হারিয়ে_খুঁজে_ফিরি #পর্ব_২ #Saji_Afroz

0
1492

#হারিয়ে_খুঁজে_ফিরি
#পর্ব_২
#Saji_Afroz

ঝলমলে আলোক সজ্জায় সাজানো বিয়ে বাড়ির গেইটের পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে মায়া। ওর কানে ফোন। হামজা বেশ কয়েকবার ফোন করেছিল। মানুষজন থাকায় রিসিভ করতে পারেনি ও। তাই এখন আড়ালে এসে কল ব্যাক করে হামজাকে।
-হ্যালো মায়া?
-হু। কী খবর তোমার?
-তোমাকে মিস করছি। ভিডিও কল দিই?
-এই না! কেউ দেখে ফেলবে।
-পিক দেখে যে সরাসরি দেখতে ইচ্ছে করছে। আমি আসি? দূর থেকে দেখব।
-একদম না! আর তুমি না আজ আমায় এনজয় করতে বলেছ?
-তাই বলে ফোন দেব না?
-কম দেবে। এখন রাখছি। কেউ দেখলে খবর আছে আমার।

এই বলে ফোনের লাইন কাটে মায়া। হামজার রাগ হয়। যদি সেদিন চড়টা না দিতো, আজ এই অনুষ্ঠানে মায়াকে যেতে ও দিতোই না। এমনটা ভেবে সারারুমে পায়চারি করতে শুরু করে হামজা।

এদিকে মায়া ফিরে আসতেই সব কাজিনরা ওকে ঘিরে ধরে। সবাই ওকে জোর করতে শুরু করে নাচ করার জন্য। সবার জোরাজোরিতে স্টেজে উঠে মায়া। গানের তালে ও নাচতে শুরু করে। বিয়ে বাড়ির সব মানুষ একত্রিত হয় ওর নাচ দেখতে।
ফারদিন মুগ্ধ নয়নে মায়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। আর আপনমনে ভাবলো, মেয়েটি কেবল রূপবতী নয়! গুণবতীও বটে!

এদিকে মায়ার ফোনে আবারও হামজার কল আসে। একটাবার ওকে ভিডিও কলে দেখার জন্য হামজার মনটা ছটফট করছে। মায়ার ফোন রয়েছে ওর ছোটো বোন মীরার হাতে। হামজার নাম দেখে ও ফোন রিসিভ করলো। মীরা জানে, হামজা নামের কেউ মায়ার ক্লাসের বন্ধু। মায়াই মিথ্যে বলেছিল ওকে। যাতে বারবার হামজার ফোন দেখলে কেউ সন্দেহ না করে।

মীরা ফোন রিসিভ করে বলল, হামজা ভাইয়া আমি মীরা। একটু পরে ফোন দিয়েন।

হামজা হালকা কেশে বলল, তোমার আপু কোথায়?
-ও তো স্টেজে! নাচছে।

একথা শুনেই ফোনের লাইন কেটে দেয় হামজা। চোখে ভাসতে থাকে নানান দৃশ্য। মায়া নাচছে, ওর নাচ দেখে ছেলেরা নানা মন্তব্য করছে। কেউ কেউ ওর সঙ্গে নাচার জন্য স্টেজে উঠে পড়েছে। মায়ার হাত ধরে ও কোমরে হাত রেখে ওরা নেচে চলেছে। এসব ভেবে হামজা অস্থির হয়ে উঠে। কেন মায়ার নাচতে হবে! যেখানে সেখানে না নাচলেই কী নয়!

নাচ শেষে সবাই করতালি দিয়ে উঠে। মায়ার প্রশংসায় চারদিক মুখোরিত হয়ে উঠে। কেউ কেউ ওর হাতে সম্মানী হিসেবে টাকা তুলে দেয়। মায়া নিচে নেমে আসে। নাচ করার কারণে ঘেমে যায় ও। তাই লম্বা চুলগুলোতে খোপা করতে শুরু করে। হঠাৎ কারো কন্ঠ শুনে পেছনে ফিরে তাকায় ও।

-আপনি খুব ভালো নাচেন। নাচ শেখা হয়?

ফারদিনকে মায়া চেনে না। তাই ও প্রথমেই বলল, আপনাকে চিনলাম না?
-আমি মীনারের চাচাতো ভাই।
-মীনার ভাইয়ার চাচাতো ভাই! কখনো দেখিনি।
-আসলে ওভাবে কোনো প্রোগ্রামে আসা হয় না আমার। তাই হয়তো দেখা হয়নি কখনো।
-ও আচ্ছা!
-বললেন না যে? নাচ শেখেন?
-শিখি। তবে টিভি দেখে।

এই বলে মায়া চলে যেতে চায়। ফারদিন ওকে থামিয়ে বলল, খোলা চুলেই ভালো লাগছিল।

মায়া আর কিছু বলে না। হেসে চলে যায় ও। মীরা এসে ওর পথ আটকে বলল, হামজা ভাইয়া ফোন করেছিল।
মায়া কল ব্যাক করতে যাবে ঠিক তখনই অন্যান্য কাজিনরা চলে আসে। তাই মায়া আর হামজাকে ফোন দিতে পারে না। ও সবার সঙ্গে আড্ডায় যোগ দেয়। ফারদিনও আসে। চেয়ার টেনে ওদের পাশে বসতেই একজন বলল, ফারদিন তুমি! তুমি কীভাবে আজ থাকলে?
ফারদিন হেসে বলল, বুয়েটে চান্স পেয়ে গেলাম। ঢাকা চলে যাব কিছুদিন পর। তাই ভাবলাম এই বিয়েটাতে এনজয় করি।
-খুব ভালো করেছ। আমি বেশ অবাক হলাম তোমাকে দেখে।

আরেকজন দুষ্টুমির ছলে বলল, আসলেই এইজন্যই থেকে গেছেন ফারদিন ভাই? নাকি মনে ধরেছে কাউকে?

মায়ার দিকে আঁড়চোখে তাকিয়ে ফারদিন বলল, ভাবতে পারো এটাও।

সবাই অবাক হয়ে মেয়েটির নাম জানতে চায়। ফারদিন হেসে মজা করেছে বলে বিষয়টি উড়িয়ে দেয়।
এদিকে বারবার মায়ার ফোনে হামজার কল আসতে থাকে। মায়া এক পর্যায়ে ওকে মেসেজ পাঠায়-
কী হলো? আশেপাশে অনেক শব্দ। তাছাড়া আমার কাজিনরাও আছে এখানে। ফোন রিসিভ করা যাবে না।

ওপাশ থেকে হামজার আসা মেসেজ দেখে মায়ার মুখে অন্ধকার নেমে আসলো।

-কীভাবে যাবে! তুই রঙ ঢং করবি কীভাবে আমার সাথে কথা বলতে থাকলে?

মুখ মলীন করে মায়া লিখলো-
আবার কী হলো?
-নাচছিস কেন তুই?
-তুমিই বলেছ নিজের মতোন মজা করতে।
-তাই বলে কোমর দুলিয়ে নাচবি? এত শখ অঙ্গভঙ্গি দেখানোর সবাইকে? আমার সঙ্গে রুমডেটে রাজি হতে পারিস না। অথচ কোমর দুলিয়ে দুলিয়ে অন্য ছেলেদের দেখাতে পারিস।

মেসেজটি দেখে মায়ার ভীষণ রাগ হয়। ও নিজের ফোনটাই বন্ধ করে দেয়। রুমে যাওয়া আর নাচা কী এক হলো! নাচ ওর শখ। সেই ছোট্ট বেলা থেকে স্কুলের প্রতিযোগিতাসহ নানা প্রতিযোগিতায় নাচ এ প্রথম স্থান অধিকার করতো ও৷ কলেজে এসে হামজা না করার কারণে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেনি৷ পারিবারিক অনুষ্ঠানে সবার আবদার রাখতে নেচেছে। এমন কী অন্যায় করে ফেলেছে ও!

এতক্ষণ বেশ হাসিখুশিই ছিল মায়া। হঠাৎ ওর মুখ মলীন হলো কেন! মায়ার মুখে হাসি নেই দেখে ফারদিনের কেমন যেন অস্থির লাগে। ওই মুখে যে শুধু হাসিই মানায়!

-আমারও না বুয়েটে পড়ার খুব ইচ্ছে। মায়া আপু তো কিছুতেই ট্রাই করলো না। কিন্তু আমি করব।

একথা শুনে মীরার দিকে তাকালো ফারদিন। ও বলল, তুমি মীনারের কী হও?
-মামাতো বোন।
-মায়া তোমার বোন?
-হু।

সুযোগটা কাজে লাগাবে ঠিক করে ফারদিন। ও বলল, তোমার কোনো সাহায্যের প্রয়োজন হলে আমায় নক দিতে পারো।
-সত্যি ভাইয়া?
-কেন নয়! এখন থেকেই প্রিপেয়ার্ড হয়ে নাও। ইনশাআল্লাহ বুয়েটে চান্স হবেই তোমার।
-এমন কাউকে এখানে পাব আমি ভাবিইনি!
-তোমার ফোন নাম্বার দাও। মাঝেমধ্যে খবর নেব।তোমাকে গাইড করব আমি।
-আমি তো ফোন ইউজ করি না। আপুরটা দিই?
-হু দাও?

ফারদিনকে মায়ার ফোন নাম্বার দিলো মীরা। এদিকে মায়া গম্ভীরমুখে বসে থাকায় ওদের কথোপকথন শোনেনি। নতুবা ওর ফোন নাম্বার ফারদিনকে দিতে নিষেধ করতো মীরাকে।

বিছানায় শুয়ে আছে হামজা। অথচ চোখে ঘুম নেই ওর। চোখ বন্ধ করলেই অদ্ভুত এক দৃশ্য ওর চোখে ভেসে আসছে। তা হলো, মায়া অন্য ছেলেদের সঙ্গে খিলখিল করে হেসে চলেছে। ফোন নাম্বারও আদান প্রদানের করেছে অনেকের সঙ্গে।
এসব ভেবে অস্থির হয়ে উঠে হামজা। এমন কিছু কী আসলেই করবে মায়া? যদি করে ওকে খুন করে ফেলবে হামজা। হামজার হাতে মায়ার মৃত্যু হতে পারে, তবুও অন্য কারো ও হতে পারে না! কিছুতেই না!

সকাল সকাল ঘুম ভাঙতেই মায়াকে খুঁজে চলেছে ফারদিন। একটাবার ওকে না দেখলে যেন মনের অস্থিরতা কমবে না। খুঁজতে খুঁজতে মায়াকে পেয়ে যায় ও। ডাইনিং রুমের পাশে লাগানো রুমটাতেই মায়া রয়েছে। বিয়ে বাড়ি বলে দরজা আটকানো হয়নি। ঝাকভর্তি মেয়েদের মাঝ থেকে আড়মোড়া ভেঙে শোয়া থেকে উঠে বসছে মায়া। এমন সুন্দর একটি দৃশ্য সকাল সকাল দেখতে পাবে ভাবেনি ফারদিন। ও চেয়ার টেনে মায়াকে দেখতে পারে মতোই বসেছে। মায়া নিজের চুল গুলো ক্লিপ দিয়ে বেধে নেয়। এরপর উঠে ব্যাগ থেকে ব্রাশ বের করে। ব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে বেরিয়ে আসে ও। ডাইনিং রুমে থাকা ওয়াশরুমটায় প্রবেশ করে। ফ্রেশ হয়ে আসতেই মায়ার ফুফু বলল, মায়া তুমিও নাস্তা করে নাও।

ফারদিনকে দেখে মায়া বলল, পরে করি?
-যারা উঠে গেছ তারা করে ফেলো। বসো বসো।

মায়া ভেতরে গিয়ে ব্রাশ রেখে, মুখটা মুছে আসে। ভাগ্যক্রমে ফারদিনের পাশের চেয়ারটাই খালি রয়েছে।
তা টেনে বসলো মায়া। ফারদিন ওর দিকে একটি খালি প্লেট বাড়িয়ে দেয়। এরপর পরোটার বাটিটি এগিয়ে দিয়ে বলল, চলবে পরোটা? নাকি পাউরুটি দেব?
-আমি নিচ্ছি। আপনি ব্যস্ত হবেন না। বরং আপনাকে কিছু দেব কিনা বলুন?
-আপনার পাশে থাকা পানির জগটি দিন।
-নিশ্চয়।

সবাই একসঙ্গে নাস্তা সেরে নেয়। দুপুরেই বিয়ে। তাই খানিকবাদে ফুফু সব মেয়েদের তাড়া দেয় এখন থেকেই তৈরী হওয়া শুরু করতে৷ কারণ মেয়েরা তৈরী হতে অনেক বেশি সময় নেয়। একথা শুনে সবাই হুড়োহুড়ি করলেও মায়া ড্রয়িংরুমে এসে বসলো। ফারদিন ওর সামনে থাকায় সোফায় বসতে বসতে বলল, কী ব্যাপার? আপনি যাচ্ছেন না তৈরী হতে?
-আমার ওতো বেশি সময় এর প্রয়োজন নেই।
-সুন্দরীদের অবশ্য সাজতে হয় না।
-আমার কাজিনরা সবাই সুন্দরী। সাজটা কেবল শখ। আমার সেই শখ নেই বললেই চলে।
-আপনার শখ কী? নাচ?
-প্রশ্ন নিজে করে উত্তরও দিয়ে দিলেন!
-মনে হলো এটাই। নাচ নিয়ে ফিউচার প্লান কী?
-সবার শখ পূরণ হয় না। অনেক সময় মাটি চাপা দিতে হয়। আমারটাও হবে না। তাই নাচ নিয়ে ফিউচার কোনো প্লান নেই।
-ফ্যামিলি চায় না?
-আছে কোনো কারণ।

এই বলে উঠে পড়ে মায়া।

ফারদিন বলল-
আমার মতে সবার আগে নিজেকে প্রায়োরিটি দেওয়া উচিত। নিজের শখই যদি পূরণ করতে না পারা যায় জীবনে, তবে সেই জীবন ব্যর্থ! জীবন তো একটাই। তাই না?

মায়া কিছু বলতে পারে না। ভালোবাসার কাছে যে নিজের শখ টাকেও বিসর্জন দিতে হচ্ছে ওকে!

কমিউনিটি সেন্টারের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বেরুচ্ছে সবাই। কাজিনরা সবাই এক গাড়িতে বসেছে। যদিও বরের গাড়িতে ফারদিনের বসার কথা ছিল। শুধুমাত্র মায়ার জন্যে ও এই গাড়িতে ফিরে আসে। অন্যান্য কাজিনরা ফারদিনের এমন আচরণে বেশ অবাক হচ্ছে। কারণ ও বরাবরই চুপচাপ স্বভাবের ছেলে। অন্যদের সাথে মিশে কম। সেই ছেলেই কিনা সারাক্ষণ ওদের পাশে ঘুরঘুর করছে!
গাড়ি চলতে শুরু করে।
ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে ফারদিন। ওর পেছনে জানালার ধারে বসেছে মায়া। ও আজ সাদা রঙের একটি গাউন পরেছে। বাতাস লাগাতে মায়ার চুলগুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। ফারদিনের খুব করে ইচ্ছে হলো, ওর চুল গুলো হাত দিয়ে ঠিক করে দিতে।
নিজের ইচ্ছে টাকে দমিয়ে রেখে গাড়ির আয়নাতেই মায়াকে আড়চোখে দেখতে থাকে ফারদিন।

খানিকবাদে কমিউনিটি সেন্টারে পৌঁছায় ওরা। হাসিমুখে মায়া গাড়ি থেকে নামলেও গেইটের দিকে চোখ পড়তেই মুখে অন্ধকার নেমে এল ওর। ওখানে যে দাঁড়িয়ে রয়েছে হামজা। সবার সামনে কী তামাশা করবে ও! অসম্ভব কিছু নয়। এই ভেবে ভয়ে কাঁপতে শুরু করে মায়া।
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here