#হৃদয়_পথে_এ_কার_ছায়া (পর্ব ১৩)
নুসরাত জাহান লিজা
মিফতা ধোপদুরস্ত পোশাকে সজ্জিত হয়েছে। একটু পরেই বেরুবে। এই মুহূর্তে মালা এসে বললেন, “বাবু, বের হওয়ার আগে বাজার থেকে কাঁচামরিচ আর কিছু সবজি কিনে দিয়ে যাইস তো।”
মিফতা ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল, ঘুরে মালার দিকে তাকিয়ে বলল, “ঠিক আছে মা। আসার সময় নিয়ে আসব।”
মালা বললেন, “আসার সময় মানে? সবজি বাদ দিলাম, মরিচ ছাড়া তো রান্না হবে না। এখন দেখলাম বাসায় কাঁচামরিচ নাই। আমরা দুপুরে না খেয়ে থাকব নাকি! চামেলি ছুটিতে। তোর বাবার শরীরটা তেমন একটা ভালো নাই।”
“সে কী! বাবার কী হইসে?”
“বয়স হইতেসে না এখন। তুই দিয়ে যা।”
মিফতা জুতো বের করে পরল, আজকের দিনে পরার জন্য গতকাল কিনেছে।
মিফতাকে অবশ্য মরিচ কেনার জন্য বাজারে যেতে হলো না, বাসার সামনের গলির মোড়েই সবজির ভ্যান দেখতে পেল। সবজি নিয়ে ফিরছিল, ঠিক তখনই ঘটল অঘটন। ওর কয়েকদিন ধরে প্রস্তুতি নিয়ে রাখা পোশাকটা কাদা লেগে নষ্ট হয়ে গেল। গত রাতের মুষলধারে চলা বৃষ্টিতে রাস্তার কিঞ্চিৎ ভাঙা অংশে পানি জমে ছিল। সে পানিতেই পা দিয়ে ফেলল।
জুতা ভিজে একাকার, প্যান্টেও কাদা লেগে গেছে। ফুলবাবু সেজে নওমীকে ইমপ্রেস করার প্রথম চেষ্টাই গুড়েবালি। রাস্তায় বসে পড়ে হাত পা ছুঁড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করল মিফতার।
আজ সময়ের মধ্যে বের হবার ইচ্ছে ছিল, সেই মতো আগেভাগে তৈরি হয়েছিল, কিন্তু সেটাও হলো না। ওর সাথেই আজ এটা হবার ছিল! মনে মনে বলল,
“সিনসিয়ার হইতে প্যারা আছে। আমার এলোমেলোই ভালো। তখন এরকম হয় নাই।”
কোথাকার কে উড়ে এসে ওর জীবনে জুড়ে বসতে যাচ্ছে। তার জন্য কখন যেন অবচেতন মন নিজে থেকে বদলাতেও চাইছে। সময় মেনে তো সে কোনোদিন চলে না। কখনো নিজেকে পরিপাটি রাখতে পারে না।
সহসা মিফতা উপলব্ধি করল, সে খুব ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে। চেনা হৃদয়ের ততোধিক চেনা অলিগলি নিজের কাছেই কেমন অচেনা লাগছে! মনে হচ্ছে এবার প্রত্যাখ্যাত হলে জীবন থেকে কী যেন একটা কিছু হারিয়ে যাবে, যা প্রচ্ছন্ন তবুও প্রভাব বিস্তারী। সে কিছুতেই তা হারাতে চায় না।
বুদ্ধি করে আগেভাগে নওমীকে কল করে বলল, “আপনি বাসাতেই অপেক্ষা করুন একটু, আমি আপনাকে সেখান থেকেই নিয়ে বের হব।”
“আজও…”
“পরে দেখা হলে সমস্যাটা বলছি।”
*
বাসায় আসার পরে মালা ওকে দেখে বললেন, “কী রে? তুই সবজি কিনতে গিয়ে কি ড্রেনের মধ্যে সাঁতার কাটতে চাইছিলি নাকি?”
এবার মিফতার রাগ হলো, “তোমার জন্য হইলো। পরে আনলে কী এমন হইত?”
সব শুনে মালা বললেন, “রাস্তাঘাটে হাঁটতে গিয়ে ঘুমাইলে এরকমই হয়। তোর নিজের অসাবধানতার জন্য উস্টা খাইছিস। একটু সাবধানে চলবি তো। এখন আবার রেডি হ৷ আমি তোর শার্ট বের করে দিতেসি।”
মায়ের বকুনি শুনতে শুনতে আরেকবার গোসল করে তার বের করে দেয়া অন্য পোশাক পরে তৈরি হলো মিফতা। আশ্চর্য হয়ে খেয়াল করল সব মিলিয়ে সময় লেগেছে মাত্র আটত্রিশ মিনিট। অন্য সময় আধাঘণ্টা সময় শুধু ওর গোসলেই লাগে। এই যে কাউকে মুগ্ধ করবার যে প্রচেষ্টা, এটাকে কী বলে! ভালোবাসা! জানে না মিফতা।
***
মিফতা নওমীর বাসার সামনে দাঁড়িয়ে রইল পাক্কা সাতাশ মিনিট। ওকে অবশ্য ভেতরে যেতে বলেছিল, কিন্তু কী এক সংকোচে যেতে পারেনি। এটা তার হবু শ্বশুরবাড়ি, কথাটা মনে হতেই কেমন লজ্জা পেল মিফতা।
নওমীকে দেখে চোখ সরাতেও বেগ পেতে হলো। কচি পাতার মতো সবুজ রঙের একটা শাড়ি পরেছে নওমী। চোখে কাজল, ঠোঁটে লিপস্টিক, কপালে একটা ছোট্ট টিপ। কানে ছোট্ট দুল পরা। এতক্ষণ অপেক্ষা করানোর ক্ষোভটুকু হাওয়ায় মিলিয়ে গেল নিমিষেই।
এই মেয়ে আগে থেকেই এমন মিষ্টি দেখতে! কই আগে তো খেয়াল করেনি। যবে থেকে সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিয়েটা করবে, নওমীকে ছাড়া চলবে না, তবে থেকে মেয়েটার সৌন্দর্য যেন মিফতার মনজুড়ে স্নিগ্ধ এক আবেশ ছুঁইয়ে দিচ্ছে। ওকে দেখলেই কেমন মন শান্ত হয়ে আসে। নিজের হৃদপিণ্ডের লাবডুব লাবডুব শব্দ সে নিজের কানেই যেন শুনতে পায়।
মুখে এই সৌন্দর্যের তারিফ করবার মতো সাহস হয় না৷ তবে এখনই ধরা দিতে নারাজ মিফতা৷ তাই স্বভাবসুলভ বাকপটুতা ধরে রাখতে বলল,
“আমি প্রায় ঘণ্টাখানেক দেরি করে আসলাম। আর আপনার সাজই শেষ হলো না।”
নওমী বলল, “আপনি ছেলে হয়ে যদি সাজতে এত টাইম লাগাম, মেয়েদের স্বাভাবিক তার দ্বিগুণ লাগবে।”
মিফতা কাদায় মাখামাখি হবার গল্পটা এড়িয়ে গেল। জেনেশুনে ছু রি র নিচে কে গলা বাড়িয়ে দেয়! সে তো কাঠবোকা নয়!
“ছেলে হলেই সাজসজ্জা করা অন্যায় নাকি?”
“কথাটা আপনি আগে তুলেছেন। আর একটা কথা, শাড়িটা মা আর ভাবির জেদের জন্য পরলাম। অন্যকিছু নয়।”
“সে আমি জানি। চলুন, যাওয়া যাক।”
ওরা সিএনজিতে উঠে বসল। মিফতার অবশ্য রিকশা নিতে ইচ্ছে করছিল, কিন্তু নওমীকে এই প্রস্তাব করার সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারেনি।
***
সামনে অনেকদূর পর্যন্ত বিস্তৃত কাশফুলের সারি। উপরে প্রগাঢ় নীল আকাশ। তাতে সাদা সাদা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। নওমীর চমৎকার লাগল জায়গাটা। সে নিজের মুগ্ধতা প্রকাশও করল।
“চমৎকার। আপনার প্রিয় জায়গাটা আসলেও সুন্দর।”
“তাহলে ঋণ মওকুফ করলেন?”
“করলাম।” হেসে বলল নওমী।
“যাক, বাঁচলাম।” হাঁফ ছেড়ে বলল মিফতা।
নওমী হাত বাড়িয়ে রেখেছে, কাশফুল ছুঁয়ে ছুঁয়ে হাঁটছে। ওর মুখে এমন দীর্ঘস্থায়ী হাসির রেখা দেখেনি মিফতা। হাঁটার গতি শ্লথ করে সে নওমীকে দেখছিল কেবল।
একঝাঁক সবুজ পাতা যেন একসাথে জড়িয়ে ওর সামনে দিয়ে হাঁটছে। আচমকা বাতাসে আঁচল উড়ছে, বেসামাল চুল উড়ছে নওমীর। নওমী ঘুরে ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
“এখানে আশেপাশে বাড়ি করলে ভালো হতো। যতদিন কাশফুলের মৌসুমে থাকবে, ততদিন, প্রতি বিকেলে এখানে আসতাম।”
“সাথে আমাকে রাখবেন? ধরেন বাড়িটা আমাদের হতো। দুজনের?”
নওমী থমকে দাঁড়ালো। হাসি ম্লান হয়ে ভীষণ সিরিয়াস হয়ে উঠল মুখভঙ্গি। এরপর মিফতার দিকে খানিকটা এগিয়ে এসে বলল,
“আমি আগেই সন্দেহ করেছিলাম। ঠিক মিলে গেল। এমন লুকোছাপা করলেন কেন? ভেবেছিলেন আমার মনের কথা জেনে নিয়ে সেটাকে আমার বিরুদ্ধে ব্যবহার করবেন? আমি কিছুই বুঝব না? আমি ঘাস খাই?”
মিফতা আজ স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে উত্তর দিল না, বরং সমঝোতা করার উদ্দেশ্য নিয়ে বলল, “নওমী, আপনি ভুল বুঝছেন। একবার আমার কথাটা শুনেন?”
“ইচ্ছে করতেসে না। আমি ফিরব। আপনি আসবেন?”
মিফতার মনজুড়ে অভিমান গ্রাস করল। সে আর নিজেকে প্রকাশ করতে পারল না। ক্ষণকালের জন্য চারপাশের অপার সৌন্দর্য অবলোকন করে নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,
“ঠিক আছে চলুন। আমরা একসাথে এলাম। একসাথেই ফেরা উচিত। আমার কথা রাখতেই এখানে এসেছেন।”
“যে কারণেই আসি, ফেরার সিদ্ধান্তটা আমার। আপনি না-ও ফিরতে পারেন।”
মিফতা মনে মনে বলল, “আমি ফিরে যাব ঠিকই। কিন্তু আমার হৃদয়টা পুরোপুরি ফিরতে পারবে না। সেটার অনেকটা আপনার অগোচরে সন্তর্পণে আপনার হৃদয়ে মিশে গেছে।”
আজকের মতো এমন বুক ভাঙা কষ্ট মিফতার কখনো হয়নি। এই তো দুদিনের কথা, তবুও অনুভূতিটা কী করে এমন শক্তিশালী হলো! মন ভাঙার ব্যথার এত প্রাবল্য কেন!
“চলুন।” অস্ফুটস্বরে বলল মিফতা।
***
রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল নওমী আর মিফতা। এদিকে যদি যানবাহন পাওয়া না যায়, সেজন্য যে সিএনজিতে এসেছে তাকেই থাকতে বলেছিল। এখন কল দিতেই জানালো, আশেপাশেই আছে, আসছে সিএনজি নিয়ে।
নওমীর ভালো লাগছে না একেবারে। ওর কঠোর প্রত্যাখ্যান এভাবে নীরবে সহ্য করল কেন মিফতা এটা বোধগম্য হচ্ছে না। মানতেও পারছে না।
প্রত্যুত্তরে সে-ও বরাবরের মতোই কিছু কড়া কথাই আশা করছিল মিফতার কাছ থেকে। তবে কি সত্যিই ঘাড়ত্যাড়া গোছের ছেলেটা ওকে ভালোবেসে ফেলেছে…
আচমকা রাস্তায় চোখ গেল নওমীর। একটা চার-পাঁচ বছরের বাচ্চা রাস্তার মাঝখানে দৌড়ে চলে গেছে, উল্টো দিক থেকে একটা গাড়ি আসছে তুমুল গতিতে।
নওমী একটু দূরে ছিল, সে ছুটে আসতে গিয়ে দেখল মিফতা ততক্ষণে মাঝ রাস্তায় চলে গেছে, শ্বাসরোধ করে অপেক্ষা করছিল নওমী, চিৎকার করে মিফতাকে সাবধান করতে চাইছিল। গলার স্বর সেই অব্দি পৌঁছাতে পারল কিনা জানে না।
পাশে আরেকজন মেয়ে রাস্তার দিকে ছুটছিল, বোধহয় বাচ্চাটির মা। এসব নওমীর চোখে পড়ছে না। কেবল দেখল পলকের ব্যবধানে দেখল বাচ্চাটাকে ধরতে পারলেও গাড়িটা মিফতাকে ধাক্কা দিয়ে গেল।
নওমী রাস্তার পাশেই বসে পড়ল, পায়ের এক ফোঁটা শক্তি নেই ওকে বইবার। ততক্ষণে লোকজন জমতে শুরু করেছে।
একবুক সাহস সঞ্চয় করে নওমী ছুটে গেল। বাচ্চাটাকে কুলে জড়িয়ে দৌড়ে আসা তরুণী আকুল হয়ে কাঁদছে। মিফতার পাশে বসে মাথাটা কোলে রাখল নওমী।
“বাচ্চাটা… ”
“ঠিক আছে। আপনার কেমন লাগছে?” আকুল হয়ে জিজ্ঞেস করল নওমী।
“তুমি কাঁদছ? কেঁদো না প্লিজ। মাথায় ভীষণ যন্ত্রণা হইতেসে। এছাড়া খুব ভালো আছি। একটা কথা বলি? আমি এখন একদম মিথ্যে বলি নাই। তোমার দিক থেকে হয়তো সাড়া পাব না, কিন্তু তোমাকে ছাড়া আমার চলতে ভীষণ কষ্ট হবে।”
মিফতার মুখে যন্ত্রণার ছাপ। লোকজনের সাহায্য নিয়ে ওকে নিয়ে যাওয়া হলো নিকটস্থ হাসপাতালে।
গলা উঁচিয়ে ঝগড়া করা ভীষণ ঝগড়াটে, ঘাড়ত্যাড়া নাকখোঁটা লোকটা এমন বিপুল সাহস কোথায় পেল! একটা বিপন্ন জীবনকে বাঁচাতে এত বড় ঝুঁকি নিল। নওমীর হৃদয়পটে এতদিনের আঁকা মিফতার ছবিটা কেমন যেন বদলে গেল আচমকাই।
……
(ক্রমশ)