আড়ালে_অন্তরালে #মাহমুদা_লিজা পর্বঃ১৬

0
448

#আড়ালে_অন্তরালে

#মাহমুদা_লিজা

পর্বঃ১৬

ঘুম থেকে জেগে উঠতেই মায়ার মনে হলো সে কোথায় আছে। ঝটপট উঠে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। পুরো বাড়িটায় কেমন ভৌতিক আবহ, সুনসান নীরবতা। নিজের নিশ্বাসের শব্দটাও স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে মায়া। নিশ্বাসের এই শব্দটা যেন আবহটা আরো ভৌতিক করে তুলেছে। ধীরে ধীরে নেমে এলো সিঁড়ি বেয়ে। হাঁটতে হাঁটতে ড্রয়িংরুমে রাখা সোফার সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেল। তার অনুসন্ধানী দৃষ্টি কাউকে খুঁজতে ব্যস্ত। ড্রয়িংরুম পেরিয়ে সে এবার রুমগুলোর দিকে এগোচ্ছে। এভাবে একা একা ভয় পাচ্ছে সে। হঠাৎ কিছু একটায় পা লেগে পড়ে যেতে নিলে সামনে থাকা দেয়ালটা ধরে নিজের ভারসাম্য ঠিক করে সে। তার মনে হচ্ছে সে কোন ভূত বাংলোয় আছে। তার নিশ্বাসের শব্দও প্রতিধ্বনি করছে তখন। আরেকটু এগিয়ে গেল সে। এবার যেন দম ফিরে পেল। সাদা কামিজ পরা, চুলগুলো পিঠে ছেড়ে দিয়ে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা আয়েশাকে দেখতে পেল রুমটায়।
নিচু কন্ঠে মায়া বলল – আসব?
কারো ক্ষীণ কন্ঠ শুনে আয়েশা পিছনে তাকালো। মায়া তাকিয়ে আছে সেদিকে। মায়া খেয়াল করল আয়েশার চোখের কোণে শুকিয়ে যাওয়া অশ্রুফোঁটা।
আয়েশা উত্তেজিত হয়ে বলল – জেগে উঠেছ ভাবী? ভাইয়া, বাবা কেউ বাসায় নেই। দুবার তোমার রুমে গিয়েও ফিরে এসেছি। একা একা বোর হচ্ছিলাম। ভেবেছি সেঝ চাচার ঘরে একবার যাব। আজই ফিরেছে ঢাকা থেকে। কিন্তু তোমায় একা রেখে যাইনিগো। এখন তুমি এসেছ, বসো গল্প করি। তার আগে বল চা খাবে? বানাব?

আয়েশার কথায় মুচকি হাসলো মায়া। মায়া বুঝতে পেরেছে আয়েশা একটু গল্প প্রিয়। খুব মিশুক। কি সুন্দর বাচ্চাদের মত করে কথা বলছে।
মায়া গিয়ে খাটে বসলো। আয়েশা আবার বলল – ও ভাবী, তুমি এত সুন্দর কেন গো? ভাইয়া ফোনে বলেছে আমায়। জানো কি বলেছে!

মায়া মাথা নাড়িয়ে বলল – না।
আয়েশা নিজের মাথায় গাট্টা মে রে বলল – তুমি কিভাবে জানবে, ভাইয়া তো আমায় বলেছে। হা হা।
মায়া বুঝতে পারলো আয়েশা তার নির্বুদ্ধিতা দেখে হাসছে আর সে আয়েশার পাগলামি দেখে মুচকি হেসেই যাচ্ছে।
আয়শা এবার বলল – ভাইয়া বলেছে আমার জন্য একটা চাঁদের মত সুন্দর ভাবী আনছে, আরো কি বলেছে জানো?
মায়া এবার আর কথা বলল না। তাকিয়ে আছে ননদের দিকে।
আয়েশা আবার বলল – ও আরো বলেছে তুমি নাকি একদম খরগোশের বা চ্চার মত আদুরে। তুমি নাকি দেখতে পুরো সিনড্রেলার মত। তোমায় নাকি ভাইয়া বিয়ে না করলে সাত সমুদ্র তের নদী পার হয়ে কোন রাজকুমার নিয়ে যেত। ভাইয়া আরো বলল তুমি কোন মানুষ নও, তুমি নাকি পরীদের রাণী।

মায়া চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে আছে আয়েশার দিকে। মনে মনে ভাবছে লোকটার কি মাথায় কোন সমস্যা আছে না কি। কেউ এভাবে বলে?
মায়া অস্বস্তি বোধ করছিলো। তাই টপিক বদলে সে বলল – তুমি কি কাঁদছিলে?
হাসিখুশি মেয়েটা তখন থমকে গেল। মাথা নিচু করে বলল – উঁহু। তুমি বসো, চা বানিয়ে আনি।
মায়া আয়েশার হাত ধরে বলল – আমিও যাব তোমার সাথে।
আয়েশা জোর করে মুখে হাসি ঝুলিয়ে বলল – রান্নাঘর কিন্তু ঘরের বাইরে। তবে সমস্যা নেই, এরিয়ার ভেতরেই।
মায়া বলল – আমি যাব।

____

ফোনে হঠাৎ ভাইব্রেশন বুঝতে পেরে ফোনটা আনলক করে থমকে গেছে মুরাদ। একনজর ইমতিয়াজের দিকে তাকিয়ে বলল – বিশ্বাস করো ডাক্তার, জামশেদকে তো ফা”লা ফা”লা করবই আর আমাদের দলের ভেতরে থাকা ঐ মীরজাফরকে এফোঁড়ওফোঁড় করে দেব একদম।
ইমতিয়াজ কিছু বুঝতে না পেরে বলল – কি হয়েছে? বুঝিয়ে বলো।
শান্ত দৃষ্টিতে ইমতিয়াজের চোখে চোখ রেখে বলল – আমাদের দলের প্রিয়তাকে ধ’র্ষ’ণ করে, খু*ন করে রাস্তায় ফেলে গেছে ঐ কাপুরুষের দল। ইস মেয়েটা কতটা যন্ত্রণা পেয়েছে আবার ম রা র পরও পেল অসম্মান।
ইমতিয়াজ ফুঁ সে উঠল। প্রিয়তাকে বোনের মত আদর করত সে। মেয়েটা গুরুত্বপূর্ণ সব তথ্য এনে দিত তাদের। কিন্তু মুরাদকে অমন শান্ত থাকতে দেখে ইমতিয়াজ যারপরনাই অবাক হলো।
এদিকে মুরাদের মনের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। দলের বাকি লোকদের সরিয়ে দিতে পারলেও প্রিয়তাকে সরানোর প্রয়োজন অনুভব করেনি সে। তার একটু ভুল সিদ্ধান্তের পরিণতি কি বিভ/ৎস তা ভেবে নিজেকে শে-ষ করতে মন চাইছে তার।

বাড়ির বাইরে আরেকটু ঘুরতে চেয়েছিল মুরাদ। আচমকা অমন সংবাদ পেয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ালো সে। তার সাথে কেউ বে-ঈ-মা-নী করছে এটা ভাবতেই তার রাগ আরো বেড়ে যাচ্ছে। ভেতরে জ্ব লে যাচ্ছে নিজে কিন্তু বাইরে একটু ছিটেফোঁটা আভাষ নেই।

___

বাড়ির ছেলে নতুন বউ নিয়ে এসেছে, নতুন বউকে দেখতে এসেছে সবাই। মুহূর্তেই নীরব ঘরখানা হৈ হৈ রবে মুখরিত হলো। মাহতাব খান সবাইকে বসতে দিলেন। বাড়ির হেল্পিং হ্যান্ডদের বললেন সবার জন্য খাবার ব্যবস্হা করতে। ফাহিম তখনো এসে পৌঁছায় নি। মায়াও টুকটাক আয়েশার সাথে এটা ওটা এগিয়ে দিচ্ছে।
নাস্তা নিয়ে মায়া যখন বাকিদের সাথে ড্রয়িংরুমে এসেছে তখন সবাই বলল – মাশাল্লাহ।

ফাহিমের চাচা – চাচী, জ্যেঠা, কাজিন সবাই মায়াকে দেখে বলল – তানভীর ভাই এবার তাহলে বাঁ ধা পড়ল।

মায়া চমকে তাকালো, তানভীর কে!
ততক্ষণে ফাহিম সদর দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। ফাহিমকে দেখেই রায়হান বলল – আমি তোর বড় হয়ে এখনো সিঙ্গেল আর তুই বউ নিয়ে এসেছিস। তাও আমার বাবা আমার দিকে সুদৃষ্টি কেন দিচ্ছে না!
রায়হানের কথায় সবাই হো হো করে হেসে উঠল।
ফাহিম এসেই আগে তার সেজ জ্যেঠাকে জড়িয়ে ধরলো। বয়স্ক এই লোকটার সাথে ফাহিমের সম্পর্ক একটু বেশিই মজবুত। বাবার অবর্তমানে এই লোকটাকে সে নিজের অভিভাবক বলে জেনেছে।
বয়স্ক লোকটা বলল – বাবারে, আমার ছেলেদের চাইতে তুই আমার বেশি প্রিয়। তোর আজকের এই খুশির দিনে আমার থেকে কেউ বেশি আনন্দিত হয়নি। আমি এই দিনটার অপেক্ষায় ছিলাম। সবসময় চাইতাম কবে আমার তানভীর বিয়ে করে সংসারী হবে?
মায়া সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকালো ফাহিমের দিকে। ফাহিমও মায়ার দিকে তাকালো একবার। মায়ার ঐ দৃষ্টি ফাহিমকে ভীত করে তুলছে। মায়ার এই চাহনি তার কাছে অচেনা।

আস্তে আস্তে সবাই যার যার ঘরে চলে গেল। ফাহিম অনেকক্ষণ আগেই নিজের ঘরে গেছে ফ্রেশ হওয়ার জন্য। মায়ার মনে চরকি পাক খাচ্ছে কত-শত প্রশ্ন।
সবাই যাওয়ার সময়ও ফাহিমের পছন্দের তারিফ করে গেল। এতটা সময়ের মধ্যে আয়েশা কারো সামনে আসেনি তবুও সবাই আফসোস করেছে এত বয়স হয়ে গেছে তবুও আয়েশার বিয়ে না হওয়ার জন্য। অথচ আয়েশার বয়স সবে ছাব্বিশ। রায়হান অবশ্য সব শুভাকাঙ্ক্ষীকে বলেছে আয়েশার চিন্তা না করে নিজের চিন্তা করতে।
সবাই যাওয়ার পরে মায়া সোফাগুলোকে হালকা ঝেড়ে নিচ্ছিল। পরিষ্কার করাটা তার একটা শখ। সোফার দুই গদির মাঝে ছোট্ট বাটন সেটটায় তার দৃষ্টি আটকে গেল। ফাঁকা ড্রয়িংরুমটায় মায়া এদিক সেদিক তাকিয়ে ফোনটা নিজের কব্জায় নিল। ফোনে মিটিং মুড অন ছিল। ভাইব্রেট করা ফোনটা নিয়ে মায়া হালকা আড়ালে গেল। ফোনে আসা ক্ষুদেবার্তাটা দেখে সে রীতিমতো শিউরে উঠল। তাতে লেখা ছিল_

” প্রিয়তার দেহটাতো রাস্তায় পড়ে আছে কিন্তু ঐ মুরাদের দেহটা তো কুকুরকে খাওয়াবো, আপনার চাই ঐ শান-শওকত, আমার চাই ওর বউ আর ওর ক লি জা।”

কাঁপতে থাকা শরীরটাকে স্বাভাবিক করে ফোনটা সাধ্যমত লুকিয়ে নিল মায়া।
হিং স্র তায় ভরপুর দুনিয়াটা বড্ড এলোমেলো লাগছে। চোখ উপচে কান্না আসছে তার। এখানে আসা কোন একজন লোক কি নোং রা কাজে যুক্ত? আর মুরাদ?
সব প্রশ্ন নিয়ে টলতে টলতে উপরে গেল মায়া। আয়েশাকে অনেকক্ষণ দেখেনি। এখন আর তাকে খুঁজতে ইচ্ছে হচ্ছে না। ইচ্ছে হচ্ছে চিৎকার করে কাঁদতে।
ঘরে আসতেই মায়া দেখল ফাহিম কি যেন ভাবছে। মায়া তড়িঘড়ি করে তার সামনে এসে বলল – আপনার নাম তানভীর, তা তো বলেন নি।
স্ত্রীর দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ফাহিম বলল – সবাই ডাকে এ নামে।
ফাহিম খেয়াল করলো মায়ার ঐ মায়াবী মুখটা কেমন পানসে দেখাচ্ছে। সে শুধালো – মন খারাপ?
মায়া দুদিকে মাথা নাড়িয়ে বলল – না।
তাকে কাছে টেনে কপালে একটা গভীর চুম্বন এঁকে ফাহিম বলল – ও মুখে আঁধার কেন নেমেছে?
মায়া তাকিয়ে আছে অপলক। কেমন জড়তা নিয়ে বলল – কোথায় ছিলেন?
ফাহিম তাকে বুকের সাথে জড়িয়ে বলল – একটু আড্ডা দিচ্ছিলামগো। আমার জন্য অপেক্ষা করছিলে বুঝি?
মায়া উত্তর দিলো না। সরে এসে বলল – মুরাদ নামে কাউকে চিনেন?
ফাহিম ভড়কালো না। মনে মনে যথেষ্ট ভয় পেলেও মুখে স্বাভাবিক ভঙ্গি রেখে বলল – চিনি নাহ। কে মুরাদ?
মায়া খানিক হেসে বলল – আপনিই মুরাদ, আপনিই ফাহিম, আপনিই তানভীর। আপনাকে এবার ভয় হচ্ছে আমার। ভীষণ ভয়।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here