অপরাহ্ন
পর্ব ৩
(সতর্কতা : অত্যন্ত পরিণতমনস্ক পাঠকের জন্য)
প্রথম দিন বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত আটটা বেজে গেল। অথচ কাজ শেষ করেছি পাঁচটায়। দেখে মা বললো, এতো কষ্ট কি সয়? কি সুন্দর ওরা থাকার জায়গা দিচ্ছিলো, কয়েকদিন থেকে আসলে কি হয়?
আমি উত্তর দিতে পারলাম না। আমি বলতে পারলাম না, আমি পারবোনা। আমি চার রাত সানজিদাকে না দেখে থাকতে পারব না। আর পাঁচদিন পরে ফিরে এসে যদি দেখি সে নেই? চলে গেছে?
রাতে ঘুমুতে এসে বললাম, ” একবারও ফোন করলে না যে? এতো দেরি হল আসতে, একটু চিন্তা হলোনা তোমার? ”
মোবাইল থেকে মুখ তুলে বলল, ” দূরের জায়গা না? দেরি তো হতেই পারে! ফোন করে কি লাভ হত কিছু বলো? ফোন করলে কি তুমি উড়ে উড়ে আসতে? ”
আমি বললাম না যে উড়ে হয়ত আসতে পারতাম না, কিন্তু আমার ভীষণ ভালো লাগতো! মনে মনে হয়ত আমি সত্যিই উড়তে শুরু করতাম? সেসব না বলে বললাম, ” তোমার দিন কেমন কাটল? অফিস? ”
” ভালো কথা মনে করেছ। শুক্রবার স্যারের ছেলের জন্মদিনে দাওয়াত দিয়েছে। আর কি ঢং, বলেছে জামাই নিয়ে যেতে হবে। কি দরকার এসবের বুঝিনা।”
” কেন? আমার তো যেতে কোন সমস্যা নেই।”
” না ইয়ে মানে, তোমার পোশাক টোশাক আমি পছন্দ করে দেব, কেমন? অবশ্য তার আগে আমিও কিছু কেনাকাটা করব। আর শোনো, আর কিছু বলবে? আমার ঘুম পাচ্ছে খুব “।
আমার আরো অনেক কিছুই বলার ছিল। কিন্তু ওর ঘুম নষ্ট করতে আমি রাজি নই। হয়ত দেখা গেল, একটা রাতের ঘুম নষ্ট হলে ওর চোখের কোলে কালি পরে গেল? আর সেই কালিমা ঢাকতে তাকে নানান কসরত করতে হল? কি দরকার?
***
শুক্রবার সকালে অনেকদিন পর ঘুম ভাঙতে দেরি হল আমার। চোখ খুলে দেখি আমার বিছানার উপরে মা বসে আছেন। তিনি বলছেন, “ও বৌ, বললানা কি রান্না করবো? সবাই বাসায় আজকে?”
সানজিদা চেয়ারে বসে চুল আচড়াচ্ছে, কথা বললো না। কিন্তু আমি উঠে বসলাম, “সপ্তাহে একদিন বেচারি বাসায় আছে, আর সকাল সকাল রান্নার আলোচনা শুরু করলে?”
মা ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে তাকালেন, ” রান্না তো করতে বলিনাই? কি খাবে তাই জানতে চেয়েছি।”
আমি থামলাম না, ” তোমার মত সবাই রাতদিন রান্না খাওয়া নিয়ে ভাবেনা মা। আমাদের রাতে দাওয়াত আছে। আর দিনে যা হোক একটা হলেই হবে। এখন যাও তো!”
মা ধীরপায়ে ঘর ছাড়লেন। তার চলে যাবার দৃশ্যটা দেখে আমার বুঁকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল, তবু আমি তাকে ডাকলাম না। আমি একবার আশা করলাম, সানজিদা হয়ত বলবে কিছু, সে বললনা।
বরং আয়নার সামনে বসে বললো, ” এই হচ্ছে বয়স্ক মানুষদের সমস্যা। রান্না খাওয়া, রান্না খাওয়া।”
আমি অবাক বিস্ময়ে শুধু তাকিয়ে থাকলাম, কিন্তু কিছু বলার সামর্থ আমার ছিলোনা। কাল রাতে সানজিদা হতাশায় কেঁদে ফেলেছিলো, এরপর তার কোন কথা বা কাজে ভুল ধরা আমার যোগ্যতায় পরেনা।
” চলো এখন বাইরে যাব ” সে বললো, ” শাড়ি কিনবো ”
আমি এটাও বলতে পারলাম না, বিয়েতে কেনা অনেকগুলি শাড়ি এখনো আলমীরার ভেতরে অধরা ঘুমিয়ে আছে, লাফ দিয়ে নামলাম বিছানা থেকে,” হ্যাঁ হ্যাঁ চলো।”
ও যখন সময় নিয়ে তৈরী হচ্ছে, আমি বের হলাম চায়ের খোঁজে। আমি দেখলাম আমার ক্রন্দনরতা মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে আমার ছোট বোনটা। আমাকে দেখে ওরা পরস্পরকে ছেড়ে সরে দাঁড়ালো। মা বললেন, চা নাস্তা সব তৈরী আছে, এখানে খাবা না রুমে নিয়ে যাবা?
নাহার আমার উত্তরের আগেই তপ্ত গলায় বললো, “চুপ করো মা। তোমার একটু লজ্জাও করেনা?”
আমি মনে মনে খুব চাচ্ছিলাম, মার কাছে ক্ষমা চাই। মাকে বলি, মা আমি ওকে হারাতে পারব না! আমার খুব ভয় করে মা। ও যদি চলে যায়? তাই ওকে খুশি করার জন্য…
বের হবার সময় আমি ওর হাতের ব্যাগটা বহন করার জন্য জেদ করতে লাগলাম। রান্নাঘর থেকে বেরোবার দরজা স্পষ্ট দেখা যায়, আমার পিঠের উপর মার দৃষ্টি আমি অনুভব করতে পারছিলাম, কিন্তু না বোঝার ভান করলাম। জীবনে প্রথমবার, বাইরে যাচ্ছি কেনাকাটা করতে, নাহারকে না জিজ্ঞাসা করে ওর কিছু চাই কিনা!
সত্যি কথা বলতে, আমি পারলে সানজিদা কে কোলে করে সিঁড়ি বেয়ে নামতাম। রাস্তায় দাঁড়িয়ে রিক্সার অপেক্ষা করার সময় ওর মাথার উপর ছাতা ধরে হা করে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতাম।
আমি বুঝতে পারছিলাম, এই নারীটি আমাকে আপাদমস্তক গ্রাস করেছে। খুব সম্ভবত আমাকে উন্মাদ বানিয়ে দিয়েছে সে। সে যদি আমাকে ছেড়ে চলে যেতে চায়, আমি সহ্য করতে পারবোনা। অথচ সে থাকলে আমি আর স্বাভাবিক ও হতে পারব না।
প্রশ্ন হল, আমার কি সমস্যা, আমার কিসের ভয়, আমার কোথায় অক্ষমতা এসবের সাথে আমার পরিবারের সাথে এই যে খারাপ ব্যবহার, তার সম্পর্ক কি?
সানজিদাকে কোনভাবেই অখুশি করতে পারবোনা, এটা যেমন একটা কারণ, আরেকটা কারণ ছিল, আমি চাইতাম না, ওদের মধ্যে কোন সখ্যাতা গড়ে উঠুক। আমি আমার মায়ের বীরপুরুষ ছেলে, বোনের আদৰ্শ বড় ভাই, সানজিদা যদি ওদের কিছু বলে ফেলে?
আমি কি কাউকে বোঝাতে পারবো, সেই যে সানজিদা বলেছিলো, আমার গায়ে গন্ধ, সেই যে সে বমি করতে ছুটে গিয়েছিল, আমি কিছুতেই সেটা থেকে বের হতে পারছিনা? বলতে পারব একরত্তি একটা মেয়ে, আকারে যে আমার চেয়ে অনেককখানি ছোট, তাকে আমি ভয় পাই? প্রচন্ড ভয়ে রাতের পর রাত আমার শরীর কুঁকড়ে থাকে?
নাহ, আমার গোপন কথা সানজিদা থেকে শুরু হয়ে সানজিদাতেই শেষ হয়ে যাবে। খুব শীঘ্রই এই সংবাদ ছড়িয়ে পরার সব সম্ভাবনা আমাকে মিটিয়ে ফেলতে হবে।
***
” ও। আপনি ” ডাক্তার সাহেব নাম দেখে হয়ত বুঝতে পারেননি, চেহারা দেখে বললেন। তার কণ্ঠে সামান্য বিরক্তি। আমার হাসি পেয়ে গেল।
” একই সমস্যা না আর কিছু? ” তিনি আবার বললেন।
” একই সমস্যা “।
তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের বিশাল ফোমের চেয়ারে পিঠ ঠেকালেন, ” আপনার দরকার সাইকোলজিস্ট। আমি মেডিসিনের ডাক্তার। এর বেশি কিছু করতে পারব না “।
আমি জানি উনি পারবেন না। উনার দেয়া ওষুধ আমি কিনেছি অনেকদিন আগে, পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়াই ইদানিং, আমার এতে আত্মবিশ্বাস বাড়ে। মনে হয়, আমি চাইলে পারি, শুধু চাইছিনা বলে…।
” আমি জানি” আমি বললাম।
” তাহলে কেন এসেছেন? ”
পাঁচশো টাকা ভিসিট দিচ্ছি দশ মিনিট কথা বলার জন্য, উনার বিরক্তির কারণ আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। কে জানে আমার মুখটাই হয়ত বিরক্তিকর একটা মুখ। কেউ কাছে আসতে চায়না।
লোকটা হয়ত কিছু বুঝল আমার অভিব্যক্তি দেখে, গলার স্বর নরম করে বললেন, ” কথা বলেছিলেন স্ত্রীর সাথে? ”
” বলেছি। ও বলেছে যেসব ভূমিকা উপসংহার এর কথা আপনি বলেছেন, তাতে আমার কিছুই হবেনা।”
” হুমম। ইন্টারেস্টিং। আরেকটা উপায় হল বিরতি কমানো। বুঝতে পারছেন? আপনি রোজ প্রাকৃতিক কাজ সারেন না? রোজ খান, রোজ ঘুমান, সেরকম রোজ রোজ ভালবাসার চেষ্টা করেন। এতেও অনেকের কাজ হয় ”
রোজ রোজ ভালোবাসা। ডাক্তার সাহেবের শব্দ চয়নে আমি অবাক হলাম। উনার অভিজ্ঞতা হয়ত বেশিদিনের না, নভিস। এতো সাহিত্য করে বলার কি আছে?
” রোজ রোজ ও রাজি হবেনা ”
” শুনুন, আবারো বলছি, এটা আমার ডিপার্টমেন্ট না। আপনারা দুইজন মিলে কাউন্সেলিং এ যান। অথবা সাইকোলজিস্ট। আমার কাছে আর আসবেন না ”
আমি শুধু চাইছিলাম, লোকটার আমাকে মনে থাকুক, কোনদিন কোন কারণে যদি দরকার হয়, বলা তো যায়না। সেই উদ্দেশ্য সফল হয়ে গেছে, আমি উঠে দাঁড়ালাম।
ভাগ্য বোধোহয় একটু বেশিই প্রসন্ন আমার, আমি চলে আসার সময় উনি বললেন, ” আর খোঁজ নেবেন ওনার বাইরে কোথাও কোন সম্পর্ক আছে কিনা। এতো নির্বিকার উনিই বা থাকেন কি করে? ”
গত কয়েকদিন ধরে সানজিদার মেজাজ তুঙ্গে উঠে আছে, অপূর্ণতার হতাশা একটু একটু করে ছুঁয়ে যাচ্ছে তাকেও। সুতরাং পুরোপুরি নির্বিকার সে নয় আর, তবে একথা ডাক্তারকে বললাম না। বরং উনি যে ভালো একটা আইডিয়া আমার মাথায় ঢুকিয়ে দিলেন, তার জন্য কৃতজ্ঞ বোধ করলাম।
হ্যাঁ, একদিন হঠাৎ আমিও পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে সক্ষম হয়েছিলাম। অথচ যেই মুহূর্তটাকে লোকে বলে পার্থিব জীবনের সবচেয়ে সুখকর মুহূর্ত, ঠিক তখন আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল, দীর্ঘ প্রতীক্ষার পরে আসা স্বপ্নের এক রজনীতে সানজিদা ছুটে যাচ্ছে বাথরুমে, বমি করবার জন্য।
ঝুপ করে পরে যেতেও আমার বেশি সময় লাগেনি।
***
গুগল এর ইতিহাস সম্পর্কে আমার খুব বেশি জানা নেই, ল্যারি পেইজ নামের এক ভদ্রলাকের নাম শুনেছি শুধু। সে যেই হোক, তাকে ধন্যবাদ না দিয়ে পারা যায়না সত্যি। আমি শুধু লিখতে শুরু করেছিলাম পূর্ণিমা… রাতারাতি আগামী এক বছরের পূর্ণিমার ইংরেজি দিন তারিখ সহ হাজির হয়ে গেল কম্পিউটারের পাতায়।
সোহরাব আমার অধীনস্ত কম বয়সী একটা ছেলে, অকারণে ছোক ছোক করা যার প্ৰিয় একটা অভ্যাস। তার ওপর ইদানিং আমার উপর দায়িত্ব পরেছে, ওকে সামান্য প্রশিক্ষণ দেয়ার। ফলে আমার কম্পিউটারের পর্দায় বেহায়ার মত তাকিয়ে থাকতে সে একটুও দ্বিধা বোধ করেনা।
” ভাবীকে নিয়ে পূর্ণিমা রাতে জোছনা বিলাসের পরিকল্পনা হচ্ছে নাকি ভাই? ” ছেলেটা দাঁত বের করে হাসছে।
হ্যাঁ, জোছনা বিলাসই বটে, রীতিমতো জোছনা স্নানের একটি পরিকল্পনা আমার মাথায় এসেছে। হয়ত অলীক অযাচিত কল্পনা, কিন্তু দীর্ঘসময় ধরে সেটা নিয়ে ভাবতে আমার ভালো লাগছে। প্রচন্ড উত্তেজনায় যেন টের পাই ধমনী দিয়ে কলকল শব্দে এপিনেফ্রিন ভ্রমণ করছে আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত। বলতে নেই, এই উত্তেজনার কাছে বাকি সব নস্যি, খেলো।
***
” স্যার আপনি বরং রিসোর্টের ব্যবস্থা করেন ” আমি বললাম, ” যেতে আসতে পিঠ ব্যাথা হয়ে যায় একদম ”
” আমিতো আগেই বলেছিলাম তোমাকে। আর টাকা তো আমাদের খরচ হচ্ছেনা, কন্ট্রাকট্ররের টাকা। তোমার এতো চিন্তা কি? অসুবিধা নেই, নেক্সট মাস থেকে আমি ব্যবস্থা রাখবো ”
” আরেকটা আবদার ছিল স্যার। গাড়িটা নিয়েই যাই। ওটাতো বসেই থাকে। সোমবার নিয়ে গেলাম, বৃহস্পতিবার রাতে ফিরত নিয়ে এলাম, চলে না? ”
” তা চলে। তোমাকে তো বাসে যেতে বলতে পারিনা। এই রুটে কোন ভালো বাস ও নেই, সব ই পাবলিক বাস। তবে ঝামেলা আছে। ড্রাইভারের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হলে একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যায় ”
” তার দরকার নেই। আমি নিজেই চালিয়ে নিয়ে যাব। চিন্তা করবেন না, আমি অক্ষত ফেরত আনবো “।
ফেরার পথে বেলি ফুলের মালা কিনে নিলাম আদরের বৌ এর জন্য। খুব খুশি আমি আজ, খুব খুশি।
চলবে
আগের পর্ব
https://m.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1654994598348894/?mibextid=Nif5oz