#সূর্যোদয়
#পর্ব_৩১(খ)
#কারিমা_দিলশাদ
“ ডাক্তারসাহেব আমার জীবনটা আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতো না। আব্বু আম্মুর বিয়ের দশ বছর পর অনেক সাধনার পর আমি আম্মুর গর্ভে আসি। তখন আমরা একটা মফস্বল শহরে থাকতাম। যেদিন আম্মু আলট্রাসাউন্ড করে জানতে পারে তিনি মেয়ে সন্তানের জন্ম দিতে যাচ্ছে সেদিন নাকি আম্মু একেবারে ভেঙে পড়ে। অথচ দশ বছর পর প্রথমবারের মতো সে সন্তানের মুখ দেখার সুযোগ পাচ্ছে। আম্মু এ’বোরশন করার চিন্তা করে। কিন্তু আব্বু খুব খুশি ছিল মেয়ে হবে শুনে। আব্বুর বাঁধা দেওয়ায় আম্মু আর আমাকে নষ্ট করতে পারে নি। তারপরও নাকি বেশ কয়েকবার বিভিন্নভাবে নষ্ট করতে চেয়েছিল কিন্তু আল্লাহর কৃপা বলব নাকি আমারই দূর্ভাগ্যের কারণে আজ আমি বেঁচে আছি জানি না। আম্মু ছেলে সন্তান চাইতো। বিভিন্ন ঝামেলা মাথায় নিয়েই আমি জন্মালাম। জন্মের পর থেকেই আমি খুব রেস্ট্রিকশনের ভিতর বড় হতে থাকি। জানেন ছোটবেলায় আমি কখনো খেলতে যেতে পারি নি। ক্লাস এইটের আগ অবধি আমার কোনো ফ্রেন্ডস ছিল না। বিকেলে যখন সব বাচ্চারা মাঠে খেলতো তখন আমি আম্মুর নজর বাচিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে তা দেখতাম। আম্মু দেখতেও দিত না। সারাদিন আমি ঘরে একা একাই এটা ওটা নিয়ে খেলতাম। আম্মু সারাদিন বাসায় থাকলেও কখনো আমার সাথে খেলতো না। বিকেলে আম্মু পাচঁ মিনিটের জন্য বাইরে নিয়ে যেত, তবে সবসময় হাত ধরে রাখতো। কেবল রাতে আব্বু এসে আমার সাথে খেলতো। তখন ছোট ছিলাম তো বিষয়গুলো আমার খারাপ লাগলেও ওটাই স্বাভাবিক মনে হতো। অভিযোগ ছিল কিন্তু বলতে পারতাম না। এভাবেই চলতে থাকে।
জীবন তো বদলে যায় আমার ভাই হবার পর। আমার যখন আট বছর বয়স তখন আমার ভাইয়ের জন্ম হয়। খুব খুশি ছিলাম জানেন। শওকত ছোটবেলায় এত্তো পরিমান কিউট ছিল, যে সারাদিন আমি ওকে নিয়েই পড়ে থাকতাম। আমার একলা জীবনে একজন খেলার সাথী এসেছে। সবকিছু একদম ঠিকঠাক। কিন্তু একদিন আস্তে আস্তে খেয়াল করি সব ঠিকঠাক থেকেও কোথাও কিছু একটা ঠিক নেই। আগে আব্বু প্রতিদিন অফিস থেকে ফেরার পথে আমার জন্য কিছু না কিছু নিয়ে আসতো। এখনও আনে, কিন্তু আমার জন্য আনে না। ভুলে যায় কি না জানি না। খালি শওকতের জন্য আনে। শওকত হওয়ার পর ওরা তিনজন কিভাবে কিভাবে জানি এক হয়ে গেল আর আমি আঁটি হয়ে বাইরে গড়াগড়ি খেতে লাগলাম। আম্মুর সাথে আমার সম্পর্ক কখনোই অতোটা আদর আহ্লাদের ছিল না। কিন্তু আব্বু? আব্বুও আমাকে সাইড করে দিল এটা আমি মানতে পারছিলাম না। আর আমাদের সমাজের কিছু মানুষ তো আছেই ছোট ভাইবোন হলেই তাদের কিছু কমন ডায়লগ থাকে ওই যে- এখন থেকে তো তোমার আদর কমে যাবে সবাই কেবল বাবুকে আদর করবে তোমাকে আদর করবে না এগুলো। তাদের কথাগুলো যেন তখন আমার সত্যি মনে হতে লাগলো। আমার জায়গায় অন্যকোনো বাচ্চা থাকলে কি করতো আমি জানি না। তবে আমি নিজেকে একেবারে গুটিয়ে নেওয়া শুরু করলাম। ওই সময়টা আমার উপর দিয়ে কি যাচ্ছিল তা আমি কাউকে বলে বোঝাতে পারব না। আটটা বছর একটা বাধা ধরা জীবন কাটিয়েছি, আদর পেয়েছি, কিছুটা বয়স হলেও বাইরের দুনিয়া সম্পর্কে আমার বিন্দু পরিমাণ কোনো জ্ঞান ছিল না। সেখানে হুটকরে আমার উপর থেকে সবার মনোযোগ সরে যাওয়াটা আমায় কষ্ট দিত। স্কুলের কেউও আমার সাথে মিশতো না। আমিও কারো সাথে মিশতে পারতাম না। অভ্যাস নেই তো, আর ওরা আমাকে অন্য চোখে দেখতো। কি যে চাপ নিয়ে থেকেছি তা আল্লাহ ভালো জানে। কেবল পড়াশোনা, নাচ আর শওকত এগুলো ধরে জীবন চলতে থাকে। আম্মু আবার আমাকে অনেক ছোট থেকেই নাচ শিখাতো। নাচতে আমার বরাবরই খুব ভালো লাগতো।
শওকত আস্তে আস্তে যত বড় হতে থাকে আম্মু আব্বুর ওকে নিয়ে পজেসিভনেস ততো বাড়তে থাকে। একবার কি হয়েছে জানেন? শওকতের বয়স তখন এক দেড় বছর। আমরা গ্রীষ্মের ছুটিতে গ্রামে যাই। আমি প্রথমবারের মতো সেবার গ্রামে যাই। তখন আবার ধানকাটারও সময় ছিল। গ্রামের বাড়িতে গিয়ে প্রথমবারের মতো এতো খোলামেলা জায়গা আর খেলার সুযোগ আর সাথী সব পেয়ে আমি তো আকাশে উড়ছি। শওকত আমার সাথেই ছিল। আমি খেলার ধান্ধায় থাকতেই শওকত কখন যেন ধান মুখে দিয়ে ফেলেছিল আমি খেয়াল করি নি। এই অপরাধে আম্মু আমার বুকে লা’থি মারে। লা’থিটা এতোটা জোরে ছিল যে আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। চারদিন আমি হাসপাতালে ছিলাম। ওই চারদিনে আম্মু একবারও আমাকে দেখতে যায় নি।
এসবের মাঝেই বড় হতে থাকি। যখন ক্লাস সিক্সে উঠি প্রথম স্কুলের দিনই মা সাবধান করে দেয় কারো সাথে যেন না মিশি। আমি আবার আম্মু আব্বুর বাধ্যগত সন্তান ছিলাম। তখন তাদের আমি খুব ভয়ও পেতাম। তাই তাদের কথা রাখতে কারো সাথে মিশি না। এভাবে যখন ক্লাস সেভেনে উঠি তখন একদিন আমার হঠাৎ করে মনে হয় কি করছি লাইফে? আমার খুশিটা কোথায়? ক্লাসের সবাই যখন একজন আরেকজনের সাথে মজা করতো, পিছনে লাগতো, টিফিন শেয়ার করে খেত আমি তখন কোণার এক বেঞ্চে বসে তাদের আনন্দ দেখতাম। বাসায় গিয়েও একা। ততদিনে শওকত আস্তে আস্তে বড় হচ্ছিল আর সবকিছুতে তার জেদ বাড়ছিল। মুখ দিয়ে যা বের করবে তা দিতে হবে মানে হবেই। এসব আমার ভালো লাগতো না। ওর থেকেও দূরত্ব বাড়তে লাগে। আমি হয়ে যাই একদম একা। তখন রিয়েলাইজ করি নিজেকে খুশি আমার নিজেকেই রাখতে হবে। কেউ আমার খুশির কারণ হবে না। এরপর থেকে আস্তে আস্তে ক্লাসের সবার সাথে মিশতে শুরু করলাম। প্রথম প্রথম খুব জড়তা কাজ করতো। তবে পরে ঠিক হয়ে যায়। নতুন নতুন ফ্রেন্ডস হয়, আমি বাসার বাইরে হাসিখুশি থাকতে শুরু করি। আগে শিক্ষা সপ্তাহ হতো না? ক্লাস এইটে যখন তখন আমি জেলা লেভেলে প্রথম হয়ে জাতীয় পর্যায়ে যাওয়ার সুযোগ পাই। ঢাকায় যেতে হতো, কিন্তু আব্বু আম্মু না করে। আমি তাদের বোঝায় এটা আমার জন্য অনেক বড় সুযোগ। আমি নাচ নিয়ে কিছু একটা করতে চাই কিন্তু তারা আমার কোনো কথা শুনে না। বরং সেদিন আমার ওই যাবতকালের নাচের সব মেডেল সার্টিফিকেট আম্মু পুড়িয়ে ফেলে। আব্বু চুপচাপ সব দেখছিল কিন্তু কিছু বলে নি। সেদিন নিজের শখ স্বপ্নকে জ্বলে ছারখার হতে দেখি। এরপর থেকে আমি কলেজে উঠার আগ পর্যন্ত আর কখনো নাচ করি নি।
এরপর শুরু হলো ডাক্তার হও ডাক্তার হও। সাইন্স নিয়ে না পড়লে ডাক্তার না হলে জীবনের কোনো মূল্য নেই। নাইন টেনে নিজের ইচ্ছেতেই সাইন্স নিয়ে পড়লেও পরবর্তীতে আমি বুঝে যায় এগুলো আমার জন্য না। আমি এগুলোর চাপ নিতে পারব না। এই ফিজিক্স ম্যাথ আমার মাথায় ঢুকে না। এসএসসির পর বিভাগ চেঞ্জ করার কথা বলতেই ঘরে তুফান শুরু হয়ে যায়। তাদের এককথা পড়তে হলে সাইন্স নিয়েই পড়তে হবে এবং ডাক্তার হতে হবে। নাহলে পড়ালেখার কোনো দরকার নেই। বিয়ে দিয়ে দিবে। আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম। আমার ফ্রেন্ডরা বললো এসব ভয় দেখানোর জন্য বলছে তুই বোঝা ওনাদের, আমিও ভাবলাম ওরা হয়তো ঠিকই বলছে। কিন্তু আমাকে ভুল প্রমাণ করে ওরা সত্যি সত্যি পাত্র দেখা শুরু করে। আমি দমে গেলাম আর সাইন্স নিয়েই পড়বো বলে জানালাম।
তবে সাইন্স নিয়ে আমি টিকতে পারছিলাম না৷ হচ্ছিল না আমার দ্বারা৷ তবে পারি না পারি না করেও কিভাবে কিভাবে যেন এইচএসসিতেও এপ্লাস পেয়ে গেলাম। তবে আমার বাবা মা তাতেও খুশি ছিল না। তাদের কথা ছিল আমি গোল্ডেন কেন পেলাম না। সেদিন বুঝলাম এদের আমি কোনোকিছু দিয়ে খুশি করতে পারব না৷ এরা তলা ভাঙা পাতিল। যত যাই দেওয়া হোক এদের মুখ ভরবে না। আর একদিন এটাও বুঝতে পারলাম ডাক্তার হওয়া আমার কর্ম না৷
ডাক্তারি বিরাট দায়িত্বের একটা পেশা। ডাক্তারের হাতে একটা মানুষের জীবন ম’রণ থাকে। আমার দ্বারা সম্ভব না এসব করা। এডমিশনের সময় তাদের পা পর্যন্ত ধরেছি আমি মেডিকেল কোচিং করব না আমি ডাক্তারি পড়ব না। জোর করেই তারা আমাকে মেডিকেল কোচিং এ ভর্তি করে। আর তাদের বক্তব্য ছিল সরকারিতে না হলেও তারা আমাকে প্রাইভেট মেডিকেলে হলেও পড়াবে, তবুও ডাক্তার হতেই হবে। তখন আমি একটা ছল করি। আমি মেডিকেলে কোচিং করলেও আমি ভার্সিটির জন্য পড়তে থাকি। আমার অন্যান্য ফ্রেন্ড’দের সহায়তায় পুরোদমে ভার্সিটির প্রিপারেশন নেই। যারফলে যা হওয়ার তাই হয়, মেডিকেলে আমার চান্স হয় না। এবং জেনেবুঝে আমি পাশমার্কও আন্সার করি না। ভালো মার্ক থাকলে প্রাইভেটে ভর্তি করিয়ে দিবে, তাই সেটাও করি না। আমি আমার পরিবার থেকে দূরে যেতে চাইতাম সেই সুযোগটাও এসে পড়ে। সাস্ট থেকে ভাইবার ডাক আসে। কিন্তু আব্বু আম্মু ওতদূরে দিবে না। তাই আর যাওয়া হলো না।
ইয়ার গ্যাপ দিয়ে দ্বিতীয়বার আবার মেডিকেলে কোচিং করায় এবারও সেম কাহিনিই করি। ভেবেছিলাম এবার যেকোনা জায়গায় যেতে দিবে। আর আমি একদম কনফিডেন্ট ছিলাম নিজেকে নিয়ে একটা না একটা ভার্সিটিতে আমার চান্স হয়েই যাবে। তবে ভাগ্যের পরিহাস বলব না আমার মা বাপের নি’র্যাতনের শিকার বলবো জানি না। তারা আমাকে একটা ভার্সিটিতেও পরীক্ষা দিতে দেয় না। আর আমার তখন সেই সাহস বা সুযোগ ছিল না যে নিজে নিজে কিছু একটা করে ফেলবো। ভর্তি হলাম আনন্দমোহনে। অথচ এটা হওয়ার কথা ছিল না।
এতো গেলো আমার ছোটবেলা আমার অতিত জীবন কেমন কে’টেছে তা। ক্লাস নাইনে থাকতেই জীবনের এক নোং’রা সত্যির মুখোমুখি হই আমি। যখন আমি ক্লাস নাইনে সেদিন জানতে পারি আমার বাবা একজন নারীলোভী পুরুষ। আর এই কথাটা আমারই এক ক্লোজফ্রেন্ড সবার সামনে আমাকে বলে। কি লজ্জার বিষয় এটা তা আপনি ধারণা করতে পারেন ডাক্তার সাহেব? আমার বাপের স্বভাবই এটা। আমার ফ্রেন্ডের পাশের বাসায় আমার বাপের অবাধ যাতায়াত ছিল। এরপর আস্তে আস্তে জানতে পারি এসব আমার মাও জানে। সেদিন উপলব্ধি করতে পারি আমার মাও সংসার জীবনে সুখী না। কি নিদারুন কষ্ট মনে রেখে সংসার করে যাচ্ছে। তবে এর পিছনে আমার সাথে এমন করার কি কোনো মানে হতে পারে? সারাজীবন ওই মহিলা আমাকে নি’র্যাতন করে গেছে। এখন আর তারজন্য আমার কষ্ট হয় না। কেন জানেন? কারণ আমার বাপও এই মহিলার সাথে সুখী ছিল না৷ আমার মায়ের ডমিনেটিং ন্যাচারই এর কারণ। আমার মা সবসময় অন্যকে ডমিনেট করতে পছন্দ করে। বিয়ের আগে আমার ছোট খালা আর ছোট মামাদের সাথে এমন করতো। বিয়ের পর আব্বু আর তার পরিবারের উপর এমন করতো। যদিও আমার দাদা বাড়ির লোকেরাও ভালো না। তারা সারাজীবন আমাদেরটাই খেয়ে গেছে। আর জন্মের পর আমার মায়ের ডমি’নেটিং এর শিকার হতে থাকি আমি। তবে এগুলো আমার বাপের করা কাজকে কোনোভাবেই জাস্টিফাই করে না। তার এসব অন্যায় কাজের কোনো জাস্টিফাই হয় না। আম্মু যেমনই হোক আব্বুর প্রতি লয়্যাল ছিল। সংসারের জন্য খেটেছে। নিজের জীবনসঙ্গীকে ধোকা দেওয়া অসম্মান করা কোনো পুরুষের কাজ হতে পারে না। আমি আজ পর্যন্ত আমার আশপাশের কোনো ভালো পুরুষ মানুষ দেখি নি ডাক্তার সাহেব। কোনো সুখী নারী দেখি নি। বিয়ের পর সুখী, প্রেমের বিয়ে করে সুখী এমন কাউকেই পায় নি।
আমার বাপের আয় রোজগার বেশ ভালো। গড়পড়তা মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আমার বাপের আয় অনেক বেশি। তবুও আমরা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মতো চলি। আমার জন্মদাতা ওসব নারীদের পিছনে টাকা উড়িয়ে এসে আর নিজের ভাই বোন আর তাদের ছেলেমেয়েদের পিছনে টাকা উড়িয়ে এসে আমাদের টাকা হিসাব করে চলতে বলতো। আবার টাকার হিসাবের এই ব্যাপারটা কেবল আমার ক্ষেত্রে। তাদের ছেলের ক্ষেত্রে না৷ শওকত যখন যা চায় তাই পায়। আমি প্রয়োজনের একটা জিনিসও প্রয়োজনের সময় পায় নি। যেই জিনিসটা আমার এখন প্রয়োজন তা এখন না পেলে অপ্রয়োজনের সময় সেই জিনিস আমাকে দশটা দিলে তো লাভ নেই। আমি খুবই মিতব্যয়ী মানুষ। আজাইরা টাকা খরচ আমার মাঝে নেই। আমার চাহিদা এবং খরচও কম। মেয়েলি জিনিসপাতি আমি কখনোই কিনি না। একটা ঈদে আমাকে কাপড় দিলে দিলো না দিলে নাই তা নিয়ে আমি কখনোই উচ্চবাচ্য করি না আমি। তবে প্রয়োজনের জিনিসটাও আমি হাজার হাজার জেরার পরে অপ্রয়োজনে গিয়ে পাই। প্রতি মাসে মেয়েদের নিত্যপ্রয়োজনের জিনিসটা আমার হিসেব করে চলতে হতো। এক প্যাকেটের বেশি লাগলেই তার কৈফিয়ত দিতে হতো। খাতা কলম কিনতে গেলেও ঘ্যান ঘ্যান করতে করতে পেতাম। অথচ শওকত যখন ক্লাস ফোর এ পড়ে তখন আম্মু ওকে নিজে অটোতে করে দিয়ে আসতো নিয়ে আসতো। অথচ বাসা থেকে ওর স্কুলের দূরত্ব হেটে গেলেও ছয় সাত মিনিট লাগে। যখন স্কুলে দিয়ে আসতো তখন আবার পকেটে ৫০ টা টাকা দিয়ে আসতো। আমি তখন কলেজে পড়ি। বাসা থেকে কলেজের দূরত্ব আধা ঘন্টা। আমাকে কেবল বিশ টাকা দিত যাওয়া আসার জন্য। যা দিয়ে আমি যাওয়া আসা বাদে অন্য কিছুই করতে পারতাম না। মাঝেমধ্যে তো আমারও কিছু খেতে মন চাইতো কিন্তু পারতাম না। ফ্রেন্ড’দের সাথে একটু ঘুরতে মন চাইতো পারতাম না। হ্যা বাবা মা’র উচিত সন্তানদের হাতে হিসেব করে টাকা দেওয়া। কিন্তু প্রয়োজন মেটানোর মতো টাকা তো দেওয়া উচিত। আর সেটা সব বাচ্চার ক্ষেত্রেই করা উচিত। একজনকে সব দিলেন আর আরেকজনকে কিছুই না এটা কেমন পেরেন্টিং? জানেন সেই ছেলে এখন এই বয়সেই নিজের মায়ের গায়ে হাত তুলে। আমার ভাই শওকত বাবা মা’র যক্ষের ধন যে এখনও এসএসসির গন্ডিও পেরোয় নি সে আরও দু তিনবছর আগে থেকেই আম্মুর গায়ে হাত তুলা শুরু করে। এখন তো আব্বুর সাথেও প্রায় ধস্তাধস্তি লাগে। ”
জয় হতবাক হয়ে ঐশীর দিকে তাকায়। জয় এতোক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে ঐশীর কথা শুনছিল। তার চোখের কোণে পানি জমা হয়েছে। এতোকিছু মেয়েটা সহ্য করেছে কিভাবে এসবই ভাবছিল। কিন্তু শেষের কথাগুলো শুনে সে হতবাক। ওইটুকু ছেলে এই বয়সেই কি না মা বাবার গায়ে হাত তুলে। দেখতে যদিও ঐশীর থেকে বড় মনে হয়। ঐশী জয়ের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে বলে,
“ কি বিশ্বাস হচ্ছে না তাই না? অথচ বাইরের মানুষ এসব কিচ্ছু জানে না। কারণ কি জানেন? আমার মা ছেলের হাতে মা’র খেয়েও ছেলের নামে হাজারটা প্রশংসা করে। তার ছেলে খুবই ভালো আদর্শ সন্তান। একটু রগচটা তবে ছেলে মানুষের রাগই সৌন্দর্য। আর আমি কিছু না করেও বাইরের লোকের কাছে খারাপ। কেন জানেন? কারণ আমার মা নিজে মানুষের কাছে বলে বেড়ায় তার মেয়ের মাঝে কোনো গুণ নেই ঘরের কোনো কাজ করে না, অসামাজিক হেনতেন আরও কতকিছু। কিন্তু ওই যে বলে না সত্য কখনো চাপা থাকে না। আমরা আগে যেখানে থাকতাম ওখানকার মানুষও আমাকে আগে খুব কথা শুনাতো। আমি মায়ের কদর করি না, মায়ের কষ্ট বুঝি না। আর শওকত ভালো। কিন্তু একদিন আমি বাসায় ছিলাম না। ছেলের হাতের মা’র খেয়ে টিকতে না পেরে পাশের বাসায় গিয়ে যখন আশ্রয় নেয় তখন তারা এতদিনের সব কিছু বুঝে যায়। আম্মুর অপরাধ ছিল শওকতের হাত থেকে মোবাইল কেঁড়ে নেওয়া। ও যখন ক্লাস ওয়ানে তখনই ওর হাতে মোবাইল দিয়ে দিয়েছিল আব্বু। তার একমাত্র ছেলে তাও আবার আজকালকার পোলাপান। মোবাইল ছাড়া কিভাবে চলে বলেন। ওখানে নাম বেশি খারাপ হয়ে যাওয়ায় এখন আমরা এখানে এসে ফ্ল্যাট কিনে উঠেছি। তাই বিয়ের কথা উঠার পরও আপনারা এসবের কিছু জানেন না। তারপরও ছেলে বলে কথা। সোনার আংটি বাঁকা হলেও সই। তাদের কাছে ছেলেই সব।
একটা কথা বলি? খারাপ ভাববেন না। ওরা যখন এভাবে এখন মা’র খায় আমার মাঝে তখন এক পৈশাচিক আনন্দ হয়। তাই এখন আমি আর কিছু বলি না। আমি কেবল তাদের আরও নিঃস্ব হতে দেখতে চাই। কারণ আমি কিছু বলি আর না বলি আমার মা বানিয়ে বানিয়ে বাইরের মানুষদের নানান কথা বলে। বলতে থাকুক। তবে তাদের ভবিতব্য কি তা আমার জানা আছে। তখন তারা আমাকে কোনদিন তাদের কাছে পাবে না। সবকিছু ক্ষমা করার মতো না। তাদের লাইফে যাই হয়ে যাক না কেন দিনশেষে আমিও তাদের সন্তান। দিনশেষে মেয়েরাই মায়ের কষ্ট বুঝে, যখন আমার বাপের কৃত্তি কলাপ সম্পর্কে জানতে পারি আমার মায়ের জন্য আমার খুব খারাপ লাগে, তবে তার জন্য আমার সাথে এমন করার কোনো লজিক ছিল না। আমার বাপ আমার প্রতি হওয়া প্রতিটা অন্যায় দেখেও চুপ ছিল কখনো কিছু বলে নি। আশপাশের বিভিন্ন ঘটনার পাশাপাশি আমার বাপের জন্যই পুরুষমানুষের উপর থেকে আমার বিশ্বাস ভরসা এক্কেবারে উঠে গেছে। আমার পক্ষে সম্ভব না কোনো সম্পর্কে জড়ানো। আমাকে মাফ করবেন।
এতকিছুর পরেও এখন কি আপনি আমাকে বিয়ে করতে চাইবেন মি. জয়?”
#চলবে
( কপি করা নিষেধ। কেউ কপি করবেন না।
আর প্লিজ সবাই গঠনমূলক মন্তব্য করবেন। আর এই দুটো একই পর্ব ছিল কিন্তু বেশি বড় হওয়ায় সবটা পোস্ট হচ্ছিল না। তাই ভাগ ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। 🙂 ধন্যবাদ। )