#সূর্যোদয়
#পর্ব_২৯
#কারিমা_দিলশাদ
ঐশীদের ড্রয়িং রুমে ঐশীর বাবা মা’র সামনে বসে আছেন ইলোরা ইয়াসমিন। এর মাঝে কে’টে গেছে দু’টো দিন। আজকে ইলোরা ইয়াসমিন এসেছে ঐশীদের বাসায়। যদিও তিনি বেশ দোনোমোনোয় ছিলেন। বিয়ের কথা একরকম ঠিকঠাক হওয়ার পর তার ছেলের কর্মকাণ্ডেই তা আর আগানো সম্ভব হয়ে উঠে নি। এখন আবার এতদিন পর সেই প্রস্তাব নিয়ে আসতে তিনি বেশ দ্বিধায় ছিলেন। তবে তার শংকাকে দূরে ঠেলে ঐশীর বাবা মা তাকে বেশ সাদরে গ্রহণ করেন।
একপর্যায়ে আমতা আমতা করে তার আসার কথাটা বললে ঐশীর বাবা মা অনেক খুশি হয়। তা মুখের ভাবভঙ্গি দেখেই বুঝা যায়।
“ এটা তো অনেক খুশির খবর আপা। আপনাদের মতো এতোবড়ো মানুষ আমাদের সাথে সম্পর্ক করতে চান এটাই তো বড় কথা। আসলে আমার মেয়েটা ওইদিন এসে বলেছিল আপনার ছেলে অন্য একটা মেয়েকে পছন্দ করে। আর সে সেটা নিয়ে অনেক সিরিয়াস। তাই আর আগায় নি। এখন এতদিন পরে এসেও যদি সম্পর্কটার একটা গতি হয় এটা তো অনেক ভালো কথা। কি বলো ঐশীর মা?”
“ হ্যা আপা। এটা আমাদের জন্য খুব ভালো খবর। আপা আপনার ছেলে আবার এই বিষয়ে জানে তো?”
“ হ্যা হ্যা আপা। ও এসে পড়বে এক্ষুনি। আসলে বের হচ্ছি তখনই ওর একটা ইমার্জেন্সি কাজ পড়ে যাওয়ায় ওকে যেতে হয়েছে। এসে পড়বে ও।”
ইলোরা ইয়াসমিন হেসে জবাব দিলেও মনে মনে সে অবাকের সাথে সাথে ভীষণ ভাবে ভড়কেও গেছে। এতো সহজে যে সবকিছু মিটমাট হয়ে যাবে তা সে কল্পনাও করে নি। ঐশীর বাবা মা’র কথা শুনে মনে হলো তারা প্রস্তাব নিয়ে এসেছে এটাই বেশি। আর কিচ্ছুর প্রয়োজন নেই। অন্তত বাবা মা হিসেবে তাদের আরও সচেতন হওয়া তো উচিত। যদি এই ঘটনাটা স্মৃতির সাথে হতো তাহলে সে ওমন ছেলের কাছে স্মৃতিকে কক্ষনো দিত না। আর এরা কেমন বাবা মা! বড় ফ্যামিলি থেকে বিয়ের প্রপোজাল আসাটাই কি বড়! তিনি অপ’মান এবং বেশ কিছু কটুকথা শুনতে হবে, এমন পরিস্থিতির জন্য মানসিক ভাবে তৈরি ছিলেন। তবে তেমন কিছুই হয় নি। এটা ভেবে সে যেমন স্বস্তি পাচ্ছে, তেমনি একজন নারী এবং মা হিসেবে তিনি ততটাই অবাক এবং আশাহত হচ্ছেন।
সব ভাবনাকে দূরে সরিয়ে সে ঐশীর মায়ের উদ্দেশ্য বলেন,
“ আপা যদি কিছু মনে না করেন আমি একটু ঐশীর সাথে দেখা করতে পারি?”
“ হ্যা হ্যা আপা। আমি এক্ষুনি ওকে নিয়ে আসছি।”
“ নিয়ে আসতে হবে না আপা। আমি এমনিতেই ওর সাথে একটু দেখা সাক্ষাৎ করতে চাই। অন্যকিছু করার দরকার নেই। ”
“ ঠিক আছে আসুন। ও হয়তো ওর রুমেই আছে। চলুন আপা।”
ইলোরা ইয়াসমিন উঠে তার পিছন পিছন যায়। যাওয়ার আগে অবশ্য একবার ছেলের সাথে কথা বলে নেয়। কথা বলে জানে জয় বাসার কাছাকাছি চলে এসেছে। ইলোরা ইয়াসমিন যেই রুমে প্রবেশ করবে সেই তিনি ঐশীর মা’র চিৎকার শুনতে পান। তিনি তড়িঘড়ি করে রুমে গিয়ে দেখেন ঐশী বিছানায় শুয়া আর তার মা তাকে অনবরত ডেকে যাচ্ছে। ঐশীর মা’র চিৎকারে ঐশীর বাবাও ছুটে এসেছেন।
ইলোরা ইয়াসমিন ঐশীর কাছে গিয়ে তার গায়ে হাত দিয়ে দেখে মেয়েটার শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। আর মেয়েটার সেন্স নেই। ঐশীর বাবা মা ঐশীকে নিয়ে অস্থির হয়ে পড়ে। তাদের চিৎকার চেচামেচি তে ঐশীর ভাইও তার রুমে এসে দাড়িয়েছে। এতকিছুর মাঝে ইলোরা ইয়াসমিন তাড়াতাড়ি জয়কে ফোন করে এখানের পরিস্থিতি সম্পর্কে বলে। জয় জানায় সে এসে পড়েছে, তখন তিনি ঐশীদের ফ্ল্যাট কোনটা সেটা বলে ফোন কে’টে দেয়। এরপর তিনি হাতের আজলে পানি নিয়ে ঐশীর মুখে ছেটাতে থাকে।
—————————–
জয় ঐশীদের বাসার দরজার সামনে দাড়িয়ে আছে।ঐশীদের বিল্ডিং-এ এসে বাইক পার্কিং-এ রাখছিল। তখনই ইলোরা ইয়াসমিনের ফোন আসে। এটুকু জায়গা যে সে কিভাবে এসেছে সে নিজেও জানে না। ভিতর থেকে কান্নাকাটির আওয়াজ আসছে। সে কাঁপা কাঁপা পায়ে এক পা দু পা করে কান্নার উৎসের নিকট এসে পৌছায়।
ভিতরের অবস্থা দেখে তার পা আর এগুচ্ছে না। ইলোরা ইয়াসমিন ছেলেকে দেখে এগিয়ে আসেন। ছেলের অবস্থা হয়তো তিনি বুঝতে পারেন, তাই তিনি জয়ের কাঁধে হাত রাখেন। জয় তার দিকে তাকালে তিনি জয়কে ঐশীর কাছে যেতে ইশারা করেন।
দরজা থেকে ঐশীর বিছানার দূরত্ব বড়জোর চার-পাঁচ কদম। অথচ এই কয়েকটা কদম চলতেই জয়ের পা কুলাচ্ছে না। বিছানায় নিথর হয়ে শুয়ে আছে ঐশী। কিন্তু সে তো এই ঐশীকে কাম্য করে নি। সে ভেবেছিল এসে ঐশীর রাগী মুখটা দেখবে। এসে তাকে ঐশীর তীক্ষ্ণ নজরের সামনা করতে হবে। কিন্তু তাকে এসে যে প্রেয়সীর রুগ্ন নিথর দেহ দেখতে হবে তা সে কল্পনাও করে নি।
সে কোনোরকমে গলা দিয়ে তাকে দেখতে দেওয়ার কথাটা বের করে। ঐশীর মা বাবা সরে গিয়ে জয়কে ঐশীর পাশে বসার জায়গা দেয়। জয় গিয়ে ঐশীর পাশে বসে। বেশ কয়েকবার জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টা করে। এরপর হাত রাখে ঐশীর কপালে এবং গলায়।
ইশশ কি মারাত্মক জ্বর। এটাই কি ভবিতব্য ছিলো। কি করতে চেয়েছিল সে, আর কি করতে হচ্ছে। ঐশীর সেবা করার দায়িত্ব কর্তব্য যাই বলা হোক তাই করতে রাজি জয়। হাসিমুখে সে বারংবার তা করতে রাজি। তবে প্রেয়সীর অসুস্থতা তো তার কাম্য না।
বন্ধ চোখ, শুকনো মুখ, শুকনো ঠোঁট, ঠোঁটের কোণের দাগটা এখনও আছে। সে নিজের আবেগ ভালোবাসা সবটাকে সাইডে রেখে ডাক্তার ধর্ম পালনে সচেষ্ট হয়ে উঠে। কিছু চেকআপ করে ঐশীর বাবার উদ্দেশ্য বলে,
“ আংকেল ওকে এক্ষুনি হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। ইমিডিয়েটলি কিছু চেকআপ করা প্রয়োজন। তারপরেই ওষুধ দেওয়া যাবে। আমি এ্যাম্বুলেন্সে ফোন করছি। তার আগে এই ইনজেকশন দুটো পুশ করতে হবে। তারাতাড়ি কাউকে দিয়ে আনিয়ে দিন।”
বলে একটা প্যাডে দুটো ইনজেকশনের নাম লিখে দেয় সে। ঐশীর বাবা ঐশীর ভাইকে তারাতাড়ি তা আনতে বলে। ঐশীর ভাই তা আনলে ঐশীর শরীরে সেগুলো পুশ করে দেয়। এর কিছুক্ষণ পর এ্যাম্বুলেন্সও চলে আসে। ঐশীর বাবা আর ভাই ধরাধরি করে ঐশীকে এ্যাম্বুলেন্সে তুলে দেয়।
জয় একবার ধরতে গেছিল। কিন্তু ওনারাই না করেন। আজ কেবল জয়ের সেই অধিকারটা নেই বলে।
——————————–
বেশ কিছু পরীক্ষা নীরিক্ষা করে ঐশীকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। ঐশীর রিপোর্টগুলো নিয়ে জয় ঐশীর বাবা মা’কে তার কেবিনে ডাকে। যদিও তাদের সাথে কথা বলতে জয়ের বিন্দুমাত্র ইচ্ছে করছে না। তবে সে এখন একজন ডাক্তার। তাকে তার ডিউটি পালন তো করতেই হবে।
“ খুব জোর বাঁচা বেঁচে গেছে ও। অতিরিক্ত জ্বরে সেন্স লেস হয়ে যাওয়াটা মারাত্মক ক্ষতিকর। ওর প্রাণও যেতে পারতো। আপনাদের কি একটু সচেতন হওয়া উচিত ছিল না?”
ঐশীর মা চট করে জবাব দেয়,
“ আমাদের কথা শুনলে তো বলমু। আমাদের কোনো কথাই তো শুনে না৷ জ্বর যে হইছে একবারও বলছে নাকি আমরারে…..”
ঐশীর বাবা তার হাত চেপে ধরতেই তিনি চুপ হয়ে যান। যা দেখে জয় আড়ালে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দেয়। হয়তো জয়ের সাথে একটা নতুন সম্পর্ক তৈরির কথা হচ্ছে বলে ঐশীর বাবা তাকে থামিয়ে দেয়। নাহলে হয়তো এই মহিলা আরও কিছু বলতো। নিজের সন্তান ঘরে জ্বরে সেন্স লেস হয়ে পড়ে আছে, আর মা হিসেবে তার কোনো খুঁজই নেই। এতোটা জ্বরে সেন্স লেস তো আর হুট করে হয় নি। মানুষের অসুস্থতা তো মুখ দেখলেও বোঝা যায়। এরা আদোও ঐশীর বাবা মা তো?
———————————
জয় ঐশীর কেবিনে বসে আছে, আর ঐশীকে দেখছে। ঐশীর বাম হাতটায় ক্যানোলা লাগানো৷ সেই লাগিয়েছে। যদি নার্সেরা ঐশীকে ব্যাথা দেয় সেই ভয়ে।
প্রেয়সীর যেই হাতে সে চু’মু খেতে চেয়েছিল যেই হাতটা এখনও নিজের করার বাকি। সেই হাতেই তাকে চু’মুর বদলে সূচ ফোঁটাতে হয়েছে। জয় আলতো করে ঐশীর অপর হাতটা ধরে নিজের কপালের সাথে লাগায়।
তার চোখ ফেটে পানি আসছে, ঐশীর এই দূর্দশা দেখে। না জানি কতটা কাতরেছে জ্বরে। না জানি কতটা অসহায়বোধ করেছে। যা কিছু হয়ে যাক ঐশীকে সে এই নরক থেকে মুক্ত করে নিজের মনের আকাশে স্বাধীন করে দিবে। ঐশীর হাতটা সাবধানে বিছানায় রেখে নিরব পায়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে আসে।
বাইরে এসে দেখে ইলোরা ইয়াসমিন সামনে রাখা চেয়ারগুলোতে বসে আছে। জয় গিয়ে ক্লান্ত অবিশ্রান্ত হয়ে তার পাশে বসে। রোজ রোজ কত ক্রিটিকেল কেস হ্যান্ডেল করে, তবে আজকের মতো ক্লান্তি সে তার এ যাবতের ক্যারিয়ারে কখনো অনুভব করে নি। বলে না আপনজনের গায়ে একটা আঁচড় লাগলেও বুক ফালা ফালা হয়ে যায়। তার হয়েছে সেই দশা।
জয় হাত দুটো দুই হাঁটুর উপর রেখে উবু হয়ে চুপচাপ বসে আছে। ইলোরা ইয়াসমিনও চুপচাপ বসে আছে। শুরু থেকে তিনি ঐশীর সাথেই ছিলেন। কেবল মাঝখানের কিছু সময় বাসায় গিয়ে ঐশী এবং তার মা বাবার জন্য খাবার নিয়ে আসেন।
নিরবতা ভেঙে জয় বলে,
“ ঐশীর খুব খারাপ কিছু হয়ে যেতে পারতো মা। বলতে পারো অল্পের জন্য বেঁচে গেছে। ঘরে একটা মানুষ অসুখে পড়ে আছে। আর ঘরের কেউ জানেই না এমনও হয় মা? তাও নিজের সন্তান। যেখানে তার মা বাবা উপস্থিত! ঐশীর ভাই বললো কালকে দুপুরের পর নাকি ঐশী আর ঘর থেকে বের হয় নি। দুপুর গড়িয়ে রাত গড়িয়ে সকাল গড়িয়ে গেছে অথচ ওর মা বাবার কোনো খোঁজ নেই! আর ওর মা বলছিল ঐশী নাকি বলেই নি যে তার জ্বর। তাহলে তারা কি করছিল?”
“ ওর মা বাবার আচরণে আমিও হতভম্ব। তারা সবকিছু খুব সহজে মানে অতি সহজে মেনে নিয়েছে বুঝলি। সত্যি বলতে ওদের জায়গায় আমি হলে আমি বিয়ের জন্য কোনদিন মানতাম না। আর সেখানে তাদের কথায় মনে হলো মেয়েটা তাদের কাছে খুব বোঝা। তাদের এসব কান্নাকাটি না আমার জাস্ট অসহ্য লাগছিল জানিস। কুমিরের কান্না মনে হচ্ছিল। সন্তান একবেলা না খেলেও তো মনে খচখচ করে। আর সন্তান ঘরে অসুখে জ্ঞান হারিয়ে নিথর হয়ে পড়ে আছে আর তাদের কোনো খোঁজ নেই! আমি নিজেও জানি না কি বলবো বা কি বলা উচিত।”
“ সন্তান তার মা বাবার কাছে সবচেয়ে বেশি নিরাপদ থাকে। সেখানে মেয়েটা তার বাবা মা’র কাছে সবচেয়ে অনিরাপদ। মা…. আমি তো ভেবেছিলাম ঐশীর মনে আগে আমি নিজের জন্য জায়গা তৈরি করে তারপর বিয়ে করবো। এখন তো আমার প্রচুর ভয় করছে। আমার আমানত তাদের কাছে কিভাবে সুরক্ষিত থাকবে বলো?”
মা ছেলের কথার মাঝেই ঐশীর মা বাবা চলে আসায় তারা তাদের কথা সেখানেই স্থগিত রাখে। ইলোরা ইয়াসমিন ঐশীর মা বাবাকে জোর করে খাবার খাওয়ায়। তারা তো খেতেই চাইছিল না। বিষয়টা তার কাছে রীতিমতো হাস্যকর মনে হলো। ঐশীর মা আরও অদ্ভুত মহিলা। বোনদের কাছে বানিয়ে বানিয়ে কত যে গালগল্প করছে, যদিও তার সামনে না দূরে গিয়ে। কিন্তু মহিলার যা গলা তাতে তিন মাইল দূরে থেকেও তার কথা শুনতে পারা যায়৷ তিনি ভাবেন সন্তানেরাও বাবা মা’র কাছে কত্ত অসহায়। ঐশীর মতো অনেক পরিবারের সন্তানদের কথার কখনো গুরুত্ব দেওয়া হয় না, তাদের অভিযোগগুলো কানে তুলা হয় না, তাদের মতামতকে প্রাধান্য দেওয়া হয় না৷ এমন পরিবেশে বাচ্চাগুলো যে টিকে থাকে এটাই তো মস্ত এক চমৎকার।
ঐশীকে ঘুমের ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে। সকালের আগে তা ভাঙবে না। ঐশীর বাবা-মা, ভাই এমন অবস্থায় মেয়েকে একা রেখে বাসায় চলে যায়। যদিও তাদের থাকার মতো ব্যবস্থা নেই। তারপরও স্বাভাবিকভাবেই পরিবার থেকে একজন থাকেই। ওনারা চলে যাওয়ায় জয় আজ হাসপাতালে থাকবে বলে ঠিক করে। এমনেতেও বাসায় গিয়েও তার মন টিকবে না। এখানে থাকলে ঐশীকে দেখতে তো পারবে। আজ প্রেমিকার সেবায় নিয়োজিত এক প্রেমিক সে।
#চলবে
( কপি করা নিষেধ। কেউ কপি করবেন না। তবে শেয়ার করতে পারেন।
আর কেমন লাগলো জানাবেন। গল্পটা কেমন লাগছে তাও জানাবেন। ধন্যবাদ।)