#Mr_Calculus (পর্ব – ১১)
পুষ্পর আজকাল একটু বেশিই পরিশ্রম যাচ্ছে। ঘরের সব কাজ গুছিয়ে তারপর নিজের পড়াশোনা করতে একটু কষ্টই হচ্ছে তবে সমস্যা হচ্ছে না। রিফাত চেষ্টা করে সাহায্য করতে। বাড়ির সবাই কেমন প্রাণহীন হয়ে পড়েছে… সবাইকে দেখেশুনে তাকেই আগলে রাখতে হয়। এক রিয়ানাই আছে নিজের মত তার পড়াশোনা নিয়ে। তানিয়ার এক্সিডেন্টের পর ৩মাস পার হয়ে গেছে অথচ এখনো সারা বাড়ি জুড়ে নিরানন্দের গুমোট আবহাওয়াটা রয়ে গেছে। সে রাতের খাবার তৈরি করে তার ঘরে এসে বসল। একটু রেস্ট করে পড়তে বসবে। রিফাত এখনো ফেরেনি। সে বই নিয়ে বসতে যাবার আগে তারেককে একটা ফোন দিল। আজ তারেক ভার্সিটিতে আসেনি। তারেক ফোন ধরতেই পুষ্প বলল-
-কিরে আজ ক্লাসে আসিসনি কেন?
-শরীরটা ভীষণ খারাপ তাই আসতে পারিনি।
-কী হয়েছে?
-সকাল থেকেই পেট খারাপ। ৬বার টয়লেট করেছি। বিকেল থেকে জ্বর। একটু আগে মেপে দেখি জ্বর ১০৫ ডিগ্রী!
-বলিস কী! ডেঙ্গু হল না তো?
-জানি না দোস্ত… মরেটরে গেলে মাফ করে দিস।
-আসলেই কী এত জ্বর? তুই দেখেছিলি ঠিক মত? তোকে দিয়ে অবশ্য আমার বিশ্বাস নেই, কী দেখতে কী দেখেছিস আল্লাহ জানে!
-তুই বিশ্বাস করলি না তো! দাঁড়া তোকে ছবি পাঠাচ্ছি। তারপর সে থার্মোমিটারে তার টেম্পারেচার মাপার ছবিটা পাঠায় ম্যাসেঞ্জারে।
-পুষ্প ছবিটা দেখে চোখ কুঁচকে ফেলে তারপর বলে, তুই এখন আবার মাপ, মেপে আমাকে আবার দেখা। আমি লাইনে আছি।
তারেক আবার জ্বর মাপল। এবার টেম্পারেচার দেখে তার অজ্ঞান হবার জোগাড়! সে অস্ফুটস্বরে বলল- পুষ্প… আমি মনেহয় বেঁচে নেইরে… মারা গেছি!
-টেম্পারেচার কত উঠেছে আগে সেটা বল তারপর মরেছিস নাকি আমি তোকে মেরে ফেলব সেটা পরে বলছি।
-তুই বিশ্বাস করবি না আমি জানতাম, বিশ্বাস তো আমি নিজেও দেখে করতে পারছি না…
-আরে হাদা বলবি তো কত উঠেছে জ্বর?
-১০৮ ডিগ্রী!!!
-আরে অন্ধ আমার দেখা লাগবে না, তুই দেখ ভালো করে। ওটা ১০৮ নয় ১০০.৮। আগেরবার ছিল ১০০.৫ ডিগ্রী। চোখ খুলে ছাগল দিয়ে খাইয়ে দিস। ওসব অকেজো জিনিস রেখে দিয়ে নিজের প্রাণটাকে আর কষ্ট দিস না! গরু কোথাকার।
তারেক পুরো থ হয়ে গেল! সে আবার থার্মোমিটার চেক করল… আশ্চর্য, পুষ্প তো ঠিকই বলেছে! ও এত গাধা কেন? এত বড় একটা ভুল কী করে করল? সে মিনমিন করে বলল- সরি দোস্ত… আসলে অসুস্থ মানুষ… তাই কী দেখতে কী দেখে ফেলেছি…
-তুই সুস্থ থেকেও এরচেয়ে ভালো কিছু দেখিস না। এখন এটা বল যে, আন্টিকে কী বলে দিয়েছিস যে, তোর ১০৫ জ্বর?
-না… আম্মু বাসায় নেই আর যাবার সময় ভুল করে ফোনটাও রেখে গেছে।
-উফফ বাঁচা গেল। নয়ত তুই নিজে তো মারা যেতি না কিন্তু আন্টিকে ঠিক মেরে ফেলতি!
-অসুস্থ মানুষ… এত বকতেছিস কেন? বললাম তো ভুল হয়ে গেছে…
-এটা ভুল না ছাগল ছানা, এটা অপরাধ। তোকে তো পুলিশে দেয়া উচিত! আচ্ছা ঠিক আছে শোন…
-হুম…
-বিছানা থেকে ওঠ। ফ্রিজ থেকে লেবু বের করে কেটে শরবত বানিয়ে খা ভালো লাগবে। কোন ফলটল ঘরে আছে কিনা দেখে নিস। অবশ্যই থাকার কথা। কেটে খেয়ে নে। জ্বর অনেক কম আছে এটা কোন ব্যাপারই না। কী উল্টা পাল্টা খেয়েছিস এখন পেট খারাপ হয়েছে আর পেট খারাপের জন্যই জ্বরটা এসেছে। জ্বর চলে যাবে থাকবে না বেশিক্ষণ, বুঝলি?
-হু, বুঝেছি। যা ওঠ, আমি ফোন রাখছি আবার পরে কথা বলব। আল্লাহ হাফেজ।
-আচ্ছা, আল্লাহ হাফেজ।
এমন সময় রিফাত পেছন থেকে বলল- কার জ্বর হয়েছে?
-তুমি কখন এলে?
-এই তো এখনই। এসেই শুনলাম ফোনে জ্বরের কথা বলছ!
-তারেকের সাথে কথা বলছিলাম। ওরই জ্বর এসেছে।
-ও… খুব বেশি? এখন তো আবার খুব ডেঙ্গু হচ্ছে…
-ও নিজেই তো একটা ডেঙ্গু ওর আবার কী ডেঙ্গু হবে?
-তা অবশ্য ভুল বলোনি!
-জানো কী করেছে?
-নিশ্চই আবার কোন অঘটন?
-সে আর বলতে? শুনলে হাসতে হাসতে তোমার কান্না চলে আসবে। তারপর সে তারেকের জ্বরের পুরো কথোপকথন রিফাতকে জানায়। রিফাত হাসতে হাসতে শেষ। বলল-
-তোমার এই বন্ধুটাকে তোমরা এভাবে ছেড়ে রাখ কেন বলতো? ওকে ছেড়ে রাখাটা রীতিমত তো ক্রাইম! ওকে তো চিড়িয়াখানায় বন্দি করে রাখা উচিত! মানুষের উচিত টিকিট কেটে ওকে দেখতে যাওয়া। জিনিস একটা, কোথায় ১০৮ আর কোথায় ১০০.৮!!!
-“ঠিকই বলেছ” বলে পুষ্প খেয়াল করল অনেকদিন পর রিফাত আজ একটু মন খুলে হাসল… এবাড়ির মানুষগুলো কেমন হাসতেই ভুলে গেছে! পুষ্প নিজেও তো মনমরা হয়ে থাকে… আশপাশের কারো মনে আনন্দ না থাকলে নিজে একা ভালো থাকা যায়? হুট করেই তার মাথায় একটা প্ল্যান চলে এলো। সে রিফাতকে বলল- শোনো, তুমি তাড়াতাড়ি ফ্রেস হয়ে এসো তো।
-কেন?
-আজ তাড়াতাড়ি ডিনার করব।
-আজ সব তাড়াতাড়ি করতে হবে কেন?
-বিশেষ কিছু তো আছেই। এখন বলা যাবে না।
রিফাত কথা না বাড়িয়ে ফ্রেস হতে চলে গেল। রাতে খেয়ে দেয়ে সব কিছু গুছিয়ে পুষ্প নিজের ঘরে এসে দেখে রিফাত বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। সে তার পাশে এসে বলে, এখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন?
-ঘরে থাকলে বিছানায় বসতে ইচ্ছে হবে আর বিছানায় বসলেই শুয়ে পড়তে ইচ্ছে হবে আর শুলেই ঘুমিয়ে যাব। আজ একটু ক্লান্ত লাগছে তো…
-তাহলে ঘুমিয়ে যেতে?
-তুমি না বললে কী যেন স্পেশাল আছে?
-তা তো বলেছিলামই… শোনো, তুমি একটু রিয়ানার ঘরে যাও। মেয়েটার কাছে আজকাল তোমরা ভাইরা কেউ যাও না। ও সারাক্ষণ পড়া নিয়ে আর তোমরা তোমাদের কাজ নিয়ে থাকো।
-মাত্র তো খাওয়ার টেবিলে দেখা হল!
-হোক তাতে কী? ওর ঘরে গিয়ে ওর পাশে একটু বসো। ওর ভালো লাগবে। তাছাড়া… ওকে ইদানীং আমার একটু চেঞ্জ লাগে…
-কী রকম চেঞ্জ?
-আরে তেমন কিছু না। গানটান বেশি শোনে মনেহয়। এখন তো পড়াশোনা বেশি করার কথা তাই মনেহল। তুমি নরমাল গল্প করবে ওর সাথে। পড়াশোনার খোঁজ নেবে আর কিছু না। ও এখনো তো ছোট আর সবচেয়ে বড় কথা বাড়ির ছোটরা কখনো বড় হতে পারে না। পরিবারে তাদের পজিশন ছোট হওয়ায় তারা আজীবন নিজেদের “ছোট থেকে বড় করতে পারে না” ছোটই থেকে যায়।
-হুম, বুঝলাম ঠিক আছে যাচ্ছি। কিন্তু এই ফাঁকে তুমি কী করতে চাইছ?
-আমি আবার কী করব? কিছুই না!
-ঠিক আছে যাচ্ছি।
রিফাত চলে যেতেই পুষ্প খুব দ্রুত একটা নীল শাড়ি পরে নেয়। তারপর চুল আচঁড়ে নেয়। আজ চুল খোলাই থাক। একটু সাজলও। পারফিউম মাখল। তারপর ঘরে কয়েকটা ডেকোরেটেড মোম জ্বালিয়ে দিল। সব কিছুই সে খুব দ্রুত করে নিল। যদিও সে জানে রিফাত একটু সময় নিয়েই আসবে কারণ রিয়ানা তার অতি আদরের একমাত্র ছোট বোন, তার সাথে আড্ডায় বসলে রিফাতের সময়ের কথা মনে থাকে না। সব কিছু গুছিয়ে এনে ল্যাপটপে হালকা একটা রোমান্টিক মিউজিক রেডি রেখে রিফাতকে ফোন দেয়।
রিফাত রিয়ানার সাথে গল্প করে উঠতেই যাচ্ছিল আর তখনই পুষ্পর ফোন আসে। সে ফোন কেটে দিয়ে উঠে পড়ে। রিফাত ঘরে ঢুকে অবাক হয়ে যায়… আর তখনই পুষ্প দরজার পেছন থেকে বের হয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। রিফাত পেছনে তাকিয়ে পুষ্পকে দেখে আবার অবাক হয় তারপর তার কাছে গিয়ে বলে, আজ কী বিশেষ কোন দিন? আমি কিন্তু কিছুই মনে করতে পারছি না!
পুষ্প দুহাতে রিফাতের গলা বেষ্টন করে বলে, আজ কোন বিশেষ দিন নয়।
-তাহলে?
-আমার ইচ্ছে হয়েছে তোমার সাথে কিছু কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করার।
রিফাত তখন পুষ্পকে কোলে তুলে নিয়ে বলে, রাত দুপুরে এসব করে আমাকে মেরে ফেলতে চাও নাকি?
-হ্যাঁ চাই… নামাও তো আমাকে।
-নামাব না।
-উফফ নামাও। আজ আমি তোমাকে নাচ দেখাব।
-শুধু নাচই দেখাবে? নাকি নাচাবেও?
-নাচাতেও পারি, নামাও এখন।
রিফাত ওকে নামিয়ে দিয়ে বিছানায় গিয়ে আরাম করে বসে বলল- নাচ আমার ময়না…
পুষ্প কুর্নিশ করার ভঙ্গি করে বলল- জো হুকুম জাহাপনা… তারপর গান প্লে করল কিন্তু তাড়াহুড়োয় খেয়ালই করল না যে, ভুল গান প্লে হয়ে গেছে! সে নাচের পজিশন নিতেই দেখে বেজে উঠেছে “ম্যায় তেরে দুশমান, দুশমান তু মেরা… ম্যায় নাগিন তু সাপেরা…” সে প্রামদ গুনল… এটা কী বাজতে শুরু করেছে!!! রোমান্টিক মোমেন্ট ধ্বংস করে নিজেই নিজেকে নাগিন বানিয়ে ফেলছে! সে তো দিয়েছিল “আইলারে নয়া দামান আসমানেরও তেরা…” ওদিকে রিফাত গান আর পুষ্পর অপ্রস্তুত অবস্থা দেখে হাসতে হাসতে বিছানা থেকে গড়িয়ে পড়ে গেল… পুষ্প তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে গান বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল। তার নাচের মুডটাই নষ্ট হয়ে গেছে! রিফাত হাসতে হাসতে এগিয়ে এসে বলল- তুমি আর তোমার রোমান্স… ওহ গড রিয়েলি… তুমি রোমান্টিক মুডেই ছিলে? অবশ্য তোমার দোষ দিয়ে লাভ নেই কিছুক্ষণ আগে তোমার ওই চিড়িয়া বন্ধু তারেকের সাথে কথা বলে নিয়েছ, তোমার তো এই হাল হবেই বলো? বলে সে আবার হাসতে লাগল। পুষ্পর তখন মুড পুরোপুরি নষ্ট। রিফাত তখন এগিয়ে এসে “আমার ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে আছো তুমি হৃদয় জুড়ে…” গানটা প্লে করে পুষ্পর কোমরে হাত রেখে মৃদু তালে নাচতে শুরু করে…
রিয়ানা পানি নেবার জন্য ঘর থেকে বের হয়েছিল ছোট ভাইয়ার ঘরের সামনে দিয়ে যাবার সময় হুট করেই গানটা তার কানে আসে… এই গানটা তো সে তূর্যর গলায় শুনেছিল! তূর্যর কাছ থেকে আর গান শোনা হল না… আরে সেদিন না ওর কাছ থেকে ওর ফোন নাম্বার নিয়ে এসেছে ও? সেটা তো ভুলেই গেছে পড়া আর বাসার টেনশনে! সে পানি নিয়ে তাড়াতাড়ি নিজের ঘরে গিয়ে ফোন হাতে নেয়, ফোন দিতে গিয়েই ভাবে রাত বাজে সাড়ে ১১টা এখন ফোন করাটা কী ঠিক হবে? আরে ইয়াং ছেলে রাত সাড়ে ১১টা মানে এদের কাছে সন্ধ্যাবেলা সে অবশ্যই ফোন দিতে পারে। সে কল দিল তূর্যকে… কী আশ্চর্য তার হার্টবিট কেমন বেড়ে গেছে! কিন্তু তূর্য ফোন ধরল না। রিয়ানা কী আবার ফোন করবে? একবার ফোন করাটা কেমন দেখায়? আবার সে এমন পরিচিত বা দরকারি বিষয়ও নয় যে দ্বিতীয়বার ফোন দেয়া যায়… কি যে মুশকিল… একটা ফোন করতেও কত ভাবনা! এই ব্রেইন নিয়ে ডাক্তার হবে কীভাবে সে? রোগীর ট্রিটমেন্ট করবে কী করবে না সেই সিদ্ধান্ত নিতে নিতে রোগী তো ততক্ষণে আকাশের তারা হয়ে যাবে! সে এসব ভাবতে ভাবতে তার ফোন বেজে উঠল, তাকিয়ে দেখে তূর্য কল ব্যাক করেছে। সে ফোন রিসিভ করে হ্যালো বলে চুপ রইল। ওপাশ থেকে তূর্য বলল-
-কে বলছেন?
রিয়ানার মনে পড়ল সে তার নাম্বার তূর্যকে দেয়নি। সে তার নাম বলল- “রিয়ানা বলছি…”
-সরি… কোন রিয়ানা?
রিয়ানা লম্বা শ্বাস টেনে বলল- সাগর কন্যা নারিকেল জিঞ্জিরা ওরফে দারুচিনি দ্বীপ, আর প্রবালে ঘেরা অসম্ভব সুন্দর ছেঁড়া দ্বীপের কর্ণধার সেইন্ট মার্টিন সমুদ্র সৈকতে বসে গানের আসর বিন্তে আপনার বাবার চেম্বার রিয়ানা।
তূর্য হেসে ফেলল, বলল- এত বড় নাম আমার বাপের জন্মে দূরে থাক দাদার জন্মেও শুনিনি! ডাকার জন্য দশজন কুলি দিয়েও সম্ভব হবে কিনা সন্দেহ! ছোট করে শুধু রিয়ানা বলা যাবে?
-যাবে। একটা মানুষ চেনাতে কতদূর পর্যন্ত ঘুরতে হয়, মাগো!
-হা হা হা… ফোন দিলে তাহলে?
-আপনি কী অপেক্ষা করেছিলেন?
-না, তবে আশা করেছিলাম।
-very smart… সাগরপাড়ে বসে আপনার গলায় যে গানটা শুনেছিলাম সেটা আজ একটু আগে ভাইয়ার ঘরে শুনে আপনার কথা মনে পড়ে গেল, তাই ভাবলাম ফোন করে একটা খোঁজ নেই?
-ভাগ্যিস, তোমার ভাইয়া গানটা শুনছিল নয়ত এই তূর্যকে মনে করার কোন হেতুই এই পৃথিবীতে ছিল না! নাকি মেডিকেলের স্টুডেন্টদের ব্রেইন আর বই ছাড়া লাইফে আর কিছু নেই?
-স্টুডেন্ট অবস্থায় তাই হওয়া উচিত। এরপরের কথা এখনো জানি না, সেটা ফিউচারই বলতে পারবে।
-গুড এ্যান্সার… এখন বলো কী বিষয়ে খোঁজ চাও?
-আপাতত একটা গান শোনালেই চলবে…
-তূর্য কোন রকম ভূমিকা ছাড়াই গান ধরল- “তুমি রবে নীরবে… হৃদয়ে মম… তুমি রবে নীরবে…”
রিয়ানা মুগ্ধ হয়ে শুনল… গান শেষ হতেই তূর্য ফোন কেটে দিল। রিয়ানার কেমন অদ্ভুত এক ভালো লাগা কাজ করতে লাগল… এই অনুভূতির সাথে তো সে পরিচিত নয়!
রাইয়ান তানিয়াকে নিয়ে তার বাবার বাড়ি থেকে বাসায় ফিরেছে। আজকাল সে বাবার বাড়িতেই থাকতে চায় অথচ কিছুদিন আগেও রাইয়ানকে ছাড়া তার এক মুহূর্ত চলত না! রাইয়ান তাকে মেঘের দেশ সাজেকে থেকে ঘুরিয়ে এনেছে। রাইয়ান আপ্রাণ চেষ্টা করেছে তানিয়াকে প্রাণবন্ত করতে কিন্তু পারেনি… মেয়েটা এত বেশি ভেঙে পড়েছে! রাইয়ান তানিয়াকে নিয়ে ফিরতেই বাড়ির পরিবেশ পাল্টে গেল। অন্য সবাই তানিয়ার সাথে আন্তরিক হবার চেষ্টা করলেও রেহানা ইসলাম একদমই পারলেন না! তানিয়া নিজেও পারল না তার সাথে আগের মত মিশতে। রেহানার সামনে দাঁড়াতে তানিয়া ভেতরে ভেতরে কেমন ভয় আর সংকোচে গুটিয়ে যায়! আমানত উল্লাহ সাহেব রেহানাকে অনেক বোঝালেন কিন্তু রেহানা কিছুতেই কিছু বুঝতে চাইলেন না। তিনি তানিয়ার কষ্ট বুঝতে পারেন না এমন নয় কিন্তু তানিয়ার কারণে তার এত ভালো ছেলেটা দুনিয়াতে তার অংশ রেখে যেতে পারবে না এটা তিনি মেনে নিতে পারেন না। সেই কষ্টটাই রাগ হয়ে তানিয়ার উপর গিয়ে প্রভাব খাটিয়ে ফেলে! তিনি তানিয়াকে সরাসরি কিছু না বলার চেষ্টা করেও চুপ থাকতে পারেন না। তাই তাদের দুজনার মধ্যে আগের মত স্বাভাবিক সম্পর্কটা অতি সন্তর্পণে নষ্ট হতে লাগল। ধীরে ধীরে রেহানা ইসলামের আচরণ তানিয়াকে ভেতরে ভেতরে বিধ্বংসী করে ফেলল। তানিয়া এসব নিয়ে কোন অভিযোগ করে না শুধু আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবে- মানুষ এমন কেন? মুহূর্তেই কী করে এমন করে রঙ বদলায়? তারপর হয়ে যায় অচেনা, অন্য কেউ? আজকাল তানিয়ার ঘুম হয় না। চোখের পাতাগুলোর কী যে হয়েছে, তারা এক হতেই চায় না… সারা রাত জেগে বসে থাকে। মাথার ভেতর কতশত ভাবনা জাল ছড়িয়ে যায় ধীরে। যে ভাবনার কোন নির্দিষ্টতা নেই! সে নিজে একটা মানুষ, তারও যে যত্ন লাগে বেঁচে থাকতে হয় এটাও যেন ভুলে গেছে! কেমন অপ্রকৃতস্থের মত জীবন যাপন করে সে। এক মাঝ রাতে সে রাইয়ানকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বলে-
-তোমাকে একটা কথা বলতে চাই…
রাইয়ান অবাক হয়ে বলে- কী, বলো?
-আমি তো আছি… তুমি আরেকটা বিয়ে করো?
-মানে কী?
-আমারও তো ইচ্ছে হয় কেউ তোমাকে আদর করে বাবা ডাকুক… ছোট ছোট হাত পায়ে তোমার সাথে খেলুক…
-রাত দুপুরে ঘুম থেকে ডেকে তুলেছ এসব কথা বলতে? কে ঢুকিয়েছে এসব তোমার মাথায়?
-কেউ ঢোকাতে যাবে কেন? বংশগতি বলেও তো একটা কথা আছে। তাছাড়া আমার খুব ইচ্ছে হয় কেউ তোমাকে “বাবা” বলে ডাকুক… তোমার কোলে ঝাপিয়ে পড়ুক… তানিয়ার গলা একটু ভারী হয়ে এলো… রাইয়ান তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল- আল্লাহ চাইলে তোমাকে দিয়েই সে আশা পূরণ হত। তোমাকে দিয়ে যখন হয়নি তখন আর কাউকে দিয়ে লাগবে না। আর আজ না হোক কাল তো রিফাত বাবা হবেই তখন তো এবাড়ির বংশ রক্ষা হচ্ছেই আর কী চাই?
তানিয়া আর কিছু বলল না। সে জানে রাইয়ানকে কোন কিছু বলেই কিছু হবে না। রাইয়ান অন্য ধাতুতে গড়া, সে কাউকে কষ্ট দিতে জানে না। সে পারে শুধু সবাইকে ভালোবেসে আগলে রাখতে! সে নিশ্চুপ হয়ে বসে রইল।
রাইয়ানকে আগের মত আর দেখা যায় না এটা যে রিফাতকে কতটা কষ্ট দেয় সেটা কেবল রিফাতই বোঝে। এক বিকেলে বাবার সাথে চা খেতে খেতে গল্প করছিল পিতাপুত্র। রিফাত প্রথমে ভাইয়ার প্রসঙ্গ তুলল। বলল-
-বাবা, ভাইয়া দিন দিন কেমন মনমরা হয়ে যাচ্ছে… ওকে এভাবে দেখতে ভালো লাগে না। ভাবির দিকে তো তাকানোই যায় না। মাও দিন দিন কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে… মনে হচ্ছে অন্য কেউ! বাড়িটায় আর আগের মত প্রাণ নেই!
-হুম… একটা বড় ঝাকুনি দরকার।
-মানে?
-যা হারিয়ে গেছে বলে বাড়ির প্রাণ নষ্ট হয়ে গেছে তা আবার ফিরিয়ে এনে।
-সেটা কীভাবে?
-তুমি চাইলেই পারো?
রিফাত এবার বুঝল বাবা কী বোঝাতে চাইছে? সে চুপ হয়ে গেল।
-এসব ব্যাপারে আসলে বাবারা সাধারণত কথা বলেন না কিন্তু আমাদের বাড়ির পরিস্থিতিটা যেহেতু স্বাভাবিক নেই তাই আমি বলতে বাধ্য হলাম। তোমার তো বিয়ের অনেক দিন হয়ে গেল, পুষ্পর ফাইনাল ইয়ারও প্রায় শেষের দিকে এখন একটা বেবি নিয়ে নেয়াটা তোমাদের এবং পরিবারের উভয়ের জন্যই ভালো হবে। আমি তোমাকে কোন ডিসিশন দিচ্ছি না তুমি নিজে ভেবে যা ভালো মন করো সেটাই সিদ্ধান্ত নাও। আমানত উল্লাহ সাহেব আর বসলেন না, উঠে গিয়ে রিফাতকে একা কিছুক্ষণ ভাববার সুযোগ দিলেন।
রিফাতের মনে হল, বাবা কথাটা মন্দ বলেননি বরং সব দিক বিবেচনা করলে এটাই সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত হয়। সে আজই পুষ্পর সাথে কথা বলবে এটা নিয়ে।
রাতে খেয়ে উঠে রিফাত পুষ্পকে বলল- চলো ছাদে বসে এক কাপ চা খাই? আজ চাঁদ উঠেছে সুন্দর।
-ঠিক আছে তুমি যাও আমি চা আর রিয়ানাকে নিয়ে আসছি।
-এর মধ্যে আবার রিয়ানা কেন?
-আরে ও সারাক্ষণ পড়াশোনা করে, ছাদ থেকে ঘুরে আসলে ওরও ভালো লাগবে।
-রিয়ানাকে ডাকবে না। ছাদে শুধু আমরা দুজন যাচ্ছি আর কেউ না।
-আচ্ছা ঠিক আছে যাও, আমি আসছি।
রিফাত ছাদে যাবার ১৫ মিনিট পর পুষ্প চা নিয়ে হাজির হয়। চায়ে চুমুক দিয়ে রিফাত বলল-
-ভাবির সাথে তোমার আজকাল কেমন কথা হয়?
-খুব কম… ভাবি একদমই কথা বলেন না, গল্প তো করেই না কিছু জিজ্ঞেস করলেও “হু/হা” দিয়ে জবাব দেয়। ওনাকে দেখলে আমার খুব কষ্ট হয়। ভাইয়াও কেমন চুপচাপ হয়ে গেছে… আগের সেই হাশিখুশি প্রাণ নেই তার মাঝে! ভালো লাগে না আমার আর…
-কী করা যায় বলো তো?
-জানি না… তাদের যতটুকু সময় দেয়া উচিত তারচেয়ে বেশি দিচ্ছি এর বেশি কী করতে পারি?
-আমি একটা কথা ভেবেছি… সেটা বলতেই তোমাকে ডেকেছি…
-কী?
-চলো আমরা একটা বেবি নিয়ে ফেলি?
-এখন! আমরা তো আরও কিছুদিন পর এসব নিয়ে ভাববো বলেছিলাম?
-হ্যাঁ, কিন্তু পরিস্থিতি এখন অন্যরকম… বাড়ির সবাইকে স্বাভাবিক করার জন্য এর বিকল্প নেই বলেই মনে হচ্ছে আমার।
-উল্টোটাও তো হতে পারে?
-উল্টোটা হবে কেন?
-ভাইয়া ভাবি যদি নতুন করে আপসেট হয়ে যায়? হয় না “কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা”র মত?
-কিন্তু আমরা তাদের ভালোর জন্য করছি। একটা বাবু এলে বাসার সবাই তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাবে তখন অন্য সব কিছুই ভুলে যাবে। আমার মনেহয় এটাই ভালো হয়।
-আমার এক মাস পর ইয়ার ফাইনাল হবে, পড়াশোনার চাপ থাকবে এর মধ্যে এই প্লানিংটা কী ঠিক হচ্ছে?
-দেখ, পড়াশোনা নিয়ে আমি কোন চিন্তা করি না ও তুমি ঠিক সামলে নেবে। আমি আছি তো প্রয়োজনে বাবাকে বলব প্রশ্ন আউট করার ব্যবস্থা করো।
-থাক, আর চাপা পিটাতে হবে না চাপা ভেঙে যাবে।
-তাহলে কথা ফাইনাল?
-আরেকটু ভেবে দেখলে হয় না?
-না, হয় না। ভাবাভাবির দিন শেষ “ফুল-বাবুর” বাংলাদেশ।
-পুষ্প আর কিছু বলল না। নিরবে চা পান করতে লাগল। সে নিজেও মনেপ্রাণে চায় সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে যাক কিন্তু এটাই সেই সঠিক সমাধান কিনা কে জানে!