পরী পর্বঃ৭ম
লেখাঃনীলাদ্রিকা নীলা
.
হাটতে হাটতে সায়েমের মনে হলো কেউ তার পিছনে আসছে। কিন্তু পিছনে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেল না। হঠাৎ মাথাটা খুব ভার মনে হতে থাকে। মনে হচ্ছে কেউ তাকে জঙ্গলের দিকে টানছে। মনের জোর নিয়ে তবুও হাটতে থাকলো। সামনে একদল ছিনতাইকারী এসে দাঁড়ালো। সায়েমের কাছে ফোন টাকা পয়সা যা আছে সব চাইলো। সায়েমের মাথাটা ঢলছে। হঠাৎ করেই তাদের একজনকে এক হাতে তুলে আছাড় দিতেই বাকিরা ভয়ে পালিয়ে যায়। মাথায় খুব যন্ত্রনা হচ্ছে। কেউ কি তাকে নিয়ন্ত্রণ করছে! দুই হাতে মাথাটা ধরে রাস্তায় বসে পড়লো সায়েম। কি হচ্ছে এসব। পিচ ঢালা রাস্তায় কারো ছায়া দেখা গেল। ছায়াটি আস্তে আস্তে এগিয়ে এসে সায়েমের কাছে এসে দাঁড়ায়। সায়েম এবার সেদিকে লক্ষ্য করতেই ছায়াটি মিলিয়ে গেল। উঠে দাঁড়ালো সায়েম। এবার দিল এক দৌড়। তাকে বাড়ি পৌঁছাতেই হবে। সেটা যে করেই হোক।
.
কলিংবেলের আওয়াজ শুনে প্রত্যাশা নিচে এসে দরজা খুলে দিলো। দরজা খুলতেই সায়েমের অবস্থাটা দেখে সে আর রাগ করে থাকতে পারলো না। সায়েম ঘেমে গিয়ে হাফাচ্ছে। ঘন ঘন দম ছাড়ছে। প্রত্যাশা সায়েমকে ধরে ভিতরে নিয়ে আসলো। ভিতরে আসতেই সায়েম অচেতন হয়ে প্রত্যাশার গায়ের ওপর পরে গেল৷
– সায়েম? সায়েম কি হলো তোমার!
সায়েমের শরীর গরম হয়ে আছে। প্রত্যাশা আর রেনু মিলে সায়েমকে ধরে উপরে নিয়ে গিয়ে বেড রুমে বিছানায় শুয়ে দিল। কিছুক্ষণ পর সায়েমের চেতনা ফিরে আসলে সায়েম রুমের জিনিসপত্র ভাঙতে শুরু করে। সায়েমের আচরণে ভয় পেয়ে যায় প্রত্যাশা। এসব দেখে সায়েমের সাথে ঝগড়া করার বিষয়টা মাথা থেকেই বেড়িয়ে গেল তার।তাড়াতাড়ি ফোন করে হুজুরকে বাড়িতে আসতে বললো। হুজুর এসে দোয়া পড়তে শুরু করলেন। আজকে উনি উনার একজন সঙ্গীকে সাথে করে এনেছেন। এসব বিষয়ে তিনি খুব ভালো বোঝেন। অনেক জ্বীন পরী তাড়িয়েছেন।
.
হুজুরের সঙ্গীটি সায়েমকে দেখে বলে উঠলেন, মনে হয় আজ সারাদিন ওর সাথে ছিল এবং এখনো ছাড়ে নি। বরং নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করতেই ছেলেটি এমন পাগলামো করতে শুরু করে।
হুজুর সাহেব দোয়া পড়ছেন। রুমের মধ্যে হঠাৎ অত্যাধিক বাতাস এসে ঝড় ওঠার মতো হয়ে গেল। আর তারপরই একটি মেয়ের কন্ঠস্বর শোনা যায়।
—-আমি যাব না। তোমরা আমাকে তাড়াতে পারবে না। আজ সে আমায় অপমান করেছে। আমি কাউকে ছাড়বো না।
হুজুর সাহেব বললেন, তুই ভালোয় ভালোয় চলে যা। এভাবে ইনসানদের বিরক্ত করলে তোর কি হাল হবে তুই ভাবতেও পারছিস না। যা চলে যা।
—– আমি আমার প্রিয়তমকে ছেড়ে যাব না।
.
এসব শুনে খুবই ভয় পেয়ে গেল প্রত্যাশা। হুজুর সাহেব দোয়া পড়ে রুমের মধ্য পানি ছেটাতে লাগলেন। আর সাথে সাথে সেই অদৃশ্য কন্ঠস্বরের আর্তনাতের চিৎকার শোনা যায়। কিছুক্ষণ পর রুমের ভিতর ওঠা ঝড় থেমে গেল। পরিবেশটাও ঠান্ডা হলো। সায়েম অচেতন হয়ে বিছানায় পরে আছে। হুজুরের সাথে আসা সঙ্গীটি সায়েমের বাহুতে একটি তাবিজ বেধে দিলেন।
হুজুর সাহেব বললেন,তোমার স্বামীর দিকে তার চোখ পরেছে৷ তাই বার বার আসছে। ওকে পুরোপুরি তাড়ানোর জন্য বড় কোনো তান্ত্রিকের সাহায্য নিতে হবে৷ এখন এই তাবিজটা দেওয়া হলো এতে সে দূরে থাকবে।
.
হুজুর সাহেব চলে যাওয়ার পর সায়েমের চেতনা ফিরে আসে। প্রত্যাশা সায়েমকে রাতের খাবার খাওয়ানোর সময় সায়েম বলে উঠল, দুপুরে তুমি খুব রাগ করেছিলে তাই না? সরি জান আমি ইচ্ছে করে কিছু করিনি। বিলিভ মি আমি ইচ্ছে করে করিনি৷ তোমায় ছাড়া আমি আর কিছু ভাবতে পারিনা জান৷
– এখন এসব থাক। খেয়ে নেও জলদি।
– আমাকেই শুধু দিচ্ছো। তুমি খাবে না? দুপুরেও তো খাও নি মনে হচ্ছে। তোমায় যে খেতে বললাম। খাও নি কেন।
– তুমি কি করে বুঝলে আমি খাই নি।
– তোমার মুখ শুকিয়ে গেছে যে। আমার ওপর অভিমান করে খাবারের ওপর রাগ দেখিয়েছো।আর বাসায় ঢোকার সময় চোখ দুটোও তো ফোলা দেখেছিলাম তখন। নিশ্চয়ই কেঁদেছো।
– সায়েম আমি তোমাকে কারো সাথে সহ্য করতে পারি না৷
– আমি শুধুই তোমার। এসব উল্টোপাল্টা আর ভাববে না৷
প্লেট থেকে খাবার নিয়ে সায়েম প্রত্যাশার মুখে দিয়ে দিলো। আবেগে প্রত্যাশার চোখে পানি এসে যায়। এই মানুষটা তাকে এতো ভালোবাসে। আর সে এভাবে তাকে সন্দেহ করলো। সায়েম সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ঘটে যাওয়া সকল ঘটনা প্রত্যাশাকে খুলে বললো। সব কিছু শোনার পর প্রত্যাশার চোখ আর পানি আটকে রাখতে পারলো না। টপ টপ করে গাল বেয়ে চোখের পানি পরতে থাকলো ।
– এই পাগলী!কি হয়েছে। কাঁদছো কেন?
প্রত্যাশা কেঁদে কেঁদে সায়েমের দিকে তাকিয়ে বলছে, আমি খুব খারাপ সায়েম!আমি তোমাকে সন্দেহ করেছি। খারাপ খারাপ কথা বলেছি। তুমি সারাদিন ঝামেলায় ছিলে আর তোমার ওপর যে ধকল গেল তবুও আমি তোমার সাথে এমন করলাম।
সায়েম প্রত্যাশার চোখের পানি মুছে দিয়ে জরিয়ে ধরে বললো, এভাবে বলতে হয় না পাগলী। তুমিই তো আমার সব। প্রত্যাশা সায়েমকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। সায়েম প্রত্যাশার ঠোঁটে নিজের ঠোঁট রেখে গভীরভাবে অনেকক্ষণ চুমু খেল। তারপর শুরু হয় দুজনের একে অপরকে আদর করার পালা।
.
সকালবেলা এই এলাকার স্থানীয় লোকজন পাশের জঙ্গলের কিছু অংশের বিধস্ত অবস্থা দেখতে পায়। কিছু গাছের ডালপালা ভাঙা। কিছু জায়গা মনে হচ্ছে আগুনে পুড়ে গেছে। আর কিছু জায়গায় মনে হচ্ছে সেখানটায় ঝড় বয়ে গেছে। কিন্তু কাল রাতে তো কোনো ঝড় আসেনি। এসব কিভাবে হলো। আর আগুনই বা কিভাবে লাগলো। কে লাগালো। পুলিশ এসে বিষয় গুলো খুটিয়ে দেখছে। মাটিতে বিভিন্ন জায়গায় আঁচরের দাগ। এগুলো কিসের তা বোঝা যাচ্ছে না।
অফিসে গিয়ে গতকাল ভাঙচুরের ঘটনার জন্য উপর লেভেল থেকে অনেক কথা শুনলো সায়েম। মিস অরি সায়েমের চেম্বারে আসলে সায়েম আজ প্রচন্ড অপমান করে তাকে চেম্বার থেকে বের করে দেয়। বের হওয়ার সময় সে বার বার সায়েমের হাতের বাহুর দিকে তাকাচ্ছিলো। যেখানটায় কাল রাতে তাকে তাবিজ বেধে দেওয়া হয়েছিলো।
.
কাল বেখালে সায়েম অনেক গুলো ফাইল উল্টোপাল্টা করে ফেলেছে। আজ সেগুলো খুঁজে পাচ্ছে না। রাগে সায়েম গলা থেকে টাই টেনে ছিড়ে ফেললো। টেবিলের ওপর থাকা ল্যাপটপটা ফ্লোরে ছুড়ে ফেলে দিলো। অফিসের লোকজন এসে সায়েমের এসব কান্ডকারখানা দেখছে। সায়েম ভাঙচুর শুরু করে দিয়েছে। পুরো অফিসের ল্যাপটপ কম্পিউটার ভেঙে লন্ডভন্ড করে দিচ্ছে। একজন বলে উঠল, স্যার আপনি এরকম করছেন কেন!
সায়েমের মাথা ক্রমেই বিগড়ে যাচ্ছে। রাগে সায়েম এক কর্মচারীর গলা টিপে ধরলো। সবাই মিলে সায়েমকে ধরে আটকায়। তবুও সায়েমের শক্তির সাথে কেউ পারছেনা। সায়েম ওদের মেরে আহত করে দিচ্ছে। কিছুক্ষন পর সায়েম একটু শান্ত হয়। এতক্ষন কিভাবে কি হলো সে কিছুই বুঝতে পারছেনা। কেন সে এভাবে এসব করলো। মাথাটা পুরোটই খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। রাগে সায়েম এবার জোরে জোরে চিল্লাতে থাকে। অফিসের সব কর্মচারীরা ভয়ে জরসর হয়ে আছে। ডাক্তার আর পুলিশে খবর দেয়া হয়েছে। ডাক্তার এসে সায়েমকে দেখে বললেন,সব তো নরমালই আছে! আপনি এরকম করছেন কেন। আপনার সমস্যা কি?
সায়েম এখন শান্ত হয়ে বসে আছে। সে অফিসের কয়েকজনকে মেরে আহত করে ফেলেছে। তাদের হসপিটালে পাঠানো হয়েছে। আর মিস অরি নাকি তার চেম্বার থেকে গায়েব হয়ে গেছেন। তাকে দুইজন কর্মচারী চেম্বারের ভিতরে ঢুকতে দেখেছে কিন্তু তারপর তাকে আর বের হতে দেখা যায় নি। ভিতরে গিয়ে দেখা যায় কেউ নেই। চেম্বার ফাকা। উনি কাউকে কিছু না জানিয়ে কোথায় চলে গেলেন কেউ বলতে পারছে না। এদিকে সায়েমের বিরুদ্ধে অফিসের লোকজনেরা অভিযোগ করতে শুরু করে দিয়েছে৷ তারা তাদের জীবন নিয়ে শংকায় রয়েছে ৷ সায়েম যখন তখন যে কারো ওপর হামলা করতে পারে। আতঙ্ক ছড়িয়ে গেছে অফিসে। সায়েম কোম্পানির বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ন ফাইল ছিড়ে ফেলেছে। আবার কিছু হারিয়েও ফেলেছে। কোম্পানির গুরুত্বপূর্ণ পোস্টে কাজ করতো সায়েম। তাই বেশিরভাগ জরুরি সব দরকারি কাগজপত্র তার কাছেই ছিলো। তাদের ধারণা সায়েমের মানসিক সমস্যা হয়েছে। সায়েম পাগল হয়ে যাচ্ছে।
.
সন্ধ্যার দিকে সায়েম বাড়ি ফিরলো। এসেই বিষন্ন মুখে শোফায় হেলান দিয়ে বসে রইলো। প্রত্যাশা পানির গ্লাস নিয়ে এগিয়ে আসতেই খেয়াল করলো সায়েমের হাতের বিভিন্ন জায়গায় কেটে গেছে।
– এসব কিভাবে হলো?
প্রত্যাশার কথা শুনে সায়েম এবার শোফা থেকে মাথা তুলে বলে উঠল, তার থেকেও বড় কথা আমার চাকুরীটা চলে গেছে প্রত্যাশা! এতোদিনের পরিশ্রম করে পাওয়া চাকুরীটা আমার চলে গেল। আমার সব শেষ!
সায়েমের কথায় বড় ধরনের ঢাক্কা খেল প্রত্যাশা।
– এসব কি বলছো!
– হ্যাঁ। আমার মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে প্রত্যাশা। আমি আর সুস্থ মানুষ নই।
– আমি জানি কার জন্য এসব হয়েছে!
সায়েম এবার রেগে বললো, তাই! কোথায় সে। আজ তার সাথে আমার বোঝাপড়া হবে। হতাশায় সায়েম খুবই ভেঙে পরেছে। রাগে রুমের জিনিসপত্র আবার ভাঙতে শুরু করে দিলো। প্রত্যাশা হুজুরকে খবর দেওয়ার পর উনি এসে দেখলেন,সায়েম খুবই উত্তেজিত হয়ে রয়েছে। তারপর দোয়া পড়ে সায়েমের গায়ে ফুঁ দিয়ে দিলেন। আর বললেন, শান্ত হও। পাগলামো করো না।
প্রত্যাশা হুজুরের দিকে তাকিয়ে বললো, এখন কি বুঝতে পারছেন। সে কি আমাদের কোনো ক্ষতি করতে চাইছে?
– এই তাবিজের জন্যই সে কাছে আসতে পারছে না। তবে চেষ্টা চালাচ্ছে। তোমরা কয়েকদিনের জন্য অন্য কোথাও গিয়ে থেকো।
সায়েম বললো, আপনি জানেন আজ আমার চাকুরীটা চলে গেছে।
– এখন এসব চিন্তা মাথায় নিও না। আপাতত বিশ্রাম নেও।
প্রত্যাশা বললো, কিন্তু আপনি বলেছিলেন তান্ত্রিকের কথা!
– সে লোকালয়ের আড়ালে থাকে। তার কাছে খবর পাঠাতে হবে। আমি তার সাথে কথা বলে নেব। তোমরা সাবধানে থেকো।
.
হুজুর সাহেব চলে যাওয়ার পর সায়েম ফোন করে বাড়িতে চাকুরী চলে যাওয়ার সংবাদটা দিল। সব শুনে সায়েমের বাবা বাড়ি চলে আসতে বললেন। রেনুকে সকালবেলা ওর বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হয়। তারপর বেলা গড়াতেই সায়েম প্রত্যাশাকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়লো। স্টেশনে গিয়ে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতেই ট্রেন চলে এলো। ট্রেনে ওঠার পর ঝিকঝিক গতিতে ট্রেন চলতে থাকে। সায়েমের মন খারাপ। তেমন একটা কথা বলছে না। এভাবে তার ক্যারিয়ারটা শেষ হয়ে যাবে সে ভাবতেই পারেনি৷ প্রত্যাশা সায়েমের কাধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পরে।
বিকালের মধ্যেই পৌঁছে গেল। ট্রেন থেকে নেমে স্টেশন থেকে ভ্যান নিয়ে ওটাতে উঠে পড়লো। ভ্যান আকাঁবাকা মেঠো পথ দিয়ে চলছে৷ রাস্তার দুইপাশে সোনালী ধানের ওপর বাতাসের ঢেউ খেলে যাচ্ছে। সূর্যটা আস্তে আস্তে হেলে পড়ছে পশ্চিম দিকে। প্রত্যাশা সায়েমের হাতটা ধরে আছে। সায়েমের মন এখন আগের থেকে কিছুটা ভালো। এই মাঠ ঘাট নদী তাকে আগে থেকেই টানে। গভীর রাতে খোলা মাঠে ঘাসের ওপর শুয়ে আকাশের চাঁদ তারা দেখা তার বহুদিনের অভ্যাস।
.
চলবে….