর্ব ৮)
নুসরাত জাহান লিজা

মিফতার জ্বর পুরোপুরি সারতে আরও দু’দিন লাগল। আজ পাঁচদিন পরে অফিসে এসেছে। বাবা-মা ফেসবুকে ওদের ভাইরাল হওয়া ছবিটা নিয়ে জানতে পেরেছেন। তার উপর নাকি নওমী একদিন কল করেছিল, তাতেই তারা নিজেদের উদ্দেশ্য সফল ভেবে বসে আছেন। ভাবছেন, ওরা দু’জন বোধহয় নিজেদের আরও ভালোভাবে জানার জন্য সময় নিচ্ছে।

সকালে বাবা এটা নিয়ে জিজ্ঞেস করায় মিফতা উত্তর দিয়েছে, “হ্যাঁ, বাবা, আমরা একটু নিজেদের চিনতে, বুঝতে চেষ্টা করতেসি।”

লাঞ্চ আওয়ারে নওমীর নম্বরে কল করে মনে মনে হেসে কুটিকুটি হলো মিফতা।

“কী ব্যাপার, আপনি নাকি আমার খোঁজ করেছিলেন?”

“হ্যাঁ। আপনার শরীর এখন কেমন?”

“বাব্বাহ্! বিয়ের আগেই এত দরদ?”

“ফালতু কথা না বললে আপনার পেটের খাবার হজম হয় না?”

“খাবার হজম ঠিকই হয়। কিন্তু আপনার এই দরদ হজম করাই কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। একেবারে অপাচ্য মনে হচ্ছে।” নওমীর সাথে কথার লড়াই চালিয়ে যেতে কেন যেন মিফতা ভীষণ উপভোগ করে। কথার যোগ্য পাল্টা উত্তর না পেলে কথা বলে মজা পাওয়া যায় নাকি!

“তাহলে বরং কিছু হজমী খান আগে৷ তারপর কল দেই। আপনার পরিপাকতন্ত্র ঠিকঠাক কাজ করা শুরু করলে একটা আইডিয়া মাথায় এসেছিল, সেটা না-হয় তখন শেয়ার করতাম।”

এবার টনক নড়ল মিফতার। নিজের মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। বেফাঁস কথা যেন মুখ ফস্কে বেড়িয়ে না যায়। এখন বিশ্বস্ত থাকতে হবে। সে যে মনে মনে এন্টি পার্টি, এটা এখন কোনোভাবেই ওই অতি চালাক শেয়াল পন্ডিতকে বুঝতে দেয়া যাবে না।

“ওরে, গ্রেট। আমিও অবশ্য কিছু আইডিয়া পেয়েছি। আপনারটা এখনি বলতে পারেন।”

“আপনি অফিসে?”

“হ্যাঁ।”

“আমি আপনাকে একটা এড্রেস টেক্সট করতেসি। অফিস শেষে সেখানে চলে আসবেন।”

মিফতা বলল, “একটা কথা, আজ কোনোকিছু হলে সেজন্য কিন্তু আমাকে দায়ী করবেন না। আমি নিজেই ভিক্টিম।”

“আমি ওই পেইজের ফটোগ্রাফাররে পাইছি। আপনি যে অকর্মার ঢেঁকি, সেটা আমার বোঝা হয়ে গেছে।”

“হ্যাঁ, আর আপনি কর্মের ঢেঁকি। সারাক্ষণ ধান ভানেন।”

“আপনি কু তর্ক পরিহার করুন। বাচ্চা ছেলে না এখন।”

মিফতাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কল কেটে দিয়েছি নওমী। একমিনিট পরেই ওর হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ এলো। তাতে একটা লোকেশন দেয়া। পরপর আরও দুটো মেসেজ এলো। একটায় লেখা,

“আজ টাইম মেইনটেইন করবেন কিন্তু। নইলে আপনার মাথায় কাঁঠাল ভাঙব।”

“এ্যাহ! মহারানী এসেছে! জো হুকুম, মহারানী বলে তার পিছে পিছে ঘড়ির কাঁটা ধরে দৌড়াতে হবে। তুই তোর কাঁঠাল নিয়ে গোল্লায় যা, ফাজিল মেয়ে।”

মনে মনে কথাগুলো আওড়াল মিফতা। কাঁঠালে যে ওর ভয়ানক ফোবিয়া তৈরি হয়েছে, এটা নওমী জানে নাকি!

নওমীর পরের মেসেজে লেখা, “আপনি আমার ফোন নম্বর যে নামে সেভ করেছেন, তার প্রতিশোধ হিসেবে আপনার নামটাও আবার নতুন করে সেভ করেছি। নিজের নাম জানার কৌতূহল হচ্ছে? পরে আবার এভিডেভিড করে মিফতা নাম বদলে সেই নামটা না দিতে চান।”

ওর কন্টাক্ট লিস্টে এই মেয়ের নাম সে কী নামে সেভ করেছে তা ওই বদ মেয়ে জানল কী করে! সত্যি সত্যি ভূত-প্রেতের সাথে যোগসাজশ আছে নাকি!

পরক্ষণেই সে বুঝল এক্ষেত্রে মেইন কালপ্রিট ওর মা। সেদিন নির্ঘাৎ জানিয়েছে। মা এটা একদম ঠিক করেননি। ঘরের কথা কেন পরকে জানাতে হবে!

সে উত্তর দিল, “তাহলে বরং আমরা দুই জন একসাথেই এপ্লাই করবনি। কেমন? আমার দেয়া আপনার নামটাও শ্রুতিমধুর। আহা!”

উত্তর এলো কিনা সেটা চেক করবার আর সময় হলো না। লাঞ্চ আওয়ার শেষ আরও পাঁচ মিনিট আগে। এমনিতেই লম্বা ছুটি নিয়েছিল। অনেক কাজ জমে আছে। কাজে ডুবে গেল মিফতা। সঠিক সময়ে যোগ্য জবাব তো সে দেবেই। কয়দিন একটু উড়ুক নওমী।

***
শায়না অনেকক্ষণ থেকে নায়লার ঘরে বসে আছে। মেয়েটাকে খানিকটা অস্থির অস্থির মনে হচ্ছে। বাইরে যাবার জন্য তৈরি হয়েছে।

“তুই একটু সুস্থির হয়ে বসবি?”

“ভাবি, তোমরা আমার সমস্যাটা বুঝবা না। যার গর্দান নেবার সমস্ত প্রসিডিওর কমপ্লিট, তাকে কখনো সুস্থির হইতে দেখছিলা?”

নওমীর কথায় শায়না চরম বিরক্তি বোধ করল। সে খানিকটা অধৈর্য গলায় বলল, “মিফতার সাথে তুই বাইরে দেখা করিস কেন? তোর ভাইয়া কিন্তু বুঝে গেছে বিষয়টা।”

“যদি বুঝেই থাকে, তাইলে বাড়াবাড়ি করার মানে কী? আচ্ছা, তোমাদের বিয়ের সময় আমি যেটা করসি, ওইটার একটা কারণ ছিল। এখন ভাইয়ার স্বার্থটা কোথায়?”

“ওইসব ও মনে রাখে নাই রে। তাছাড়া তোরা দুই ভাইবোন নিজেদের এই ঝগড়ায় আমারে টানিস না কিন্তু বলে দিলাম। পরে দেখা যাবে, তোরা দুইটা মিলে গেছিস, আমি মাঝখানে তোদের শত্রু হয়ে গেছি। নীরব তোর খারাপ চাইবে?”

নওমী কিছু বলল না, এখন বেশি কথা বললে প্ল্যান ভেস্তে যাবে। নীরবের সাথে ওর যেটুকু খুঁনসুটি তা কেবল কথায় সীমাবদ্ধ। তারা কেউ পরস্পরের কোনো ক্ষতি হোক তা ঘুণাক্ষরেও চায় না। বরং একজনের সামান্য বিপদেও অন্যজন ঢাল হয়ে সামনে চলে যাবে। এটা নওমী জানে। তবুও মিফতাকে কোনোভাবেই নিজের জীবনসঙ্গী ভাবতে পারে না।

কথায় কথায় অপযুক্তি, বাজে তর্ক। ছেলেরা এত কথা বলে নাকি! তার উপর আছে প্রথম দিনের ওই বিচ্ছিরি অভিজ্ঞতা। দোষ বলে শেষ করা যাবে না। কোনো সময়-জ্ঞান নেই, কমন সেন্সও নেই। খালি আছে চেহারা। পারফেক্ট মাকাল ফল যাকে বলে। বাইরে থেকে সুন্দর, ভেতরে অন্তঃসারশূন্য।

ওর কল্পনার জীবনসঙ্গীর থেকে সহস্রগুণ দূরে মিফতা। ‘ঘাড়ত্যাড়া গবেট’ একটা। এই নামে নম্বরটা সেভ করে ভালো হয়েছে। তবে এরচাইতে যথোপযুক্ত নামের সন্ধানে আছে সে।

“শোন, কাউকে ঠিকমতো জানতে হলে বুঝতে হলে তাকে খুব কাছ থেকে জানতে হয়। মিফতার মধ্যে তেমন কিছু না থাকলে তোকে বাবা মা, নীরব কেউই জোর করত না নিশ্চয়ই।”

“আচ্ছা ভাবি, আমি ভেবে দেখব। আজ সত্যি সত্যি ইরার বাসায় যাচ্ছি। ফিরতে দেরি হবে।”

“ইরার বাসায় যেন আবার মিফতার ঠিকানা না হয়ে যায়।” হেসে বলল শায়না।

নওমী বেরিয়ে পড়ল ঘর থেকে। এবার যেতে হবে। ওই কাণ্ডজ্ঞানহীন লোকটার সাথে দেখা করতে হবে। আজ যদি সময় মতো না আসে তবে সত্যি সত্যি ওর মাথায় কাঁঠাল ভাঙবে সে।

***
নওমীকে বিস্মিত করে মিফতা আজ ওর আগে এসে হাজির হয়েছে। ইরার বাসায় গিয়ে আধাঘণ্টা পরেই বেরিয়ে এসেছে সে।

মিফতা ওকে দেখামাত্র ভুবন ভোলানো হেসে বলল, “আজ কিন্তু আমি অন টাইম।”

“সেটাই দেখছি। জ্বর হয়ে খানিকটা কাণ্ডজ্ঞান হয়েছে দেখছি।”

“জ্বর থেকে যদি দারুণ কিছু হয়, তবে খারাপ কী?”

“কপি করা ডায়লগ ছাড়া আর কী জানেন আপনি?”

“অনেককিছু। কিন্তু নিজের জ্ঞান প্রকাশের সুযোগ পাচ্ছি না। আপনারা আমার মতো একজন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী হারাচ্ছেন। দুঃখজনক।” নাটুকে ভঙ্গিতে বলল মিফতা।

নওমীর ধৈর্যচ্যুতি ঘটল এবার, “তা সেই জ্ঞান প্রয়োগ করে কয়টা প্ল্যান বের করলেন?”

মিফতা মনে মনে বলল, “যে প্ল্যান পেয়েছি, তাতে খুব শীঘ্রই তোমার অতিবুদ্ধি নিয়ে ক্লিন বোল্ড হবে।”

মুখে অবশ্য তার আভাস দিল না। বলল, “সেটা তো আপনি বের করেছেন। শুনি আগে।”

“এই রাস্তায়?”

“তাহলে চলুন, এদিকে একটা কফিশপ আছে। সেইখানে গিয়ে বসি।”

নওমী প্রায় আঁতকে উঠে বলল, “একদম না। এবার আর এসবে না। একটা নির্জন জায়গায় যাব। আমার বেশ পছন্দের জায়গাটা। সেখানে পরিচিত কারোর সাথে দেখা হবার সম্ভাবণা নাই।”

“কী ব্যাপার বলুন তো?” মিফতা সন্দিগ্ধ গলায় প্রশ্ন করল।

“কীসের ব্যাপার?”

“এই যে, নিজের প্রিয় জায়গায় আমাকে নিয়ে যেতে চাইছেন? প্রিয় জায়গায় তো মানুষ প্রিয়জনকে নিয়ে যাইতে পছন্দ করে।”

“অপ্রিয় থেকে প্রিয় যেন না হোন, সেটার জন্যই নিয়ে যাচ্ছি। বেশি না ভেবে চলুন তো।”

তাড়া দিল নওমী। পায়ে হেঁটেই যাচ্ছে ওরা। হাঁটতে হাঁটতে মিফতা জিজ্ঞেস করল,

“প্রতিশোধ হিসেবে কী নাম পেলাম? এভিডেভিড করার জন্য যোগাযোগ শুরু করা যায় কিনা ভাবছি।”

নওমী উত্তর দিল না। সে আজ ভীষণ ফোকাসড। আগে কাজের কথা বলতে হবে। নইলে দেখা যাবে ঝগড়া করতে করতে আসল কথা বলার সময়ই পেল না।

***
জায়গাটা আসলেও চমৎকার। লেকের ধারে আজ তেমন লোকজন নেই। চারপাশে গাছপালায় ভরা। সূর্য লালচে হতে শুরু করেছে। সেই আলো নওমীর মুখে এসে পড়ছে। বাতাসে মেয়েটার অবাধ্য চুলগুলো উড়ছে।

মিফতার আচমকা মনে হলো, সে যদি চুলগুলো নিজের হাতে ঠিক করে দিতে পারত!

মনকে কষে চড় দিয়ে নিজেকে সেই ভাবনা থেকে বের করে নিয়ে এলো। ওমন অদ্ভুত খেয়াল হঠাৎ কেন এলো ওর মনে!
……..
(ক্রমশ)
১১০০+ শব্দ। যদিও আরও বড় করার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু বিকেলে লিখতে লিখতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আম্মুর ডাকে ঘুম ভেঙেছে আটটার পরে। ভাবছি আগামীকাল আরেকটা ছোট্ট পর্ব দেব কিনা! বেশি বেশি মন্তব্য করবেন কিন্তু।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here