সূর্যোদয় #পর্ব_৩২ #কারিমা_দিলশাদ

0
722

#সূর্যোদয়
#পর্ব_৩২
#কারিমা_দিলশাদ

“ বিয়েতে শাড়ি পড়বে না লেহেঙ্গা পড়বে? এমনেতেই কিন্তু আমার শাড়ি পছন্দ বুঝলে। আমার খুব শখ একদম টকটকা লাল রঙের শাড়িতে তোমাকে দেখার। তবে বিয়েতে তুমি তোমার মতো করেই সেজো। শাড়ি মনে ধরলে শাড়ি আর লেহেঙ্গা মনে ধরলে লেহেঙ্গা। আর তোমাকে দেখতে পারলেই আমার হলো। ”

“ আমি এতোক্ষণ কি বললাম আপনি শুনতে পান নি?”

“ শুনবো না কেন। সবই খুব মনযোগ দিয়ে শুনেছি। আর তোমার সমস্যাটাও বুঝেছি। দেখো ঐশী আমি মানছি তুমি আর দশটা মানুষের মতো বড় হও নি। তোমার আশেপাশের পরিবেশও ভালো ছিল না। তীব্র কষ্ট নিয়ে তুমি বড় হয়েছ। তবে তোমাকে এটা তো মানতে হবে যে পৃথিবীর সব মানুষ সমান হয় না। আমাদের হাতের পাঁচটা আঙুল যেমন এক না, তেমনি পৃথিবীর সব মানুষও এক না। তোমার কথাই ধর। তোমার ভাই যেমন তুমি তো সেরকম না। তুমি যেরকম পরিবেশে বড় হয়েছ তাতে তোমার মাথায় এই চিন্তাগুলো আসাটাই স্বাভাবিক। তবে তোমাকে একটা কথা বলি আমার বাবা মা তাদের সাংসারিক জীবনে অনেক সুখী ছিল। সত্যি তারা খুবই সুখী ছিল। তারা আমার বাবা মা তাই আমি এটা বলছি, এমন না। তুমি আমার মা’কেও জিজ্ঞেস করতে পারো। মা’কে যদি তুমি বাবার কথা জিজ্ঞেস করো, তাহলে তুমি তার ফেস এক্সপ্রেশনটা জাস্ট খেয়াল করে দেখো। তুমি মা’র চোখে প্রশান্তি দেখতে পাবে, একটা সুখী সুখী ভাব দেখতে পাবে। আমি তাদের সুখটা নিজের চোখে দেখেছি ঐশী। আমার দাদা দাদীর মাঝেও তুমুল ভালোবাসা ছিল। আমি দেখেছি দাদা যতক্ষণ ঘরে না ফিরতো দাদীকে উন্মুখ হয়ে দাদার অপেক্ষা করতে। আমার দাদা খুব রগচটা মানুষ ছিলেন কিন্তু দাদা তাদের সাংসারিক জীবনে কোনদিন নাকি দাদীর সাথে রা’গারা’গি করেন নি। দাদার রা’গ হলে দাদী তার সামনে গেলে দাদা ঠান্ডা সুবোধ বালকের মতো হয়ে যেতেন। একবার ভেবে দেখো সব পুরুষ যদি খারাপই হতো তাহলে কি কোনো নারী আর বিয়ে, প্রেম, ভালোবাসায় জড়াতো? হ্যা মানুষ চিনতে ভুল হয়। তুমি প্রথম যেই প্রশ্নগুলো করেছিলে, সেই প্রশ্নগুলোর জবাব আমার কাছে নেই। তোমার কথাগুলোও ঠিক আছে। তবে সবার ক্ষেত্রেই তো এমন হচ্ছে না বলো। ভালো খারাপ সবকিছু মিলিয়েই মানুষ। সম্পর্কেও ভালো দিক খারাপ দিক থাকে, ভালো সময় খারাপ সময়ও থাকে, মান অভিমান থাকে। সবকিছু মিলিয়েই সংসার, সবকিছু মিলিয়েই সম্পর্ক আর এই সবকিছু মিলিয়েই জীবন।

আমাদের ডাক্তারি ভাষায় ডাক্তার হিসেবে আমরা অনেক রুলস ফলো করতে বলি। এই ধরো বাইরের জিনিস না খাওয়া, সিগারেট না খাওয়া, চিনি না খাওয়া, হেলদি খাবার খাওয়া আরও কত কিছু। এখন মানুষ কি আসলেই তা তা ফলো করে? আমরা নিজেরাও করি না। আমরা সবাই এই বিষয়গুলো জানি কিন্তু জেনেও মানি না। কারণ কি? কারণ এতোকিছু মেনে চিন্তাভাবনা করে বাছ বিচার করে জীবন চলে না। খারাপ কিছু হওয়ার ভয়ে তুমি যদি কিছুই না করো তাহলে তোমার জীবন কি আদোও চলবে? তুমি শুধু নেগেটিভটা নিয়ে ভাবছো। একবার পজিটিভটাও ভেবে দেখো। এন্ড আই প্রমিজ ঐশী………

জয় ঐশীর একদম কাছে ঝুঁকে ধিমি আওয়াজে নিজের বুকে আঙুল ঠেকিয়ে ঐশীর দিকে তাকিয়ে বলে,

“ আই প্রমিজ ইউ ঐশী জাস্ট একটাবার আমায় বিশ্বাস করে দেখো। একটাবার আমাকে সুযোগ দিয়ে দেখো তোমাকে আমি আমার বুকে আগলে রাখবো। জ্ঞানত তোমায় কখনো কষ্ট পেতে দিব না। একটা সুন্দর সুখী পরিবার হবে আমাদের। তোমার জীবনের যেকোনো পরিস্থিতিতে তোমার পাশে থাকবো, তোমার বিপদে ঢাল হয়ে থাকবো। তোমার স্বপ্ন পূরণে তোমার সঙ্গী হবো। তোমার সুখের কারণ হবো, তোমার দুঃখগুলো আমার হবে, তোমার কষ্টগুলোও আমার হবে। সবকিছু ভাগ করে নিব। তোমার পাশে বসে একই কাপে চা খেতে চাই, তোমার সাথে রাত জাগতে চাই, বৃষ্টিতে ভেজা রাস্তায় হাতে হাত রেখে হাঁটতে চাই, তোমার সাথে বৃদ্ধ হতে চাই। জাস্ট একটা সুযোগ দাও ঐশী জাস্ট একটা। একটু ভরসা করো আমায় কোনদিন হাত ছাড়বো না। ”

ঐশী নিশ্চুপ হয়ে জয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। হয়তো জয়ের কথার সত্যতা খোঁজার চেষ্টা করছে। কিন্তু পরক্ষণেই সে নিজের চোখ নামিয়ে নেয়। আর বলে,

“ বিষয়টা এতোটাও সহজ না মি. জয়। আমার সাথে কোনো মানুষ থাকতে পারবে না। ইভেন আমি নিজেও কারো সাথে থাকতে পারবো না। আমার অনেক অনেক বদঅভ্যেস আছে। যা কোনো মানুষের পক্ষে মেনে নেওয়া মোটেই সহজ হবে না। ”

“ ঐশী সব মানুষের মধ্যেই কিছু না কিছু বদঅভ্যেস আছে। এই বদঅভ্যেসগুলোও মানুষের একটা অংশ। আমার নিজেরও অনেক বদঅভ্যেস আছে। পৃথিবীতে কেউই এসবের বাইরে না।”

“ কথাটা আপনি যত সহজে বলছেন ততটা সহজ না মি. জয়। আমার OCD আছে। আমি ভয়ংকরভাবে OCD তে ভোগী। আমার মনে হয় আমি ব্যতিত পৃথিবীর সব জিনিসেই নোং’রা আছে জীবাণু আছে। OCD কি তা নিশ্চয়ই আপনাকে বলে দিতে হবে না? আমি আমার বিছানার চাদরটাও কাউকে ধরতে পর্যন্ত দেই না। বসা, শোয়া তো দূরের কথা। কেউ আমার রুমে আসলেও আমার ভয় ভয় লাগে না জানি আমার কোন জিনিসটা ছুঁয়ে ফেলে। আমি কারো সাথে রুম শেয়ার করতে পারি না, কেউ আমার সাথে থাকলে আমার একবিন্দুও ঘুম আসে না কান্না পায় আমার। আর বিয়ের পর একটা ছেলের সাথে তার রুমে এক খাটে থাকবো, সে আমাকে ছুঁবে এসব ভাবলেও আমার গা ঘিনঘিন করে। আমি আমার বাথরুমেও কাউকে যেতে দেই না। বাইরে থেকে এসে গোসল না করে আমি কোনকিছু ধরি না, কোনো কাজ করার আগে পরেও আমি হাত ধুয়ে সেই কাজ করি। আদোও কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব এসব মেনে নেওয়া? না, সম্ভব না৷ এটা আমি নিজেও জানি।
আমি ভীষণ বদমেজাজি, ভীষণ। কখন কেন কিসের জন্য রাগ হয় আমার নিজেরও জানা নেই। বসে থাকতে থাকতে আমার রাগ উঠে যায়, খেতে খেতে আমার রাগ উঠে যায়। কোনো কারণ লাগে না আমার রাগের, বসে থাকতে থাকতে ১০ বছর আগের কোনো কথা মনে পড়লেও রাগ উঠে যায়। যার কোনো মানেই নেই। আমার সারাক্ষণই মুড সুয়িং হয়। কখন আমি কোন মুডে থাকি, কি করতে ইচ্ছে করে আমি তা নিজেও জানি না। আমি ভীষন কনফিউজড আর অতিরিক্ত চিন্তা করা একজন মানুষ। দ্বৈত চরিত্রের মানুষের মতো হাজারটা চরিত্রে আমি একাই লিভ করি। কখনো আমি ম্যাচিউরড বিহেভ করি কখনো ইমম্যাচিউর। কোনো মানুষের এতো আজাইরা ধরনের সমস্যা থাকে না যতটা আমার আছে। এসব অন্য কোনো মানুষের দ্বারা সহ্য করা সম্ভব না ডাক্তার সাহেব। কারো সেই দ্বায়ও পড়ে নি। যেখানে আমার নিজের মা বাবা আত্মীয় স্বজনই এসব সহ্য করে না সেখানে অন্য কারো কাছ থেকে এসব আশা করাটাও বোকামি।

এসবকিছু মেনে নিয়ে কারোপক্ষে সংসার করা সম্ভব না। আপনি হয়তো এখন আবেগের বশে হ্যা বলে দিলেন কিন্তু কিছুদিন পরেই এই বিষয়গুলো আপনার গলায় কাঁটার মতো বিঁধে থাকবে। না আপনি তা গিলতে পারবেন আর না তা ফেলতে পারবেন। এর পরিণাম স্বরুপ একটা টক্সিক সম্পর্কের সৃষ্টি হবে। আর এরপর বিচ্ছেদ। আমার এসব সহ্য করার মতো কোনো মন মানসিকতা নেই। সো প্লিজ লিভ মি ডাক্তারসাহেব।”

ঐশী চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে এতোক্ষণ কথাগুলো বললেও শেষের কথাগুলো বলার সময় তার গলায় অসহায় ঠিকরে পড়ে। জয় নিজের মাথার চুল নিজেই কিছুক্ষণ টানতে থাকে। এই অতি চিন্তা করা মেয়েটাকে জয় কিভাবে বুঝাবে? ও হাসবে, কাঁদবে, রাগ করবে না কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। সে ঘাসের উপর ধপ করে শুয়ে পড়ে। চার হাত পা চারদিকে দিয়ে। কিছুক্ষণ জোরে জোরে শ্বাস নেয়। কিন্তু তাতেও তার মাথা ঠিক হচ্ছে না। এরপর সে উঠে ঐশীকে বলে,

“ দেখো অতিরিক্ত চিন্তা করাটা বন্ধ করো। রাগ কমবেশি সবার মাঝেই আছে। আমারও মাঝে মাঝে এমনে এমনেই রাগ হয়। কম, বেশি, এক্সট্রিম লেভেলের OCD তে ভোগা মানুষও আছে। তারাও সংসার করছে। আমি, আমার মা দুজনই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা মানুষ। আম্মুর নিজেরও কিছুটা শুচিবাইগ্রস্ততা আছে। সো তোমার খুব একটা সমস্যা হবে না।

আর এগুলো খুব একটা বড় সমস্যাও না৷ এগুলো কিছু ম্যান্টাল ইস্যু। রোগ টোগ, সমস্যা টমস্যা কিচ্ছু না। তুমি তোমার সমস্যাগুলো নিজে নিজেই ধরতে পেরেছ। এগুলো যে ভালো না তা তুমিও জানো। তোমার মাঝে এই বোধটা যেহেতু আছে তাই আমি তোমাকেই কথাগুলো বলছি। তোমার আসল সমস্যাটা কি জানো? একাকিত্ব। তুমি কখনো মানুষের সাথে তেমনভাবে মেশার সুযোগ পাও নি, তোমার আশেপাশে অনেকে থেকেও নিজের বলতে কেউ নেই। অসুস্থ একটা পরিবেশে তুমি বড় হয়েছো এবং এখনো আছো। কারেক্ট মি ইফ আই এম রং নিজেকে ব্যস্ত রাখতে সময় কাটাতে অবশ্যই তুমি বিভিন্ন ধরনের চিন্তা, বিভিন্ন ট্রিকস খাটাও। তোমার আলাদা একটা জগৎ আছে, যেখানে তুমি সব নিজের মতো করে চিন্তা করো, কল্পনা করো। তুমি তোমার লাইফের সব কষ্ট থেকে ওভার কাম করতে চাও। আর সেই চাওয়া থেকেই এসবের সৃষ্টি। তোমার আশেপাশে তোমার আপনজন থেকেও তারা তোমার আপন না। তুমি তাদের কখনো আপন করে নিতে পারো নি, এর থেকে বলা ভালো তারা তোমাকে সেই সুযোগটা দেয় নি। তারাই হয়তো কখনো তোমার আপন হতে চায় নি, তোমাকে বুঝতে চায় নি। তাই তাদের জন্য তোমার এতো রেস্ট্রিকশন। তারা তোমার আশেপাশে থাকায় তোমার এতো অস্বস্তি। তারা যেন তোমার আশেপাশে না থাকে তাই তোমার এতো ফন্দি। একবার ভেবে দেখ তো যখন তুমি তাদের আশেপাশে না থাকো তখন কি তোমার মাঝে এতো কিছুর ধরাবাঁধা নিয়ম থাকে? তুমি কি ফিল করো তখন? জাস্ট থিংক এরপর আমার কথাগুলোর মানে বুঝার চেষ্টা করো। তাহলেই তুমি বুঝতে পারবে আমি তোমাকে কি বুঝাতে চাচ্ছি।”

জয় একটা দম নিয়ে আবার বলে,

“ এতো চিন্তা করো না ঐশী। জীবনে এতো চিন্তা করে কোনো লাভ নেই। যা হওয়ার, আল্লাহ তায়ালা যা লিখে রেখেছে তা হবেই। তোমার আমার চিন্তা ভাবনা করায় তা বদলাবে না। এত হিসাব-নিকাশ ক্যালকুলেশন করেও জীবন চলে না। এটা আমি আমার জীবন থেকে বুঝেছি। এই যে ভাবছো তোমার এসব আমি মেনে নিতে পারবো না, সংসার ভেঙে যাবে। এসব তোমার মনের ভয়। এই যে তুমি তোমার নজর থেকে নিজের এতো সমস্যার কথা বললে। আমার কিন্তু একবারের জন্যও মনে হয় নি আমি তোমাকে কিভাবে হ্যান্ডেল করবো এন্ড অল টাইপস কিছু। শুধু এটা ভেবেছি তোমাকে কি করে বোঝাই। আবেগের বয়স এখন আমার নেই, আর বিয়েটাও আবেগের খেলা না। আমি তোমাকে আপন করে নিয়েছি ঐশী। তুমি যেমন আমি তোমাকে সেভাবেই তোমার সবটাকে আপন করে নিয়েছি। তোমার এসবেরও একটাই সমাধান। আপন করে নেওয়া। আমাকে, আমাদের আপন করে নেও ভালোবেসে নেও তখন দেখবে এসব আর ম্যাটার করবে না। তুমি মানিয়ে নেওয়া, মেনে নেওয়া এসবে হয়তো ভয় পাও। কিন্তু যখন তুমি তোমার আপন মানুষের জন্য কিছু করবে তখন তোমার মাথায় এই মানিয়ে নেওয়া মেনে নেওয়া এই শব্দগুলো আসবে না। তুমি যেমন আছো সেভাবেই তুমি সুন্দর, সেভাবেই তুমি বেস্ট। আর তুমি যেমন তেমনভাবেই তুমি আমার। এতোকিছু না ভেবে চোখ বন্ধ করে বিয়েতে রাজি হয়ে যাও। বাকিটা আমি সামলে নিব। তোমাকে দ্বিধামুক্ত করার দায়িত্ব আমার।”

——————————–

জয় বাসায় এসে আজ প্রথমেই মায়ের রুমে যায়। তার মনটা আজ খুব বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। গিয়ে দেখে ইলোরা ইয়াসমিন চোখে চশমা পড়ে খাতা দেখায় ব্যস্ত। ও গিয়ে মায়ের পায়ের কাছে বসে পড়ে। মায়ের কোলে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে নেই।

ইলোরা ইয়াসমিন কিছুটা চকিতে নিজের কোলে তাকান। ছেলেকে দেখে মনটা শান্ত হয়ে যায়। তিনি কলম রেখে ছেলের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে,

“ কি রে আজকে এসে ফ্রেশ না হয়েই আমার রুমে এসে পড়লি যে। কতবার তোকে বলেছি বলতো ফ্রেশ না হয়ে আমার কাছে আসবি না। কি হয়েছে এমন স্ট্যাচু হয়ে আছিস কেন?”

“ মা???”

“ হুমম…..”

“ তুমি আমার ঐশীকে আদর করবে মা? একদম মায়ের মতো করে?
ওর অনেক কষ্ট মা। ওর মনে অনেক ভয় অনেক দ্বিধা। সেগুলোই ও কাটিয়ে উঠতে পারছে না। কি করে ওকে রাজি করাই বলোতো।”

“ বিশ্বাস করা ওকে।”

“ বিশ্বাস করতেই তো ওর ভয় মা। বিশ্বাসই তো করছে না। আজকে ওর সাথে দেখা করেছি মা। অনেক কিছু বললো। ওর কষ্ট শুনে ওর উপর আমি আরও দূর্বল হয়ে পড়েছি মা।”

ইলোরা ইয়াসমিন আর জিজ্ঞেস করলেন না কি কষ্ট ঐশীর। কারণ তিনি জানেন যদি বলার হয় তাহলে জয় নিজেই বলবে। আর যদি না বলে তাহলে তার তা জানাই ভালো। তিনি বললেন,

“ তাহলে কি করবি এখন? পরশুদিন কি যাব না?”

“ দুইটা দিন সময় দিয়েছি ওকে। দুদিন পর যাব। আমি চেয়েছিলাম ওর মনে নিজের জন্য একটু জায়গা তৈরি করতে। কিন্তু এখন বিষয়টা জোর করার মতো হয়ে যাচ্ছে। জোরই তো করছি বলো। কিন্তু আমিই বা কি করবো বলো? ও তো মানতেই চাচ্ছে না আমাকে। আর ওর যা বাবা মা, আমি ওকে ওখানে রেখে এখন শান্তি পায় না মা। এখন দরকার পড়লে জোর করে বিয়েই সই। জিদ্দি একটা।”

জয়ের কথা শুনে ইলোরা ইয়াসমিন হাসলেন। জয় এভাবেই আরও অনেক কথা বলতে লাগলো। তাতে ইলোরা ইয়াসমিনও যোগ দেন।

——————————–

ইলোরা ইয়াসমিন আর ঐশী মুখোমুখি এক রেস্টুরেন্টে বসে আছে। পরশু জয়ের সাথে কথা বলার পরও ঐশী তার দ্বিধা কাটিয়ে উঠতে পারে নি। নিজের মাইন্ড সেট তো আছেই সাথে আছে জয়ের বিষয়টাও। সত্যি বলতে সে জয়কে নিয়ে অন্যকিছু ভাবতেই পারছে না। এতদিন জয়কে সে চেনাপরিচয় হিসেবে একজন বন্ধুর মতো ট্রিট করে এসছিল। মাঝে মাঝে টুকটাক কথাবার্তা হতো এরপর স্মৃতির জন্য তা আরেকটু বেড়ে গেল। কিন্তু তাকে নিয়ে অন্য কোনো চিন্তাভাবনা কখনো ঐশীর খেয়ালও আসে নি। তাই কালকে সারাদিন অনেক চিন্তা ভাবনা করে আজকে সে ইলোরা ইয়াসমিন এর সাথে কথা বলতে ভার্সিটি এসেছে। তার দৃঢ় বিশ্বাস ইলোরা ইয়াসমিন কিছু একটা করতে পারবে। সেই বিশ্বাস থেকেই এখানে আসা।

কিন্তু এখন সে আর কিছু বলতে পারছে না। অনেক বেশি অস্বস্তি হচ্ছে। যদিও সে বুঝতে দিচ্ছে না বিষয়টা। সাহস করে এসে পড়েছে তো ঠিকই কিন্তু এখন কিছু বলার সাহস হচ্ছে না। ইলোরা ইয়াসমিন দেখতে খুবই সুন্দর। তারমাঝে আভিজাত্যের একটা ব্যাপার আছে। খুবই মিষ্টভাষী, কিন্তু ঐশীর কেন জানি উনাকে খুব রাগী মনে হয়।

ইলোরা ইয়াসমিন আসার পর থেকেই ঐশীকে পরখ করে যাচ্ছেন। মেয়েটা বোধহয় হালকা নার্ভাস, যদিও ঐশীর আচার আচরণে তা বুঝার উপায় নেই। তবে তার মনে হচ্ছে, যদিও তার পরখ ভুলও হতে পারে। দুজনে প্রথম থেকেই কিছু সৌজন্যমূলক কথা চালিয়ে গেলেও এবার ঐশী সাহস করে মূল কথাই আসে। কিন্তু তার আগেই ইলোরা ইয়াসমিন বলে,

“ ঐশী আমার সাথে হাঁটবে? চলো ঠান্ডাটা নিয়ে বাইরে গিয়ে হাটাহাটি করতে করতে কথা বলি?” -ঐশীও মাথা নেড়ে সায় জানায়।

——————————–

জব্বারের মোড় থেকে আম বাগানের রাস্তাটা ধরে হাঁটছে ইলোরা ইয়াসমিন আর ঐশী। আজকে চারপাশে খুব বাতাস আছে। খুব রোদও না আবার খুব মেঘলাও না। সুন্দর একটা আবহাওয়া। হাটতে হাটতে ইলোরা ইয়াসমিন ঐশীর সাথে টুকটাক অনেক কথা বলছেন। ইলোরা ইয়াসমিনও জানছে ঐশীর বিষয়ে পাশাপাশি ঐশীও টুকটাক অনেক প্রশ্ন করছে। ঐশীর ভালো লাগছে ইলোরা ইয়াসমিনের সাথে হাটতে। প্রথম প্রথম অস্বস্তি হলেও এখন সে খুব উপভোগ করছে বিষয়টা। একসময় ইলোরা ইয়াসমিন বলে উঠে,

“ জয় যখন হয় তখন জয়ের জন্য আমি চাকরিটা ছাড়তে চেয়েছিলাম জানো? আমিও চাকরিতে ব্যস্ত, তোমার আংকেলও চাকরিতে ব্যস্ত তাই। কিন্তু তোমার আংকেল ছাড়তে দেয় নি। বলতো চাকরিটা আছে দেখে তোমার নিজের একটা অবলম্বন আছে। চাকরিটা থাকুক। আমরা দুজনে মিলেমিশে বাচ্চাটাকে বড় করে নিব। তোমার আংকেলের কথার মূল্যটা এখন বুঝি। একটা মেয়ের নিজস্ব একটা আয় রোজগারের উৎস থাকা কত্ত দরকার। ছোটবেলা থেকেই জয়কে আমরা তেমন সময় দিতে পারতাম না। তাই হয়তো ও অনেক ছোট বয়স থেকেই বেশ বোঝদার। কখনো তেমন কোনো বায়না করতো না। কোনো কিছু লাগলেও আগে আমার আঁচল ধরে ঘুরতো৷ তারপর আমি যখন আদর করে জিজ্ঞেস করতাম কিছু লাগবে কি না তখন এসে মিনমিন করে যা লাগবে তা বলতো। জয় ওর জীবনে দুইবার আমার কাছে আবদার করেছে। একটা আমি ওকে দিতে পারি নি। তা এখন ম্যাটারও করে না। তবে সে দ্বিতীয়বার আমার কাছে তোমাকে চেয়েছে। আবার ভেবে নিয়ো না তোমাকে কোনো পণ্য মনে করছি আমরা মা ছেলে। বিষয়টা তেমন না। সেদিন প্রথমবার আমি জয়ের চোখেমুখে নতুন কিছু দেখেছি। তোমাকে পাওয়ার যে কি তীব্রতা ছিল ওর চোখেমুখে তা আমি দেখেছি। পৃথিবীর খুব কম মানুষই আছে বুঝলে যারা ভালোবাসতে জানে। আমার ছেলেটা সেই দলের। ছেলেটা আমার খুব যত্ন করে ভালোবাসতে জানে, খুব। এটা ওদের বংশের একটা ধারাও বলতে পারো। ওর বাবাও খুব যত্ন করে ভালোবাসতে জানতো, আমার শ্বশুরমশাইও, তেমনি আমার ছেলেটাও। এরা খুব যত্ন করে ভালোবাসতে জানে।

ঐশী তোমার অতিত জীবনে কি হয়েছে, জয়কে বিয়ে না করতে চাওয়ার কি কারণ তা আমি জানি না। যেদিন আমি প্রথম তোমাকে অথৈদের বাসায় দেখি সেদিনই তোমাকে আমার পুত্রবধূ রুপে পছন্দ হয়ে যায়। আমি সেদিন থেকেই আমার ছেলের বউ হিসেবে মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু আমার ছেলের কারণেই তা তখন হয়ে উঠে নি। জয় এখন তোমাকে ভালোবাসে। তার গভীরতা কতটা তা আমি বলতে পারব না। শুধু এইটুকু বলতে পারব জয়ের ভালোবাসা নিয়ে কখনো দ্বিধায় থেকো না। ও ওর বাবার আদর্শে বড় হয়েছে, আমার শিক্ষায় বড় হয়েছে। আমি অন্তত এটুকু তোমাকে গ্যারান্টি দিতেই পারি জয় একবার তোমার হাত ধরলে তোমার হাত কখনো ছাড়বে না।

সেদিন তোমাদের মাঝে কি কথা হয়েছে আমি তা জানি না। আর জানতেও চাই না। আমার তা জানার প্রয়োজন নেই। শুধু সেদিন রাতের বেলা এসে আরেকটা আবদার করে আমার ছেলে আমার কাছে। তোমাকে যেন আমি আমার মেয়ের মতো আদর করি। তোমাকে যেন মায়ের মতো স্নেহ করি। তার ঐশীকে যেন কখনো কষ্ট পেতে না দেই। তার ঐশী কষ্টে আছে। সে তার ঐশীর সব কষ্ট মুছে দিতে চায়।”

ইলোরা ইয়াসমিন এবার ঐশীর দিকে তাকায়। মিষ্টি রঙের থ্রি পিছ পড়া মিষ্টি স্নিগ্ধ একটা মেয়ে। যার চোখ দিয়ে অঝোরে অশ্রু ঝরছে। কি সুন্দর লাগছে দেখতে। তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন, দাঁড়িয়ে গেল ঐশীও। এবার সে মাথা নিচু করে কাঁদছে। ইলোরা ইয়াসমিন ঐশীকে তারদিকে ঘুরিয়ে নিয়ে দুহাতে ঐশীর মুখটা ধরে বললেন,

“ তোর সাথে আমার সম্পর্কটা হবে শাশুড়ী বৌমার। আর শাশুড়ী কখনো মা হতে পারে না। এইকথাটা আমি মানি। তাই তোর আপন মায়ের মতো হয়তো আমি হতে পারব না, তবে তোর ভালো শাশুড়ী হয়ে দেখাবো। খুব খুব খুব ভালো শাশুড়ী হবো আমি। তোকে প্রথম দেখাতেই আমার মাঝে একটা মমতা কাজ করছিল কেন জানি। কথা দিলাম সেই সবটা উজাড় করে দিব। ভয় পাস না মা। একবার বিশ্বাস করে দেখ ঠকবি না। গ্যারান্টি দিয়ে বলছি অমন পাগল প্রেমিক বরও পাবি না আর আমার মতো শাশুড়ীও পাবি না। আমরা এক পিসই আছি। কেবল তোর জন্য। তোর ঘর,তোর বর আর তোর শাশুড়ী, তোর ননদ সব তোর অপেক্ষায় রইলাম মা।”

ঐশী আর কিছু না ভেবেই ইলোরা ইয়াসমিনকে জড়িয়ে ধরে। ইলোরা ইয়াসমিনও পরম স্নেহে আগলে নেয়। ঐশী যা যা বলতে এসেছিল তার কিচ্ছু বলা হলো না, যা করতে এসেছিল তা করা হলো না। কেন জানি মনে হচ্ছে এসব করার দরকারও নেই, তার মনে হচ্ছে এই মানুষটার কথায় তার সব প্রশ্ন দ্বিধা চলে গেছে। মনে মনে এমন একটা পরিবারই যেন সে চাইছিল। এই জড়িয়ে ধরাটুকুও ঐশী কখনো তার মায়ের কাছ থেকে পায় নি। এভাবে ভালোবাসার প্রকাশ কখনো তার মা বাবাও তার জন্য করে নি। অন্য কেউ যদি তার ১% ও করে তবে তাদের নিয়ে কোনো দ্বিধা রাখা তার উচিত না। ঐশীর কপালে চু’মু একে দিলেন ইলোরা ইয়াসমিন।

#চলবে

( কপি করা নিষেধ। কেউ কপি করবেন না। চাইলে শেয়ার করতে পারেন। ধন্যবাদ।

কেমন লাগলো আজকের পর্বটা জানাবেন প্লিজ। 😊😊)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here