প্রেমনদীর_মাঝি #পর্ব_১৪+১৫ #মুসফিরাত_জান্নাত

0
424

#প্রেমনদীর_মাঝি
#পর্ব_১৪+১৫
#মুসফিরাত_জান্নাত
_________________

আবছা অন্ধকারে ভেসে বেড়াচ্ছে কুঞ্জ কুঞ্জ কালো মেঘের দল।উড়ো হাওয়া বইছে চারিধারে৷হিম শীতল ভাব ছড়িয়ে পড়েছে আনাচে কানাচে। ব্যস্ত শহরের রাস্তার মাঝে ফুটে উঠেছে সোডিয়াম লাইটের হলদেটে আলো।অসংখ্য গাড়ির ভীরে সেই আলোয় পথ খুঁজে বেড়াচ্ছে ক্লান্ত পথিকেরা। একটু আগেই আমি আর নিভৃত বাসা থেকে আমাদের গ্রামের উদ্দেশ্যে বের হয়েছি।ওনাকে আর ভাই বলে সম্বোধন করি না আমি।বিষয়টা বেমানান ছাড়াও কেনো যেনো নিজেরও ইচ্ছে জাগে না।চরম অসাচ্ছন্দ্য লাগে ওনাকে নিভৃত ভাই বলতে।অথচ আগে ভাই ডাকেই পুরোদমে সাচ্ছন্দ্য বোধ করতাম।ভাই ছাড়া ডাকার কথা চিন্তাও করতে পারতাম না।কিন্তু এখন অনুভুতির বদল ঘটেছে।এটা ছাড়াও এরকম আরও কিছু কিছু ক্ষেত্রে ওনার প্রতি আমার অনুভুতির বদল হয়েছে।আগে যা অস্বস্তি সৃষ্টি করতো এখন তা স্বস্তি হয়েছে।সত্যি সময় বদলায়।সাথে বদলায় মানুষের অনুভুতি।সম্পর্কের খাতিরে অপ্রিয় বিষয়গুলোও প্রিয় হয়ে যায়।এইযে আগে ওনার চুপচাপ অভিব্যক্তি,গম্ভীর স্বভাব এসব আমার ভীষন অপ্রিয় ছিলো।কত না উল্টা পাল্টা নামেই ডেকেছি তখন।কুলুপ বয়, সুপার গ্লু ঠোঁটের অধিকারী ইত্যাদি ইত্যাদি। অথচ এখন?চাইলেও ওনাকে আর ওসব বলে ব্যঙ্গ করার সাধ্য আমার নেই।বরং অন্য কেও ব্যঙ্গ করলেও প্রতিবাদি হয়ে উঠতে দ্বিধা করবো না।উনি আমার অন্য রকম এক আশ্রয় স্থল, ভরসার ব্যক্তি হিসেবে পরিগনিত হয়েছেন ।যাকে ছাড়া আর একটা দিনও ভাবতে পারি না এখন।ওনার একটু সান্নিধ্য পেতে আকুলি বিকুলি করে মন।ওনার নিরব সঙ্গও ভালোলাগার সৃষ্টি করে।এমনকি ওনার কল্পনায়ও সুখ খুঁজে পাই আমি।বেশ কিছুদিন হলোই এমন হয়েছে।এই অনুভুতির নাম জানি না আমি।মাঝে মাঝে ভাবি এটাকেই কি মানুষ প্রেমে পড়া বলে?যদি বলে তবে আমি ওনার প্রেমে পড়েছি। আর প্রেমে পড়ার অনুভুতি নিঃসন্দেহে চমৎকার অনুভুতি।এই অনুভুতিতে একবার পা দিলে দুঃখ আর তাকে ছুঁয়ে দেখতে পারে না।সর্ব অবস্থায় সুখ অনুভুত হয়।শুধু মানুষটার একটু সান্নিধ্য প্রয়োজন।

গাড়ির জানালার কাঁচ গলিয়ে বাইরের প্রকৃতি দেখতে লাগলাম আমি।অথচ মন দিয়ে রেখেছি ওনার মাঝে।আমার খুব করে ইচ্ছে করছে উনি আমাকে দেখুক।একটু কথা বলুক।এইজন্য ওনার দিকে ঘুরে বসলাম আমি।কিন্তু আমার কোনো চাওয়াই পূরণ হলো না।উনি আপন ধ্যানে ড্রাইভ করছেন।একদম নিরব ভঙ্গিতে।আমার দিকে কোনো খেয়ালই নেই যেনো।মনটা খানিক খারাপ হলো আমার।এত অবজ্ঞা কেনো?একটু আমাকে দেখলে কি পুরো বিশ্ব অশুদ্ধ হয়ে যেত?রুষ্ট হলাম আমি।সাথে এই মুহুর্তে বিরক্তও ছুঁয়ে দিলো আমাকে।জানালার কাঁচ বেশ খানিকটা নামিয়ে দিয়েছি বলে ঠান্ডা বাতাস এসে চুল এলোমেলো করে দিচ্ছে আমার।সামনের ছোট ছোট চুল গুলে চোখে মুখে আছড়ে পড়ছে।যা বিরক্তের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।আমি দুই হাত তুলে চুল গুলো মুঠো করে একটা ব্যান্ড দিয়ে বাঁধতে নিলাম।এমন সময় উনি সামনের দিকে দৃষ্টি রেখেই বললেন,

“সব কিছুকে বশে আনতে নেই।কিছু জিনিস উন্মুক্ত হয়ে উড়বে, অবাধ্য হয়ে ঘুরে বেড়াবে, তাতেই শোভা পায়।”

কথাটা কর্ণপাত হওয়ার সাথে সাথে আমি থমকে গেলাম।হাতের বাঁধন ঢিলা হয়ে এলো আমার৷আমি নিষ্প্রভ নয়ন মেলে ওনার দিকে তাকালাম।ওনার স্থির দৃষ্টি আমাতেই নিবদ্ধ করে রেখেছেন।যা মুহূর্তেই আমার মন ভালো করে দিলো।মিনিট খানেক আগে মনে পুষে রাখা বিরক্তি নামক পাখিটি যেন ডানা ঝাপটে উড়ে পালালো।একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে ওনার দিকে তাকালাম আমি।উনি স্মিত হেসে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিলেন।যেই হাসিটা বুকের মাঝখানে এসে বিঁধে গেলো আমার।ইশ! কি সর্বনাশা সেই হাসি।আমার হৃদয় কেড়ে নিয়ে গেলো পলকেই।আমি ঠোঁটের কোনে লজ্জালু হাসি টেনে হাতের মুঠোয় পেঁচানো চুলগুলো ছেড়ে দিলাম। সাথে সাথে বন্য লতার মতো এলোমেলো ভাবে গড়িয়ে সারা পিঠে পড়লো এক গুচ্ছ চুল।গুটি কয়েক চুল বাতাসে উড়ে ওনার দিকেও ভেসে যেতে লাগলো।আমি দুই হাত দিয়ে সবগুলো চুল একত্রে এনে ঠিক করে নিয়ে মনে মনে বললাম,

“আপনার এই প্রত্যক্ষ আবদারকে উপেক্ষা করার সাধ্য আমার নেই মশাই।চুলগুলো তাই খোলাই রাখলাম।চুলগুলোকে আজ বশে আনলে যে অপরাধ হয়ে যাবে। ঘোর অপরাধ!যার শাস্তি সহ্য করার ক্ষমতা আমার নেই!”

কথাটা বলে ওনার দিকে অতি শীতল চাহনি নিক্ষেপ করলাম।উনি আপন মনে গাড়ি চালাচ্ছেন।আর ওনার অতি সাধারণ মুখশ্রী অসাধারণ ভাবে মুগ্ধ করছে আমাকে।
____________________

নিষুপ্ত রজনী।কোথায় কোন জন মাববের চিহ্ন নেই।রাতের ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক গ্রাম্য রজনীর বুকে এঁকে বেঁকে ভেসে বেড়াচ্ছে।যার ছন্দবদ্ধ শব্দ ঘুম গাঢ় করছে গ্রামের বুকে।গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে সবাই।রাত প্রায় নয়টার দিকে গ্রামের রাস্তায় ঢুকেছি আমরা।কিছুটা পথ আসার পর আমার দৃষ্টি কাঁচ ভেদ করে সামনে রাস্তার ধারে মাথা গজিয়ে দাঁড়ানো দোতলা বিল্ডিং এর দিকে নিবদ্ধ হয়ে আছে।বিয়ের পর এই প্রথম নিজ বাড়িতে ঘুরতে আসছি আমি।বিয়ের পর নানান ঝামেলায় কখনো সুযোগ হয়নি আমার বাড়ি ফেরার।মাঝে একবার আব্বু আম্মু আমাকে দেখতে বগুড়া গিয়েছিলো।তারপর আর দেখাও হয় নি।এতদিন অনেক বার বাড়ি আসতে চেয়েছি।পড়াশোনার দোহাই দিয়ে উনি আসতে দেননি।আর আজ সে নিজেই সত্যি সত্যি আমাকে গ্রামে নিয়ে আসছে তা আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না।মনের মাঝে উড়ে বেড়াচ্ছে শত ডানার প্রজাপতির দল।এক রাশ ভালো লাগা জেঁকে ধরেছে আমায়।বিয়ের পর বাবাড় বাড়ি ফেরাটা যে এত মজার তা আজ না এলে জানা হতো না।কিছুক্ষণ পর আমরা বাড়িতে পৌছাই।আম্মু আমাকে দেখে জড়িয়ে ধরে খুশির দমকে কেঁদে ওঠেন।আব্বুরও চোখ মুখ খুঁশিতে চিকচিক করছে।আমিই তাদের একমাত্র সন্তান।আমি ছাড়া নিশ্চয়ই এ বাড়ি শূন্য ছিলো।আমি ফিরতেই যেনো তা প্রাণ ফিরে পেলো।হেসে উঠলো উঠোন।বাড়ির আঙিনার শিউলি গাছ তার দুয়েকটা ফুল ঘাসে ফেলে স্বাগতম জানালো আমায়।রাত্রী বেলা জন্য বাড়ির আঙিনা আর ঘুরে দেখা হলো না।তবে একটুখানি সুখানুভুতি জড়িয়ে নিলো আমায়।এত পথ জার্নি শেষে ক্লান্ত অনুভুত হওয়ার বদলে শরীর চাঙ্গা হয়ে গেলো যেনো।বাড়ি ফেরার এত আনন্দ যে ক্লান্তি বুঝতেই দিল না।

আম্মু রাতের খাবার গরম করে ঝটপট টেবিলে গুছিয়ে নিলেন।আমরা দুজন গোছল সেড়ে খেতে বসলাম।গরম গরম ভাতে গরুর মাংস ভুনা, সাথে ইলিশ মাছ ভাজি,তিল ভর্তা,আলু ভাজি ও ডাল মিশিয়ে বেশ তৃপ্তি ভরে খেলাম।কতদিন পর মায়ের হাতের রান্না, মজাই আলাদা।খাওয়ার পর্ব চুকিয়ে উনি আমার ঘরে গেলেন।আমি আম্মুর হাতে হাতে সাহায্য করে গল্প জুড়ে দিলাম।রাত বারোটা নাগাত গল্প শেষ করে ঘরে ফিরলাম আমি।গ্রামের ভিতর এটা গভীর রাত।অথচ আমরা আসায় এ বাড়িতে উৎসব লেগেছে যেনো।এত রাত হয়েছে খেয়ালই হলো না কারো।ঘরে ফিরে ঘড়িতে তাকিয়ে সময় দেখে লাইট নিভিয়ে বিছানায় যাই আমি।বাহিরে জ্বলা সাদা আলো জানালা ভেদ করে ঘরে ঢুকছে। সেই সাথে দক্ষিনা বাতাস বয়ে হিম ধড়িয়ে দিচ্ছে শরীরে।অন্ধকারের আবছা আলোয় দেখতে পেলাম উনি গায়ে কাঁথা জড়িয়ে শুয়ে আছেন।নয়ন যুগলটি ওনার বন্ধ রাখা। আমি কিছু না বলে হুট করে ওনার কাথার মাঝে নিজের শরীর ঢুকিয়ে ওনার একদম কাছাকাছি শুয়ে পড়ি। আমার এমন এহেন কান্ডে তিনি অপ্রস্তত হয়ে যান। চোখ খুলে তাকান আমার দিকে। অতঃপর ঘটনা ক্রমে বুঝতে পেরে লম্বা এক নিঃশ্বাস নিয়ে বলেন,

“বললেই হতো কাঁথা লাগবে।আমি কি দিতাম না নাকি?এভাবে ঘেঁষে শোবার কি আছে?”

আমি অকপটে জবাবে বলি,

“আমার যা দরকার আমি নিজে ছিনিয়ে নিবো।আপনাকে জিজ্ঞেস করে নিতে হবে নাকি?”

জবাবে তিনি ইতস্তত কণ্ঠে বললেন,

“আমি তা বলিনি!”

ওনার কন্ঠ শুনে কেমন যেনো অস্বাভাবিক লাগে আমার নিকট।আমি সরু চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করি,

“তো কি বলেছেন আপনি?”

আমার কথার জবাবে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,

“এটাই বলেছি যে তুমি এত কাছে ঘেষে এসেছো কেনো?সড়ে ঘুমাও ফাজিল।”

আমি দায়সাড়া ভাবে বলি,

“আমার যেভাবে খুশি সেভাবে ঘুমাবো।আপনার কোনো সমস্যা?”

আমার জবাবে তিনি পুনরায় চোখ বন্ধ করলেন।নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললেন,

“আমার কোনো সমস্যা না কিন্তু আমার বউয়ের অনেক সমস্যা হতে পারে।কিন্তু সে না বুঝলে কি করার!”

কথাটা শুনে আমি ফুঁসে উঠি।আবছা অন্ধকারের মাঝে তার দিকে কিছুক্ষণ কটমট দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি। কিন্তু ওনার মধ্যে কোন হেলদোল দেখা যায় না।দৃষ্টি সরিয়ে নেই আমি। অতঃপর মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি আসে।আমি বুঝে গিয়েছি ওনার গা ঘেঁষে শোবার জন্য অস্বস্তি হচ্ছে ওনার।ওনাকে আটও খানিকটা জ্বালাতে ওনার আর একটু গা ঘেঁষে শুয়ে নিদ্রার দেশে পারি দেওয়ার চেষ্টা করি।উনি এখনও কিছু বললেন না।বিরক্তির ছাপও বোঝা যাচ্ছে না।আচ্ছা উনি কি ঘুমিয়ে পড়লেন নাকি?এতক্ষনে তো চুপ থাকার কথা না।প্রশ্নটা মাথায় আসতেই চোখ মেলে দেখতে লাগলাম ওনাকে।নাহ উনি ঘুমাননি।তবে এমন নিরব কেনো?

আমি গোল গোল চোখে তাকালাম ওনার দিকে।উনি চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন।ওনার একদম নিকটে আসায় ওনার গায়ের উষ্ণতা আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে শিহরনের ঢেউ বইয়ে দিলো।তিরতির করে দেহ কাঁপতে লাগলো অজানা শিহরণে।দম বন্ধ হয়ে আসতে চাইলো।হৃৎস্পন্দন দ্রুত হলো।উনি বাঁকা হেসে আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললেন,

“আমাকে জ্বালাতে চাইলে এতটা কাছে আসাই যথেষ্ট।এরচেয়ে বেশি নিকটে আসতে চেও না।তাছাড়া তুমিও জ্বলে পুড়বে।নাকি সেটাই চাইছো?আমি কি সাহায্য করবো? ”

কথাটা বলে আমার দিকে সুক্ষ্ম চোখে তাকালেন উনি।ওনার কথাটা বুঝতে কিছুটা সময় লাগলো আমার।তড়িৎ লজ্জারা হানা দিলে চোখে মুখে।আমি ছিটকে সড়ে এলাম।ঘন ঘন শ্বাস প্রশ্বাস নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করতে ব্যস্ত হলাম।উনি যে এমন কিছু বলবেন তা কল্পনায়ও ছিলো না আমার।এতদিন এক বিছানায় থেকেও নিজেকে যথেষ্ট সংযত রেখেছেন তিনি।এমন কথাও কখনো বলেননি আজ হটাৎ এমন বললো কেনো?আমি কি বেশি বাড়াবাড়ি করেছিলাম!

আমি বেশ খানিকটা দূরত্ব বাড়িয়ে গুটিশুটি মে’রে শুয়ে থাকলাম।বাইরে থেকে তির তির করে হাওয়া বইছে।বেশ শীত অনুভুত হচ্ছে।তিনি আমার গায়ের উপর কাঁথার একাংশ ছড়িয়ে দিয়ে অন্য দিক ঘুরে শুয়ে পড়েন।রাত যত গভীর হতে লাগলো বাতাসের বেগ আরও বৃদ্ধি পেলো।আমার ঘরে জানালা খুলে কখনো ঘুমানো যায় না।নদীর উপর দিয়ে বয়ে চলা হিম বাতাসে শেষ রাতের দিকে শীত ধরে যায়।তাই জানালা বন্ধ করে ঘুমাতাম আমি।কিন্তু আজ উনি খুলে রেখেছেন না জেনে।আমিও লাগানোর প্রয়োজন বোধ করি নি।কিন্তু এখন ভুলটা অনুধাবন করতে পারছি।কিন্তু অলসতার দরুন উঠতেও ইচ্ছে করছে না।আমি একটু একটু করে আবারও ওনার গা ঘেঁষে শুলাম।এবার ওনাকে জ্বালানোর উদ্দেশ্য নেই।মানুষের গায়েও এক ধরনের উষ্ণতা থাকে, যা আমাদের শীত ভাব কমায়।আমিও সেই চেষ্টা করছি।কিন্তু ওনার গায়ে স্পর্শ লাগতেই ঘুম ছোটে গেলো ওনার।ওনার আগে থেকেই ঘুম পাতলা।এই কয়টা মাসে একত্রে থেকে এটা বুঝে গিয়েছি আমি।উনি যে জেগে যাবেন এটা মাথায়ই ছিলো না।ওনার এত কাছে আমাকে দেখে চোখ মেলে তাকালেন উনি।তারপর কি একটা ভেবে আমার গায়ে কাঁথাটা ভালোভাবে জড়িয়ে দিয়ে ওনার বাহুদ্বয়ে আবদ্ধ করে নিলেন।তারপর আমার মাথার কাছে মুখ নিয়ে ঘুমিয়ে গেলেন।আমি অবাক না হয়ে পারলাম না।উনি যে আমাকে জড়িয়ে ধরবেন এটা কল্পনায়ও ছিলো না আমার।তখন ওনার সান্নিধ্যে যাওয়ায় ওভাবে বলে এখন জড়িয়ে নিলেন?ব্যপারটা অন্যরকম ভালেলাগার সৃষ্টি করলো আমার মাঝে।ওনার গায়ের উষ্ণতা গা ছুঁয়ে দিতেই প্রশান্তি অনুভব করলাম আমি।ওনার সাথে লেপ্টে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
______
আঁধারের প্রভাব কাটিয়ে ধরার বুকে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে।স্নিগ্ধ সোনালী আলোয় ঝলমল করে উঠেছে পরিবেশটা। নীলাভ আকাশের মাঝে পেঁজো পেঁজো মেঘের হাতছানি। স্নিগ্ধ পরিবেশে মনোরম এক সকাল।ঘড়িতে প্রায় ছয়টা বাজে।আমি বাড়ির আঙিনাটা ঘুরে ঘুরে দেখছি।সেই পরিচিত স্থান, পরিচিত অনুভুতি, পরিচিত গন্ধ আমাকে মুগ্ধ করে চলেছে।কতদিন এদের দেখা হয়নি।ও পাশের নদীর পানির ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ ও যে আমার ভীষন প্রিয়।সেই প্রিয় স্থানটাতে চোখ বুলাতে পিছন গেট খুলে দিলাম।সাথে সাথে এক ঝলক স্নিগ্ধ বাতাস আছড়ে পড়েলো আমার চোখেমুখে।আমি দু চোখ ভরে দেখি সূর্য উদয়ের ছটা নদীর পানিতে পড়ছে।তারপর পাশে তাকাতেই চোখে পড়ে শখের শিউলি গাছ।বুক উজার করে শিউলি ঝরিয়েছে সে।সবুজ ঘাসের বুকে কমলার ছটা লাগা সাদা শিউলি পড়ে রয়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ।আমি দৌঁড়ে গিয়ে শিউলি কুড়াই।আগে রোজ কুড়াতাম।হটাৎ সেই আনন্দটা ঘিরে ধরে আমায়।একটু পর এখানে নিভৃত আসেন।ওনাকে দেখতেই কেমন অস্বস্তি হয় আমার।কাল রাতের ঘটনাটা মনে পড়ে যায়।উনি ও ভাবে আমাকে জড়িয়ে নিলেন,সেই প্রভাব আমি কাটাতেই পারছি না।অথচ ওনার ভাবে ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে কিছু হয়ই নি।গতরাত্রে নিভৃত যখন জড়িয়ে ধরেছিলেন, তখন বেশ ভালোলাগছিলো আমার।আমি মোটেও আশা করি নি যে, উনি আমায় ওভাবে আগলে নিবেন। মনের মাঝে জাগ্রত হয়েছিলো এক অন্যরকম ভালো লাগার অনুভূতি। যা আমার কাছে ছিল একদম নতুন আর ভিন্ন অনুভূতি। মূহুর্তেই তীব্র এক শান্তি ছড়িয়ে গিয়েছিল সর্বাঙ্গ জুড়ে।খুঁজে পেয়েছিলাম এক নিরাপদ আর নির্ভরযোগ্য স্থান।কোনোরুপ চক্ষুলজ্জা কাজ করেনি আমার। সেখানে আমি বেহায়ার মত লজ্জা-শরম ভুলে তার বুকের মাঝে লেপ্টে ছিলাম।কিন্তু সকালে নামাযের আযান পড়তে যখন দুজন একত্রে জেগে উঠলাম, তখন আচমকা লজ্জা লাগলো আমার।ওনার বুকের মাঝে যেনো মিশে রয়েছিলাম আমি।ওনার এক হাত আমার গায়ে।আর আমার এক হাত ও এক পা ওনার গায়ের উপর তুলে দেওয়া ছিলো।ইশ! কি লজ্জাজনক ব্যাপার।আমি ছিটকে সড়ে গিয়েছিলাম।তারপর নামায পড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ি।আর ওনার সামনে দাঁড়াইনি।যেন ওনার সামনে পড়লেই লজ্জা গি’লে খে’ত আমায়।

আমি আড়চোখে ওনার দিকে তাকাতেই দেখি সদ্য ফ্রেশ হয়ে এখানটায় এসেছেন উনি।চুল গুলো বেশ গোছানো।কালসেটে গোলাপি রাঙা অধরে শুকিয়ে রয়েছে ।অ্যাঁশ কালারের টি শার্ট ও চেক ট্রাউজার পরনে।ওনার মুখশ্রীর সৌন্দর্য অসম্ভব সুন্দরের পাশাপাশি আরও কিছু অসাধারণ ব্যাপার আছে বলে মনে হয় আমার।ওনার দিকে একবার চোখ পড়লে চোখ ফিরাতে কেও পারবে না।আমিও পারি না।তাই সুযোগ পেলেই ওনাকে দেখতে থাকি।আজও আড়চোখে দেখে যাচ্ছি ওনাকে।উনি গভীর ধ্যানে ফোন স্ক্রল করছেন।এতে আমার বেশ সুবিধাই হয়েছে।আমি যে ওনাকে দেখছি তা উনি বুঝতে পারেননি এমনটাই ভেবে চলেছি।কিন্তু আমার ভাবনায় এক বালতি পানি ঢেলে দিয়ে তিনি ফোনে দৃষ্টি রেখেই বললেন,

“দৃষ্টি যদি সড়াতেই না পারো,তবে কাছে গেলে দুরে ঠেলে দেও কেনো?”

কথাটা শোনা মাত্র আমার গায়ের সবগুলো লোম কাঁ’টা দিয়ে যায়।লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেলি আমি।আমি যে ওনাকে দেখছি তা এই ব্যাটা বুঝলো কিভাবে? হাও?সাথে কি আরেকটা অদৃশ্য চোখ আছে নাকি?আমি শুকনো ঢোক গিললাম।অতঃপর সাজিয়ে গুছিয়ে কিছু বলতে যাবো তখন তিনি স্বগোতক্তি কণ্ঠে বললেন,

“তোমাদের গ্রামের সকালটা বেশ মনোমুগ্ধকর।স্পেশাল ফিল করাচ্ছে।”

কথাটা শুনে আমি অকপটে বলি,

“হুম।আমাদের বাড়িটা আরও স্পেশাল।পিছন গেটের সাথেই শিউলি গাছ, সবুজ ঘাস তার সাথে লাগোয়া নদী।একদম সিনেমার মতো।”

“হুম৷এখানে শুটিং স্পট করলেও মন্দ হবে না।”

“একদম ঠিক বলেছেন।”

এটা নিয়ে বেশ কিছুক্ষন আলাপ চললো আমাদের।তারপর আম্মুর ডাক পড়ে।আমি ওনাকে প্রকৃতি উপভোগ করতে দিয়ে রান্না ঘরে চলে আসি।

_____________________

সকাল আটটা ছুঁই ছুঁই। সূর্য যখন অনেকটা উঠে বসেছে ঠিক তখনই আমাদের রান্নার সমাপ্তি হলো। বাড়িতে জামাই আসায় বেশ অনেক আইটেম রান্না করেছে আম্মু।একা হাতে সামলে উঠতে পারছিলো না বলে আমাকে সাহায্য করতে ডাক পাঠিয়েছে।আমি এখন রান্নাটা বেশ ভালোই আয়ত্ত করে নিয়েছি।এডমিশন টেষ্টের পর ফাকা সময়টায় ভালো লাগতো না বলেই খালামনির সাথে রান্না শেখা।তাই আম্মুকে হেল্প করতে কষ্ট হচ্ছে না।বরং আম্মুর সাথে সাহায্য করার সময় খালামনির হাতে রান্না শেখার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছিলাম।আম্মু হটাৎ বললো,

“বড় আপাকে নিয়ে আসতে পারতি তোদের সাথে।নিশি নদীকেও আনতি।ওরা তো কখনো এ বাড়ি আসেনি।”

“আমি তো বললামই আসতে,তা ওরা বললো পড়ে নাকি আসবে।এবার আমরা দুজন ঘুরে যাই।”

চটপট জবাব দিলাম আমি।আম্মু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।তারপর চুপ হয়ে গেলো।আম্মুকে দেখে মনে হলো কোনো গভীর চিন্তায় ডুবে আছে।তা দেখে আমি জিজ্ঞেস করলাম,

“কি ভাবছো আম্মু?”

আম্মু ছোট্ট করে উত্তরে বললো,

“কিছু নাহ।”

আম্মু মুখে না বললেও তার চেহারা দেখে যে কেও বুঝবে সে চিন্তা করছে।হটাৎ আমার মাথায় একটা প্রশ্ন আবারও দৌড়াদৌড়ি করলো।আমি আমতা আমতা করে বললাম,

“একটা কথা জিজ্ঞেস করি আম্মু।সত্যি বলবে?”

আম্মু কিছু না ভেবেই বললো,

“হুম বল।”

আমি একটু সময় নিয়ে বললাম,

“আসলে অতীতে কি হয়েছিলো তোমাদের?খালুজানের সাথে তোমার দ্বন্দ কি নিয়ে?”

প্রশ্নটা শুনে আম্মু আচমকা রেগে গেলো।কটমট করে তাকিয়ে বললো,

“এসব তোর জানা কি খুব জরুরী?”

আমি অসহায় হয়ে বললাম,

“যদি অতীত নাই বলতে পারো তবে বিয়ে দিলে কেনো ওখানে?খালুজান আমাকে মেনে নিয়েছেন মুখে বললেও বাসায় আসেনি আর।নিয়মিত যোগাযোগ রাখলেও উনি কখনো ফিরবেন বলে মনে হয় না।এটা ওই বাসার সবাই বুঝেও মানতে চায় না।তারা ভাবে খালুজান ফিরবেন।উনি যদি ফেরেনও তিনি কি আমায় আদৌ মেনে নিবেন বলো?যদি মেনে নেনও তোমাদের সাথে আমার সম্পর্ক ছিন্ন হবে নয় কি?এত ঘটনার পরও, এত কিছুর পরও অতীতটা আমি জানতে চাইতে পারি না?আমি আগে কখনো জানতে চেয়েছি এসব?এখন তো আমার জীবন জড়িয়ে ফেলেছো ওই ঘটনার সাথে।তবুও কি এটা জানা জরুরী নয়?”

আমার কথাগুলো শুনে আম্মু দমে গেলো।তার তেজ মাটি চাপা পড়লো।সে কেবল শান্ত স্বরে বললো,

“আমরা ভেবেছিলাম সে মৃ’ত।তাই সেখানে বিয়ে দিয়েছিলাম তোমাকে।”

কথাটা বলে থামলো আম্মু।আম্মুর কণ্ঠটা বেশ ভারী শোনালো।আমি কেবল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম।মানুষটা খুব কষ্ট পেলে আমাকে তুমি সম্বোধন করে।আম্মুর ভারাক্রান্ত মুখ দেখে আমার কি যেনো হলো জানি না।আমি হু হু করে কেঁদে উঠলাম।জীবনের বেশ সমীকরণ মিলে গেলেও এখনো অনেক হিসাব নিকাশ বাকি।সেগুলো আদৌ কখনো মেলাতে পারবো তো?আম্মু কি যেন মনে করে আমাকে জড়িয়ে ধরলো।আমার কষ্ট গুলো হয়তো বুঝতে পারলো।মায়েদের তো এই ক্ষমতা থাকে।সে মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করলো আমাকে।তারপর কি মনে করে বিবশ কন্ঠে বললে,

“বাবা মায়ের অতীতের গোপন কথা কখনো জানতে চাইতে নেই মা।এতে তারা লজ্জা পায়।তাদের লজ্জা দেওয়া কি ঠিক?তুই আর কখনো এসব জানতে চাস না।”

আমি কোনো জবাব দিলাম না।কেবল আম্মুর বুকে লেপ্টে রইলাম।হাজার ব্যস্ততার মাঝে, সুখের মাঝে ওই সংসারে সময় কাটালেও ওই সংসারে ধরা ঘুন পোকাটা যে নিজেকেই মনে হয়।বড় অপরাধী লাগে নিজেকে।সংসারটা একেবারে ঠিক হবে তো?এই চিন্তা কুঁড়ে কুঁড়ে খায় আমাকে।কবে মুক্তি মিলবে এর থেকে?কবে এতো শতো ঝামেলার সমাপ্তি ঘটবে?কবে সবটা স্বাভাবিক হবে?এমন হাজারো প্রশ্ন মনে ঘোরে।অথচ উত্তর পাই না আমি।কেবলই প্রশ্ন খুঁড়ে খুঁড়ে বের করি।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here