প্রেমনদীর_মাঝি #পর্ব_১৮ #মুসফিরাত_জান্নাত

0
454

#প্রেমনদীর_মাঝি
#পর্ব_১৮
#মুসফিরাত_জান্নাত

সুখের সময়গুলো যেনো নীল গগনের পাখির দলের মতো মহা সমারোহে ডানা মেলে উড়ে উড়ে ঘুরপাক খায়।সেই ডানা ঝাপটানোর শব্দ মুখরিত করে চারিপাশকে।আনন্দ উল্লাসে ভরিয়ে তোলে সবটা।প্রকৃতি প্রেমিককে মুগ্ধ করে।উদাস ব্যক্তির দৃষ্টি কেড়ে নেয় অনায়াসে।আর বিষাদিনীর মন চকচক করে তোলে স্বতঃস্ফূর্ততায়।তেমনি আমাদের বাসার সবাই এখন মুখরিত সময় কাটাচ্ছে।সেদিন খালুজান হুট করে ফিরে আসায় এ বাসা নতুন মাত্রা পেয়েছে।সেই নতুন মাত্রায় সুখ ঢেলে পূর্ণ করেছে আরও একটি দারুন খবর।খালুজান ফিরে এসেছিলেন নদী আপুর বিয়ের ব্যবস্থা নিয়ে।ওনার কলিগ এর সুপুত্রের সাথে বিবাহ আলাপ নিয়ে ফিরে এসেছেন।ছেলে আমেরিকায় সেটেলড।ওখানে ভালে পজিশনে জব করে।দেশে এসেছেন কেবল বিয়ে করার জন্য। মেয়েকে ছেলে পক্ষের সবার পছন্দ হলে আপুও মত দিয়ে দেয়।যেহেতু আপুর কোনো পছন্দ ছিলো না, সেহেতু দ্বিরুক্তি করারও কারণ বিশেষ নেই।তাই কোনো ঝামেলা ছাড়াই তাদের বিবাহের সুচনা লগ্নের কার্য সম্পাদিত হয়েছে।মানে দিন তারিখ ধার্য সহ সার্বিক কথাবার্তা পাকা করা হয়েছে।সামনে শুক্রবার আকদ হবে।আপুর গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট হলে একেবারে ধুমধাম অনুষ্ঠান করে তুলে দেওয়া হবে তাকে।তখন আপুকে আমেরিকা নিয়ে যাওয়া হবে এবং সেখানেই মাস্টার্স কমপ্লিট করবে।এমনটা ঠিক হয়ে গেলো।আপাতত ঘরোয়া ভাবে বিয়ে হবে।কেনাকাটা নিয়ে তাই ব্যস্ত সময় চলছে সবার।সারাদিন এখানে সেখানে ঘোরাঘুরি করে ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরেছি আমরা।এখন সবার বিশ্রাম নেওয়ার মুড হলেও নদী আপু বেশ ফুরফুরে মুডে আছে।করিডরে গিয়ে ফোনের সাহায্যে সারাদিনের বর্ণনা দিয়ে চলেছে হবু বরের কাছে।কি কি কেনা হলো এই সব হাবিজাবি আলোচনা।যার কিঞ্চিৎ কথাবার্তা রুম থেকে শুনতে পাচ্ছি আমরা।নিভৃত এখনো বাড়ি না ফেরায় নদী আপুদের ঘরে এসেছিলাম সময় কাটাতে।কিন্তু আপু এখন ওনার হবু উনি নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন।আর আমি ও নিশি বিছানায় চিৎপটাং দিয়ে শুয়ে পপকর্ণ খাচ্ছি আর আপুর প্রেম দেখে চলেছি।আমি অসহায় মুখভঙ্গি করে বললাম,

“হাও রোম্যান্টিক মনু।বিয়ে হওয়ার আগেই কত প্রেম!আহ,এদের দেখে তো আমার হিংসে হচ্ছে।এরকম জামাই না পেলে কপালডাই বৃথা!”

কথাটা নিশিকে উদ্দেশ্য করে বললাম আমি।নিশির মন মেজাজ ইদানীং ভালো নয়।খালুজান আসায় মেয়েটি যতটা খুশি হয়েছিলো, তার সবটা মিলিয়ে গিয়েছে আপুর বিয়ে ঠিক হওয়ার পর।এখন আপুর এরকম আচরণেও সে বিরক্ত হচ্ছে।আমার কথার জবাবে বিরক্ত প্রকাশ করে সে বললো,

“প্রেম না ছাই।এসব আদিখ্যেতা ভালো লাগছেনা আর।বিয়ে ঠিক হওয়ার পর থেকেই দেখছি ফোন কানের কাছে সেট করে রাখছে।যেন বিয়ে আর কারো ঠিক হয়ই না।যত্তসব বেহায়াপনা!”

নিশির কথ শুনে ভ্রু কুটি করে তাকালাম আমি।সন্দিহান হয়ে বললাম,

“ওরা কথা বলছে তাতে তুই এতো রিয়েক্ট করছিস কেন বলতো!কি হইছে তোর?”

আমার কথায় সে ফুঁসে উঠে বললো,

“আমার কিছু হয় নাই।তবে আপুর সাথে আব্বু আম্মুর অনেক কিছু হচ্ছে।বিয়ের আগে এভাবে কথা বলা হারাম।পাপ হচ্ছে সবার।সে খেয়াল আছে কারো?”

কথাটা যুক্তি সঙ্গত।আজকালকার ছেলে মেয়েরা বিয়ে ঠিক হওয়ার পর থেকেই কথা বলা শুরু করে দেয়।যা ইসলামে সম্পূর্ণ না জায়েজ।কিন্তু আমাদের সমাজ যেন এসব ইসলামের ধার ধারে না।বিয়ে ঠিক হলেই অবাধ কথাবার্তা স্বাভাবিক নজরেই দেখা শুরু করে।নিশি এই জেনারেশন এর মেয়ে হয়ে ওর মুখে এমন কথা শুনে খুশি হওয়ার কথা থাকলেও খুশি হতে পারলাম না আমি।কোথাও কোনো ঘাপলা আছে মনে হলো।ও তো এত ইসলাম মেনে চলা মেয়ে নয়।তবে হটাৎ এমন হাদিস দিচ্ছে কেনো?সন্দেহ হলো আমার।তবে আমি নিজ সন্দেহ প্রকাশ না করে চুপ করে রইলাম।চটে যাওয়া মানুষের সাথে তর্কে না জড়ানো ভালো।তাছাড়া কখন কার হেদায়েত নসিব হয় কে জানে?এটা তো তর্ক করার মতো কথাও নয়।আমি কিছু না বললেও ওর কথার টোনে নদী আপুর কানে গেলো সব।আপু ফোনের লাইন কে’টে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে শান্ত কণ্ঠে বললো,

“আমি কথা বলছি বলে রাগে ফুঁসছিস।তুইও যে চিঠি আদান প্রদান করিস তাতেও তো পাপ হয়।তার বেলায়?”

আপুর কথাটা শুনে রেগে যায় নিশি।ক্রুদ্ধ হয়ে বলে,

“আমি চিঠি আদান প্রদান করি মানে?কয়টা চিঠির উত্তর দিয়েছি আমি?তাছাড়া তোমার অবগতির জন্য বলছি, ওসব চিঠি তোমার জন্য আসে।আমার জন্য না।সো এসব মিথ্যা অপবাদ দেওয়া বাদ দেও।”

কথাটা বলে বের হয়ে যায় নিশি।নিশি বেরিয়ে যেতেই আপু দুষ্টুমি করে হেসে ওকে জ্বালাতে বলে,

“আরে রাগিস না বইন।দোয়া দিলাম নতুন চিঠির প্রেরক পাবি।তাও আমার প্রেমে নজর দিস না।”

নিশি এসব শুনলো কিনা বোঝা গেলো না।কারণ অনেক আগেই সে ঘর ত্যাগ করেছে।আপু সেদিকে তাকিয়ে হাসলো।তারপর আমার পাশে এসে বসলো আমি এসবের আগা মাথা কিছু বুঝলাম না।ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম কেবল।আমার অভিব্যক্তি দেখে আপু জানালো সব ঘটনা।যার সারমর্ম হলো নিশি শেষ কয়েকদিন হলো ওর অজানা চিঠি দাতার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিলো।চিঠির জবাবও দেওয়া শুরু করেছিলো কয়েকদিন হলো।কিন্তু আপুর বিয়ে ঠিক হওয়ার পর আল্লাহর বান্দা আপসেট হয়ে গেছে।তার শেষ চিঠিতে স্পষ্ট হয়েছে চিঠিটা সে নিশিকে নয় আপুকে উদ্দেশ্য করে দিতো।এতেই মন ভার হয়েছে নিশির।আর রাগ ঝাড়ছে আপুর উপর।এটা নিয়ে আপুও মজা লুফে নিচ্ছে।খালুজান আসায় ব্যস্ত হয়ে পড়ায় এসবটা জানা হয়নি আমার।এখন এসব শুনে এক গাল হাসলাম আমি।নিশির বয়স কম।ওর এসব অনুভুতি নিছক ছেলেমানুষী ছাড়া কিছু নয়।কয়েক দিন গেলেই সব কে’টে যাবে।তাই আমুলে নিলাম না কেও।বরং ওকে জ্বালিয়ে মজা নিলাম।কিন্তু ও যে সত্যি কষ্ট পেয়েছে তা বোঝা গেলো দিন কয়েকের মধ্যে।ও একদম রাগ করতেও ভুলে গেলো।কেমন মন ম’রা হয়ে পড়লো।আপু তখন থেকে ওকে নিয়ে চিন্তিত হলো।ওর সাথে মজা নেওয়ায় অনুশোচনা হলো আমাদের। আমরা ওকে বোঝাতে শুরু করলাম।তেমনি একদিন ওকে এসব সাময়িক অনুভুতি বলে বোঝাতে বললাম,

“তোদের তো আর পাঁচ ছয় বছরের সম্পর্ক ছিলো না।ফোনে কথা,ঘোরাঘুরি এসব কিছু হয়নি।কোনো স্মৃতিও নেই।জাস্ট কয়েকটা চিঠি আদান প্রদান।এসব কয়দিন গেলেই ভুলে যাবি।মানুষ পাঁচ দশ বছরের সম্পর্ক ভুলে যায়…”

আমি কথাগুলো সম্পূর্ণ করতে পারলাম না।বাচ্চাদের মতো কেঁদে দিলো সে।আমি ভড়কে গেলাম ওর কান্না দেখে।কিছু বুঝে উঠতে না পেরে তাকে জড়িয়ে ধরলাম।সে অসহায় হয়ে বললো,

“সে কে আমি জানি না আপু।সে যদি আমাকে রিজেক্ট করে চলেও যেত, আমি কষ্ট পেতাম না।কিন্তু সে চিঠি গুলো আমাকে দেয়নি ভেবে কষ্ট হচ্ছে।অপমান লাগছে আমার।আমার জীবনের প্রথম প্রেম কিনা এমন কেও হলো যে আমাকে ভালোই বাসেনি।অথচ সে আমায় ভালোবাসে ভেবে নিজের মনে কল্পনার প্রাসাদ সাজালাম।নিজেকে খুব অপমানিত লাগছে আপু।ছোট মনে হচ্ছে।এমন ভুল আমি কীভাবে করলাম?আমার বড় বোনের প্রতি যার অনুভুতি,নিজের কল্পনায় ভুল ভেবে তাকে ভালোবাসলাম।এখন আপুর সামনে যেতেও লজ্জা লাগে আমার।নিজেকে আড়াল করে রাখতে ইচ্ছে করে।”

“আরে ধুর পা’গলি।এখানে লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই।তুই কি জানতি নাকি?তাছাড়া আপুও এসব সিরিয়াসলি নেয়নি।তাই ফ্রী ফিল কর।আর এসব প্রেম ভালোবাসা জীবনে বহুবার আসবে যাবে।কিন্তু আপুর বিয়ে কিন্তু একটাই হবে।এসব করে কিন্তু তুই একমাত্র বোনের বিয়ের মজাটা নষ্ট করছিস ছাড়া কিছু হচ্ছে না কিন্তু।”

আমার কথা শুনে কান্না থামালো নিশি।কিন্তু মুখ ভার করে রইলো।আমি ওকে ফিসফিস করে বললাম,

“বিষয়টা এখন আমি তুই আর নদী আপু ছাড়া কেও জানে না।কিন্তু তুই এমন করলে ঘটনাটা ছড়িয়ে যাবে।ব্যাপারটা কিন্তু আরও লজ্জাজনক হবে।এখন বোঝ এভাবেই স্বাভাবিক হয়ে সব ঠিক করে ফেলবি নাকি দশজনের মাঝে লজ্জিত হবি?”

কথাটা শুনে দ্বিধাযুক্ত হলো নিশি।তারপর কি মনে করে মিনমিন করে বললো,

“বিয়ে তো তিনদিন পর।আমার তো কিছুই কেনা হয়নি।এখন কি হবে!”

নিশির চট করে পরিবর্তন হয়ে যাওয়ায় ঠোঁটের কোনে হাসি জমলো আমার।আমি জবাবে রসিকতা করে বললাম,

“এমন দেবদাসী হয়ে থাকলে কেনাকাটা হবে কি?কিনতে গিয়েছিস কিছু?তারচেয়ে বরং এক কাজ কর।তোর কিছু কেনার দরকার নেই।আমরা সেজেগুজে ঘুরবো।আর তুই এক কোনায় বসে শোক বিলাস করিস।চাইলে আমাদের ফটোগ্রাফার ও হতে পারিস।কিন্তু আগেই বলে রাখছি কোনো পেমেন্ট দিতে পারবো না।”

আমার কথাটা শুনে কপট রাগ দেখালো নিশি।

“তোমরা আছোই তো এই ধান্দায়।আমার তো মনে হয় ওই চিঠিগুলা তোমরাই যুক্তি করে লিখেছো।যেনো আপুর বিয়ে আমি এনজয় করতে না পারি।হুহ!”

ওর কথা শুনে হেসে ফেললাম আমি।অতঃপর ঐকান্তিক হয়ে বললাম,

“তাহলে ঝটপট রেডি হ।চল দেখি কি কি কিনতে পারিস।”

“হু।”

নিশি রাজী হতেই হুড়মুড় করে বেরিয়ে আসতে নিলাম।সময় নেওয়া যাবে না বেশি।কিন্তু দরজার কাছে এসে হুট করে কারো শক্ত দেহের সাথে ধাক্কা খেলাম।সাথে সাথে ‘আউচ’ শব্দ বের হলো আমার মুখ দিয়ে।আমি চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে দেখি নিভৃত এসেছেন।ওনার হাতে কয়েকটা শপিং ব্যাগ।আমি ওনাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নাকে হাত দিয়ে রুষ্ট কণ্ঠে বললাম,

“এমন থাম্বার মতো এখানে দাঁড়ায় আছেন কেন?কি সমস্যা?”

আমার প্রশ্ন শুনে উনি ভ্রু কুটি করে তাকালেন।তারপর ভাবলেশহীন কণ্ঠে বললেন,

“সমস্যা তো আমার না।সমস্যা তোমার চোখে।দেখে চলতে পারো না?”

ওনার কথায় ফুঁসে উঠি আমি।দাঁত কটমট করে বলি,

“কি বললেন আপনি?আমার চেখে সমস্যা?”

উনি গা ছাড়া ভাব নিয়েই বললেন,

“হুম।”

“কিসের হুম হ্যাঁ?আমার যদি চোখে সমস্যা হয় তো আপনি অশিক্ষিত,মূর্খ।শুধু মুর্খ না, গণ্ড মূর্খ।নূন্যতম ফাইভ পাশ করার যোগ্যতা নেই আপনার।আবার আসছে আমার চোখ যাচাই করতে!”

কথাটা বলে মুখ ভেংচি কা’টলাম আমি।উনি ভ্রু কুটি করে বললেন,

“আমি মূর্খ?”

“হুম অবশ্যই আপনি মূর্খ।পথিকের চলার পথে যে এমন কিছু রাখতে নেই, যাতে পথিকের অসুবিধা হতে পারে এটাও ওয়ান টুর পোলাপানদের শেখানো হয়।রাস্তায় কাঁটা, ইট পাথরের টুকরো দেখলে নিজ দ্বায়িত্বে সড়িয়ে ফেলতে শিখায়।আর আপনি উল্টো রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে পথিককে কষ্ট দিচ্ছেন।আবার আসছেন জ্ঞান দিতে।হুহ!”

কথাটা কর্ণপাত হওয়া মাত্র উনি বিস্ময়ে নয়ন দুইটি বৃহৎ আকার ধারণ করালেন।ঠোঁট দু’টির মাঝে বিরাজমান হলো কিঞ্চিৎ ফাঁক।সুক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে আমাকে কিছু বলতে যাবেন তার আগেই ওনার নজর পড়লো নিশির দিকে।সে আমাদের ঝগড়া দেখে মুখ টিপে হাসছে।ব্যাপারটা দেখে রেগে যাওয়ার কথা থাকলেও রাগলেন না উনি।বরং হাতে থাকা ব্যাগগুলো নিশির দিকে ছুঁড়ে মে’রে শীতল কণ্ঠে বললেন,

“নেহ, তোর জন্য শপিং করে এনেছি।দেখ পছন্দ হয় কিনা!”

নিশি ব্যাগ গুলো থেকে সব পোশাক বের করে ওগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেখে বলে,

“খুব সুন্দর হয়েছে ভাইয়া।এসব তুমি কিনেছো?”

উনি এইবার প্যান্টের পকেটে দুই হাত গুঁজে গম্ভীর কন্ঠে বললেন,

“বেশি কথা না বলে ওর্নামেন্টস গুলো সাইজে ঠিক হয় কিনা দেখ।”

নিশি কিছু না বলে ওর্নামেন্টসগুলো গায়ে হাতে লাগিয়ে সাইজ দেখতে নিলো।ওসব দেখে বিষ্মিত হলাম আমি।এ তো রুচিশীল মেয়েদের মতো চয়েস।একজন ছেলে মানুষ হয়ে তাও কিনা এমন কাঠখোট্টা টাইপের ব্যক্তি,তিনি এতো সুন্দর ওর্নামেন্টস, ড্রেস কিনেছে ভাবতেই পারছি না আমি।আমি নিশির কাছে এগিয়ে গিয়ে ওসব দেখতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতেই উনি গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,

“ওদিকে আবার কি?রুমে এসো।”

কথাটা বলে গটগট করে চলে গেলেন উনি।আর নিশির সামনে এভাবে বলায় লজ্জা পেলাম আমি।এত দিন তো তাকে কাঠখোট্টা এলিয়েন ভাবতাম, কিন্তু এখন তো দেখছি সে নির্লজ্জও বটে।লজ্জার লেশ মাত্র নেই।বোনের সামনে কিভাবে বললো রুমে এসো।আরে ভাই ইশারা করে বললেও তো হতো নাকি?এখন নিশি কেমন ঠোঁট টিপে হাসছে।এমনিতে তো সবসময় খোঁচায়, এখন থেকে তা বেড়ে কতগুন বৃদ্ধি পাবে আল্লাহ জানে।নিশি শ’য়তানি হাসি দিয়ে মুখ ফুটে কিছু বলতে যাবে তার আগেই চট করে বেরিয়ে এলাম আমি।এখানে থাকা মানেই এখন লজ্জা দিয়ে মা’রবে আমায়।তারচেয়ে কে’টে পড়া ভালো।

______
কিছুটা লজ্জা,কিছুটা কপট রাগ ও কিছুটা আশা নিয়ে ঘরে ঢুকলাম আমি।ওনার ডাকা দেখে মনে মনে ভেবেই নিয়েছি আমার জন্যও হয়তো কিছু কিনেছেন।কিন্তু ঘরে প্রবেশ করে এমন কিছুর আভাস পেলাম না।ঘরে কোনো ব্যাগ বা প্যাকেট কিছুই নেই।নিজের আশায় পানি পড়ায় হতাশ হলাম আমি।সাথে কিছুটা অভিমানীও হলাম।আমার জন্য কিছু যখন আনেনি, তখন এভাবে তাড়া দিয়ে সঙ্গে আনার কি ছিলো?মনে কষ্ট লাগলো আমার। কিন্তু তা মনেই চাপা দিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে বললাম,

“ডেকেছেন কেনো?কিছু বলবেন?”

উনি ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চুল আঁচড়াচ্ছিলেন।আমার প্রশ্নে পিছু ফিরে তাকিয়ে নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললেন,

“হুম।”

আমি জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে বললাম,

“জ্বী বলুন?”

উনি চুলের ব্রাশটা যথাস্থানে রেখে এগিয়ে এলেন আমার দিকে।অতপর ধাতস্থ হয়ে বললেন,

“আব্বু আজ তোমাদের বাড়ি যেতে চাচ্ছে।”

কথাটা শুনে বিষ্মিত হই আমি।চোখ দুটো প্রশস্ত হয়ে যায়।আমি হকচকিয়ে গিয়ে বলি,

“কেনো?”

প্রতিউত্তরে উনি ভ্রু কুঁচকে বলেন,

“সাধে কি বলি কমন সেন্সের অভাব তোমার।তিনদিন পর নদীর বিয়ে।তোমার বাবা মা’কে দাওয়াত দিতে হবে না?”

প্রশ্নটা শুনে ক্যাবলার মতো মাথা নাড়লাম আমি।এ বাড়ির কোনো অনুষ্ঠানে কখনো আব্বু আম্মুকে দাওয়াত করা হয়নি।আমাদের বাড়ির অনুষ্ঠানেও এদের দাওয়াত করা হয়নি।তবে এখন দাওয়াত করতে যাবে কেনো?প্রশ্নটা কিছুক্ষণ ঘুরঘুর করলো মাথায়।কিছু সময় গেলে বুঝলাম আগের হিসেব আর এখনের হিসেব আলাদা।এখন বেয়াই পক্ষ হয়ে গেছেন ওনারা।তাছাড়া আব্বু আম্মুও তো খালামনিদের সাথে ফোনে কথা বলে এখন।যা আগের জন্য কল্পনাতেও ছিলো না।সময়ের চাহুদায় সব বদলায়।
____
মিনিট দশেক পর ফ্রেশ হয়ে হিজাব পড়ে ওনাদের সাথে রওয়ানা হলাম আমি।আমার নানুবাড়ি শেরপুর।যাত্রাপথে নানু ও নানিকেও আমাদের সাথে গাড়িতে তুলে নেওয়া হলো।খালামনি, খালুজান, নিভৃত,আমি ও নানা-নানী যাচ্ছি আমাদের বাড়িতে।একটা উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করে।জানিনা আম্মু এতদিনের রাগ ফেলে আদৌ এই দাওয়াত কবুল করবেন কিনা?খালুজানকে সসম্মানে আমাদের বাড়ি গ্রহন করবেন কিনা তাও জানি না।তবুও এক বুক আশা নিয়ে ছুটছি আমরা।হয়তো সব ঝামেলার আজ অবসান হবে, নয়তো এই বাড়ির দরজা আমার জন্য চিরদিনের জন্য বন্ধ হবে।শেষের অপশনটা ভাবতেই বুক কেঁপে উঠলো আমার।মনে মনে দোয়া করতে লাগলাম, আল্লাহ সব ঠিক করে দাও।নিজের জন্মস্থান, নিজ পিতা মাতা ছাড়া করো না আমায়।এদের মাঝের ঝামেলা কি আমি জানি না আল্লাহ।তুমি সব জানো।সব ঝামেলা নির্মূল করে দাও আল্লাহ।রহম করো আমার প্রতি,সদয় হও।
মনে মনে কথাগুলো আওড়াতে নিয়ে চোখের বাঁধ ভাঙলো আমার।দু ফোঁটা নোনাপানি গাল বেয়ে পড়তেই নিচে হাত রেখে তা ধরে ফেললো নিভৃত।আমার চোখের পানি খুব সন্তর্পণে মুছে দিয়ে বললো,

“দুষ্টুমিতে মুখরিত হওয়া যার চির অভ্যেস, কান্নায় তাকে শোভা পায় না।আর কখনো কাঁদবে না তুমি।”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here