ভূমধ্যসাগরের তীরে #পর্বঃ৭ #লেখিকা দিশা মনি

0
14

#ভূমধ্যসাগরের তীরে
#পর্বঃ৭
#লেখিকা দিশা মনি

মিষ্টির দিনগুলো ভীষণ বোরিং ভাবে পার হচ্ছিল। সারাদিন ঘরে বসে শুয়ে বসেই তার দিন কাটে৷ ভার্সিটিতে গিয়েই যা একটু শান্তি পায়। তাছাড়া তার আর তেমন করার মতো কোন কাজ নেই। মাঝে মাঝে রান্নাবান্না সহ অন্যান্য গৃহস্থালি কাজে নিজের শ্বাশুড়ি রোকসানা শিকদার কে একটু সাহায্য করে এই আরকি! যদিও ফারিয়ার থেকে সে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলে৷ কারণ ফারিয়ার আচার ব্যবহার তার কাছে খুব একটা ভালো লাগে না। এভাবেই চোখের নিমেষে এক মাস পেরিয়ে গেল।

মিষ্টি আজও নিত্যদিনের মতো ভার্সিটি থেকে ফিরে নিজের ঘরে বসে ছিল। এমন সময় রোকসানা শিকদার ছুটে আসেন মিষ্টির রুমে। মিষ্টি রোকসানা শিকদারকে আসতে দেখে বলে,
“আপনি? কিছু কি হয়েছে?”

রোকসানা শিকদার মিষ্টির দিকে একটা চিঠি বাড়িয়ে দিয়ে বলেন,
“এটা তোমাকে দেয়ার ছিল।”

“কি এটা?”

“এটা রাফসানের লেখা একটা চিঠি। ও ফ্রান্সে যাওয়ার আগে এই চিঠিটা লিখে গেছিল। আমায় বলেছিল, এই চিঠিটা খুলে না দেখতে এবং সরাসরি এটা তোমার হাতেই তুলে দিতে যখন আমি ভালো মনে করি। তবে এত দিন আমার মনে কিছু দ্বিধা কাজ করছিল তাই সাহস পাচ্ছিলাম না। তবে আজ ভাবলাম, তোমার এটা পড়া উচিৎ। তাহলে হয়তো অনেক কিছুই জানতে পারবে।”

বলেই তিনি মিষ্টির দিকে চিঠিটা বাড়িয়ে দেন। মিষ্টি চিঠিটা হাতে নিয়ে বলে,
“কি আছে এই চিঠিতে?”

“সেটা তো আমি জানি না। আর হ্যাঁ, আমি রুম থেকে বেরিয়ে যাবার পর চিঠিটা পড়িও। আর এই চিঠিটার ব্যাপারে কাউকে কিছু বলবেও না। কারণ রাফসান বলেছিল এটা শুধুমাত্র তোমার জন্য।”

মিষ্টি হ্যাঁ-বোধক মাথা নাড়ায়। রোকসানা শিকদার কক্ষ থেকে বের হতেই মিষ্টি দরজা ভিড়িয়ে এসে বিছানায় বসে পড়ে। অতঃপর ভাবুক স্বরে বলে,
“কি এমন আছে এই চিঠিতে যা নিয়ে উনি এতোটা গোপনীয়তা রক্ষা করতে বলেছেন।”

এসব ভাবনা পাশ কাটিয়েই মিষ্টি চিঠিটা খুলল। ভেতর থেকে একটা খাম বেরিয়ে এলো। মিষ্টি সেটা হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করল। বেশ বড় বড় অক্ষরে লেখা,
“মিষ্টি চৌধুরী! চিঠিটা আপনার জন্য। আপনাকে প্রিয় বলে সম্মোধন করার অধিকার আমার আছে কি নেই সেটা ঠিক আমি জানি না। তাই শুরুটা একটু ব্যতিক্রম ভাবে করলাম। আপনার ভালো থাকার আশা করাটাও বৃথা তবুও সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করি তিনি আপনাকে ভালো রাখুক। জানি না, আমার প্রতি আপনার অনুভূতি কেমন হবে। রাগ, অভিমান, ঘৃণা…এর মধ্যে কোন একটা হয়তো। আমি এসব ছাড়া অন্য কিছু আশাও করছি না। যাক গে, এসব অতিরিক্ত কথা বাদ দিয়ে আসল কথায় আসি। আজকেই আপনার সাথে আমার বিয়ে হলো। অথচ সুখী দাম্পত্য জীবন শুরু করার পরিবর্তে আমি পারি জমাচ্ছি ভূমধ্যসাগরের তীরে! এটা নিয়ে আপনার অভিযোগ থাকতেই পারে৷ তবে আমার তরফ থেকে আমি স্পষ্ট করে দিচ্ছি, আমার কাছে সবথেকে জরুরি হলো আমার পেশাজীবন। এ জন্য আমি কোন পিছুটানও রাখতে চাই না। বিয়েটা করারও আমার কোন ইচ্ছা ছিল না শুধুমাত্র বাবার জেদের বশেই আমাকে বিয়েটা করতে হলো। তবে আপনার জীবন নষ্ট করার কোন ইচ্ছাই আমার ছিল না এবং এখনও নেই। আপনাকে এখন আমি যা বলব, সেসব কথা কাউকে না জানানোর অনুরোধ রইল। যদিওবা আপনার উপর চাপ সৃষ্টির অভিপ্রায় আমার নেই তবে একটা নিছক অনুরোধ বলতে পারেন। আমি ফ্রান্সে কোন সফরের জন্য নয় যাচ্ছি এক গুরুত্বপূর্ণ মিশনে। আর এই মিশন সফল ভাবে শেষ করে আমার বেঁচে ফেরার সম্ভাবনাও ভীষণ কম৷ এজন্য আপনাকে একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিচ্ছি, আমার জন্য অপেক্ষা করবেন না। পারলে নিজের জীবনটা নতুন ভাবে শুরু করুন। আমাকে নিয়ে কোন আশা রাখবেন না মনে। নিজের জীবনটা নিজের মতো করে বাঁচুন। আপনার সুখ-সমৃদ্ধির আশা নিয়ে পত্রটা এখানেই শেষ করছি। ভালো থাকবেন।”

চিঠিটা পড়েই মিষ্টির হাত কাপতে শুরু করে। চোখের জল যেন আর বাধা মানতে নারাজ। গোটা রাত্রি মিষ্টির কাটল জেগে জেগে, অশ্রু বিসর্জন করে। নিয়তির এই কি নিষ্ঠুর পরিহাস! মিষ্টি যে নিতে পারছে না এত কিছু। তার সহজ সরল জীবনটা কেন হঠাৎ করে এত জটিল হয়ে উঠল। চারপাশের অকৃত্রিম জটিলতা যে তাকে জড়িয়ে ধরছে শক্তভাবে। যা থেকে বেরোনোর কোন উপায় খুঁজে পাচ্ছে না সে।

★★
সকালে ব্রেকফাস্টের টেবিলে উপস্থিত হয়েছে সবাই। ফারিয়া সবাইকে খাবার পরিবেশন করতে করতে খেয়াল করল মিষ্টি আনমনে বসে আছে। যেন কোন গভীর চিন্তায় মগ্ন। তার চোখ ভীষণ লাল, চোখের নিচে কালো দাগ জানান দিচ্ছে নির্ঘুম রজনীর। ফারিয়ার কাছে বিষয়টা কেমন জানি সন্দেহজনক লাগল। তাই সে প্রশ্ন করে বসল,
“কি হয়েছে মিষ্টি? তোমাকে এমন লাগছে কেন?”

মিষ্টি শুরুতে সাড়া দিল না। দুবার ডাকার পর সাড়া দিয়ে বলল,
“তেমন কিছু না।”

তবে ফারিয়া বুঝল কিছু তো একটা ব্যাপার আছেই। রোকসানা শিকদারও মিষ্টির ব্যাপারটা লক্ষ্য করলেন। তিনি বুঝলেন নিশ্চয়ই রাফসানের লেখা চিঠিতে এমন কিছু ছিল যা পড়ে মিষ্টি আজ এমন আচরণ করছে। কিন্তু তিনি তো ছেলেকে কথা দিয়েছিলেন এই চিঠির ব্যাপারে কিছু জানতে চাইবেন না এবং এই চিঠি পড়ার পর মিষ্টি যেমনই প্রতিক্রিয়া দেখাক না কেন তা সহ্য করে নেবেন তাই রোকসানা শিকদারও বুকে পাথর চেপে রাখলেন।

এদিকে মিষ্টি হঠাৎ করে বলে উঠল,
“আমি আমার বাবার বাড়িতে যেতে চাই কিছু দিনের জন্য।”

ফারিয়া ভ্রু কুচকে বলল,
“বিয়ের এক মাস হতে না হতেই বাপের বাড়ি যাবার এত কিসের তাড়া? মা, আপনিই কিছু বলুন।”

রোকসানা শিকদার মিষ্টির দিকে তাকিয়ে বলেন,
“বেশ, যদি তোমার ইচ্ছা হয় তাহলে যেতে পারো। আমি বাঁধা দেব না।”

মিষ্টি আর খেতে পারল না। খাবার নিয়ে কোন রকমে নাড়াচাড়া করে উঠে দাঁড়ালো। অতঃপর নিজের রুমে গিয়ে নিজের সমস্ত জিনিসপত্র গোছাতে লাগল। ঘরের এক কোণে রাফসানের একটা ছবি টাঙানো ছিল। নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে সেই ছবিটার সামনে গিয়ে মিষ্টি বলল,
“আমি আপনাকে কখনো ক্ষমা করবো না, কখনোই না।”

বলেই সে বেরিয়ে আসতে নিল এমন সময় হঠাৎ করে কিছু একটা মনে পড়তেই সে আবারো রুমে ফিরে এলো। রুমে এসে আবারো রাফসানের ছবির সামনে দাঁড়াল। অতঃপর বলল,
“আপনি যদি ভেবে থাকেন, আমি দমে যাব তাহলে ভুল ভাবছেন। আমাকে এভাবে অথৈ সাগরে ফেলে আপনি হারিয়ে যাবেন সেটা আমি মেনে নেব না, আপনি যখন আমাকে বিয়ে করেছেন তখন এই বিয়েটাকে আপনি অস্বীকার করতে পারেন না। আপনার মিশন আপনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে কিন্তু আমার কাছে না। প্রয়োজনে আমি আপনাকে খুঁজে বের করার জন্য গোটা দুনিয়া ঘুরব..ভূমধ্যসাগরের তীরে গিয়েও উপস্থিত হবো। তবু এত সহজে আপনার পিছু ছাড়ব না।”

এসব বলেই সে ধীর পায়ে নিচে নামতে থাকে। রফিক শিকদার মিষ্টিকে নিচে নামতে দেখে বলেন,
“চলো আমি তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।”

রোকসানা শিকদার একটু দূরেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। মিষ্টি তার দিকে তাকায়। তিনি গম্ভীর স্বরে বলেন,
“সাবধানে যেও।”

অন্যদিকে ফারিয়া একটু দূরেই মুখ ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তার মিষ্টির এত স্বাধীনতা একদমই ভালো লাগছিল না। মিষ্টি বাড়ি থেকে বের হতে যাবে এমন সময় কিছু লোক হড়বড়িয়ে বাড়িতে প্রবেশ করল। তাদের দেখে রফিক শিকদার চিনতে পারলেন। বললেন,
“আপনারা নেভি অফিসের লোক না? রাফসানের কলিগ। আপনারা হঠাৎ এখানে কেন?”

তাদের প্রত্যেককেই বেশ আতংকিত ও শোকাহত লাগছিল। তাদের এই অবস্থা দেখে পরিবারের সবাই ভীত হয়ে পড়ে। তাদের মধ্যে লম্বা করে কালো একজন লোক বলে ওঠে,
“একটা খারাপ খবর আছে, নেভি মিস্টার রাফসান শিকদার ও তার টিমকে বহনকারী জাহাজটা ভূমধ্যসাগরে ডুবে গেছে। রিপোর্ট বলছে কারোরই বাঁচার আশা নেই!”

রোকসানা শিকদার এই খবর শোনামাত্রই আর্তনাদ করে ওঠেন, “আমার রাফসান” বলে এবং সাথে সাথেই অজ্ঞান হয়ে যান।

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here