#হৃদয়_পথে_এ_কার_ছায়া (পর্ব ১১)
নুসরাত জাহান লিজা
মিফতার এই দুইদিন কাটল অস্থিরতায়। নিজের ইগো সরিয়ে নওমীকে কল করতে পারল না ঠিকই, তবে মনে মনে ঠিকই দৃশ্যকল্প মঞ্চস্থ হলো। সেখানে দুই কুশীলব নওমী আর মিফতা তুমুল ঝগড়ায় মত্ত।
বাস্তবে তো পুরো পরিবার আছেই। যেদিন থেকে সে বিয়েতে মত দিয়েছে, সেদিন থেকে মা ওকে জ্বালিয়ে মারছেন। ওদিকে চামেলি ওকে দেখলেই দুঃখী দুঃখী মুখ করে বলে,
“ভাইজান, কষ্ট পাইয়েন না। আফনে দেকতে শুনতে রাজপুত্রের লাহান। আফনেরে হে ফিরাইবার পারব না।” যেন মিফতা কষ্টে মরে যাচ্ছে, আর ওর কষ্টে চামেলি সমব্যথী।
সে ধমক দিয়ে বলল, “আমি কষ্ট পাব কোন দুঃখে! তুমি তোমার নিজের কাজ করো তো।”
“আমার কাম আমি ফাঁকি দেই না। সব টাইম টু টাইম মাইপ্যা পাইপ্যা কইরে ফালাই।”
মিফতা ওকে থামিয়ে দিয়ে আবারও কিছু বলতে গেলেও ওকেই থেমে যেতে হলো। একটা মানুষ এত অপ্রাসঙ্গিক কথা বলতে পারে!
“বুজছি তো, ভাইজান। যহন মানুষ কইতেও না পারে, সইতেও না পারে, তহন ক্যামুন লাগে আমি জানি তো।”
মিফতা বসার ঘর থেকে উঠে নিজের ঘরে চলে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল।
ওর মনে হলো নওমী যেন কোথাও থেকে সব দেখছে। অট্টহাস্যে সে মিফতাকে ফোঁড়ন কেটে বলছে, “কী সাপুড়ে মহাশয়, বীণ বাজানো শিখতে গিয়ে তো দেখি আপনিই বীণের তালে নাচতেসেন।”
মিফতার ইচ্ছে করল মাথার খুলি থেকে মস্তিষ্ক বের করে ধুয়ে নওমীর অস্তিত্ব পরিষ্কার করে ফেলে। যদি মস্তিষ্ক থেকে মেয়েটাকে ব্লক করতে পারত কিছুদিনের জন্য। এত জ্বালাচ্ছে কেন! আশ্চর্য! সামনে না থেকেও কেমন দৌড়ের উপরে রেখেছে। ফাজিলের ফাজিল একটা মেয়ে!
ওকে এভাবে দেখলেই নির্ঘাত হাসবে নওমী, চায়ের কাপে চুমুক দিতে গিয়ে ঠোঁট পুড়ে গেলে হাসি বের হয় কীভাবে দেখা যেত। পরক্ষণেই এমন বদ দোয়া তুলে নিল। মেয়েটাকে হাসলে ভারি মিষ্টি লাগে।
নওমীর হাসিটা খরতপ্ত ঊষর ভূমির বুকে প্রাণ শীতল করা এক পশলা বৃষ্টির মতোই মায়াময়। যে শীতলতা মিফতাকে প্রশান্তি দেয়৷ সেই হাসি নষ্ট হয়ে যাক সে তা চায় না। অতটা হৃদয়হীন মিফতা নয়।
বরং হৃদয়ের তালাবদ্ধ প্রকোষ্ঠের আগল সে খুলে দিল। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মতো যেন সেখানে জল জমতে শুরু করল। বৃষ্টি স্নাত প্রশান্তিমাখা জল। সে জলে যেন নওমী আরও বেশি করে সেঁধিয়ে গেল মিফতার হৃদপিণ্ডে।
***
মা’কে মিফতা রাজি করিয়েছিল, এখনই যেন নওমীদের বাড়িতে ওর সম্মতির কথা না জানানো হয়। মা দু’দিন সময় দিয়েছিলেন। আজ পুরো পরিবার নওমীদের বাসায় যাবে।
এবার যাবার আগে মিফতা প্রথমারের মতো নিজের পোশাক পরিচ্ছদ নিয়ে সচেতন হলো। ওর কাছের বন্ধু সায়নকে ডেকে এনেছে। ওকে বারবার জিজ্ঞেস করছিল,
“দেখ না দোস্ত, মানাইসে? আকাশী কালার শার্টটা বেশি মানাইতো নাকি এইটা?”
সায়ন বলল, “এত কনফিউশান থাকলে পাঞ্জাবি পরে যা।”
“লাভ ইউ দোস্ত।”
মিফতা দুই তিনটা পাঞ্জাবি পরে ট্রায়াল দিয়ে হালকা সবুজ রঙের একটা পাঞ্জাবি পরল, এটাই সবচাইতে ভালো মানাচ্ছে আজ। হাতে ঘড়ি পরছিল, সায়ন ভেতরে এসে বসতে বসতে বলল,
“তুই তো বিয়েটা করতে চাইতেসিলি না। এহন এমন মেক-আপ সেকআপের কাহিনী কী?”
মিফতা চুলে চিরুনি চালাতে চালাতে বলল, “আগে চাই নাই বলে যে কোনোদিন চাইতে পারব না এমন কোনো রুলস আছে নাকি শালা? আমি কি সন্ন্যাস ব্রতের পণ করসিলাম?”
“সেটা ঠিক আছে। কিন্তু যারে দুইদিন আগে গালাগালি করলি তারে দেখতে যাবার এত ঘটা?”
“শোন, আগে অসহ্য লাগত, মানুষের অনুভূতি বদলায় না? আমারও বদলাইসে।”
“ওরে পছন্দ করিস?”
এবার মিফতা খানিকটা থমকালো। নওমীকে সে সর্বদা অনুভব করছে ইদানিং। মনে হচ্ছে এর সাথে কথা না বললে, বিশেষ করে ঝগড়া না করলে ওর দম বন্ধ হয়ে আসবে। এই অদ্ভুত চাওয়ার মানে সে জানে না।
মিফতা কেবলমাত্র নওমীকে জব্দ করতেই বিয়ে করতে চাইছিল। কিন্তু গত কয়েকদিনের এই ঝগড়াহীন, দেখাহীন, কথাহীন সময়টা ওকে চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে গেল, এ নিছক জেদ নয় মনটাও সর্বান্তকরণে নওমীকেই চায়। নইলে বারবার কেন একটুখানি কথা ছোড়াছুড়ির জন্য মন এমন ব্যকুল হয়ে উঠবে! এক পলক দেখবার জন্য হৃদয়ে উথাল-পাতাল ঢেউ বইবে।
কেন মনে হবে রেগে থাকলে মেয়েটাকে ভারি অন্যরকম দেখায়। তেজস্বী অথচ কেমন আপন আপন, ক্ষুব্ধ তবুও যেন ভারি স্নিগ্ধ লাগে। ঝগড়াটে তবুও ভীষণ মিষ্টি, কত দূরের তবুও কেন যেন বহুল আকাঙ্ক্ষিত। কেন সে চায় অদৃশ্য মায়ার অমোঘ টানে মিফতার হৃদয়ের নিভৃত গহীনে যে আসন পাতা আছে, তাতে অধিকার করে বসুক নওমী। আসন অলঙ্কৃত করে পূর্ণ করুক ওকে!
তবে সে বুঝতে পারে না, যার নাম শুনলেই গায়ে আ গু ন ধরে যেত, তাকে ঘিরেই সহসা এমন অনুভূতি কেন হলো! অনেক ভেবে ভেবে মিফতা আবিষ্কার করল, বিষয়টা অভ্যস্ততার। নওমীর সাথে যে কথার ল ড়া ই চলে তা সে উপভোগ করে। এটাকে পছন্দ বলা যায় নাকি ভালোবাসা অথবা অন্যকিছু সে জানে না। তবে এটুকু জানে নওমীকে ছাড়া ওর চলবে না।
মেয়েটা কেন যে ওকে চায় না! সে-ও তো চাইতো না। সেটা যেন এই বিষয়টা ঠিক এই মুহূর্তে মনেই এলো না, সূক্ষ্ম অভিমান জমা হলো মনের কোথাও। আজ প্রথমবার প্রত্যাখ্যান জ্বালা ধরালো মিফতার মনে।
*
মালা আর জামিল দু’জনেই ছেলেকে দেখে এগিয়ে গেলেন। এমন শতভাগ পরিপাটি মিফতাকে তারা সচরাচর দেখে অভ্যস্ত নন। সেই কবে চাকরির ভাইভা দিতে গিয়েছিল ফরমাল পোশাকে, নিজেকে পরিপাটি করে। কখনো সখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইভাতে এমন মিফতার দেখা মিলত।
মালা ছেলের ঘরে এসে দেখলেন, আজ খুব একটা এলোমেলো নয় ঘরটা। অন্তত বিছানার চাদর খানিকটা কুঁচকে থাকলেও একেবারে গোয়াল ঘর নয়। বিছানা ছাড়ার পরে তাতে যেন গোছানোর চেষ্টা করার ছাপ।
মালা বললেন, “একেবারে বর সেজে যাচ্ছিস যে, বিয়েটা কি আজই করাবো নাকি?”
মিফতা ভীষণ লজ্জা পেল, সে বলার চেষ্টা করল, “মা, তুমি..”
“আয়, দেরি হয়ে যাবে এরপর।”
ছেলের হাত ধরে টেনে বের করতে করতে মালা বললেন, “তোকে একটু অগোছালোই বেশি সুন্দর দেখায়।”
মিফতার পা থেমে যেতে চাইল, বলল, “তাহলে এত কষ্ট করে এসব…”
মালা হেসে বললেন, “চিন্তা করিস না। তোকে এভাবেও ভালো লাগছে।”
মিফতা বুঝল মা আজ আবার মজা করছেন ওর সাথে। এই মুহূর্তে কথা না বাড়ানোই ভালো। পরে নিজে কী বলতে গিয়ে কী বলবে, পাছে বেইজ্জতির একশেষ হবে! দরকারটা কী!
***
নওমীকে অনেক বলে কয়েও শাড়ি পরানো গেল না। শেষে শায়না হাল ছেড়ে দিল। গাঢ় নীল রঙের সুতোর কাজ করা একটা সালোয়ার কামিজ পরল। শায়না এবার আর কোনো কথা শুনল না। ওর উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের মুখটায় মানানসই প্রসাধনীর প্রলেপ লাগিয়ে দিল।
“আমি নিজেই পারতাম।”
“বিয়ের কণেকে নিজের সাজতে হয় না।”
“তোমাকে কে বলসে? আমি বিয়ের কণেও নই।”
“আমি নিজেই বলসি। এখন কথা বন্ধ কর তো। মাশকারাটা দিয়ে দিই।”
শায়না মনের মতো করে নওমীকে সাজিয়ে দিল। এরপর বলল, “সাজসজ্জায় মাঝেমধ্যে একটু চেঞ্জ আনা লাগে। দেখ আজকে কেমন অন্যরকম লাগতেসে। মিফতা তোকে শরতের আকাশ না ভেবে ফেলে!”
টিপ্পনী কেটে বললেও নওমী খানিকটা লজ্জাই পেল। এমন সরাসরি প্রশংসায় কেমন অস্বস্তি হচ্ছে। তবে ওই মাথামোটা গবেটটার জন্য এই সাজ ভাবতেই লজ্জাটুকু মুছে গেল, জায়গা করে নিল রাগ।
শায়না ওর অভিব্যক্তি দেখে আরেকবার ফোঁড়ন কাটল, “ঝগড়া থেকে রাগ, রাগ থেকে অনুরাগ, অনুরাগ থেকে ভালোলাগা, এরপর…”
বলে মুহূর্তের জন্য থেমে সুর বদল বলল, “ভালোবাসা।”
“ভাবি, ভালোবাসা? ওই ঘাড়ত্যাড়া নাকখোঁটা লোকটার জন্যে? অসম্ভব!”
*****
জহির সাহেব এসেছেন আজ। বন্ধুর মেয়ে যদি তার পরিবারের সদস্য হয় তাতে তিনি বড়ই খুশি হবেন। নওমীকে জন্মের পর থেকেই দেখেছেন তিনি। তাছাড়া নিজের ভাইপোকে তো চোখের সামনে বড় হতে দেখেছেন।
জহিরের ছেলের বয়স নওমীর থেকে অনেক কম। মাহমুদ আর তিনি কত রকম স্ট্রাগল সুখ দুঃখের মুহূর্ত একসাথে কাটিয়েছেন সেই ছাত্রজীবন থেকে। তার মেয়ের সাথে নিজের ভাতিজা একটা চমৎকার জুটি হবে জীবনে, এমনই বিশ্বাস তার।
দুটো চমৎকার স্বচ্ছ মনের মানুষ একসাথে জুড়ে গেলে সংসার হোক, কিংবা ব্যক্তিজীবন কোথাও বেগ পোহাতে হয় না। সুখ লুটোপুটি খায় ঘরজুড়ে।
তার অত্যন্ত কাছ থেকে দেখা দু’জনেই। মিফতার মধ্যে ছেলেমানুষী জেদ আছে কিছুটা, কিন্তু সম্মান দিতে জানে মানুষকে, কাছের মানুষের জন্য বড়সড় জীবনের ঝুঁকি নেবারও উদাহরণ রয়েছে।
নওমীর ক্ষেত্রেও কথাগুলো খাটে। এই বয়সে নিজেদের একটা আলাদা মতামত তৈরি হয়। দুনিয়াকে অন্য দৃষ্টিতে দেখতে পছন্দ করে। নিজের বক্তব্যে তারা স্বচ্ছ আর স্পষ্ট। রাখঢাক করে না। কিন্তু বেয়াদব নয়, অকারণে কু তর্ক করে না। সে-ও সবাইকে যথাযথ সম্মান দেয়।
তবুও কোথাও যেন দুজনের টিউনিং হচ্ছে না। কোথাও একটা গ্যাপ থেকে যাচ্ছে।
নওমী আর মিফতাকে ছাদে পাঠাবার বন্দোবস্ত সম্পন্ন করে তারা নিজেরা বসলেন জরুরি বৈঠকে।
***
আকাশ আর নওমী যেন আজ মিলেমিশে একাকার। মিফতার চোখে একরাশ বিমুগ্ধতা। অনুভূতি বদলে গেলে কি মানুষের দেখার চোখও বদলে যায়!
নওমীর সৌন্দর্য বেশিক্ষণ দেখবার সুযোগ হলো না, কারণ সাপিনী ফোঁস করে উঠল।
“এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?”
“তাতে সমস্যা কী? আমার চোখ, আমি তাকিয়ে আছি।”
“কিন্তু আপনি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন, ছ্যাচড়ার মতো। আমার অস্বস্তি হয়। আকাশ বাতাস, গাছপালা, লতা-পাতা যা খুশি দেখুন, আমার দিকে তাকাবেন না। ”
“আমি মেঘ দেখছি। একতাল মেঘ ভুল করে এই ছাদে এসে পড়ে গেছে।”
নওমী কড়া চোখে চাইল, “আজ হঠাৎ পটাবার তালে আছেন মনে হইতেসে? এসব মেয়ে পটানো কথা শুনে পটে যাবার বয়স বহু আগে পেরিয়ে এসেছি।”
“আপনার বয়স কত? একশো ছাপ্পান্ন?”
“না, এর দ্বিগুণ, তিনশো বারো।”
“আপনি তো দেখছি ম্যাথে অনেক ভালো। একশো ছাপ্পান্ন’র ঘরের নামতা বলতে পারেন?”
“কেন? সবার কি আপনার মতো গবেট হওয়া উচিত ছিল?”
“আমি গবেট নই মোটেই। অবশ্য যে যেমন সে সবাইকে তার মতোই মনে করে।”
মিফতা কিছু কথা বলার জন্য উশখুশ করছিল, কিন্তু এই মেয়ের উপর্যুপরি কথার বাণে সে সুযোগ হচ্ছিল না। ধৈর্যের বাঁধ ধীরে ধীরে ভাঙছে।
“তাই নাকি? এই জন্যই আমার নামের সাথে ভূত বসাইছেন? আপনি ভূত-প্রেত নন তো?”
“ভূত নই, কিন্তু ভূতকে মিস করতেসি ইদানিং।”
মিফতার এই কয়দিনের শূন্যতা যে আচমকা পূরণ হলো নওমীর সাথে কথা বলতে পেরে। এক পলকা ফুরফুরে বাতাস ওদের ছুঁয়ে গেল, মিফতার মনকেও!
সাথে যুক্ত হলো আশঙ্কা, যা জেদি মেয়ে! সে কি শেষ পর্যন্ত মত দেবে নাকি ওকে একতরফা…
……….
(ক্রমশ)
আজকে বড় করে দিয়েছি। কেমন লাগল, জানাতে ভুলবেন না! যারা সুন্দর করে ভালো-মন্দ কমেন্ট করেন, লাইক দেন তাদের জন্য ভালোবাসা।