রংধনুতে_প্রেমের_বাড়ি #পর্ব_১৪ #ফারজানা_মুমু

0
480

#রংধনুতে_প্রেমের_বাড়ি
#পর্ব_১৪
#ফারজানা_মুমু

জয়-বিজয় দোকানে প্রবেশ করতেই দোকানদার লোকটি প্রশ্ন করে, স্যার দেখুন এই মেয়ে চারশো টাকায় শাড়ি কিনতে আসছে। বলেছি কম হবে না কিন্তু শুনছে না। এখন বলে মামলা করবে। মা’থা খারাপ মনে হয়।

জয় রা’গী দৃষ্টিতে তাকালো। ধ’মক দিয়ে বলল, মেয়ে মেয়ে কাকে বলছো? সে তোমাদের ভাবি। আমার হবু বউ। বুঝে-শুনে কথা বলবে পরেরবার।

দোকানদার ছেলেটা মাথা নিচু করে ফেলল। বলল, সরি স্যার আমি জানতাম না ওনি আমাদের ভাবি ।
-” এখন যাও ওনাদের জন্য কফি নিয়ে আসো।

লোকটি চলে গেল। চৈতি সহ বাকি দু’জন অবাক হলো। শান্তা কৌতুহল চেপে রাখতে না পেরে বলেই ফেলল, দোকানটা তোমাদের?

দু-ভাই মাথা নাড়িয়ে জবাব দিল, হুম আমাদের। তুমি তো জানো আমরা বিজনেস করি কিন্তু কিসের বিজনেস জানতে না। মার্কেটের তিনটি তলায় আমাদের বুটিকস,শাড়ি, সুজস, ব্র্যান্ডের কসমেটিক অ্যান্ড ব্যাগের কালেকশন আছে। পুরোটা এরিয়াই আমাদের।

শান্তা লজ্জা পেল। হুট করেই মাথা গরম হয়ে যাওয়ায় বাজে কাজ করে ফেলেছে। লজ্জায় এখন কান কাঁ’টা যাচ্ছে তাঁর। ছি এখন সবাই কী ভাববে? বলবে মেয়েটা ভালো নয় তারছিরা। চোখের কোনায় অশ্রু জমলো। রাগ হলো নিজের প্রতি। জয় নিশ্চয় এখন তাকে ছ্যাঁচড়া টাইপ মেয়ে ভাববে।

হঠাৎই শান্তার চোখের অশ্রু চৈতির নজরে পড়ল। মুখে মুচকি হাঁসি ফুটিয়ে জড়িয়ে ধরে বলল, আরেহ বোকা কান্না করছিস কেন? জয় ভাইয়া জানে তুই কেমন।

জয় বলল, এই যে ঝাঁসির রাণী একদম কান্না করবে না। তুমি এমন বলেই তো আমি তোমায় ভালোবেসেছি। যদি এইরকম না হতে তাহলে তোমার প্রেমে জয় পড়ত না। সো কান্না থামাও। তুমি তো প্রায় বলতে একদিন আমার টাকায় প্রচুর শপিং করবে, আমায় ফকির বানাবে। আজ নেও সুযোগ। যত ইচ্ছে কিনাকাটা করো। সুবর্ণ সুযোগ কিন্তু বারবার আসে না।

হেসে দিল শান্তা তারপর জয়কে ছেড়ে বিজয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, দুলাভাই চুপচাপ আছে কেন? ভয় পাচ্ছে নাকি?

বিজয় নিজের চুলে হাত বুলিয়ে বলল, ভয় পাচ্ছি না দুষ্টু শালীকা। আমার চোখ তো তোমার বোকা বোনের দিকে। অবুঝ চোখ জোড়া কিছুতেই দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরাতে পারছে না। বুকের ভিতর গান বাজছে, কি যাদু করিলা পিরীতি শিখাইলা
থাকিতে পারিনা ঘরেতে প্রান সজনী
থাকিতে পারিনা ঘরেতে
কি মন্ত্র পড়িলা ভাবেতে মজাইলা
থাকিতে পারিনা ঘরেতে প্রান সজনী
থাকিতে পারিনা ঘরেতে।

বোকা কান্তা লজ্জায় লাল হয়ে আছে। যেন এক্ষুনি রক্ত কণিকারা ছিটকে পড়বে। চৈতি মুচকি হেসে নাক টেনে বলল, এই যে বিয়ের বর-কনেরা রোমাঞ্চের দুনিয়া থেকে বের হয়ে কিনাকাটার দুনিয়াতে প্রবেশ করুন। আমার কিন্তু তাড়াতাড়ি বাসায় যেতে হবে।

চৈতির কথায় চারজন একসাথে বলে উঠল, অক্ষরের সাথে প্রেম করার জন্য? সমস্যা নেই সময় মত আপনাকে বরের কাছে যেতে দেওয়া হবে। নো চিন্তা।

ওদের লজ্জায় ফেলতে গিয়ে নিজেই ফেঁসে গেল চৈতি। লজ্জায় মুখ লাল। একেই হয়তো বলে পরের জন্য গ’র্ত খুঁ’ড়লে সেই করতে নিজেকে পড়তে হয়।

******

সময় চলল তাঁর গতিতে। শান্তা-কান্তার হলুদের দিন চলে আসলো। বাসা থেকে ফিটফাট হয়ে চৈতিকে নামিয়ে দিয়ে গেল চয়ন। দু’দিন থাকবে শান্তাদের বাসায়। চয়ন অনেক উপদেশ দিয়ে গেল। মনে করিয়ে দিল অক্ষরের সাথে দেখা কিংবা কথা বার্তা যেন না হয় সে নজর রাখবে। চৈতি ভদ্র মেয়ের মত মাথা ঝাকিয়ে শুনলো সব। চয়ন চলে যেতেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচল সে।

রুম থেকে বের হয়ে ড্রয়িং রুমে আসলো সে। গায়ে হলুদের ডালা সাজাতে হবে এখন তাঁকে। ডালা সাজানোতে এক্সপার্ট চৈতি। মনের মত ডালাগুলো সাজালো।

দুটি ডালায় বরের গায়ে হলুদের জামা কাপড়, জুতা। একটি ডালায় গায়ে হলুদের সরঞ্জাম রাখা, বিয়ের গহনা, গায়ে হলুদের আনুসঙ্গিক জিনিস । একটি তে হলুদ, মেহেদি, উপ্টান, প্রদীপ রেখেছে। একটি তে পান, সুপারি, জরদা । একটি তে গায়ে হলুদের সব কস্মেটিক্স। দুটি ডালা তে সব মিষ্টি। একটি তে ফল কারভিং করে রাখা ডালা। জোড়া বড় কাতলা মাছের গায়ে হলুদ গামছা, ঠোঁটের কোণায় সিগারেট দিয়ে সামান্য হলুদ লাগিয়ে রেখেছে। ডালা সাজাতে সাজাতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসলো। চৈতি ক্লান্ত হয়ে পড়ল। এখন তার বিশ্রামের পালা। কনেপক্ষের তত্ত্ব এখন বর পক্ষের বাসা নিয়ে যাওয়া হবে। দুপুরে বরের বাড়ির তত্ত্ব চলে এসেছে। তারাও জোড়া রুই মাছ পাঠিয়েছে। হাতের কাজ শেষ করে চলল ফ্রেশ হতে এখন সে নিজে সাজবে। আজকের সাজ শুধুই অক্ষরের জন্য!

গোল্ডেন পাড়ের হলুদ শাড়ি। কৃত্রিম ফুলের গহনা। হাত ভর্তি হলুদ গোল্ডেন কাচের চুড়ি, অর্ধেক চুল একপাশে রেখে সিথী সোজা কৃত্রিম ফুলের টিকলি পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে চৈতি। চোখের পরখ পড়ছে না। অদ্ভুদ সুন্দর দেখাচ্ছে তাকে। মনেমনে সে ভাবছে, বিয়ের পানি শরীরে বহিছে বলেই কী আজ এত সুন্দর দেখাচ্ছে তাকে? নাকি আজ অক্ষর আসবে তাকে হলুদ সাজে দেখবে তাই বলে এত সুন্দর লাগছে? আচ্ছা অক্ষর আজ বরের মত সেজে আসবে তো? অদ্ভুদ চিন্তায় হেসে দিল নিজেই।

স্টেজ সাজানো হয়েছে বাসার সামনে খোলা জায়গায়। কাপড়, নেট, ফুল ইত্যাদি দিয়ে সুন্দর করে ডেকোরেশন করা হয়েছে। যেহেতু যমজ ভাই-বোনের বিয়ে তাই সবকিছুই দুটো করে ইউনিক ভাবে করা হয়েছে। গোল্ডেন ও হলুদ কাপড়ের সমঞ্চয়ে স্টেজ তৈরি। চৈতি সামনে আসতেই দেখল শান্তা-কান্তার গ্রামের আত্মীয়রা ভিন্ন রকম সুন্দর ডালা সাজিয়েছে। ডালা নয় মূলত এটাকে গ্রাম অঞ্চলে কুলো বা কুলা বলা হয়। বড় সমতল তলাওয়ালা চ্যাপ্টা পাত্র যার একটি দিকের কানা খোলা। জিনিসটি দেখে চৈতির চোখ অদ্ভুদ আনন্দ উপভোগ করল। গ্রামে দেখেছে জিনিসটা কিন্তু শহরে আসার পর আর দেখেনি। গ্রামের মহিলারা গায়ে হলুদে আরো কিছু নিয়ম রীতি মেনে চলে। অনেকগুলো রীতি মূলত মঙ্গোলীয় এবং অন্যান্য আদিবাসী উপজাতি থেকে এসেছে। যা গ্রামে এখনও মেনে চলা হয়। যেমন অনুষ্ঠানে হলুদ ছাড়াও অন্যান্য উপকরণ ব্যবহৃত হয় যেমন, ধান, দুর্বা, তিল, সরিষা, মাষকলাই, মেথি, গিলা, সুঁই, মেহেদি, মিষ্টি, মাছ, পঞ্চপ্রদীপ প্রভৃতি। প্রদীপগুলোতে আ’গুনের ছোট্ট ফু’লকি দা’উ’দা’উ করছে। অন্ধকারে আগুনের ছোট্ট ফু’ল’কি অপরূপ সৌন্দর্য ছড়াচ্ছে। মুগ্ধ নয়নে দেখে চলেছে চৈতি।

শান্তা-কান্তা এন্ট্রি হলো গান দিয়ে, গতরে হলুদ ও লাগাইয়া কন্যারে , সাজাও বধূরো সাজে মিলিয়া……

চৈতি দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো শান্তা তখন নাচের মধ্যই ইশারা দিল আসার জন্য। প্রথম চৈতি আসতে না চাইলেও শান্তার মা জোর করে পাঠাল। শুরু হলো তাদের এন্ট্রি নাচ। নাচ শেষে ক্লান্ত দুই বোন। অরেঞ্জ জুস মুখে তুলে চৈতিকে বলল কান্তা, দোস্ত আমার লেন্স খুলে গেছে। আমি কিছুই দেখতে পারছি না।

সুন্দর একটা মুহূর্তে কান্তার কথা শুনে শান্তার মুখের জুস পরে গেল। রাগী গলায় বলল, তোকে আগেই বলেছি চশমা পরেই থাক কিন্তু শুনিস নাই।

কান্তা গাল ফুলিয়ে বলল, বিয়েতে আমায় অসুন্দর লাগুক তুই ঐটাই চাস আমি জানি। এখন পার্লারের মেয়েটাকে ফোন দিয়ে বল আমার চোখে ভালো করে লেন্স পড়িয়ে দিতে।
-” আমি চশমা আনতে বলছি তুই আর লেন্স পড়বি না। চশমা ছাড়া আমাদের বরে-রা যদি চিনতে না পারে তখন অঘটন ঘটে যাবে। বাসর রাতে অদল-বদল হয়ে যাব। পাপ কাজ থেকে দূরে থাক।

শান্ত আলাভোলা মেয়েটা হঠাৎ উরুঁচন্ডী হয়ে গেল। কপট রাগ দেখিয়ে বলল, অদল-বদল হলে সমস্যা নাই দুটোই এক কোম্পানির। আপাতত আমি চশমা পড়বো না।

শান্তা-কান্তার এক কথা শুনে ইশারায় একজন মেয়েকে ডাকল। মেয়েটাকে সব বলে পার্লারের মেয়েটাকে আনতে বলল। চৈতি সবকিছু দেখে জোরে হাসলো। কিন্তু মনের ভিতর তাঁর হাসি হাসছে না। হাঁসফাস করছে মন। অক্ষর তাকে দেখে কী বলবে, হলুদ পরী? নাকি রাঙ্গা বউ? অনেককিছুই বলতে পারে অক্ষর। আচ্ছা অক্ষরকে আজ কেমন লাগছে নিশ্চয় নতুন বরের মত? আজ যদি আমাকে বউয়ের মত লাগে তাহলে অক্ষরকে বর কেন লাগবে না? আলবাদ আজ অক্ষরকে বরের মতোই লাগছে।

পুরো দমে চলছে হলুদের অনুষ্ঠান। হৈ-হুল্লোড়ে মেতে আছে সকলে কিন্তু একমাত্র মন খারাপ চৈতির। জয়-বিজয় এসেছে শান্তা-কান্তাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য কিন্তু অক্ষর আসেনি। মন খারাপটা শরীর বেদ করে হৃদয়ের গভীরে প্রবেশ করল। অনুষ্ঠান থেকে অনেকটা দূরে আকাশের দিকে তাকিয়ে অশ্রু বিসর্জন দিল। যার জন্য সাজলো তার দেখা নেই। অভিমানে ভরপুর হৃদদেশ। গতকাল থেকে কথা হচ্ছে না ফোন বন্ধ। খাঁ খাঁ হৃদয় আজ মরুভূমি। তখনই ফোন আসলো চৈতির। হাতের উলটো পাশে চোখের পানি মুছে ফোনের স্ক্রিনে তাকাল দেখল অক্ষরের ফোন। রিসিভ করে অভিমানী কণ্ঠে বলল, একজন প্রেমিক কখনোই ভালো স্বামী হতে পারে না।

অপরপাশ থেকে ভেসে আসলো শব্দের ধ্বনি। শব্দকে উপেক্ষা করে অক্ষর বলল, বাগানের উত্তর দিকটায় চলে আসুন। সময় তিন মিনিট।

##চলবে,
®ফারজানা মুমু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here