#হারিয়ে_খুঁজে_ফিরি
#পর্ব_১
#Saji_Afroz
মাঠ ভর্তি মানুষের সামনে প্রেমিকের হাতে চড় খাবে এমনটা কখনো ভাবেনি মায়া। এই মুহুর্তে চারপাশটা অন্ধকার মনে হচ্ছে ওর। লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে। আশপাশের কারও হাসির শব্দ কানে বাজতেই ঘোর কাটে মায়ার৷ খেয়াল করলো, ওর দিকেই তাকিয়ে হাসছে কয়েকজন। এইবার আর নিজেকে সামলাতে পারে না ও৷ ছুটতে শুরু করে মায়া। ছুটতে ছুটতে চলে আসে রাস্তায়। ওর দিকে একটি মালবাহী ট্রাক এগিয়ে আসছে দেখেও সরলো না ও। চোখ বুজে দাঁড়িয়ে রইলো রাস্তার মাঝখানেই। ঠিক তখনি কারও হ্যাচকা টানে দূরে সরে আসে মায়া। হামজাকে দেখে রাগটা আরও বেড়ে যায় ওর। হামজার কাছ থেকে নিজেকে সরানোর চেষ্টায় লেগে পড়ে। হামজা ওকে কোলে তুলে রাস্তা থেকে সরে আসে। এরপর ওকে কোল থেকে নামিয়ে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলল, শান্ত হও প্লিজ!
মায়া রাগান্বিত হয়ে বলল, না হব না!
-আচ্ছা কী করলে তোমার রাগ ভাঙবে বলো? আমায়ও চড় দেবে তুমি? চলো তবে মাঠে আবার।
-আমি বাসায় যেতে চাই হামজা।
-আমার রাগ করাটা স্বাভাবিক নয় বলো? বুঝলাম আজ তোমাদের কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। তাই বলে ডিজে’র তালে ঢ্যাং ঢ্যাং করে নাচতে হবে?ছেলেরা কেমন করে তাকাচ্ছিল না!
-হামজা আমার হাত ছাড়ো!
-আগে হাসো?
মায়া চ্যাচিয়ে বলল, এই অবস্থায় আমার মুখে হাসি আসবে? সবাই দেখেছে আমাকে মেরেছ তুমি।
আচমকা হামজা ওকে টানতে টানতে সেই মাঠে নিয়ে আসে। এরপর ও কানে ধরে উঠবস করতে থাকে। মায়া বলল, কী করছ এসব?
-সবাই দেখেছে তোমাকে মেরেছি, সবাই এটাও দেখুক যে আমি নিজেই নিজেকে শাস্তি দিচ্ছি।
ওর কাণ্ড দেখে হেসে ফেলে মায়া।
এমনটা নতুন নয়! হামজা প্রায়শই মায়ার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে। আবার কিছু একটা করে মায়ার রাগ গায়েব করে ফেলে। কিন্তু আজকে গায়ে হাত তোলার মতো জঘন্য কাজ করেছে হামজা। এরপরেও মায়া কত সহজে ওকে ক্ষমা করে দিলো! ভালোবাসা মানেই বুঝি এমন!
বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে মায়া। ঘুম থেকে উঠে মা এর ডাকে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। মায়া এখনো ঘুমিয়ে আছে দেখে মীনারা জান্নাত ওকে ডাকলেন। মায়া উঠে ফ্রেশ হয়ে আসলো। মীনারা জান্নাত ওর জন্যে চা নিয়ে এলেন। মেয়ের পাশে বসে বললেন, মাথাটা ধরেছে নিশ্চয়?
চা এর কাপটা হাতে নিয়ে মায়া বলল, হ্যাঁ মা। এখন চা প্রয়োজন ছিল।
চা শেষ হলে মেয়ের চুল আঁচড়ে দিলেন তিনি। এরপর বললেন, এখন হালকা লাগবে।
-তা তো লাগবেই। তোমার হাতে যে জাদু আছে!
তিনি হেসে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন। মায়া ফোন হাতে নিয়ে অনলাইন হতেই মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। ইনবক্সে অনেক গুলো মেসেজ জমা হয়ে আছে। কেউ পরিচিত আবার কেউ অপরিচিত। সবারই একটা কথা। কেন আজ ওকে মেরেছে হামজা?
ঘটনা ভুলে গিয়েছিল মায়া। মনে পড়তেই আবারও মনটা বিষণ্ণ হয়ে পড়ে। কারও মেসেজের রিপ্লাই না দিয়ে অফলাইন হয়ে যায় ও।
সাথে সাথেই ফোনের রিং বেজে উঠে। মায়ার বান্ধবী জেনীর ফোন দেখে রিসিভ করলো ও। জেনী বলল, এসব কী মায়া! আমি দেখিনি কিন্তু শুনেছি। হামজার এসব অভ্যাস কী পরিবর্তন হবে না?
-কী শুনেছিস?
-তোকে চড় মেরেছে তা। তুইও আমায় কিছু জানাসনি।
-ওর হঠাৎ রাগ উঠেছিল।
-আমাকে একদম কিছু শিখাতে আসবি না। সবই ওর হঠাৎ হয় তাইনা? আমাদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেও ওর কেন আসতে হবে? এসে প্রতিবারের মতো তামাশা করলো। গায়ে হাত তুলেছে এইবার। আঙ্কেল, আন্টি কখনো তোকে মারে? ওর সাহস কীভাবে হয় এটা করার?
মায়া কিছু বলতে পারে না। জেনী আরও কিছু কথা শুনিয়ে ফোনের লাইন কেটে দেয়।
মনটা খারাপ হয়ে যায় মায়ার। বারান্দায় এসে চেয়ারে বসে ও তাকিয়ে রইলো বাইরের দিকে। ভাবতে থাকে হামজার কথা।
শুরুটা হয়েছি তখন, যখন মায়া কেবল মাত্র নবম শ্রেনীর ছাত্রী। একই স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেনীর ছাত্রী হামজার বোন হেনা। ওর সঙ্গে একবার স্কুলে এসেছিল হামজা। তখনি ওর চোখ যায় মায়ার দিকে। কিছুদিন মায়ার পিছু নেয়। পাশাপাশি এলাকার মেয়ে ও। অথচ কখনো দেখেয়নি একে অপরকে! হামজার মায়াকে খুব বেশি ভালো লেগে যায়। ঠিক করে মায়াকে ও ওর মনের কথা জানাবে।
যেই ভাবা সেই কাজ। পরিচিত এক ছোটো বোনের সাহায্যে মায়ার ব্যাগের মাঝে একটি কার্ড ও চিরকুট রেখে দেয়। তাতে লেখে দেয় মনের কথা। কিন্তু মায়া তখনো হামজা কে জানেই না। তাই বিষয়টা এতটা গুরুত্ব ও দেয়না। কার্ড ও চিরকুট ছিড়ে ফেলে দেয় স্কুলের ডাস্টবিন এ। এভাবে কিছুদিন কেটে যায়। একদিন হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হয়৷ মায়া ছাতা না আনার কারণে স্কুলের বারান্দাতেই দাঁড়িয়ে রইলো। হঠাৎ কারো কণ্ঠস্বর শুনে দাঁড়ালো ও।
-আমার ছাতাটি নিয়ে যান।
পেছনে ফিরে মায়া বলল, প্রয়োজন নেই। ধন্যবাদ।
-নিয়ে যান। কাল এই সময়ে ফেরত দিয়েন আবার।
মায়ার বান্ধবী জেনী ছাতাটি নেয়। আগামীকাল ফিরিয়ে দেবে বলে মায়াকে নিয়ে হাঁটা শুরু করে৷ জেনী ও মায়ার বাসা পাশাপাশিই।
পরেরদিন একই সময়ে একই জায়গায় হামজাকে ছাতাটি দিতে আসে ওরা। জেনী ছাতা দিয়ে বলল, অপরিচিত কাউকে কেউ এমন সাহায্য করে! আপনি আসলেই বেশ ভালো মানুষ।
-মানুষ আমি ভালো৷ তবে স্বার্থের জন্যই করেছি এমন।
-কী স্বার্থ?
-আপনার বান্ধবীর ব্যাগে যে কার্ডটি ছিল ওটা আমারই দেওয়া।
এই বলে মৃদু হেসে প্রস্থান নেয় হামজা।
মায়া হা করে দাঁড়িয়ে রইলো। তবে মনের মাঝে অন্য রকম এক ভালো লাগা কাজ করে ওর। লম্বা, ফর্সা, বিড়াল চোখা হামজাকে যে ওর মনে ধরেছে। কিন্তু প্রেম-ভালোবাসা! বাসায় জানলে ওকে মেরেই ফেলবে। এই ভেবে সব ভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে ও। কিন্তু হামজা? সে কী এত সহজে মায়াকে ছেড়েছে? আঠার মতো লেগে ছিল মায়ার পেছনে। ওকে ভালোবাসে প্রমাণ করতে কত কী না করলো হামজা! বৃষ্টির মাঝেও মায়ার বাসার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা, শত শত চিঠি পাঠানো, ক্লাস শেষে মায়ার পিছু নিয়ে বাসা অবধি যাওয়া। শেষমেশ নিজের হাতটাও কেটেছিল৷ এভাবে প্রায় সাত মাস কেটে যায়। হামজার এসব পাগলামী দেখে একসময় ওর প্রস্তাবে রাজি হয় মায়াও। কারণ মায়াও ভালোবেসে ফেলে হামজাকে। কী এক অনুভূতি এই ভালোবাসা! পড়তে বসলেও ওর কথা মনে পড়ে, খেতে বসলেও তাই, এমন কী ঘুমোনার সময়েও ওকে নিয়েই স্বপ্ন দেখে! প্রেমে পড়ে হামজার এই পাগলামীর কারণ আরও বেশি উপলব্ধি করতে পারে মায়া।
সবই ঠিক ছিল। কিন্তু হামজা মায়ার উপরে সব বিষয় জোর করে চাপিয়ে দিতে চায়। মায়া কোনো আত্মীয় এর বাসায়ও যদি যায়, হামজার অনুমতি নিতে হত। আবার ওর বাসায় কোনো ছেলে কাজিন আসলে সারাক্ষণ ফোনে সময় দিতে হত। এসবের আরও অবনতি ঘটে মায়া কলেজে ভর্তি হওয়ার পর থেকে। কথায় কথায় মায়ার খুত ধরতে শুরু করে হামজা। ঠিকঠাক ক্লাসটাও ওকে করতে দেয় না। ক্লাস না করে ওকে সময় দিতে বলে। কোনো ছেলে বন্ধু মায়ার নেই। তবুও প্রয়োজনে কারো সাথে কথা বললে সেই খবরটাও হামজা পেয়ে যায়। এটা নিয়েও শুরু করে অশান্তি। মায়াকে বেশি ভালোবাসে বলে হামজা এমন করে। এটা বুঝে মায়া। কিন্তু আজ ও যেটা করলো এটা কী আদৌ ঠিক হলো! ভালোবাসার মানুষকে শুধু ভালোবাসা দিলেই হবে? সম্মান কী দিতে হবে না!
হামজার ফোন আসে। মায়া রাগের বশে অনেকক্ষণ রিসিভ করে না। হামজাও নাছোড়বান্দা। একের পর এক কল দিতেই থাকে। এক পর্যায়ে মায়া ফোন রিসিভ করে। হামজা বলল, কোথায় ছিলে?
-জাহান্নামে।
-এভাবে কথা বলছ যে?
-কিভাবে বলব? আজ তুমি আমার গায়ে হাত তুলেছ হামজা!
-সেটার না মিটমাট হয়ে গেল?
-এত সহজ তোমার কাছে সবকিছু?
-বুঝলাম! কান ভরিয়েছে কেউ তোমার?
-খারাপ কিছু বলেনি।
-আচ্ছা স্যরি! আর হবে না।
-প্রতিবার এমন বলো। কিন্তু আবারও কিছু না কিছু করো।
-সত্যি হবে না!
-তাই! সামনে আমার কাজিনের বিয়ে। তুমি শুনলেই ওখানে যেতেও নিষেধ করবে। কত বিয়ে অসুস্থতার কথা বলে বাদ দিয়েছি এভাবে। অথচ তুমি কিছু বাদ দাও? সবসময় যে বাইরে থাকো, বলতে পারবে রাস্তাঘাটে মেয়েদের কুনজরে দেখো না!
-তুমি মেয়ে। এটা মাথায় রাখতে হবে তোমার।
-আমি কী করছি এটা দেখার জন্য আমার পরিবার আছে। তবুও তুমি মাথা ঘামাও। কারণ তুমি প্রেমিক। তবে প্রেমিকা হয়ে আমি মাথা ঘামাব না?
মায়ার যে মেজাজ বিগড়ে গেছে হামজা বুঝেছে। তাই পরিস্থিতি সামাল দিতে বলল, আচ্ছা বাবা আচ্ছা! যাও তুমি কাজিনের বিয়েতে।
-যেতে বললেও কী হবে! সেইতো ফোনে আমার মাথাটাও খাবে নানান কথা বলে।
-বিরক্ত করব না। ইচ্ছে মতোন মজা করো। শুধু মাঝেমধ্যে আমার একটু খবর নিও। খুশি?
মায়া মৃদু হেসে বলল, হু। ঠিক আছে এইবার।
এই সহজে হামজা এই বিয়েতে যেতে দিতে রাজি হত না। আজ যে মায়ার গায়ে হাত তুলেছে ও। এটা ঠিক হয়নি। হামজা অনুতপ্ত। তাই বিয়ের বিষয়ে আর কোনো ঝামেলা ও করলো না। কিন্তু মনের মধ্যে ভয় ওর ঠিকই ঢুকেছে। মায়াকে নিয়ে যে ভয় কাজ করে ওর। ভীষণ ভালোবাসে মায়াকে। হারানোর ভয়টা অনেক বেশিই। তাইতো এমন পাগলামি করে বসে ও। এটা কেন বোঝে না মায়া!
দেখতে দেখতে মায়ার ফুফাতো ভাই এর বিয়ের অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেল। আজ গায়েহলুদে মায়া হলুদ রঙের একটি শাড়ি পরেছে। লম্বা চুল গুলো রেখেছে খোলা। কোনো মেকআপ ছাড়াই ওকে দেখতে ভীষণ মিষ্টি লাগছে। অবশ্য সুন্দরী মেয়েদের তালিকাতে মায়ার স্থান তো আছেই।
-ফারদিন বাবা! সারাক্ষণ পড়া পড়া করে জীবন পার করলে চলবে? আজ তোর চাচাতো ভাই এর গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান। অন্তত আজকের রাতটা এনজয় কর। জীবনে কোনো গায়েহলুদে মজা করেছিস তুই?
মা এর কথা শুনে ফারদিন বলল-
উহু মা! খেয়েছি, সবাইকে দেখেছি হয়েছে! এইবার আমায় যেতে দাও। এসব আমার ভালো লাগে না তুমি জানোই!
এই বলে ফারদিন অনুষ্ঠান ছেড়ে বেরুতে চায়। হঠাৎ মাঠের একপাশে চোখ গিয়ে আঁটকায় ওর একটি মেয়েকে দেখে। অন্যদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে কী মিষ্টি হাসি দিচ্ছে মেয়েটি! ফারদিন অপলকভাবে তাকিয়ে থাকে মেয়েটির দিকে।
-দাঁড়িয়ে পড়লি যে?
মেয়েটির দিকে তাকিয়েই ফারদিন বলল, ভাবছি আজ থেকেই যাই!
-সেই ভালো। থাক, সবার সাথে মজা কর।
ওর মা আরও কিছু বলে যাচ্ছে। সেসব ওর কানে যাচ্ছে না। ও কেবল মেয়েটির হাসির শব্দ শুনতে পাচ্ছে। কে এই মেয়ে! কখনো দেখেছে বলে মনে হচ্ছে না। কেউ একজন মেয়েটির উদ্দেশ্যে বলল, এই মায়া? আজ কিন্তু নাচতেই হবে তোমাকে। শুনেছি খুব ভালো নাচো তুমি!
মায়া! তবে মেয়েটির নাম মায়া! নামের মতোই দেখতে মেয়েটি। ঠিক যেন মায়াবতী!
.
চলবে