ভূমধ্যসাগরের তীরে #লেখিকা_দিশা_মনি সুহাসিনী #পর্বঃ৫

0
18

#গল্পঃভূমধ্যসাগরের তীরে
#লেখিকা_দিশা_মনি সুহাসিনী
#পর্বঃ৫
মিষ্টি নিজের চোখের জল মুছে কোন রকমে দৌড়ে নিজের ঘরে চলে আসে। অতঃপর দরজা বন্ধ করে জোরে জোরে আর্তনাদ করে কাঁদতে থাকে। তার আজ ভীষণ কষ্ট হচ্ছে৷ কেন জানি মায়ের বলা কথাগুলো খুব মনে পড়ছে৷ ইচ্ছা করছে এক ছুটে এখান থেকে চলে যেতে। কিন্তু কেন জানি মন তাতে সায় দিচ্ছে না৷ মিষ্টি স্বগতোক্তি করে বলে,
“আমি এখান থেকে এখন কোথাও যাব না। আমি এর শেষটা দেখতে চাই। আমি ঐ রাফসান শিকদারের মুখোমুখি হতে চাই৷ তার কাছে জানতে চাই, কেন আমাকে বিয়ের পর এভাবে একা ফেলে গেছিল। অন্তত আমি তার কাছে ছোট হবো না। কোন কিছুর মূল্যেই না। সেদিন আমি বুক ফুলিয়ে ওনাকে বলব, উনি ওনার দায়িত্ব পালন না করলেও আমি করেছি৷ সে দিনটার জন্য এখানে থেকে আমায় যতো কষ্টই সহ্য করতে হোক না কেন, আমি তা করব।”

মিষ্টি এই কথা বলে পণ করে নেয় এখন থেকে সে নিজেকে আরো শক্ত করবে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে।

★★
রোকসানা শিকদার রুটিতে তা দিচ্ছিলেন। এমন সময় ফারিয়া সেখানে এসে বলে,
“একি মা! আপনি এসব করছেন কেন? মিষ্টি কোথায়? ওকে না আমি বললাম এসব কাজ একা হাতে করতে। তা না করে ও আপনাকে রান্না করতে দিয়ে চলে গেছে। মেয়েটার সাহস তো মন্দ নয়।”

রোকসানা শিকদার বিরক্ত স্বরে বলেন,
“আহ! ফারিয়া। মিষ্টিকে তো দেখলাম তেমন রান্নাই করতে পারে না। রুটির সাইজ তো যেন এক একটা দেশের মানচিত্র! তার উপর নিজের হাতটাও পুড়িয়ে ফেলতে ধরছিল। আমার মনে হয় মেয়েটার প্রতি একটু বেশি কঠোর হয়ে যাচ্ছি। এতোটা কঠোর‍তা দেখানো ঠিক না।”

ফারিয়া বলে,
“আপনিও বাবার মতো ঐ মেয়ের এসব চালাকিতে ফেঁসে যাচ্ছেন। সবকিছুই ঐ মেয়ের নাটক।”

“নাটক কি নাটক না সেটা আমার দেখার ব্যাপার না। আর মিষ্টি নাহয় রান্না পারে না কিন্তু তুমি তো পারো নাকি? এই নাও নাকি রুটি গুলো তুমি করো।”

বলেই রোকসানা শিকদার সরে দাঁড়ান। ফারিয়া বলে,
“আমি? কিন্তু আমাকে তো রকিকে স্কুলে নিয়ে যেতে হবে।”

“আজ নাহয় রকিকে ওর বাবাই স্কুলে নিয়ে যাবে। আমি নাহয় বড় খোকাকে বলে দেব।”

বলেই তিনি একটা থালাতে রুটি আর তরকারি সাজাতে থাকেন। ফারিয়া সেদিকে আড়চোখে তাকিয়ে বলেন,
“এগুলো নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন?”

“মিষ্টির কাছে নিয়ে যাচ্ছি। মেয়েটা কাল রাতেও কিছু খায়নি। এভাবে না খেয়ে থাকলে তো অসুস্থ হয়ে পড়বে।”

বলেই রোকসানা শিকদার সামনের দিকে পা বাড়ান। ফারিয়া সেদিকে তাকিয়ে ফোঁস ফোঁস করতে করতে বলেন,
“ঢং দেখে বাঁচি না! আমার জন্য তো কখনো এভাবে খাবার নিয়ে যেতে দেখি না। নিজের ছোট ছেলের বউয়ের জন্য দরদ একেবারে উতলে উঠছে। কোথায় আমি ভাবলাম, এই মেয়ের ঘাড়ে সব কাজের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে পায়ের উপর পা তুলে একটু আরাম করব তা না! উফ..”

বলেই ফারিয়া আবার রুটি ভাজায় মনযোগ দিল। অগত্যা এখন তাকেই এ সমস্ত কাজ করতে হচ্ছে।

রোকসানা শিকদার খাবার নিয়ে মিষ্টির দরজার সামনে এনে দরজায় নক করেন। মিষ্টি বলে ওঠে,
“কে?”

“আমি, দরজাটা খোলো।”

মিষ্টি নিজের চোখের জল মুছে এসে দরজাটা খোলে। রোকসানা শিকদার ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে বলেন,
“কাল রাতে তো বোধহয় কিছু খাও নি, তাই এই রুটিটা খেয়ে নাও।”

মিষ্টি অবাক চোখে রোকসানা শিকদারের দিকে তাকান। যেই মহিলাটা একটু আগে তাকে এত কথা শোনালো এখন সেই তার জন্য খাবার নিয়ে এসেছে!

মিষ্টির অবাক হয়ে তাকানো দেখে রোকসানা শিকদার বলেন,
“এমন হা করে তাকিয়ে আছ কেন? খেয়ে নাও তাড়াতাড়ি। আবার তুমি অসুস্থ হয়ে গেলে তো তোমার মা এসে আমাদের গুষ্টি উদ্ধার করে ছাড়বে।”

মিষ্টি বলে,
“আচ্ছা, রেখে যান৷ আমি খেয়ে নেব।”

রোকসানা শিকদার একটা টেবিলে খাবার রেখে বলেন,
“এক্ষুনি খেয়ে নাও। আমি এখানেই আছি। তুমি খাওয়া শেষ করো। তোমার খাওয়া শেষ হলে আমি যাব। ”

অগত্যা মিষ্টি রুটি, তরকারি দিয়ে খেতে শুরু করে। এই মুহুর্তে রোকসানা শিকদার এর নজরে আসে তেল ছিটকে মিষ্টির হাতের কিছু অংশ পুড়ে গেছে। তাই তিনি দ্রুত ড্রয়ার থেকে একটা অরনামেট বের করে বলেন,
“দেখি, হাতটা এদিকে দাও।”

মিষ্টি যেন আজ অবাকের উপর অবাক হচ্ছিল। রোকসানা শিকদার নিজের হাতে যত্ন করে মিষ্টির হাতে অরনামেটটা লাগিয়ে দেন৷ মিষ্টি তখন হতবাক নয়নে তাকিয়ে ছিল এই কঠোর মানুষটার দিকে। যাকে সে সবসময় হিটলার লেডি হিসেবেই জেনে এসেছে। তার যে এমন একটা নরম মাতৃসূলভ দিক আছে সেটা সে কখনো আন্দাজই করতে পারে নি। রোকসানা শিকদার মিষ্টির উদ্দ্যেশ্যে বলেন,
“এতোটা অবাক হওয়ার কিছু নেই। আমিও এক সময় নতুন বউ ছিলাম৷ তাই, এই সময় একটা মেয়ের কেমন অনুভূতি হয় সেটা বুঝি। তুমি হয়তো জানো না, আমারও বিয়ের দুদিন পরেই তোমার শ্বশুর মশাইকে একটা জরুরি মিশনে বাইরে যেতে হয়। দীর্ঘ ৬ মাস পর তিনি ফিরে আসেন। এই সময় আমার জীবনের অভিজ্ঞতা ভীষণ বাজে ছিল। আমি চাই না, তোমাকেও সেই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হোক। আসলে গতকালকার ঘটনাটা নিয়ে তোমার মায়ের উপর ভীষণ রেগে ছিলাম সেই রাগের বহিঃপ্রকাশ তোমার উপরে করে ফেলেছি। আসলে কি বলো তো, এই পরিবারকে আমি অনেক কষ্টে আগলে রেখেছি। তাই কেউ যখন এই পরিবারের দিকে আঙুল তোলে তখন আমার ভালো লাগে না।”

মিষ্টি বলে,
“আমি আপনার ব্যাপারটা বুঝতে পারছি। আমি কিছু মনে করিনি।”

“বেশ, তাহলে এখনকার মতো খেয়ে নাও। আর হ্যাঁ, তোমার যদি কোন রান্না শেখা না থাকে তাহলে ধীরে ধীরে শিখে নিও। আমি তোমায় সাহায্য করব।”

মিষ্টির হঠাৎ কি হয় সে জানে না। মিষ্টি রোকসানা শিকদারকে জড়িয়ে ধরে। রোকসানা শিকদারও হতবিহ্বল হয়ে পড়েন৷ তিনি মোটেও এটা আশা করেন নি। মিষ্টি ব্যাপারটা বুঝতে পেরে দূরে সরে এসে বলেন,
“দুঃখিত! আসলে হঠাৎ করে আমার কি যে হলো…”

রোকসানা শিকদারের মতো গম্ভীর মানুষের মুখেও এক চিলতে হাসির দেখা মেলে। তিনি বলেন,
“কোন ব্যাপার না। আমি কিছু মনে করিনি। খেয়ে নাও, খাবারটা ঠান্ডা হয়ে গেলে আর ভালো লাগবে না।”

মিষ্টি খেতে শুরু করে।

★★★
বিশাল বড় একটা জাহাজ ভেসে চলেছে সমুদ্র জলরাশির উপর দিয়ে। সেই জাহাজের একপ্রান্তে বসে সুনীল আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে এক পুরুষ। চোখে তার তীব্র জেদ। হঠাৎ করেই কারো একটা পায়ের শব্দ শুনে পেছনে ফিরে তাকায় সেই পুরুষ। আরমান এগিয়ে আসে। স্মিত হেসে বলে,
“কি ব্যাপার রাফসান? রোজ ঐ আকাশের দিকে তাকিয়ে কি দেখ?”

রাফসান বলে,
“এই আকাশ যেন এক বিশাল রহস্য আর প্রশ্নের ভাণ্ডার লুকিয়ে রেখেছে নিজের মাঝে। এমন কত রহস্য তো এই পৃথিবীর বুকেও লুকিয়ে আছে৷ তাই না?”

“বুঝি না, তুমি আজকাল এসব কেমন রহস্যজনক কথা বলো। সদ্য বিবাহিত বউকে ছেড়ে এসে বুঝি পাগল হয়ে গেছ। মেয়েটার মুখও বুঝি ঠিকভাবে দেখো নি, তাই না?”

রাফসান প্রসঙ্গ বদলে বলে,
“আমাদের মার্সেই বন্দরে পৌঁছাতে আর কত সময় লাগবে?”

“সবে তো মাত্র ২ দিন হলো। আমাদের আরো ২০-২৫ দিন সময় লাগবে মার্সেই তে পৌঁছানর জন্য। মাঝপথে যদি ঝড় ওঠে তাহলে আরো বেশি সময় লাগতে পারে।”

রাফসান একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,
“সময় যেন এগোচ্ছেই না। অথচ আমাকে যত দ্রুত সম্ভব ভূমধ্যসাগরে তীরে ঐ মার্সেই শহরে পৌঁছাতে হবে!”
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨
[আজকের পর্বে মিষ্টি ও রোকসানা শিকদার এর মুহুর্ত গুলো পড়ে কেমন লাগল, কমেন্ট করে জানাবেন। আপনাদের কমেন্টই আমাকে লেখার অনুপ্রেরণা জোগায়।]
👉 তাফসির জাহান
👉 সাহিত্যের কুটির

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here