#ভূমধ্যসাগরের তীরে
#পর্বঃ৮
#লেখিকা দিশা মনি
রাফসানের সম্ভাব্য মৃত্যুর কথা জেনে মিষ্টি হতবাক হয়ে গেল। তার কানে বারবার বাজছিল শব্দগুলো। সে আর কিছু ভাবতে পারছিল না। রাফসানের লেখা চিঠির কথা মনে পড়তেই তার বুক কেপে উঠল। মিষ্টি ক্রন্দনরত স্বরে বলল,
“এটা হতে পারে না৷ উনি এভাবে আমার সাথে দেখা না করে চলে যেতে পারেন না। ওনার থেকে যে আমার অনেক প্রশ্নের উত্তর জানার বাকি আছে।”
বৃদ্ধ রফিক শিকদার পুরোপুরি ভেঙে পড়লেন। একেই নিজের সন্তানের মৃত্যু-সংবাদ তার উপর নিজের স্ত্রীর অচেতন অবস্থা মিলিয়ে তাকে একদম দূর্বল করে দিল। তিনি দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে পড়লেন। রাহুল এই অবস্থায় নিজের মা-বাবাকে সামলাতে লাগল। অথচ এত কিছুর মাঝেও ফারিয়ার মনে মানবিকতার উদ্রেক হলো না। সে মিষ্টির উদ্দ্যেশ্যে বলল,
“এখনো দাঁড়িয়ে আছ কেন এখানে? এই সংসারটা করার ইচ্ছা ছিল না তাই তো তোমার? দেখ তোমার ইচ্ছাই পরিপূর্ণতা পেয়েছে৷ আমার দেবর আর নেই এই দুনিয়ায়। এসব লোক দেখানো বিলাপ করছ কেন? তোমার তো এখন আনন্দ করার কথা আনন্দ করো।”
রাহুল রাগান্বিত স্বরে বলে,
“এসব তুমি কি যা তা বলছ ফারিয়া?”
“আমি একদম ঠিক বলছি।”
“আল্লাহর দোহাই লাগে, চুপ করো। এমনিতেই আমার পরিবারের সবাই ভীষণ ভেঙে পড়েছে। তুমি আর দয়া করে এসব কথা বলো না।”
মিষ্টি নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। হঠাৎ করেই যেন শিকদার বাড়িকে এক শোকের পরিবেশ আছন্ন করে নিল। পুরো বাড়ি হয়ে পড়ল স্থবির।
★★
রাফসানের সম্ভাব্য মৃত্যুর কথা শুনে পাড়া-প্রতিবেশী, নিকটাত্মীয় সহ অনেকেই ইতিমধ্যে ভীড় জমিয়েছেন শিকদার বাড়িতে। তারা এসে পরিবারের লোকদের সান্ত্বনা দিয়ে যাচ্ছেন। কেউ কেউ মিষ্টির কথা ভেবে বলল,
“মেয়েটার কপালটাই খারাপ! বিয়ের পর ঠিক মতো স্বামীর সান্নিধ্যই পেল না আর তাতেই কিনা স্বামীর মৃত্যু সংবাদ শুনতে হলো।”
তবে এত কিছুর মাঝেও কিছু সমালোচনা করা স্বভাবের মানুষ মিষ্টির পিছনে পড়ে গেল৷ তাদের ভাষ্য,
“মেয়েটা নিশ্চয়ই অপয়া! নাহলে বিয়ের মাস ঘুরতে না ঘুরতেই এভাবে স্বামীর মৃত্যু হয়?”
এসব কথা মিষ্টির কানেও এলো। এত কথার মাঝে মিষ্টি দুমড়ে মুচড়ে গেল। ফারিয়াও ছিল সেই সব সমালোচনাকারীদের দলে।
এদিকে রোকসানা শিকদার এর অবস্থা বেশি একটা ভালো না। যতবারই তার জ্ঞান ফিরছে ততবারই তিনি রাফসানের নাম ধরে আহাজারি করে আবারো জ্ঞান হারাচ্ছেন। অবস্থা বেগতিক দেখে তাকে স্যালাইন লাগিয়ে রাখা হয়েছে। পুত্রশোকে স্তব্ধ রফিক শিকদার নিজের স্ত্রীর শিয়রে বসে নিরবে চোখের জল বিসর্জন করছেন।
এত সবকিছুর মাঝে মিষ্টির মা সুইটি চৌধুরী ও বাবা মোর্শেদ চৌধুরীও ছুটে এলেন এই দুর্দিনে। মোর্শেদ চৌধুরী নিজের বন্ধু রফিক শিকদারের কাছে গিয়ে তাকে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন। এদিকে সুইটি চৌধুরী মিষ্টির কাছে এলেন। মিষ্টি নিজের মাকে দেখেই কেঁদে ফেলল৷ দৌঁড়ে গিয়ে ছুটে জড়িয়ে ধরল নিজের মাকে। সুইটি চৌধুরীও পরম আবেশে জড়িয়ে ধরলেন নিজের মেয়েকে। অভয় বার্তা দিয়ে বললেন,
“চিন্তা করো না মিষ্টি, সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।”
মিষ্টি নিজের মায়ের সহচার্য পেয়ে কিছুটা স্বাভাবিক হয়। এরকম মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দেয়া একজন মানুষেরই তো অভাব ছিল এই পরিস্থিতিতে।
ধীরে ধীরে পরিবেশ কিছুটা স্বাভাবিক হয়৷ রোকসানা শিকদার এখনো অব্দি শোকাচ্ছন্ন থাকলেও আগের মতো আর আহাজারি করছেন না। তার চোখের জলও যেন ফুরিয়ে এসেছে। ইতিমধ্যে একজন ইমাম এসে উপস্থিত হলেন শিকদার বাড়িতে। তিনি রফিক শিকদারকে পরামর্শ দিয়ে বললেন,
“যেহেতু আপনার ছেলে সমুদ্রে ডুবে মারা গেছে তাই এটা এক ধরনের অপমৃত্যু। তার দেহ পাওয়া যাবে কিনা এই আশাও সীমিত। তাই সঠিক পদ্ধতিতে দাফন হয়তো সম্ভব হবে না তার। সলিল সমাধী হয়েছে আপনার ছেলের। তার জন্য আল্লাহর নিকট বেশি বেশি দোয়া করবেন।”
রফিক শিকদার মৌন হয়ে সবটা শোনেন। তেমন কোন প্রতিক্রিয়া জানানোর ভাষা তার নেই।
সুইটি চৌধুরী মোর্শেদ চৌধুরীকে বলেন,
“তুমি ভেবেছ কিছু কি করবে?”
“কিসের ব্যাপারে?”
“মিষ্টির ব্যাপারে। আমাদের মেয়েটার পুরো জীবনটা এখনো বাকি আছে। আমি মানছি যা হয়েছে তা অন্তত কষ্টের। কিন্তু..আমার মনে হয়, মিষ্টিকে আমাদের সাথে করে নিয়ে যাওয়া উচিৎ। এমনিতেও ও যেই পরিচয়ে এই বাড়িতে ছিল তা এখন মূল্যহীন।আমাদের মেয়ের ব্যাপারে এখন তো আমাদেরকেই ভাবতে হবে।”
“এই সময় কি এসব কথা না বললেই নয়, সুইটি?”
রফিক শিকদার পাশেই ছিলেন। তিনি বললেন,
“ভাবি তো ঠিক কথাই বলেছেন। আমাদের বাড়ির পরিস্থিতি এখন বেশি একটা ভালো না। মিষ্টি মা এই পরিবেশে থাকলে মানসিক অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়বে। তার থেকে ভালো তোরা ওকে তোদের সাথে করে নিয়ে যা। এতে যদি মেয়েটা একটু স্বাভাবিক হয়।”
সুইটি চৌধুরী একটু দূরে নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নিজের মেয়ে মিষ্টির দিকে তাকান। ধীর পায়ে মিষ্টির কাছে এগিয়ে গিয়ে বলেন,
“চলো মা, আমি আর তোমার বাবা তোমাকে নিয়ে বাড়িতে ফিরতে চাই।”
মিষ্টি নিজের চোখের জল মুছে বলে,
“কোথাও যাব না আমি। কোথাও না।”
বলেই সে দৌড়ে রোকসানা শিকদার এর নিকট যায়। শোকে আছন্ন রোকসানা শিকদার মিষ্টিকে দেখে কিছুটা থমকে যান। মিষ্টি রোকসানা শিকদারের হাতটা আলতো করে ধরে বলে,
“আমার উপর আপনি বিশ্বাস রাখেন তো?”
রোকসানা শিকদার বুঝতে পারেন না মিষ্টি কি বলতে চাইছে। মিষ্টি ব্যাপারটা টের পেয়ে বলে,
“আমার বিশ্বাস, আপনার ছেলে এখনো জীবিত। কিচ্ছু হয়নি তার। তার সর্বশেষ চিঠি পড়ে আমি এমনই আন্দাজ পেয়েছি। আপনি আমার উপর ভরসা রাখতে পারেন। আমি কথা দিচ্ছি, আপনার ছেলেকে আবার আপনার কাছে ফিরিয়ে দেব।”
রোকসানা শিকদার ধরে আসা গলায় বলেন,
“এসব কি বলছ তুমি?”
সুইটি চৌধুরী এসে মিষ্টিকে বলেন,
“তোমার মাথা কি খারাপ হয়ে গেছে মিষ্টি? যেখানে রাফসানের নেভি অফিস থেকে তার মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়েছে সেখানে তুমি বলছ ও বেঁচে আছে!”
“হ্যাঁ, বলছি। আমার বিশ্বাস উনি বেঁচে আছেন। আর এটা নিশ্চিত করার জন্য আমাকে মার্সেইতে যেতে হবে।”
সুইটি চৌধুরী এবার সামান্য ক্রোধিত স্বরে বলে,
“মার্সেই! মানে ফ্রান্সের মার্সেই শহরে যাবে তুমি? এসব কি বলছ? তোমার মাথা ঠিক নেই। চলো আমি তোমায় বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছি।”
মিষ্টি জেদ দেখিয়ে বলে,
“না, মম। আমার মাথা একদম ঠিক আছে। তোমরা কেউ আমায় বাধা দিও না। আমায় বোঝার চেষ্টা করো। আমাকে মার্সেইতে যেতেই হবে। যেকোন মূল্যে!”
রোকসানা শিকদার মিষ্টির এমন অদম্য ইচ্ছা দেখে কিছুটা আশা খুঁজে পান। তিনি বলেন,
“তুমি সত্যি বলছ? আমার ছেলেকে খুঁজে এনে দেবে তুমি?”
“হ্যাঁ, শুধু আমাকে আপনারা একটা সুযোগ দিন।”
রফিক শিকদার এগিয়ে এসে বলেন,
“তোমার মা ঠিক বলছে মিষ্টি। তুমি এমন পাগলামো করো না। তোমার মা-বাবার সাথে ফিরে যাও। আমি রাফসানের বাবা হিসেবে ওর মৃত্যুটা মেনে নিয়েছি। তুমিও চেষ্টা করো মেনে নেয়ার।”
“আমাকে একটা সুযোগ দিন। আমি আপনাদের কাছে অনুরোধ করছি।”
রফিক শিকদার আর কিছু বলতে যাবেন এমন সময় মোর্শেদ চৌধুরী বলেন,
“আমি আমার মেয়ের উপর ভরসা রাখি। তুইও রাখার চেষ্টা কর। ও যখন বলছে তখন অবশ্যই ওর কথা রাখবে।”
রোকসানা শিকদারও বলেন,
“হ্যাঁ, মেয়েটা যখন এত করে বলছে তখন ওকে একটা সুযোগ দিয়েই দেখি।”
রফিক শিকদার বলেন,
“কিন্তু ও একা একটা অজানা শহরে..”
মিষ্টি তীব্র আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলেন,
“আমি পারবোই।”
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨
[এখানেই থেকেই মূল গল্প শুরু হলো। আগামীকাল থেকে আবার নিয়মিত দিব ইনশাআল্লাহ। আপনাদের কাছে শুধু একটাই অনুরোধ বেশি বেশি করে লাইক আর গল্প সম্পর্কে গঠন মূলক কমেন্ট করবেন। এসবই আমাদের আগ্রহ জোগায়। নাহলে গল্প লেখার তেমন একটা আগ্রহই থাকে না। আশা করি, আপনারা আমার ব্যাপারটা বুঝতে পেরে একটু সুন্দর সুন্দর কমেন্ট করবেন। আর বেশি কিছু চাই না। এটুকুই বলার ছিল।]