কন্যা_সর্বনাশী (পর্ব – ৬/শেষ পর্ব)

0
1024

#কন্যা_সর্বনাশী (পর্ব – ৬/শেষ পর্ব)

সরফরাজ বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন- মায়ের কথায় কষ্ট পাস না। মায়ের জায়াগা থেকে মা হয়ত ঠিকই ভেবেছে। কোন মা-ই চায় না তার সন্তান এতটুকু খারাপ থাকুক। মায়ের জায়গায় তুই হলে তুই নিজেও হয়ত এভাবে ভাবতি। এখন মায়ের ভাবনাটা বাদ রাখলাম, তুই কী ভাবছিস আমি শুধু সেটা জানতে চাই। আবিরের সম্পর্কে আমি সবটা জানি। আজ একটা ঘটনা বলি যেটা তুই হয়ত জানিস না। ও যখন প্রথম আমার কাছে আসে তখন ওর সব কথা শুনে আমি এটা সেটার বাহানায় ওর কাছ থেকে কিছু সময় নেই। তারপর ওর পেছনে দুজন স্পাই লাগিয়ে দিয়েছিলাম যেটা ও আঁচ করতে পারেনি। আমার স্পাই একদিন এসে বলল, আবির নাকি মাঝে মাঝেই রাস্তা থেকে ভিখিরি মহিলা ধরে নিয়ে রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাওয়াত। গুটুর গুটুর গল্পও করত। ব্যাপারটা আমার কাছে অদ্ভুত লেগেছিল। ওর সাথে পরেরবার যেদিন দেখা করি সেদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম এমনটা কেন করে? ও বলেছিল “নীলার সাথে সম্পর্কে জড়ালে মাঝে মাঝে আমরাও রেস্টুরেন্টে গিয়ে খেতাম। সেটা যেহেতু হয়নি তাই এই ব্যবস্থা। যখন বুঝলাম এই ব্যাপারটায় অনেক শান্তি আছে তখন থেকে নিয়মিত করার চেষ্টা করলাম। তাদের সাথে কথা বলে তাদের জীবনের কষ্টের অনেক গল্প জেনেছি। আমার খুব ইচ্ছে হয় তাদের জন্য কিছু করতে, তাদের জীবনটা পাল্টে দিতে… সেটা তো আমার একার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই যতটা পারি চেষ্টা করি।” এটা শোনার পর মনে হয়েছিল, এই ছেলে আর যা-ই হোক আমার বোনকে কখনো কষ্ট পেতে দেবে না। আমরা যারা আইন-শৃঙ্খলার পেশায় থাকি তারা মানুষ চিনতে ভুল করি না। এখন আবিরের ব্যাপারে আমি তোর মতামত জানতে চাই। তুই যা বলবি তাই হবে। তবে সিদ্ধান্তটা যেন শুধুমাত্র আবেগ দিয়ে নেয়া না হয়।

ভাইয়ার কাছ থেকে এসব শুনে আবিরের প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসাটা বেড়ে গেল নীলার। সে ভাইয়াকে বলল- আমি আবিরের পাশে থাকতে চাই ভাইয়া… আর সেটা তুমিও চাইবে বলেই বিশ্বাস করি।

-ঠিক আছে। মায়ের সাথে আমি কথা বলব। এর জন্য যা যা করতে হয় আমি করব। তুই কিছু চিন্তা করিস না। ওঠ এবার। ফ্রেস হয়ে খেতে আয়।

-খেতে ইচ্ছে করছে না ভাইয়া…

-ঠিক আছে যখন খিদে পায় খেয়ে নিস। আমি যাই।

সরফরাজ চলে যেতেই নীলা উঠে বসে। তার এখন অনেকটাই নির্ভার লাগছে। ভাইয়া যখন বলেছে তখন তার আর কোন চিন্তা নেই। কান্না করে চোখ মুখ ইতিমধ্যেইই ফুলিয়ে ফেলেছিল সে তাই উঠে ফ্রেস হয়ে এসে আবিরকে ফোন করে। একবার দুবার বার বার করে কিন্তু ফোন রিসিভ হয় না। আবির কি ঘুমিয়ে পড়ল? এত তাড়াতাড়ি তো ঘুমাবার কথা না! নীলা একটা ম্যাসেজ দিয়ে রেখে দিল।

আবির বারান্দায় বসে আছে। তার পাশে রাখা ফোনটা বেজে যাচ্ছিল… নীলা ফোন করেছে, করেই যাচ্ছে। আবির ফোন সাইলেন্ট করে রেখে দেয়। নীলার সাথে কথা বলার অভ্যেসটা এবার তার ছাড়াতে হবে! আজ তার মা হুট করে বলেছে- “নীলার সাথে তোর আর কথা না বলাই ভালো।” মা শুধু এই একটা কথাই বলেছে কিন্তু সেই কথাটায় অনেক কথা লুকিয়ে ছিল। আবির ইদানীং একা থেকে সব কিছুর ভাবনার গভীরে যাওয়াটা শিখে গিয়েছে। আটকে থাকা ঝিনুক থেকে মানুষ যেমন মুক্তো বের করে আনে আবিরও তেমন কারো না বলা কথা থেকে অনেক কিছুই বের করে আনতে পারে। মা কিছু না বললেও আবির বুঝতে পেরেছে নীলাদের বাড়ি থেকে এমন কিছু বলা হয়েছে যার কারণে তার মা তাকে এই কথা বলেছে। তারই সূত্রে আবিরের মনে হয়েছে নীলার সাথে কথা বলার অভ্যেস থেকে তাকে বের হয়ে আসতে হবে। নীলার ম্যাসেজ পড়ে আবিরের বুক চিরে দীর্ঘাশ্বাস বেরিয়ে আসে… বাকি জীবন তাকে হয়ত এভাবে দীর্ঘশ্বাসের সাথেই বাঁচতে হবে!! নীলার সর্বনাশী ভালোবাসায় জড়িয়ে গিয়ে আজ নিজেকে নি:স্ব মনে হচ্ছে। কেন এত ভালোবাসা দিল নীলা? এটা মনে হতেই তার চোখ থেকে দু’ফোটা উষ্ণ পানি গড়িয়ে পড়ল।

নীলা সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখে আবির না কোন ফোন করেছে না কোন ম্যাসেজ দিয়েছে, এমনটা তো হবার কথা না! সে আবিরকে আবার ফোন করল কিন্তু সে ধরল না। নীলার বুকের ভেতর অস্থির একটা কষ্ট মাথাচাড়া দিয়ে উঠল… আবির কি কোন কারণে কষ্ট পেয়েছে? নীলা দুয়ে দুয়ে চার মিলিয়ে নিল। তার চোখে পানি চলে এলো। সে ভেবেছিল আবিরের সাথে কথা বলে সব সামলে নেবে… কিন্তু সামলে নেবার আগেই মনে হচ্ছে সব কিছু তছনছ হয়ে গেছে! সে এখন কী করবে? নীলা সকালেও আর খেতে পারল না। সারাটা দিন তার আবিরের ভাবনায় কেটে গেল। ছেলেটা এত অভিমানী! একটাবার কথা তো বলবে? আমার কোন কথা না শুনেই সে এমনটা করতে পারছে? সারাদিনেও যখন আবিরের কোন খোঁজ পাওয়া গেল না তখন বিকেলে সে সিদ্ধান্ত নিল আবিরের বাসায় যাবে। তার মুখোমুখি হবে। এছাড়া আর কোন উপায় সে খুঁজে পেল না।

তখন বিকেলের শেষ আলোটাও নিভে যেতে শুরু করেছে। আলতো পায়ে সন্ধ্যা নেমে আসছে। আবির বারান্দায় বসে সেই দৃশ্যটা দেখছিল আর ভাবছিল তার জীবনেও এভাবে আলো হারিয়ে অন্ধ্যকার নেমে আসছে ধীর পায়ে… প্রতিটা অন্ধকার রাতের পর নতুন আলোকিত দিনের সূচনা হয়, আবিরের জীবনে কী সেটা আর আদৌ হবে? মানুষের জীবন নাকি ক্ষণে ক্ষণে রঙ বদলায়। জীবনের বাঁকে বাঁকে রঙ পরিবর্তন হয় মননে, মগজে আর আত্মশুদ্ধিতে। সে এখন বেশিরভাগ সময় বারান্দায় বসে আকাশ দেখে কাটায়। আর ভাবনার জগতটা হাট করে খুলে রাখে। কী করে সূর্যটা টুকুস করে ডুবে গিয়ে অন্ধকার চলে আসে ব্যস্ত শহরে সেটা সে মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করে। ধীরে ধীরে সন্ধ্যার শেষ আলোটাও নিভে গিয়ে রাস্তায় ল্যাম্পপোস্টের নিয়ন বাতি জ্বলে ওঠে। ব্যস্ত মানুষ ঘরমুখো হয়। পাখিরা জোড়া বেঁধে উড়ে যায় কিচিরমিচির করতে করতে। হয়ত সারাদিনের ভালোবাসার খুনসুটি করে ওরা তখন। আবির আজকাল এ সবই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খেয়াল করে। অন্ধ্যকার নামার পরও সে যখন বসে বসে এসব নিয়ে ভাবছিল ঠিক তখনই পেছেন থেকে কেউ বলে উঠল-

“তুমি আমার সাথে কথা বলছ না কেন?”

আবির চমকে উঠে পেছনে তাকিয়ে দেখে নীলা! তার বুকের ভেতর বড় একটা ঢেউ যেন আছড়ে পড়ল। নীলা এই প্রথম তাকে “তুমি” বলল এবং সেটা খুব দায়িত্ব সহকারেই! তার বুকের ভেতর আস্তে করে আশার একটা টিনটিনে বাতি কি দপ করে জ্বলে উঠতে চাইল?

-কি হলো কথা বলছ না কেন?

-হঠাৎ তুমি এখানে?

-তুমি আমার ফোন ধরছ না, ম্যাসেজের রিপ্লাই দিচ্ছ না, কথা বলছ না, কেন?

-কি বলব? রোজই তো কথা হয়… রোজ রোজ একই কথা আর কত বলব?

-কই আগে তো এমন মনে হয়নি? আর রোজ রোজ আমরা একই কথা কখন বলেছি?

-সব সময় সব কিছু কি একই থাকে?

-থাকে না। কিন্তু কথা না বলে এভাবে এড়িয়ে চলার স্পষ্ট কারণটা আমি জানতে চাই।

-তোমাকে বুদ্ধিমতী মেয়ে বলেই জানি। এড়িয়ে চলার কারণটা বুঝতে না পারার তো কোন কারণ নেই?

-আমি তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই?

-তুমি সত্যিই বুঝতে পারো না?

-না, পারছি না।

দেখো, আমি এক মেয়েতে দীর্ঘ সময় আটকে থাকতে পারি না। তোমাকে আমার প্রতি দুর্বল করে দেয়াটাই আমার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল। ওসব প্রেম ভালোবাসা বলে কোন কিছুর জায়গা আমার মনে নেই, কখনো ছিলও না। আমি শুধু টাইম পাস করতে জানি। আর এটা বুঝতে না পারার মত মেয়ে তুমি এখন সেটা বুঝতে হবে আমায়?

-এসব উদ্ভট, আজগুবি, বানোয়াট, কাল্পনিক কথা আমায় বলতে আসবে না একদম। সত্যি কথাটা বলো?

-এখানে “সত্যি” বলতে অন্য আর কিছু নেই। তুমি এখানে কেন এসেছ? এভাবে চলে আসাটা মোটেও উচিত হয়নি। বাড়ি চলে যাও।

-এখানে এই মুহূর্তে থাকার জন্য আসিনি আমি। আমি শুধু আমার প্রশ্নের উত্তর চাই। আর উত্তর না নিয়ে তো আমি যাব না।

-আমি তোমার কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য নই। চলে যাও তুমি। আমি আর চাই না এসব। তোমাকে অর্জন করার জেদ ছিল মনে, সেটা পাওয়া হয়ে গিয়েছে তাই তোমার প্রতি আমার আর কোন আগ্রহ নেই। বলে আবির তার ঘরের দিকে পা বাড়াল। নীলা আচমকাই ঘরে ঢুকে আবিরকে জড়িয়ে ধরল। সে ভেজা গলায় বলল-

-তুমি আমার সাথে এমন কেন করছ? আমার কষ্ট হয়… তুমি কি এখনো বুঝতে পারো না নীলা নামক গল্পটায় আবির নামটা জড়িয়ে গেছে? এই গল্পটা আবির আর নীলা নামেই শেষ হবে। নীলার সমাপ্তি যে আবিরেই।

-আবিরের ভেতরের ঢেউটা জলোচ্ছ্বাসে রূপ নিতে চাইল। তার ইচ্ছে হল নীলাকে শক্ত করে চেপে ধরে বলে “আমাকে ছেড়ে যেও না… এভাবেই ধরে রাখো, আগলে রাখো অনন্তকাল। তুমি না থাকলে এই আমি নি:স্ব হয়ে যাব, অন্ধ্যকারের অতলে তলিয়ে যাব… ” কিন্তু সে কিছুই করল না। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

-নীলা তখন কেঁদে ফেলল।

-আবির নীলাকে কিছুক্ষণ কাঁদতে দিল তারপর নিজেকে আস্তে করে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল- কেন বুঝতে চাইছ না নীলা? আবেগ দিয়ে সব চলে না। যেদিন আবেগ ফুরিয়ে যাবে সেদিন হয়ত তোমার জীবন অন্য রকম হয়ে যাবে।

-আবেগ আর অনুভূতির পার্থক্য আমি বুঝি আবির।

-বুঝতে পারো না। পারো না বলেই এসব বলছ। আর তুমিই তো বলো “নীলা সবার সয় না”।

-নীলা যদি একজনেরও সয় তাহলে সেটা আবির।

-আবির কি বলে এই অবুঝ মেয়েটাকে বোঝাবে ভেবে পাচ্ছে না। এ তো কিছুই শুনতে চাইছে না! তখন আবিরের মা আবিরকে ডেকে পাঠালেন। বললেন নীলাকে নিয়ে ড্রইং রুমে আসতে। ড্রইং রুমে এসে আবির দেখল নীলার ভাই বসে আছে সেখানে।

সরফরাজ খান নীলার দিকে তাকিয়ে দেখলেন ওর চেহারায় কান্নার ছাপ স্পষ্ট। সে আবিরকে বলল-

-আবির আমার বোনটাকে সেই ছোটবেলা থেকে ডাকাবুকো টাইপ দেখেছি, হাসিখুশি দেখেছি। ওকে কখনোই এর আগে এভাবে অসহায়ের মত অবস্থায় দেখিনি। তাই ব্যাপারটা আমি হজম করতে পারছি না। নীলা আমার অতি আদরের একমাত্র বোন। ওর ভালো থাকাটা আমি নিশ্চিত করতে চাই। তোমাকে বলে রাখছি আমার বোনের চোখে আজকের পর এই কান্নাটা যেন আর না দেখি। তারপর আবিরের মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল-

-আন্টি আমার মায়ের কথায় কষ্ট পাবেন না। মা হিসেবে সে হয়ত ভুল ভাবেনি। আমি মা’র সাথে কথা বলেছি। তাকে বুঝিয়েছি নীলার ভালো আবিরে গিয়েই শেষ হয়। মা সেটা শেষ পর্যন্ত মেনে নিয়েছেন। আবিরের যেমন এখন নীলাকে পাশে প্রয়োজন তেমন নীলার পাশেও আবিরকে প্রয়োজন। তাই আমরা চাইছি বিয়েটা খুব দ্রুত হয়ে যাক। আমি আজ আপনাদের দাওয়াত দিতে এসেছি বিয়ের দিন তারিখ পাকা করার জন্য।

আবিরের মা বললেন- দেখো বাবা, আবির আমার একমাত্র ছেলে, ওর যেখানে ভালো হয় আমরা সেটাই চাই। তোমার মায়ের ব্যাপারটা আমি বুঝি। তার জায়গায় থাকলে আমিও হয়ত এভাবে ভাবতাম। তিনি যে বুঝতে পেরেছেন তাতে আমার কি যে শান্তি লাগছে তা বোঝাতে পারব না। আমরা অবশ্যই আসব। ছেলে মেয়েদের ভালোর জন্য যা কিছু করতে হয় করব।

কথা শেষ করে সরফরাজ উঠতে চাইলে আবিরের মা যেতে দিলেন না। তিনি নীলার চেহারা দেখে বুঝতে পেরেছে ওর উপর দিয়ে কি ঝড় যাচ্ছে… মেয়েটা সারাদিন হয়ত কিছু খায়ওনি। তাই রাতের খাবার না খেয়ে ওদের যেতে দিলেন না।

খাবার শেষ করে নীলা আবিরের কাছ থেকে বিদায় নিতে গেলে আবির বলল-

-তুমি এত জেদি কেন?

-তুমিই তো বাধ্য করলে।

-এখনো সময় আছে ভেবে দেখো এমন ৩পা ওয়ালা মানুষ চলবে কিনা?

-আবার যদি এভাবে বলো তাহলে ভাইয়াকে বলে সোজা হাজতে ঢুকিয়ে দেব।

-ইসস আসছে, ভাইওয়ালা গুন্ডি। আচ্ছা যাও আর বলব না তবে সেজন্য আমাকে এখন আরেকবার জড়িয়ে ধরতে হবে।

নীলা চোখ বড় বড় করে বলল- কী অভদ্র ছেলে! তখন তো তাড়িয়েই দিচ্ছিলে এখন আবার এত ঢং!

-অনেক ঢং…

-এত ঢং কোথায় পাও?

-বুকের বা’পাশে।

-ওসব বুকের বা’পাশেই আটকে রাখো। বিয়ের আগে তোমার সাথে এটাই আমার শেষ দেখা জনাব। আসি তাহলে।

-নিষ্ঠুর রমণী।

-আবিরের আজ অনেকদিন পর শান্তির একটা ঘুম হল, সাথে নীলারও।

আজ আবির নীলার বিয়ের দিন। নীলা আবিরের ঘরে বউ সাজে পা তুলে বিছানায় বসে আছে। সে এই ঘরটায় আগে যখন এসেছিল সেদিন ঘরটা দেখতে কেমন তা দেখার সুযোগ পায়নি। তাই আজ ঘরটা ভালো করে দেখছে। ঘরটা বেশ বড়… একটা টেবিল আছে তার উপর ডেক্সটপ, টেবিলের পাশে হোম থিয়েটার, একটা আলমিরা আছে, একটা ছোট বুক শেল্ফ আছে যেটা বইয়ে ঠাসা, এক কোনায় একটা গিটার আছে, দেয়ালে বেশ কিছু পেইন্টিং ঝুলছে, আর আছে একটা বেড, যার উপর নীলা বসে আছে, তাও আবার সিঙ্গেল বেড! এত দিন একা ছিল এটাই নাহয় ঠিক ছিল তাই বলে এখনও এই সিঙ্গেল বেড থাকবে? এটা বোকামি তো হতেই পারে না নিশ্চই আবিরের বদমাইশি। এই সিঙ্গেল বেডে দুজন মানুষ একসাথে ঘুমাবে কি করে? তখন আবির ঘরে ঢুকল। নীলার পাশে বসে বলল-

-আমার ঘরটা দখল করতে পেরে কেমন লাগছে এখন?

-আর কেউ একজন যে আমাকে এই ঘরের বাসিন্দা বানাতে জগত সংসার পাল্টে দিয়েছিল তার কী?

-জগত সংসার তো আরও একজন পাল্টে দিয়েছে আর সে শুধু সেটা করেই ক্ষ্যান্ত হয়নি সাথে আমার কোনদিন কারো সাথে শেয়ার না করা ঘরটাও একেবারে দখল করে নিয়েছে!

-হুম, একেই বলে “women’s power” বুঝলে?

-ওসব পাওয়ার টাওয়ার রাখো। সেদিন তোমার বিছানায় আমাকে একটু শুতে পর্যন্ত দাওনি। আজ আমি তার শোধ তুলব কড়ায়গণ্ডায়।

-আসছে শোধ তুলতে। তার আগে বল তুমি বিছানাটা কেন বদলাওনি?

-বিছানা কেন বদলাব? আজব! এই বিছানা আমার ভালোবাসা, একে ছাড়া আমার ঘুম হয় না। এটা বদলাবার তো প্রশ্নই আসে না।

-আমার কিন্তু ঘুমের মাঝে হাত পা ছোড়ার অভ্যাস আছে। তুমিই ঘুমাতে পারবে না পরে।

-ঘুমাতে চাইছে কে? কত রাত আমার নির্ঘুম কাটাবার কারণ ছিলে তুমি সেটা এখন পরিশোধ করবার পালা। আর ঘুমালেও ঘুমাবে তো আমার হাতের ভেতর হাত পা ছুড়তে দিলে তো?

-ইসস আসছে হিসাব ওয়ালা। এই ঘরের মালিক এখন আমি আর আমি যা বলব তাই হবে।

-আর আমি মালিকানা ছেড়ে দিয়ে এই ঘরের ঝাড়ুদার হয়ে গেছি নাকি? আমি শুধু এই ঘরের না এ বাড়ির বউটারও মালিক। আমার সাথে হিসেব করে কথা বলবে।

-তাই না? দেখা যাবে কে কত হিসেব করে। শোনো, আমি এখন চেঞ্জ করতে চাই।

-করো, আই ডোন্ট মাইন্ড…

-হ্যাঁ চেঞ্জ করব তবে তুমি ঘর থেকে বাইরে যাবার পর। যাও বের হও।

-প্রথম দিন এসেই আমাকে আমার ঘর থেকে বের করে দিচ্ছ! এত সাহস কোথায় পাও?

-এমনিতেই আমার সাহস একটু বেশি তার উপর এখন বিয়ে হয়েছে জামাই আছে তাই ডাবল সাহস পয়দা হয়েছে।

-ঠিক আছে আমি বের হচ্ছি না, বসে থেকে তোমার সাহস এঞ্জয় করি একটু।

-ওরে পাজি বের হও তো। না হলে ঠেলে বের করে দেব।

-বাসর ঘর থেকে বের করে দেয়ার মত নিষ্ঠুর রমণী আগে দেখিনি।

-ও হ্যালো, এই এক পিসই দেখবে। এখন যাও তবে যাবার আগে আমার চুলটা একটু খুলে দাও। যা তা করে আটকে দিয়েছে আমি একা খুলতে পারব না।

-শুধু চুল? আর কিছু খোলার সুযোগ পাব না?

-একদম অসভ্যতা করবে না বলে দিলাম।

-হুম… কিছুই করতে দিচ্ছে না। তাহলে আর এঘরে থেকে করবই কি? বের হয়ে যাওয়াই উত্তম মনে হচ্ছে এখন।

নীলা ফ্রেস হয়ে আসলে আবির নীলাকে নিয়ে বারান্দায় গিয়ে বসল। এক ফালি চাঁদ তখনও আকাশে জ্বল জ্বল করে জ্বলছিল। ল্যাম্পপোস্ট আর চাঁদের আলো আধারিতে নীলাকে মনে হচ্ছিল অন্য কোন ভূবন থেকে আসা। মায়াবী মনের সর্বনাশী এই কন্যা আবিরের জীবনে হুট করে এসে তাকে লুট করে ফেলেছে। নীলার দিকে তাকিয়ে ওর হাত ধরে আবির বলল- সবটা স্বপ্ন লাগছে আমার কাছে… মনে হচ্ছে ঘুম ভাঙলেই তুমি নাই হয়ে যাবে। তুমি কি সত্যিই আমার ঘরে?

-জ্বী জনাব।

-তোমাকে ছাড়া আমি শেষ হয়ে যেতাম। আমার বেঁচে থাকার ইচ্ছেটা বাঁচিয়ে রাখার জন্য তোমাকে আজীবন ভালোবাসা। পারবে তো আমার পাশে এভাবেই ভালোবেসে থাকতে?

-নীলা আবিরের হাত তার দু’হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল-

-“প্রাণের বাঁধন দিয়েছি প্রাণেতে দেখি কে খুলিতে পারে।”

-একটা কাজ করতে পারবে?

-কী?

-আমার গিটারটা নিয়ে এসো।

নীলা গিটার এনে আবিরের হাতে দিয়ে বলল- তুমি গান জানো? আমি তো আগে জানতাম না সেটা!

-সবে তো এলে আস্তে আস্তে অনেক কিছুই জানতে পারবে। তারপর গান ধরল-

-“আমার ভিতরও বাহিরে অন্তরে অন্তরে আছো তুমি হৃদয় জুড়ে…”

আবিরের কাঁধে মাথা রেখে নীলা মুগ্ধ হয়ে গান শুনল… বলল- তুমি এত ভালো গাও!

আবির হাসল। গল্প আর গানে গানে প্রায় পুরো রাত পার করে দিল তারা। ফজরের আযান হতে আর বেশি বাকি নেই। দুজন একসাথে নামাজ পড়ে নিল। আবির বলল- তুমি একটু ঘুমিয়ে নাও। তোমার চেহারায় যদি ঘুম না হবার চিত্র ভেসে থাকে তাহলে সকাল হতেই তোমার ভাই আমাকে ধরে নিয়ে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে জেরা করতে শুরু করে দেবে।

-তোমাকে জেরা করলে আমার কী যায় আসে?

-তাই না? ঠিক আছে আমিও তাহলে বলব- “তুমিই সারা রাত আমায় জাগিয়ে রেখেছ”

-এই তুমি এত অসভ্য কেন?

-শোনো, এই অসভ্য ছেলেটার জন্যই কিন্তু তুমি পাগল হয়ে গিয়েছিলে। আর তোমার সাথে অসভ্যতা করব না তো কী পাশের বাসার আন্টির মেয়ের সাথে করব?

-পাশের বাসা পর্যন্ত যাও না মেরে নাক ভেঙে দিব। আর হ্যাঁ, ইতিহাস ঘেঁটে একবার দেখে এসো কে কার জন্য পাগল হয়েছিল।

-ইতিহাস ঘাঁটতে হবে না তুমি একটু ফ্ল্যাশব্যাকে গিয়ে দেখো তাহলেই হবে।

-আমি সামনে এগিয়ে চলা লোক, পেছনে তাকাই না। ভালো কথা আমি তো এখানে ঘুমাব তুমি কোথায় ঘুমাবে?

-“তুমি কোথায় ঘুমাবে” মানে? আমার ঘর, আমার বিছানা আমি তো এখানেই ঘুমাব। আর তুমি আমার পাশে এডজাস্ট করবে।

নীলা তখন দৌড়ে গিয়ে বিছানায় উঠে পড়ে বলল- আমি তো আমার জায়গা দখল করে ফেলেছি, তুমি এখন কী করবে করো।

-আবির গিয়ে বিছানায় উঠে পেছন থেকে নীলাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ে বলল- সিঙ্গেল বেডটা কি এমনি এমনি রেখেছি? তোমাকে আর এতটুকু দূরে থাকতে দেব না।

বাকি সময়টাও তাদের খুনসুটি করেই কেটে গেল।

সকালের দিকে আবির ঘুমিয়ে গিয়েছিল। নীলা সেই মুখটার দিকে অনেক্ষণ তাকিয়ে থাকে। এই মানুষটা তার… একান্তই তার নিজের। এই মানুষটাকে সে কখনো কষ্ট পেতে দেবে না। প্রাণ দিয়ে আগলে রাখবে।

নীলা উঠে ফ্রেস হয়ে বসে থাকে। সারা রাত জাগার কারণে মাথায় কেমন ভোতা যন্ত্রণা হচ্ছে তার। এক কাপ চা পেলে খুব ভালো হত। আবির তখনও ঘুমাচ্ছে। তার ঘুমন্ত মুখটা দেখতে অদ্ভুত সুখ সুখ লাগছে। একটু পর আবিরের মা ডাকলেন আবিরের নাম ধরে। নীলা দরজা খুলে বলল-

-মা আপনার ছেলে তো এখনো ঘুমাচ্ছে।

-ও… আবিরকে ডেকে তোলো আমি চা পাঠিয়ে দেই?

-মা, চা’টা আমি বানাই?

-সে কি! প্রথম দিনেই তুমি রান্নাঘরে যাবে? আমাকে দজ্জাল শ্বাশুড়ি বানাতে চাও নাকি?

-তা নয় মা… নীলা মুখ নিচু করে রইল…

-নতুন বউয়ের হাতের মেহেদী না ওঠা পর্যন্ত রান্নাঘরে যেতে নেই। তবু তুমি যখন চাইছ এবেলার চা করতে দিচ্ছি। চলো।

নীলা চা করে শ্বশুর শ্বাশুড়িকে দিয়ে নিজের আর আবিরের জন্য নিয়ে তার ঘরে চলে গেল। আবির তখনও ঘুমাচ্ছিল। নীলা চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে আবিরের কানের কাছে তার হাত নিয়ে চুড়ির রিনিঝিনি শব্দ করল।

আবির চোখ মেলতেই নীলার মিষ্টি মুখটা দেখল। দিনের শুরুটা তার সুন্দর করে শুরু হল… মনে মনে বলল “তার প্রতিটা দিন এভাবেই আসুক”।

আবিরের জীবন এখন অনেকটাই পাল্টে গেছে। নীলা তার জীবনে বন্ধঘরে দখিনের খোলা জানালা হয়ে এসেছে। যে জানালা থেকে প্রতি মুহূর্ত শীতল বাতাস এসে আবিরকে শীতল করে দেয়। মন চাইলেই জানালার বাইরের বিশাল আকাশটাতে উড়ে বেড়ানো যায়। এখন ওর এলোমেলো ঘরটা সব সময় গোছানো থাকে। আগে অফিসে যাবার আগে এটা ওটার জন্য আম্মুকে ডাকতে হত, এখন নীলা সব এগিয়ে গুছিয়ে রাখে। নীলার চোখে মুখে শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা ছাড়া অন্য কিছু কখনো দেখতে পায়না আবির। কখনো কখনো ঘর এলোমেলো করে নীলার সাথে ইচ্ছে করে ঝগড়া বাধায়। নীলা যখন কাজে ব্যস্ত থাকে তখন তাকে বিরক্ত করাটা আবিরের প্রিয় অভ্যাস। রাত হলে হুটহাট বারান্দা বা ছাদে বসে চা খেতে খেতে দুজন গান করে। মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে গেলে বুকের ভেতর গুঁজে থাকা নীলার মুখটা দেখতে ভালো লাগে। হাজার বছর বাঁচতে ইচ্ছে হয় তখন। জীবনটাকে সহজ মনেহয়, সুন্দর মনেহয়। ইচ্ছে করে এই শহরের প্রতিটি বিলবোর্ডে নীলার নামে দু’লাইন ভালোবাসা উৎসর্গ করে দেয়। জীবন চলুক না এমনই নদীর মতন।

সমাপ্ত।।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here