#কন্যা_সর্বনাশী (পর্ব – ৫)
দেখতে দেখতে শুক্রবার চলেই আসল। আবির তার মা বাবাকে নিয়ে নীলাদের বাড়ি এসেছে। খাওয়া দাওয়া আর গল্পগুজবে খুব ভালো সময় কাটল সবার। খাওয়া দাওয়ার এতটা সময় গেছে অথচ নীলা এখনো একবার আবিরের সামনে পড়েনি। আবির ততক্ষণে উসখুস করছিল নীলার জন্য। নীলার ভাবি সেটা বুঝতে পেরে হাসছিল খুব। খোঁচা মারতেও ছাড়ছিল না। তখন আবিরের মা বললেন নীলাকে নিয়ে আসতে। নীলা ঘরে ঢুকতেই আবিরের বুকে ব্যথা করে উঠল… সেই প্রথম দেখায় যেমন হয়েছিল। আবিরের মায়ের দেয়া শাড়ীটা পরেছে… দারুণ লাগছে। বড়রা সবাই কী বলছিল তা যেন আবিরের কানেই যাচ্ছিল না।
আংটি পরানো হয়ে গেলে নীলার ভাবি খেয়াল করল আবির ইশারায় নীলাকে কি যেন বলতে চাইছে… ভাবি তখন বলে উঠল
-আবির কিছু বলছ?
-হুট করে বলায় আবির একটু ছিটকে উঠল। ভাবি মুখ টিপে হেসে উঠে। নীলা নিজেও মুখ টিপে হাসল। নীলা ভাবিকে আস্তে করে ডেকে বলল
-ভাবি প্লিজ আমাদের একটু একা কথা বলার সুযোগ করে দাও না?
-ইসসস একেবারে ধৈর্য হারা হয়ে যাচ্ছে… দাঁড়াও ব্যবস্থা করছি। সে বড়দের উদ্দেশ্যে বলল- গল্প আর আলোচনা তো চলতেই থাকবে আমরা নাহয় ওদের একটু একা কথা বলার সুযোগ দেই?
-আবিরের মা বললেন হ্যাঁ ওদের ভেতরে নিয়ে যাও। নীলার ভাবি ওদের নীলার ঘরে নিয়ে গিয়ে বললেন-
-ইসস সেই তখন থেকে দুজনার ইশারা চলছে। এত কিসের কথা, হুম? ফোনে তো সারাক্ষণ দুজন কথা বলেই যাচ্ছ। এখন বল যত কথা, আমি আসছি।
-ভাবি বেরিয়ে যেতেই আবির বলল তোমার ভাবিটা চমৎকার। তারপর সে পুরো ঘরটায় চোখ বুলিয়ে বলল-
এই তাহলে তোমার ঘর? ভালো। খাওয়া দাওয়া করেছি এবার বিছানার শুয়ে একটু গড়াগড়ি করে নিলে কেমন হয়?
-খুবই বাজে হয়।
-কেন?
-শুয়ে পড়লে ঘুমাতে চাইবেন তারপর বলবেন আজ থেকে যাই…?
-এত বোঝো আমাকে!
-হুম, বুঝি তো।
-তাহলে বলো এখন আমার কী ইচ্ছে হচ্ছে?
-আমার হাত ধরতে ইচ্ছে হচ্ছে।
-বাহ্ নিজের ইচ্ছে আমার নামে চালিয়ে দিচ্ছ?
-ইচ্ছে নিজের লোকের উপর চাপাব না তো কী কুলির কাঁধে চাপাব?
-হা হা হা… বলছ তাহলে আমি তোমার নিজের লোক? নিজের লোক হিসেবে বলব কী ইচ্ছে হচ্ছে?
-না।
-প্লিজ বলি?
-অবশ্যই না!
-ঠিক আছে তাহলে হাতটা অন্তত ধরি?
-না।
-“না না না” নিষ্ঠুর রমণী।
নীলা মুচকি হেসে বলল- চলুন বাইরে যাই বড়রা আবার কী ভাববে…
-না। আমি আরও কিছুক্ষণ থাকতে চাই। ঘরটা আমার পছন্দ হয়েছে। পুরো ঘর জুড়ে তোমার স্মেল… বিছানাটায় একটু গড়াগড়ি না দিয়ে যাব না, বলে আবির শুয়ে পড়ে।
-ভাবিইইইই…
-আবির লাফিয়ে উঠে নীলার মুখ চেপে ধরে… ইসসস আমার প্রেস্টিজটা এভাবে ধ্বংস না করলে চলছে না তোমার?
-একটা কুমারী মেয়ের বিছানায় ঘুমাতে চান কেন?
-শোনো এই কুমারী মেয়েটা না আমারই হবু বউ। একটা কথা বলব?
-কী?
-তোমাকে কেমন বউ বউ লাগছে।
নীলার মুখ লজ্জায় ইষৎ রক্তিম বর্ণ হয়ে গেল… সে মুখ নামিয়ে নেয় তারপর মুচকি হেসে আস্তে করে বলে- আর আপনাকে গুন্ডা গুন্ডা লাগছে।
আবির উচ্চস্বরে হেসে ফেলে… গুন্ডা! তাহলে তো বাংলা সিনেমার ডায়লগ দিতে হয়- “সুন্দরী আজ তোকে একলা পেয়েছি… আমার হাত থেকে তোকে কেউ বাঁচাতে পারবে না…. মুহা হা হা হা…”
-ভাইয়া কিন্তু ঘরেই আছে।
-উফফ এর মধ্যে আবার পুলিশ কেন?
-বাহ্, গুন্ডা আসবে আর পুলিশ আসবে না? চলুন উঠুন তো এবার। সবাই বসে আছে বাইরে।
-থাকতে দিলে না… আমি কিন্তু তোমার মত এতটা অভদ্র নই। আমার বাড়িতে চিরদিনের জন্য তোমাকে থাকতে দেব।
-আর মনে?
-এই বুকে হাত দিয়ে দেখো?
নীলা মুগ্ধ দৃষ্টিতে আবিরের দিকে তাকাল… এই মুখের দিকে তাকিয়ে সে তার পুরো জনম কাটিয়ে দিতে চায়। তারপর আস্তে করে বলল, চলুন যাই।
এর পরের দিনগুলো ওদের স্বপ্নের মত কাটতে লাগল। সপ্তাহ খানেক পর আবির নীলাকে ফোন করে বলে-
-বিকেলে একটু আসতে পারবে? মনে হচ্ছে তোমায় অনেকদিন দেখি না!
-বিয়ের আগে এত দেখেদেখি কিসের হুম?
-ও হ্যালো, ভার্সিটি লাইফে যদি আমার প্রেমটা কবুল করে নিতে তাহলে আমরা চুটিয়ে প্রেম করতে পারতাম। ঘুরতাম, বেড়াতাম… সেগুলো তো সব পাওনা রয়ে গেছে, কিছুটা হলেও এখন তোমার তা শোধ করা চাই।
-বাপরে, এ তো দেখছি পাওনাদার ভয়ংকর!!
-হুম, পাওনা চাইলেই সবাই তখন ভয়ংকর হয়ে যায়, আজব!
নীলা হেসে বলল- আচ্ছা? তো মি. পাওনাদার, আপনার পাওনা পরিশোধ করতে আমাকে কী করতে হবে?
-চলো সিনেমার মত দুজনে নিড়িবিলি কোথাও গিয়ে রোমান্টিক গান গাই, হাত ধরে দৌড়াদৌড়ি করি, নাচানাচি করি?
-আপনি মারামারি করতে জানেন তো?
-এর মধ্যে মারামারি কোথা থেকে এলো?
-না, সিনেমায় তো রোমান্টিক নাচ গান শেষ হতেই একদল ভিলেন এসে হাজির হয়। তাদের ঢিসুম ঢুসুম মারতে হবে না?
-তোমার তো দেখছি নায়কের চেয়ে ভিলেন নিয়ে ভাবনা বেশি! সব কথায় কুমিরের ল্যাজের মত ভিলেন টেনে নিয়ে আসো! শোনো, তোমার গল্পে নায়ক এবং ভিলেন দুটোই আমি। পালাবার কোনো পথ নেই। বিকেলে চলে এসো। টিএসসিতে বসে চা খাবো এক সাথে।
-জো হুকুম জাহাপনা।
-জাহাপনার মত এত ভারী শব্দ না বলে “জান” এর মত সুইট আর সহজ শব্দটা বললেই তো পারো?
-“তু জান জান কারকে মেরি জান লেগায়ি”
-ইসসস… মার ডালা…
নীলা আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন রেখে দেয়। তারপর সাজগোজ করে আবিরের উদ্দেশ্যে বের হয়ে যায়। আবিরের অফিসের সামনে এসে ফোন করে তাকে।
আবির ফোন পেয়ে নিচে এসে দেখে নীলা রাস্তার উল্টো পাশে ওর জন্য অপেক্ষা করছে। আবির নীলার সাথে ফোনে কথা বলতে বলতেই যাচ্ছিল… নীলার দিকে তাকিয়ে কখন বেখেয়ালি হয়ে রাস্তায় পা বাড়িয়েছে আবির তা টেরই পায়নি! আর তখনই পাশ থেকে একটা বাইক এসে আবিরকে সজোরে ধাক্কা মারে, আবির ছিটকে গড়িয়ে পড়ে যায় রাস্তায়! নীলার সমস্ত পৃথিবী মুহূর্তেই দুলে উঠল… সে দৌড়ে গিয়ে আবিরের পাশে বসে পড়ে আবিরের মাথাটা কোলে তুলে নিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে… আবির চোখ মেলে ঝাপসা চোখে নীলাকে একবার দেখে, মেয়েটা কেমন অসহায়ের মত কাঁদছে! মায়াবী মেয়েটাকে সে এভাবে আতংকে ফেলে দিল? তারপর সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে!
আবিরকে পুরো এক সপ্তাহ হাসপাতালে থাকতে হল। এক্সিডেন্টে সে মারাত্মক ভাবে আহত হয়েছিল। শরীরের অনেক জায়গায় কেটে গেছে, থেঁতলে গেছে সেগুলো এখনো পুরো সারেনি, সময় লাগবে। তবে মূল আঘাতটা পেয়েছে বাম পায়ে। দুই জায়াগায় ফ্রাকচার হয়েছে। ফ্রাকচারের কারণে তার নার্ভ ড্যামেজ হয়ে গেছে। ফ্রাকচার ঠিক হতে এক মাস সময় লাগবে। তবে দু’মাস পরেই যে আবির নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে তা নয়। নার্ভ ড্যামেজের কারণে ডাক্তার আশংকা করছেন আবিরকে হয়ত সারা জীবন স্ক্র্যাচে ভর দিয়ে বা খুঁড়িয়ে হাঁটতে হবে!!
এই এক সপ্তাহ নীলা সারাদিন হাসপাতালে থেকেছে আবিরের পাশে। রাতে ঠিক মত ঘুমায়নি। তার চেহারায় ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। আবির ভেতর থেকে একেবারে ভেঙে পড়েছে… নীলা সার্বক্ষণিক আবিরের মনে সাহস জোগাবার চেষ্টা করেছে। নীলা না দেখালেও তার হাসিখুশি মাখা মিষ্টি মুখটায় ক্লান্তি আর আতংকের ছাপ ঠিকই দেখতে পেত আবির। সব কিছু ছাপিয়ে নীলার মলিন চেহারায় তার জন্য কী আশ্চর্য এক ভালোবাসাও ভরে থাকত।
এক্সিডেন্টের কারণে ওদের বিয়েটা পিছিয়ে গেল। যদিও নীলা চাচ্ছিল নির্ধারিত সময়ে হয়ে যাক। কারণ আবিরের এখন নীলাকে বিশেষ ভাবে পাশে প্রয়োজন। কিন্তু বাড়ির বড়দের সেটা বোঝানো গেল না। তারা চাইল বিয়েটা পিছিয়েই যাক।
দেড় মাস পর আবিরের পায়ের প্লাস্টার খোলা হল। তার পায়ের ফ্রাকচার ঠিক হলেও সে নিজের পায়ে আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না! আবির ভেতর থেকে একেবারে ভেঙে পড়ল। পায়ের সাথে সাথে তার জীবনটাও এখন খোঁড়া হয়ে যাবে না তো? সবাই হয়ত এখন তাকে করুণার চোখে দেখবে… সে আদৌ কী আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারবে?
নীলার আবিরের কাছে যাওয়াটা নীলার মা আর পছন্দ করছিলেন না। তিনি মন থেকে চাইছিলেন এই বিয়েটা আর না হোক। এতে সবাই তাকে খারাপ ভাবে ভাবুক তার কিছু যায় আসে না। নীলার মত এমন মেয়ের পাশে একটি পঙ্গু ছেলেকে তিনি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না। নীলার বাবা আর ভাইয়া এ ব্যাপারে কিছু বলছেন না। তারা চাইছেন নীলা বুঝে শুনে নিজেই একটা সিদ্ধান্তে আসুক। সে বুদ্ধিমতী মেয়ে, নিশ্চই ভুল সিদ্ধান্ত নেবে না। নীলা যে সিদ্ধান্ত নেবে তারা সেটাকেই সাপোর্ট করবে।
ওদিকে আবির এখন একা থাকতেই বেশি পছন্দ করে। কারো সাথে তেমন কথা বলতে চায় না। নীলার সাথেও না! সবার থেকে দূরে থাকার অদৃশ্য দেয়াল তার চারপাশে তুলে দিচ্ছে সে ধীরে ধীরে। আগের মত প্রাণ নেই ছেলেটার চেহারায়। আবিরের মা ছেলেকে এমন দেখে নিজেও ভেঙে যাচ্ছেন। তিনি চাইছিলেন বিয়েটা তাড়াতাড়ি হয়ে যাক। নীলা এসে ঠিক আবিরকে সামলে নেবে। সে আশাতে সে নীলার মায়ের সাথে কথা বলতে গিয়েছিল কিন্তু নীলার মায়ের কথাগুলো যেন কেমন ছিল… তার ভালো লাগেনি। তিনি বুঝতে পারছিলেন না নীলার মা এভাবে কেন কথা বলছেন! এই বিষয়ে আবিরের বাবার সাথে শেয়ার করলে তিনি বুঝলেন নীলার মা কি চাইছেন। তারপরও ছেলের কথা ভেবে তিনি বললেন, “চলো নীলাদের বাড়ি গিয়ে একবার কথা বলে দেখি তারা কী বলেন?” ওরা সিদ্ধান্ত নিলেন এ ব্যাপারে আবিরকে কিছু না জানিয়ে নীলাদের বাড়ি যাবেন বিয়ের ব্যাপারে কথা বলতে।
পরদিন আবিরের মা বাবা দুজন নীলাদের বাড়ি গেল। নীলার মায়ের চেহারায় আজ কেমন যেন প্রাণচঞ্চলতা নেই! মেঘে ঢাকা অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশ। কুশল বিনিময়ের পর আবিরের মা বললেন-
-আমরা আসলে বিয়ের ব্যাপারে কথা আগাতে চাইছিলাম। বিয়েটা তো অনেকদিন হল পিছিয়ে গেছে… আবির এখন মোটামুটি সুস্থ। কিন্তু মনের দিক থেকে আমার ছেলেটা একদম ভেঙে পড়েছে… এই সময়ে নীলা ওর পাশে থাকলে খুব ভালো হত। তাই বিয়ের দিনটা তাড়াতাড়ি ঠিক করে ফেললে…?
নীলার বাবা বললেন- হ্যাঁ এ বিষয়ে এখন আলোচনা করা উচিত।
-আলাপ করতেই তো এলাম, বলল আবিরের বাবা।
-নীলার মা বললেন, দেখুন আমি এত ভণিতায় যেতে চাই না। সরাসরি কথা বলতে পছন্দ করি… নীলার পড়া এখনো শেষ হয়নি। আমি এই মুহুর্তে ওর বিয়েটা দিতে চাচ্ছি না। আরও কিছুদিন যাক… পড়া শেষ হোক, একটা কিছু করুক তারপর বিয়ের কথা ভাবা যাবে।
আবিরের মা স্পষ্টই বুঝতে পারলেন নীলার মা কী বোঝাতে চাইছেন। তিনি বেশ অবাক হলেন তার কথায়। মানুষ এতটা কঠিন হয়ে যেতে পারে? সে ভাঙা গলায় বলল-
-আমার ছেলেটা একটা এক্সিডেন্ট করেছে এখন সবার উচিৎ তার পাশে থাকা। আপনারা যদি এভাবে বলেন তাহলে আমার ছেলেটা শেষ হয়ে যাবে। ও নীলার জন্য কী না করেছে? নিজেকে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে গেছে তার কোন মূল্যই কী নেই?
নীলার মা কিছু বলতে যাচ্ছিল তাকে থামিয়ে দিয়ে নীলার বাবা বললেন- ভাই আমরা নীলার সাথে আলাপ করে আপনাকে জানাব। আপনারা এত ভাববেন না।
-আবিরের মা বুঝল এখানে আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। তবু জিজ্ঞেস করলেন- নীলা মায়েরও কী একই কথা?
নীলার মা বলল- হ্যাঁ। আমাদের মেয়েকে আমরা যা বলব সে তাই করবে।
-আবিরের বাবা বলল, আমি নীলা মায়ের সাথে একটু কথা বলতে চাই।
-নীলার মা বললেন, আমার মেয়েটা সরল তাই ওর সাথে কথা বলে ওকে ইমোশনাল করে ফেলবেন সেটা না হওয়াই ভালো।
আবিরের মা বাবা আর কোন কথা বললেন না। এখান থেকে চলে যাওয়াটাই সমীচীন মনে করলেন। তারা চলে যাবার পরই নীলা ঘরে ঢুকল। সে এতক্ষণ দরজার পাশে দাঁড়িয়ে সবটা শুনেছে। তার মা যে এভাবে বলতে পারে সেটা সে বিশ্বাসই করতে পারছিল না! সে ঘরে ঢুকে সরাসরি মাকে জিজ্ঞেস করল-
-মা এটা তুমি কি করলে? কেন তাদের সাথে এমন আচরণ করলে?
-যা ঠিক মনে হয়েছে আমি তাই বলেছি। তুমি এটা নিয়ে কোন কথা বলবে না। আমরা যা সিদ্ধান্ত নেব তাই হবে।
-তুমি সিদ্ধান্ত নিলে তো হবে না মা। আর যেখানে বিয়ে পাকা হয়ে গেছে আংটি বদল হয়ে গেছে সেখানে তুমি এসব ভাবছ কি করে?
-ভাবছি কারণ কোন পঙ্গু ছেলের সাথে বিয়ে হয়ে আমার মেয়েটা সারা জীবন কষ্ট করুক সেটা আমি চাই না।
-মা! তুমি এভাবে বলছ? আবির আমার জন্য কি না করেছে আর এখন একটা ছোট্ট এক্সিডেন্ট তার জীবনের সব কেড়ে নেবে?
নীলার মা প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে বললেন- তুমি এত বেশি কথা কেন বলছ? আমি যা বলেছি তাই হবে। আমি তোমার মা, নিশ্চই তোমার খারাপ চাইব না? যাও নিজের ঘরে যাও। এ ব্যাপারে আমি আর কোন কথা শুনতে চাই না।
নীলা আর কিছু না বলে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে কাঁদতে লাগল। আবিরকে তো সে ভালোবেসে ফেলেছে… আর আজ তার ভালোবাসার মানুষটা যখন জীবনের সবচেয়ে খারাপ সময় পার করছে তখন সে তার পাশে থাকবে না? নীলার খুব অসহায় লাগল নিজেকে। নীলার প্রতি আবিরের তীব্র ভালোবাসার কিছুই কি সে ফিরিয়ে দিতে পারবে না? ভালোবাসার বদলে তো ভালোবাসাই দিতে হয়। একজন বিশ্বাসঘাতক প্রেমিকা হয়ে পৃথিবীর বুকে কীভাবে বেঁচে থাকবে নীলা? এটা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। কী করবে এখন সে?
নীলার ভাইয়া বাসায় এসে রাতে খেতে বসে দেখে নীলা নেই। নীলা কোথায় জানতে চাইলে তার বউ বলল-
-নীলার মন ভালো নেই সে খাবে না বলেছে।
-মন ভালো নেই? কী হয়েছে?
-নীলার মা নিজেই তখন সবটা খুলে বললেন।
-সরফরাজ বললেন, মা তুমি এগুলো কী করেছ? তাদের সাথে এভাবে কথা বলে ঠিক করোনি। নীলার উপর কী প্রেশার যাবে বুঝতে পারছ? নীলার সাথে আগে কথা তো বলে নেবে?
-নীলা আবেগী অবস্থায় আছে তার সাথে এখন কথা বলার কোন মানেই হয় না। এখন সে আবির ছাড়া কিছুই বুঝবে না।
-আমি নীলার সাথে কথা বলব। নীলা যা করতে চাইবে আমি তার সাথে একমত থাকব। ও যদি আবিরকে চায় তো তাই হবে।
-এসব তুই কি বলছিস?
-ঠিকই বলছি মা। আচ্ছা এই এক্সিডেন্টটা যদি বিয়ের পর হত তখন কি করতে? নীলা কি পারত তখন ওকে ফেলে আসতে? নাকি তোমরা পারতে নীলাকে আবিরের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিতে?
-যেটা হয়নি সেটা নিয়ে কেন কথা বলছিস? কী হতে পারত আর কী হতে পারত না সেটা ভেবে দুনিয়া চলে না। যেটা হয়েছে সেটাই দেখার বিষয়।
-আমি তোমার সাথে একমত হতে পারছি না। মানুষকে তার অতীত এবং বর্তমান মিলিয়েই ভবিষ্যতের দিকে আগাতে হয়। আমি চাই না আমার বোন সারা জীবন আত্মগ্লানি নিয়ে বাঁচুক। আমি নীলার সাথে কথা বলছি।
সরফরাজ তার মাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নীলার ঘরে চলে যায়।
লাইট নিভিয়ে বিছানায় শুয়ে কাঁদছিল নীলা। সরফরাজ ঘরে ঢুকে বলল-
-নীলা ঘুমিয়ে গেছিস?
নীলা চোখের পানি মুছে অস্ফুটস্বরে বলল- না।
-তোর সাথে একটু কথা বলতাম, বাতি জ্বালাই?
-আমার কিছু ভালো লাগছে না ভাইয়া। কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না…
-আচ্ছা তোর কথা বলতে হবে না, বাতিও জ্বালাতে হবে না। আমি তোর পাশে বসি কিছুক্ষণ।
-নীলা কিছু না বলে উঠে বসল।
সরফরাজ নীলার পাশে বসে বলল- এভাবে কেন ভেঙে পড়ছিস? তোর ভাইয়া আছে না?
-নীলা ভাইয়ার কোলে মাথা রেখে হু হু করে কেঁদে ফেলল…
চলবে…