#ভূমধ্যসাগরের তীরে
#পর্বঃ৪
লেখিকা দিশা মনি
সুইটি চৌধুরী মিষ্টির দিকে হতাশার সাথে তাকিয়ে ছিলেন। তিনি বুঝতে পারছিলেন না মিষ্টি এমন একটা বোকা সিদ্ধান্ত কিভাবে নিলো। তিনি মিষ্টির উদ্দ্যেশ্যে বললেন,
“যা বলছ ভেবে বলছ তো মিষ্টি? আমি কিন্তু তোমার ভালোর জন্যই তোমাকে এখান থেকে নিয়ে যেতে চাইছি৷ এমন সিদ্ধান্ত নিও না যাতে করে পরবর্তীতে তোমাকে পস্তাতে হয়।”
মিষ্টি সুইটি চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বলে,
“আমি যা বলছি ভেবে চিন্তেই বলছি মম৷ তুমি প্লিজ, আমাকে আর এই নিয়ে কিছু বলো না। আমি এখানেই থাকব।”
সুইটি চৌধুরী আরো কিছু বলতে যাবেন তার আগেই রোকসানা শিকদার বলে উঠলেন,
“আমার বাড়ির বউ আমার বাড়িতেই থাকবে। আপনার মেয়ের মতামতও তো শুনলেন। এরপর আশা করি, আপনি আর কোন অমত করবেন না।”
সুইটি চৌধুরী পরাস্ত হলেন না। বরং তিনি বলে উঠলেন,
“মিষ্টি নিজের ভালোটা হয়তো বুঝছে না। কিন্তু আমার মেয়েকে আমি এমন অনিশ্চয়তার মধ্যে রেখে যেতে পারি না।”
মোর্শেদ চৌধুরী এবার রাগান্বিত স্বরে নিজের স্ত্রীর উদ্দ্যেশ্যে বললেন,
“ব্যস, অনেক হয়ে গেছে সুইটি৷ অনেকক্ষণ থেকে তোমার অনেক বাড়াবাড়ি আমি সহ্য করেছি। নেহাতই রফিকরা ভদ্রলোক তাই কিছু বলছে না কিন্তু তুমি যেভাবে সবার সামনে ওদের ছোট করছ তা মেনে নেয়া সম্ভব না। তোমাকে আর এক মুহুর্ত আমি এখানে থাকতে দেব না। আমি চাই না, তুমি আমাদের মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে আর কোন সিনক্রিয়েট তৈরি করো যার প্রভাব আমাদের মেয়ের উপর পড়বে। চলো এখান থেকে। এক্ষুনি আমি তোমায় এখান থেকে নিয়ে যাব।”
বলেই তিনি সুইটি চৌধুরীকে জোরপূর্বক নিয়ে যেতে থাকেন। সুইটি চৌধুরী বলে ওঠেন,
“ছাড়ো আমায়! আমি আমার মেয়েকে না নিয়ে কোথাও যাব না।”
কিন্তু মোর্শেদ চৌধুরী তার স্ত্রীর কোন কথা শুনলেন না। জোরপূর্বক তাকে নিয়ে যেতে লাগলেন। এদিকে সুইটি চৌধুরী যেতে যেতেও মিষ্টিকে বলে গেলেন,
“তোমার যেকোন সমস্যা হলে তুমি আমাদের বাড়িতে চলে আসবে মিষ্টি। আজ আমি চলে যাচ্ছি কিন্তু আমি বলে দিয়ে যাচ্ছি, তোমার সাথে যদি এরা কোন অন্যায় করে তার ফল ভালো হবে না। আমি তোমার জন্য গোটা পৃথিবীর সাথে লড়াই করব। তোমার ড্যাডকেও পরোয়া করব না।”
সুইটি চৌধুরী ও মোর্শেদ চৌধুরী চলে যেতেই রোকসানা শিকদার মিষ্টির কাছে এসে বলেন,
“তোমাদের ফ্যামিলি ড্রামা শেষ হলে এখন যাও উপরে নিজের ঘরে যাও। তোমাদের জন্য আমাদের পরিবারের মান সম্মান সব ধুলোয় মিশে গেল।”
রফিক শিকদার বলে উঠলেন,
“ওকে এভাবে বলছ কেন রোকসানা? ওর কি দোষ?”
“নাহ, ওর তো কোন দোষ নেই৷ সব দোষ আমার। তুমি এখন এই মেয়ের হয়েই ওকালতি করো। ওর মা যেভাবে আমাদের সবাইকে অপদস্ত করল তার কি হবে?”
মিষ্টি নতজানু স্বরে বলে,
“আমার মায়ের করা ব্যবহারের জন্য আমি আপনাদের সবার কাছে ক্ষমা চাইছি।”
রোকসানা শিকদার তেজ দেখিয়ে বলেন,
“ক্ষমা চাইলেই কি সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে নাকি? আমাদের ইমেজ যেভাবে তোমার মা সবার সামনে খারাপ করল তার কি হবে?”
রফিক শিকদার বললেন,
“আহ,রোকসানা৷ যা হবার হয়ে গেছে৷ এখন আর এসব নিয়ে কথা বলে কি লাভ?”
“বেশ। আমি আর কিছু বললাম না৷ কিন্তু তুমি একটা কথা কান খুলে শুনে রাখো, ঐ সুইটি চৌধুরী যেন আর কখনো শিকদার বাড়িতে পা না রাখে। নাহলে কিন্তু আমার থেকে খারাপ আর কেউ হবে না।”
বলেই তিনি রাগে ফুসতে ফুসতে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ান। তার বড় ছেলের বউ ফারিয়াও তার পিছন পিছন যায়। মিষ্টি সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে কাচুমাচু হয়ে। রফিক শিকদার মিষ্টির কাঁধে হাত রেখে বলেন,
“তুমি কোন চিন্তা করো না, মা৷ দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে৷ রোকসানা এখন একটু রেগে আছে৷ তবে ওর মাথা ঠান্ডা হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি ওর কথায় কিছু মনে করো না।”
“না, আমি কিছু করিনি।”
বলেই স্মিত হাসে মিষ্টি।
★★★
রোকসানা শিকদার নিজের ঘরে আলো নিভিয়ে বসে ছিলেন। সুইটি চৌধুরীর করা ব্যবহার গুলো তিনি ভুলতে পারছিলেন না৷ এমন সময় রুমে আসে ফারিয়া। তার উপস্থিতি টের পেয়েই রোকসানা শিকদার বলেন,
“আমি এখন রুমে একা থাকতে চাই। আমাকে কেউ বিরক্ত করো না।”
ফারিয়া এগিয়ে এসে বলে,
“আপনার সাথে অনেক জরুরি কথা আছে।”
“কি বলার তাড়াতাড়ি বলো৷ আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না।”
“দেখলেন ঐ মিষ্টির মা সবার সামনে কেমন ব্যবহার করলেন। আমারও তো বিয়ে হবার অনেক দিন হয়েছে। আমার মা-বাবা কি কখনো এই বাড়িতে এসে এমন ব্যবহার করেছে? আপনার কি মনে হয় এসব এমনি এমনি হয়েছে?”
“কি বলতে চাইছ স্পষ্ট করে বলো।”
ফারিয়া এবার চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলে,
“আমি তো শতভাগ নিশ্চিত যে, ঐ মিষ্টি আছে এসব কিছুর পেছনে। ঐ নিজের মাকে উস্কে দিয়ে সবার সামনে এমন সিনক্রিয়েট করালো৷ এর মানে বুঝতে পারছেন? সব কিছু আগে থেকেই পরিকল্পনা করা ছিল। শেষের দিকে ও এই বাড়িতে থাকার কথা বলে সবার সামনে নিজেকে মহান প্রমাণ করার চেষ্টা করল। দেখলেন না, বাবা কিভাবে ওর প্রতি মুগ্ধ হয়ে গেলেন।”
রোকসানা শিকদার বলেন,
“আমি তো এসব ভেবে দেখিনি।”
“আপনারা তো সহজ-সরল মানুষ। তাই ওর এই চালাকি ধরতে পারেন নি৷ কিন্তু আমি ঠিকই ধরতে পেরেছি। এই মেয়ে যা ধুরন্ধর না। একে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে পরবর্তীতে আমাদের মাথায় উঠে ছুরি ঘোরাবে। বিশেষ করে রাফসান ফেরার পর না জানি এ আরো কত খেল দেখাবে।”
“ঠিক বলেছ তুমি ফারিয়া৷ আমাদের কিছু একটা করতে হবে।”
ফারিয়া হেসে বলে,
“আমি তো এই ব্যাপারে ইতিমধ্যেই ভেবে নিয়েছি৷ আপনি শুধু আমার বুদ্ধিটা শুনুন। দেখবেন এই মেয়ে একদম সিধে হয়ে যাবে।”
“ঠিক আছে।”
★★
পরদিন সকালে,
ঘরের দরজায় তীব্র করাঘাতের শব্দে মিষ্টির ঘুম ভাঙল। সে উঠে ঘড়ি হাতে নিয়ে দেখে সবে ৭ টা বাজে। মিষ্টি কোনরকমে উঠে দরজাটা খুলেই দেখতে পায় তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে রোকসানা শিকদার। তাকে দেখে মিষ্টি বলে,
“আপনি?”
” হুম, এটা তোমার বাপের বাড়ি পাও নি। এটা তোমার শ্বশুর বাড়ি৷ এখানে এত শুয়ে বসে থাকলে চলবে না।”
“জ্বি, বলুন আমায় কি করতে হবে।”
“যাও গিয়ে সবার জন্য সকালের নাস্তা বানাও।”
‘আচ্ছা।’
বলেই সে নিচে নেমে যায়। ফারিয়া নিচে রান্নাঘরেই ছিল। মিষ্টিকে দেখেই বলে,
“তুমি এসে পড়েছ। এই নাও, আমি ময়দা পানিতে ভিজিয়ে রেখেছি তুমি এগুলো মেখে রুটি বানিয়ে নাও৷ সাথে ডিমও ভেজো৷ আমার ছেলেটা আবার স্কুলে যাবে আমায় ওকে তৈরি করে দিতে হবে। আশা করি, বাকি কাজটা তুমি করতে পারবে।”
মিষ্টি অবাক স্বরে বলে,
‘কিন্তু আমি তো আগে কখনো রান্না করি নি।’
“এত বড় ধেড়ে মেয়ে হয়েছ আর রান্না করো নি? তাহলে ইউটিউব দেখে করে নাও। আমি এতদিন একা হাতে সব করেছি। এবার তুমি করবে। বুঝলে?”
বলেই ফারিয়া চলে যায়। মিষ্টি হতাশ চোখে তাকিয়ে থাকে। ফারিয়া যেতে যেতে বলে,
“এবার এই সুযোগে আমি সব দায়িত্বের বোঝা নিজের কাধ থেকে ঝেড়ে ফেলব।”
এদিকে মিষ্টি কোনরকমে ফোনে রেখে রুটি বেলে। যদিও সেগুলার সাইজ ঠিকঠাক হয় না। এরপর সেগুলো কড়াইতে রাখতেই তার হাতে তেল ছিটকে পড়ে পোড়া যায়। এতে সে চেচিয়ে ওঠে। যা শুনে রোকসানা শিকদার ছুটে আসেন। তিনি এসেই রুটির সাইজ দেখে বলেন,
“এগুলো রুটি বানিয়েছ না তোমার মায়ের মাথা? ছি!”
মিষ্টির চোখে জল চলে আসে। তার মায়ের বলা কথাগুলো মনে পড়ে।
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨