সূর্যোদয় #পর্ব_১৬ #কারিমা_দিলশাদ

0
839

#সূর্যোদয়
#পর্ব_১৬
#কারিমা_দিলশাদ

আজকে এক তারিখ। ইলোরা ইয়াসমিন ভার্সিটিতে আর স্মৃতি কলেজে। জয় আজকে হাফ ডে’র ছুটি নিয়ে নিয়েছে। বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে স্মৃতিকে পিক করে ওকে নিয়ে ডান্স ক্লাসে যাবে।

বাসায় গিয়ে গোসল করে একদম ফ্রেশ হয়ে নেয় জয়। গোসল করে বাইরে এসে আয়নার সামনে দাঁড়ায় জয়। নিজেকে দেখছে আর ভাবছে কোন কাপড়টা পড়ে যাওয়া যায়।

স্কুল কলেজে সে ল্যাদাবাচ্চা টাইপের ছিল। কিন্তু মেডিকেল কলেজে উঠার পর থেকে তার মাঝে আমূল পরিবর্তন হয়। মেডিকেলের ছাত্রজীবন থেকে এখন হাসপাতালের জুনিয়র স্টুডেন্ট দের কাছেও জয়ের আলাদা একটা চার্ম আছে। লম্বা চওড়া পেটানো শরীরের অধিকারী জয়ের যে বেশ চর্চা নারী মহলে তা তার বেশ জানা। তার ভদ্র, গম্ভীর তবে মিষ্টি আচরণ,দায়িত্বশীলতা এবং তার ব্যক্তিত্ব তাকে ভিন্নভাবে প্রদর্শন করে।

ঐশীর সাথে যখন প্রথম বার দেখা হয়। এবং যে কয়বার দেখা হয়েছে আজ পর্যন্ত। প্রত্যেকবার তার সামনে জয় সবসময় অগোছালো, নার্ভাস, চাইল্ডিশ এবং অপরিপক্ক হিসেবে প্রেজেন্ট হয়েছে। যা সে মোটেই না। তবে আজ অন্তত সে একটা গুড ইমপ্রেশন তৈরি করতে চায়। নিজেকে ভালোভাবে প্রেজেন্ট করতে চায়।

ঘেটে ঘেটে বাছাই করে সাদা শার্ট, ঘিয়ে কালার প্যান্ট একদম ফরমাল লুকে তৈরি হয়ে নেয় সে। কি মনে করে যেন আবার শার্ট ইন করে নেয়। যেভাবে হাসপাতালে যায়। নইলে স্মৃতি দেখে যদি আবার কিছু বলে। তারপর আবার কিছুক্ষণ দেখে নেয় ভালো লাগছে তো তাকে? ঐশী কি মনে করবে? কি মনে করবে, কিছুই না। ঐশীর কথা এতো কেনো ভাবে সে? কে কি বলবে না বলবে এতো কিছু তো আগে কখনো ভাবে নি৷ কি হচ্ছে তার?? উফফফফ। থাক ব্যাপার না। এবার বের হওয়া যাক।

————————–

কলেজ থেকে স্মৃতিকে পিক করে নেয়। স্মৃতি তো খুব খুশি। তার চোখ মুখের চমক দেখেই তা বোঝা যাচ্ছে।বোনের খুশি দেখে জয়েরও ভালো লাগলো। এরপর স্মৃতিকে বাইকে নিয়ে চলে গন্তব্য।

কলেজ থেকে ডান্স ক্লাসের দূরত্ব ওয়াকিং ডিস্টেন্স। হেটে গেলে বড়জোর ১০ মিনিট লাগবে। আর বাইকে করে চার পাচঁ মিনিটেই পৌঁছে গেল তারা। একটা পুরনো বিল্ডিং এর সামনে এসে বাইক থামায় জয়।

পুরনো একটা দুতলা বিল্ডিং যার মূল ফটক হিসেবে আছে লোহার কেঁচিগেইট। যা আপাতত খোলা। তার উপরেই অতি সাধারণভাবে লেখা “ নৃত্যশৈলী একাডেমি ”। সাধারণ হলেও বিষয়টা খুব সুন্দর লাগলো। অন্যরকম একটা ভাব। স্মৃতির কথায় হুশ হলো তার।

বাইকের ছোট আয়নায় চুলটা ঠিক করে দেখে নেয় নিজেকে। তারপর স্মৃতিকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“ এই শোন। কেমন লাগছে আমাকে বলতো? ঠিক আছে না সব?”

স্মৃতি জয়কে একবার আগাগোড়া চেক করে নেয়। সাদা শার্ট, ঘিয়ে প্যান্টে ইন করা। গোছানো চুল, চোখে কালো সানগ্লাসে সাউথ ইন্ডিয়ান কোনো হিরোর থেকে কম লাগছে না তার ভাইকে। তবে সে সেসব কথার ধারেকাছে না গিয়ে, মুখে বিরক্তিকর ভাব নিয়ে বলে,

“ যেমন তোকে সবসময় লাগে তেমনই লাগছে। এ আবার নতুন কি বলতো। চল ভিতরে।” — যা শুনেই মুখটা তেঁতো হয়ে গেল জয়ের। যেমন লাগে মানে! তাহলে এত সময় দিয়ে লাভ হলো কি? ধ্যাত…….

ততক্ষনে স্মৃতি কেচিগেইট পেরিয়ে কাঠের দরজা দিয়ে ভেতরে চলে গেছে। তেঁতো মন আর বিরক্তিকর মেজাজ নিয়ে সেও প্রবেশ করে ভিতরে। তবে তার সমস্ত তেঁতো এবং বিরক্তিকর ভাব যেন ছো মন্তর হয়ে গেছে।

দরজায় পাতলা সাদা পর্দা ঝোলানো। যেই দরজা পেরিয়ে হল রুমের মতো বেশ বড়সড় একটা রুম। মুখ বরাবর ওয়াল জুড়ে বড় আয়না। সামনের দেয়ালের বাম পাশেই আবার একটা দরজা। হাতের ডান দিকে বড় বড় তিনটা জানালা। যেগুলোতে সাদা পর্দা এবং কিছু সুন্দর জড়ির কাজ করা কিছু একটা তো ঝুলানো। যা সম্পর্কে অবগত নয় জয়। আর রয়েছে বেশ বিভিন্ন ভ্যারাইটির মানিপ্ল্যান্ট, এবং অন্যান্য গাছ।

এক পা বাড়িয়ে বাম দিকে তাকাতেই চোখে পড়ে কর্ণারে রাখা ছোট্ট গোল একটা বেতের টেবিল যার চারপাশে বেতের চারটা চেয়ার। টেবিলের উপরেও শোভা পাচ্ছে কিছু মানিপ্ল্যান্ট। এছাড়াও ঘরের প্রতিটা কর্ণারে স্থান পেয়েছে বিভিন্ন জাতের মানিপ্ল্যান্ট এবং নাম না জানা কিছু গাছ। বাম দিকের যে দরজা তার দুপাশের ওয়াল জুড়ে বেশ কিছু ফটো ফ্রেম, ছোট ছোট আয়না, আবার কিছু গাছ সেট করা। আর এই পুরো মহলটা আরও মোহময় করে তুলেছে ঘুঙুরের শব্দ।

জয়ের চোখ জুড়িয়ে গেছে। এতো সাধারণ, এতো স্নিগ্ধ, এতো তৃপ্তিদায়ক পরিবেশ তার সব মন খারাপ ভাব চলে গিয়ে ঠোঁটের কোণে অজান্তেই এক চিলতে হাসি এনে দিয়েছে। খুবই স্নিগ্ধ মোহময় পরিবেশ। আর এই মোহময়তাকে আরও একধাপ বাড়াতেই যেন আগমন নিল এক রমণী।

বেশ উচুঁ করে গ্রামীণ চেক শাড়ী পড়া যার কারনে নিচের কালো লেগিংস দৃশ্যমান। তবে এরকমভাবে শাড়ী মেয়েরা নাচের সুবিধার জন্য পড়ে থাকে। যার আচল কোমড়ে গুজা এক শ্যামা রমণী। যার মুখে ছেয়ে আছে স্নিগ্ধতা। মুখে কোনোধরনের কোনো কৃত্রিমতা নেই। তার ঠোঁট জুড়ে রাখা অতিমিষ্ট হাসিটাই যেন তার সবচেয়ে বড় অলংকার, সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য।

জয় এবং স্মৃতিকে দেখে ঐশী হাসিমুখে তাদের সামনে আসতেই স্মৃতি গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে। দুজনে কুশল বিনিময় শেষে ঐশী জয়কে তার হালচাল জিজ্ঞেস করলেও জয়ের কাছ থেকে কোনো উত্তর পায় না৷ বরং জয়কে একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে। তাই সে এবার একটু জোরে জিজ্ঞেস করে।

ঐশীর কথার জোড়ে জয় অমোঘ এক ঘোর থেকে যেন বেরিয়ে আসে। এতে তার হাতে থাকা সানগ্লাসটাও পড়ে যায়। জয় ঐশীর প্রশ্নের জবাবে কোনোরকম ভালো বলে সানগ্লাসটা তুলে নেয়। এবং আবারও একই জবাব দেয়।

জয়ের এমন হাবভাবে ঐশী বেশ অবাক হয়। সাথে স্মৃতিও। ঐশী জয়কে জিজ্ঞেস করে,

“ ডাক্তার সাহেব আর ইউ ওকে? কি হয়েছে আপনার?”

স্মৃতিও ভাইকে জিজ্ঞেস করে। জয় কোনো উত্তর না দিয়ে কেবল মেকি হাসি দেয়। ঐশী জয়কে কর্ণারে রাখা টেবিলে বসতে দেয়। এবং সে বাম দিকের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর দুই গ্লাস ঠান্ডা পানি নিয়ে আসে। যা জয় এবং স্মৃতিকে দিয়ে নিজেও জয়ের পাশে রাখা চেয়ারে বসে পড়ে। জয় এক নি:শ্বাসে পুরো পানিটা শেষ করে। ঐশী তা দেখে প্রশ্ন করে,

“ ডাক্তার সাহেব আরেকগ্লাস পানি দিব?”

“ না না আর লাগবে না৷ আমি ঠিক আছি। আসলে খুব গরম তো।” — বলেই আবারও একটা মেকি হাসি দেয়।

“ তা যা বলেছেন। ভীষন গরম। তো বলুন কি নিবেন?”

“ না না কিছু না থ্যাংকস।”

ঐশী এবার স্মৃতিরকেও একই কথা বলে। স্মৃতিও না করে। ঐশী তখন স্মৃতিকে বলে,

“ তুমি কোন বিভাগে?”

“ আর্টসে।”

“ আর্টসে কেন? তোমার ভাইয়া ডাক্তার তাহলে তুমি সাইন্স নিলে কেন?”

“ ভাইয়া ডাক্তার দেখেই তো নিলাম। সবাই যদি ডাক্তার হয় তাহলে রোগী হবে কে? হি হি……” —স্মৃতির কথায় ঐশীও হেসে দেয়।

আর জয় একদৃষ্টিতে সেই হাসি দেখে। মেয়েটা হাসলে কথা বললে তার ঠোঁটের নিচে একটা ছোট্ট ভাজ পড়ে। যা দেখতে দারুণ লাগে। ঐশী আর স্মৃতি কথা বলছে আর জয় হা করে ঐশীর কথা বলা, তার হাসি দেখছে। এরমধ্যে ঐশী উঠে বাকিদের উদ্দেশ্য বলে,

“ গাইস এখন আপাতত বিশ্রাম নেও। ” — তারপর জয়কে উদ্দেশ্য করে বলে,

“ ডাক্তার সাহেব আপনি বসুন আমি আসছি।”
বলেই সামনের দিকে গিয়ে সাদা পর্দা সরিয়ে ভিতরে ঢুকে যায়। এতক্ষণ যা ওরা পুরোটা দেয়াল মনে করছিল, সেখানে একটা দরজাও আছে। দেয়ালটাও সাদা হওয়ায় তা ওরা বুঝতে পারে নি। ওপাশেও হয়তো আরেকটা রুম আছে। অল্প কিছুক্ষণ পরই আবার ঐশী চলে আসে। চেয়ারে বসে বলে,

“ এই ফরমটা পূরণ করতে হবে।”

জয় প্রশ্ন করে

“আর?”

“ আর কিছু না। কেবল মাসিক বেতনটা দিলেই হবে।”

“ কত?”

“ এক হাজার।”

“ মাত্র এক হাজার!”

“ কেন কম হয়ে গেল নাকি? আপনি চাইলে বেশিও দিতে পারেন, আমি কিছু মনে করবো না।” — বলেই হেসে ফেলে ঐশী। তার সাথে জয় আর স্মৃতিও যোগ দেয়।

“ না মানে এখন এক হাজার টাকায় কেউ এসব শেখায় জানা ছিল না। অনেক আগেও এক হাজার টাকা নিয়ে শেখানো হতো তাই বললাম। ”

“ আমিও শিখেছি। ম্যাম বাসায় এসে শিখাতো। এখন ওরা আমার কাছে এসে এক হাজার টাকায় শিখছে পার্থক্য তো আছেই তাই না।”

জয় হ্যাসূচক মাথা নাড়ায়৷ স্মৃতি ফরমটা ফিলাপ করে দিলে ঐশী স্মৃতিকে বাকিদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। এরপর স্মৃতিকে বলে,

“ তাহলে আজকে এখন থেকেই স্টার্ট করে দেও। কোনো সমস্যা নেই তো?”

“ না না কোনো সমস্যা নেই। ”

“ আর তুমি চাইলে টাইমটা চেঞ্জ করে তোমার কমফোর্টেবল টাইমেও আসতে পারো। তবে সেটা কয়েকদিন পর থেকে। ”

“ না আপু এটাই কমফোর্টেবল আছে। কলেজ ছুটির পর এটুকু টাইম আমার হাতে অবসর থাকে। এই সময়টাকে কাজে লাগালাম আরকি। এরপর অন্যান্য প্রাইভেট আছে। ”

“ তাহলে তো ভালোই হলো। তুমি তাহলে বাকিদের সাথে কথা বলে পরিচিত হয়ে নাও আমি আসছি।”

এরপর ঐশী জয়ের কাছে গেল। জয়কে মনযোগ দিয়ে আশপাশ দেখতে দেখে। সে গিয়ে দাঁড়াতেই জয় বলে,

“ শুধু কি এই একটা রুমই? ওপাশে মনে হচ্ছে আরেকটা রুম আছে। ”

“ হ্যা আরও রুম আছে। আসুন আমি আপনাকে দেখাচ্ছি।”

এরপর জয়কে নিয়ে বাম দিকের দরজা দিয়ে বের হয়। দরজা পেরোতেই বেশ বড়সড় লম্বা একটা বারান্দা। বারান্দা পেরিয়ে আবার উঠোনের মতো খালি জায়গা৷ জায়গাটা চারপাশ দিয়ে বিভিন্ন গাছগাছালীতে ভরা। বারান্দা দিয়ে সোজা ডানদিকে হাঁটলে দুটো রুম, কিচেন, বাথরুম সবই আছে। বেশ বড়সড় আর খোলামেলা জায়গা। কিন্তু সব রুমগুলো খালি।

সব দেখে জয় বলে,

“ বেশ বড়সড় আর খোলামেলা জায়গা। আপনি কি এখানেই থাকবেন? না মানে এই রুমগুলো নাহলে কি করবেন?”

“ আসলে ওরকম রুম পাচ্ছিলাম না। রুম পেলে বাজেটে কুলাচ্ছিল না, বাজেট হলে রুম হচ্ছিল না, আবার পরিবেশটাও মন মতো হচ্ছিল না। তাই এইপুরো ফ্ল্যাটটা নিয়ে নিলাম। উপরের তলাটা মালিকদের জন্য হলেও। তারা এখানে থাকে না। মাঝে মাঝে আসে। গানের আওয়াজে সমস্যাও হবে না। আর রুম ব্যাপার না। একটা নিজের জন্য রাখব। থাকবো না হয়তো। তবে থাকলো নিজের একটা আরাম আয়েশের জায়গা। আর একটা রুম কেউ যদি সবদিক বিবেচনা করে মেনে থাকতে পারে তাহলে তাকে দিলাম। আর নাহলে থাকলো এভাবেই। বাসাটা আমার বাজেট অনুযায়ী। ”

“ কতজন স্টুডেন্ট? ”

“ স্মৃতিকে নিয়ে ছাব্বিশ জন হলো।”

“ বাসাটা পনেরো’র মধ্যে নিশ্চয়ই? পনেরো হাজার গেলেও আপনার কাছে তাও এনাফ এমাউন্ট থাকছে। স্টুডেন্ট আরও বাড়বে। বাহ্ ইম্প্রেসিভ। আমি মেডিকেলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত এক পয়সাও কামাই করতে পারি নি। মেডিকেলে উঠে কেবল একটা স্টুডেন্ট পড়িয়েছি। আর আপনি তো এখন থেকেই হাজার হাজার টাকার মালিক! ধন্য ম্যাডাম আপনি ধন্য…….”

জয়ের কথায় ঐশী হেসে দেয়। সাথে জয়ও হেসে দেয়।

#চলবে……..
( কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ। তবে শেয়ার করতে পারেন।)

[ বি:দ্র: কিছু ব্যক্তিগত অনিবার্য কারণ বশত আমি আগামী সাতদিন গল্প দিতে পারবো না। Out of network হয়ে যাব। সুস্থ থাকলে সাতদিন পর থেকে আবার গল্প দিব ইনশাআল্লাহ। তবে সুযোগ এবং নেটওয়ার্ক পেলে অবশ্যই আমি গল্প দেওয়ার চেষ্টা করব। ❤️❤️

এটা আমার লেখা প্রথম গল্প। আর জার্নির শুরুতেই চলমান গল্পে এমন লম্বা ব্রেক নেওয়ার জন্য আমি খুবই দুঃখীত। তবে আমি এখন অপারগ। সরি। দোয়া করবেন আমার জন্য আমি যেন সুস্থভাবে ফিরে এসে আবার গল্প লিখতে পারি। 😊😊]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here