#নীরব_সূর্যাস্ত
#পর্ব_৩
#সারা_মেহেক
ছয় বছর পূর্বে,
নিহা আজ ভীষণ খুশি। দু বছর যাবত জমিয়ে রাখা ভালোবাসার অনুভূতিগুলো আজ জুনায়েদের সামনে প্রকাশ করবে। প্রারম্ভে সে ভীষণ ইতস্ততবোধ করছিলো। কিন্তু পরে নিজেকে এই বুঝ দিলো, চার বছরের বন্ধুত্ব তাদের। আর ক’দিন পর ফাইনাল পরীক্ষা। এর মাঝেই নিজের মনে চেপে রাখা অনুভূতিগুলো প্রকাশ করা উচিত। নচেৎ দেরি হয়ে যাবে যে!
ক্লাস শেষ করে নিহা কৃষ্ণচূড়া গাছের দিকে এগুলো। এখানেই সচারাচর জুনায়েদ থাকে। আজও ছিলো। নিহা সেদিকে পা বাড়ালো। কিন্তু কিছুদূর গিয়ে তার পা জোড়া আর সেদিকে এগুলো না। স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সে। কেননা আজ যাকে সে মনের কথা বলতে এসেছে, সে-ই অন্য এক মেয়েকে ফুল দিয়ে প্রেম নিবেদন করছে!
নিহা কয়েক সেকেন্ডের জন্য শূণ্য মস্তিষ্কের হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তার ঠিক সামনে জুনায়েদ তাদের জুনিয়র ব্যাচের অর্থাৎ থার্ড ইয়ারের একটি মেয়েকে গোলাপ দিয়ে প্রপোজ করছে। মেয়েটির নাম অরিন। অরিনের সৌন্দর্য তাদের ডিপার্টমেন্টের প্রতিটি ছেলের মুখে শোনা যায়।৷ এমনকি মেয়েরাও তার সৌন্দর্যের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়। এহেন সুন্দর মেয়েকে প্রপোজ করা আসলে কোনো তাজ্জবের ব্যাপার নয়। কিন্তু এভাবে হুটহাট করে জুনায়েদ অরিনকে প্রপোজ করে বসবে তা কল্পনাতীত ছিলো নিহার নিকট। কই জুনায়েদ তো কখনো অরিনের ব্যাপারে কিছু বলেনি। তাহলে আজ এভাবে প্রপোজ কেন?
নিহা আর সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। পিছে ফিরে দূর্বল পায়ে হেঁটে হোস্টেলে চলে এলো। সারা রাস্তা সে বহু কষ্টে কান্না দমিয়ে রেখেছিলো। বারবার চাইছিলো রাস্তায় কারোর সামনে যেনো কান্না না করে বসে সে।
হোস্টেলে ফিরে ইচ্ছেমতো কাঁদলো সে। একদম বুকে ফেটে কান্না বের হলো যেনো। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার। মনে হচ্ছে বুকের ভেতর কেউ ইচ্ছেমতো অনবরত ছু’ড়ি বসিয়ে দিচ্ছে। সামান্য করুণাও দেখাচ্ছে না তার প্রতি। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, মাথাটা ভার হয়ে আসছে। আচ্ছা, প্রথম ভালোবাসাগুলো কেনো এতো পুড়ায়? কি হতো যদি এ প্রথম ভালোবাসা, প্রথম অনুভূতি পূর্ণতা পেতো? সারাজীবন এ অপূর্ণতা নিয়ে কি করে দিন কাটাবে সে? উপরন্তু জুনায়েদকে রোজ চোখের সামনে দেখতে হবে। নিহা কি করে সহ্য করবে তারই সামনে জুনায়েদ অন্য মেয়ের প্রশংসা করছে? অন্য মেয়ের সাথে প্রেমালাপ করছে? এ যে এক অসহ্য যন্ত্রণা! কিছু মানুষ হয়তো ঠিক বলে, প্রেম ভালোবাসা অশেষ যন্ত্রণা বয়ে আনে জীবনে।
নিজেকে অনেক করে বুঝালো নিহা। দুদিন ভার্সিটিতে এলো না সে। এ দুদিন জুনায়েদের সাথেও কথা বলেনি। শুধু তাকে ম্যাসেজ করে মিথ্যে বলেছিলো যে সে দুদিনের জন্য বাড়ি যাচ্ছে। জুনায়েদও আর এ নিয়ে ঘাঁটায়নি।
দুদিন বাদে নিহা ভার্সিটিতে গেলো। ভাবখানা এমন রাখলো যে সে অরিন আর জুনায়েদের ব্যাপারে কিছুই জানে না। লোকমুখে শুনেছে জুনায়েদ অরিনকে প্রপোজ করেছে। ব্যস, এ বাদে সে কিছুই জানে না৷ জুনায়েদও তাকে এ নিয়ে বেশি কিছু বললো না। নিহাও এ ব্যাপারে আর জিজ্ঞেস করলো। কিন্তু সে জুনায়েদের সাথে এমন আচরণ করলো যেনো তার মনে জুনায়েদকে নিয়ে কখনো কোনো অনুভূতিই ছিলো না! কি অদ্ভুত ব্যাপার, তার মনে যে বিশাল এক ঘূর্ণিঝড় বয়ে যাচ্ছে তা বাইরের কেউই জানতে পারছে না! জুনায়েদও না! আচ্ছা, জুনায়েদ কেনো তার না বলা মনের হাল, চোখের ভাষা বুঝতে পারে না? বুঝলে হয়তো চূর্ণবিচূর্ণ এ মনটা কিছুটা হলেও জোড়া লাগানো যেতো!
জুনায়েদকে নিজের অনুভূতি সম্পর্কে বিন্দুমাত্রও ধারণা দেয়নি নিহা। সে চেয়েছিলো জুনায়েদ যেনো সারাজীবন সুখী থাকে। এক্ষেত্রে জুনায়েদ যদি অরিনের সাথে সুখে থাকে তাহলে তাদের সুখ নষ্ট করার সে কে! তার তো বরং খুশি হওয়ার কথা যে তার ভালোবাসার মানুষটি ভালো আছে। নিহা খুশি হয়েছিলো জুনায়েদের জন্য। কিন্তু নিজের জন্য হয়েছিলো ভীষণ দুঃখী।
ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হলো। শেষ পরীক্ষার দিন ভার্সিটির বড় মাঠটিতে এক কেলেঙ্কারি বেঁধে গেলো। জুনায়েদের বিরুদ্ধে চরিত্র হননের অভিযোগ তুললো অরিন। জুনায়েদকে চরিত্রহীন দাবি করতে যা যা প্রয়োজন সবই সবার সামনে প্রকাশ করলো অরিন। জুনায়েদ পড়লো অকূলপাথারে। কারণ বিশাল এ জনগণের মাঝে তাকে সমর্থন করার মতো কেউই নেই। প্রত্যেকের অরিনের পক্ষে কথা বললো। তাদের ভাষ্যমতে জুনায়েদ ভীষণ ছন্নছাড়া প্রকৃতির এক ছেলে। অরিনের সাথে এমন নিচু কাজ করা তার পক্ষে অসম্ভব কিছু নয়।
নিহা পরীক্ষা দিয়ে হোস্টেলে চলে গিয়েছিলো। আজই বাড়িতে ফেরার কথা ছিলো। কিন্তু ভার্সিটির এ ঘটনায় তাকে জরুরি তলব দিয়ে ভার্সিটিতে ঢেকে আনা হলো। সেখানে গিয়ে সম্পূর্ণ ঘটনা শুনে তার মাথায় হাত। তার কিছুতেই বিশ্বাস হলো না জুনায়েদ এমন কিছু করতে পারে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে আনা প্রতিটি অভিযোগের সত্যতা প্রমাণ করলো অরিন। একজন মেয়ে হিসেবে চিন্তা করে নিহা কিছুতেই পারলো না অরিনকে রেখে জুনায়েদের উপর বিশ্বাস করতে। সেদিন নিহা’র সেদিন কি হয়েছিলো জানে না, অরিনের উপস্থাপন করা প্রতিটি তথ্য সে বিশ্বাস করে নিয়েছিলো। অরিনের সাথে জুনায়েদের অসম্মানজনক কথাবার্তা, ছবি আদানপ্রদান, সব বিশ্বাস করেছিলো নিহা।
সেদিন জুনায়েদের জন্য নিহার দৃষ্টিতে একরাশ ঘৃণা জন্মেছিলো। জন্মেছিলো অবিশ্বাস। সেদিনের পর থেকে সে জুনায়েদের সাথে আর যোগাযোগ করার চেষ্টা করেনি। জুনায়েদ তার বিভিন্নভাবে কথা বলতে চেয়েছে কিন্তু সে মানেনি। ফোনও বন্ধ করে রেখেছিলো সে। কিন্তু ঠিক এক বছর পর নিহা তাদেরই এক ক্লাসমেটের মাধ্যমে ঘটনার সব সত্যতা জানতে পায়।
জুনায়েদ বাজিতে জেতার জন্য অরিনকে প্রপোজ করেছিলো তাদেরই এক ক্লাসমেট পলাশের কথায়। পলাশ বলেছিলো অরিনকে প্রপোজ করে গার্লফ্রেন্ড বানালে সে জুনায়েদকে তার কালেকশনের সবচেয়ে দামী বাইক ফ্রি’তে দিয়ে দিবে। বাইকের লোভে পড়ে এক মাসের জন্য অরিনকে গার্লফ্রেন্ড বানাতে রাজি হলো জুনায়েদ। কিন্তু এক্ষেত্রে শর্ত প্রযোজ্য হলো, এ বাজির ব্যাপারে কেউই জানবে না। এমনকি নিহাও না। এভাবে এক মাস যেতে না যেতেই অরিনের ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিলো জুনায়েদ। অরিনকে যেখানে সবাই ভালো ও ভদ্র মেয়ে হিসেবে জানতো সেখানে জুনায়েদ অরিনের এক বিশ্রি নতুনরূপ আবিষ্কার করেছিলো। নিজের কথার ছলে, শরীর দেখিয়ে ছেলেদের বশে রাখা ছিলো অরিনের পুরোনো অভ্যাস। এ কারণে জুনায়েদ অরিনের সাথে ব্রেকাপ করেছিলো। কিন্তু অরিনও হার মানার পাত্রী ছিলো না। সে জুনায়েদকে নানাভাবে ব্ল্যাকমেইল করতে থাকে। কিন্তু যখন ব্ল্যাকমেইলেও কাজ হলো না তখন অরিন সব ম্যাসেজ, ছবি উল্টোপাল্টা করে জুনায়েদকে দোষী করে সবার সামনে প্রকাশ করে।
এসব সত্য জানার পর নিহার মাথায় যেনো আকাশ ভেঙে পড়ে। প্রচণ্ড অস্থির হয়ে পড়ে সে।জুনায়েদের খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু কেউই তার খোঁজ দিতে পারে না। উপরন্তু সে নিজের মোবাইল নাম্বারও বদলে ফেলেছিলো। এভাবে বছর দুয়েক চেষ্টা করার পর নিহা হাল ছাড়ে। বুকে একরাশ ব্যাথা, মনে একরাশ অপরাধবোধ নিয়ে ভুলে যেতে চেষ্টা করে জুনায়েদকে। কিন্তু ভাগ্যের পরিক্রমায় ছয় বছর পর তারা আবারও একত্রিত হয়।
নিহার ঘুম ভাঙলো। ত্রিশ মিনিটের জন্য চোখ বুজেছিলো সে। চোখ খুলে দেখলো সে জুনায়েদের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। এ পরিস্থিতি বোঝা মাত্রই সে তড়িৎ গতিতে মাথা তুলে ফেললো। জুনায়েদ স্বাভাবিক হলো। বললো,
” ঘুমের মধ্যে তুই মাথা রেখেছিলি কাঁধে। ভাবলাম ঘুম ভেঙে যাবে তাই আর ডাকিনি।”
নিহা কোনো প্রত্যুত্তর করলো না। জানালার বাইরে দৃষ্টি স্থাপন করলো। এ মুহূর্তে জুনায়েদের সাথে তার সকল ভুল বুঝাবুঝির অবসান ঘটাতে মন চাইলো। কিন্তু মুখ খোলার সাহসটুকু অব্দিও সে জুটাতে পারলো না। শেষমেশ পুরো রাস্তা সে নীরব ছিলো। কথা বলেনি স্বয়ং জুনায়েদও। কে জানে, হঠাৎ কোথা থেকে নিহার প্রতি একরাশ অভিমান এসে জমা হলো!
গাবতলীতে বাস থামলো। একে একে সব যাত্রী নেমে গেলে জুনায়েদ ও নিহাও নামার প্রস্তুতি নিলো। তবে সিট ছাড়ার পূর্বে জুনায়েদ নিহার কাছে তার ফোন নাম্বার চাইলো। নিহাও আর কথা না বাড়িয়ে জুনায়েদকে তার নাম্বার দিলো।
জুনায়েদ বাস থেকে নেমে নিহার জন্য একটা টেক্সি ঠিক করে দিলো। নিহা টেক্সিতে উঠতেই জুনায়েদ হাসিমুখে বললো,
” এখন তো তোর খোঁজ পেয়ে গিয়েছি। সামনে কোনো একদিন দেখা করবো। সময় হবে তো তোর?”
নিহা এক গাল হেসে বললো,
” অবশ্যই। পুরোনো বন্ধুর জন্য আমি সময় বের করতে রাজি। ”
” তাহলে একদিন কল করবো। আর হ্যাঁ, তোর বিয়ের দাওয়াত দিতে ভুলিস না যেনো। কবে তোর বিয়ে হচ্ছে?”
” এখনই না৷ সময় আছে। তাশদীদের প্রমোশন হলে তবেই বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক হবে। তাও হয়তো চার পাঁচ মাস লাগবে।”
” আচ্ছা। একদিন তোর অফিসে গিয়ে তাশদীদের সাথে নাহয় দেখা করবো। ”
” আচ্ছা আসিস তাহলে। আর ভালো থাকিস জুনায়েদ। নিজের খেয়াল রাখিস। আর পারলে অতীতের ভুলের জন্য ক্ষমা করে দিস।”
জুনায়েদ প্রত্যুত্তর করলো না। স্তিমিত হাসি দিয়ে বললো,
” এখন আর এ বিষয়ে কথা বলবো না। তুই বাসায় যা। গিয়ে আমাকে জানাস। ”
বলেই সে টেক্সি ড্রাইভারকে বললো,
” চাচা, ভালোভাবে টেক্সি চালাবেন। আর ওকে ভালোমতো পৌঁছে দিয়ে আসবেন। ”
ড্রাইভার হ্যাঁসূচক মাথা নাড়ালো। স্টার্ট দিলে টেক্সিতে। জুনায়েদকে পিছে ফেলে চলে গেলো টেক্সি। যতক্ষণ টেক্সি দেখা গেলো ততক্ষণ জুনায়েদ সেদিকেই তাকিয়ে রইলো। সে অনুভব করলো নিহা চলে যাওয়াতে তার বুকের ভেতরে অদ্ভুত ব্যাথা হচ্ছে, বুকটা মোচড় দিয়ে উঠছে। ছয় বছর পরও এমন লক্ষণ কেনো দেখা যাচ্ছে। এ যে ঘোর বিপদ ডেকে আনবে। কেননা নিহার আর ক’দিন বাদে বিয়ে। এ মুহূর্তে কি দরকার পুরোনো অনুভূতিগুলো জাগ্রত হওয়ার!
জুনায়েদ জোরপূর্বক নিজেকে বুঝালো। একটা টেক্সি নিয়ে সে নিজেও বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো।
এদিকে জুনায়েদকে দৃষ্টির ত্রিসীমানার বাইরে যেতে দেখেই নিহার মনে পুরোনো সে পীড়া আঘাত হানলো। অশ্রুসিক্ত হলো তার দৃষ্টিজোড়া। বুক চিড়ে বেরিয়ে এলো না বলা কিছু কথা,
” একজন মেয়ে হিসেবে সেদিন সফল হলেও বন্ধু হিসেবে আমি ব্যর্থ ছিলাম জুনায়েদ। পারলে মাফ করে দিস আমাকে। ”
#চলবে
®সারা মেহেক
গ্রুপ লিংক ঃ https://facebook.com/groups/259972409591747/