গল্প: ম্যানহোলের_অতলে পর্ব-১

0
1595

পাড়ার বাজে ছেলেটার সাথে পিয়াশ ঠোঁটের সাথে ঠোঁট আলিঙ্গণ করছে। সিঁড়ির কোণে মেয়ের সাথে পাড়ার বাজে মস্তান ছেলেকে দেখে মাথা রক্তবর্ণ সুলতানার। চোখ দিয়ে যেন আগুনের ফুল্কি বের হচ্ছে৷ ইচ্ছে করছে এখনি গিয়ে কষে থাপ্পড় দিতে। রাত বারোটায় হঠাৎ ঘুম ভেঙে যাওয়ায় সদর দরজা হুট করে খোলা পায় কিছুক্ষণ পর আবিষ্কার করলো সুলতানার স্বীয় কন্যার প্রেম বৈ অশালীন কাজ কর্মের। চোখ দিয়ে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। নিজেকে খানিকটা সামলে নিয়ে রুমে এসে বসলেন।

সুলতানার দুই মেয়ে। ছেলে বাচ্চার প্রতি এক টান অনুভব করতো কখনো, হয়তো স্বয়-সম্পত্তি দেখভাল করবে এমন নয়, ভালো লাগতো ছেলে বাচ্চাকে। কিন্তু পরপর দুটো কন্যার পর পুত্রের আশা ত্যাগ করেছিলেন সুলতানা। মন খারাপ হলেও সামলে নিয়েছিলো। বর্তমানে কম কিসে মেয়েরা? প্রতিটা স্তরে যশ খ্যাতি জমিয়ে নিয়েছে। কিন্তু বান্ধুবি কিংবা রাস্তায় কোনো পুত্র বয়সী ছেলে দেখলেই বুকের বাঁ পাশটা কেঁপে উঠতো। সুলতানার স্বামী রিটার্ড সেনাবাহিনীর জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার (জেসিও) মোহাম্মদ শেখ আমির । তিনি কখনো সন্তানদের নিয়ে অভিযোগ করে নি। হেসে বলেছে,

“দ্বিতীয় কন্যা সন্তান এর কথা ভেবে মন খারাপ করো না, সে নিশ্চয়ই আমাদের মুখ উজ্জ্বল করবে!”

এই তবে মুখ উজ্জ্বল এর চিত্র! ঘেন্নায় বেসিনে বমি করলেন সুলতানা। কখনো কিছুতে অভাব দিয়েছিলো নাকি, যে আজ এই ঘটনা থাকে দেখতে হচ্ছে!
পিয়াশ খুব কৌশলে দরজা অফ করে, পা টিপে টিপে রুমে ঢুকতে যাবে, তখন পেছন থেকে ডাকলো সুলতানা। মায়ের ডাকে গলায় শুকিয়ে আমতা আমতা করে তাকালো।
সুলতানা কষে থাপ্পড় দিলো কয়েকটা। নির্বিঘ্নে মার খেয়ে যাচ্ছে পিয়াশ। সুলতানার রক্তিম চোখে পানি ঝড়ছে৷ মেয়েকে উচ্চ কন্ঠে শাসিয়ে বললো,

—- লজ্জা হয় না তোর, সাহস কিভাবে হয়? তুই কোন সাহসে এইগুলো করলি? স্কুলের গন্ডি পাড় হয়নি তোর, এখনি এমন! সাহস হয় কি করে? ঠিক কয় দিন বল, কয়দিন এইগুলো করেছিস বল?

সুলতানার চিৎকারে বড় মেয়ের সুপ্তির ঘুম ভেঙে গেলো। মা এবং ছোট বোনের এই পরিস্থিতি কেন? কি কারণে হাজারটা প্রশ্ন থাকতেও বোনকে আগলে নিলো। চিৎকার করে বললো,

— মা, কি হয়েছে? এত রাতে মারছো কেনো?

— তোর বোনকে জিজ্ঞেস কর! আজ ওকে মেরেই ফেলবো! তোর মত তোর তো চরিত্রহীন মেয়ে পেটে আসবে জানলে গলা টিপে মেরে ফেলতাম। বেয়াদপ মেয়ে।

সুলতানা কোথা থেকে বড় কাঠ নিয়ে এসেছে, প্রবল বেগে পিয়াশের দিকে আগাচ্ছে। আমিরের ঘুম ভাঙ্গলো, বউকে সামলে নিলো, লাভ হলো না চিৎকারের বেগ বাড়লো।

— তুমি আমায় থামাও? দোষ তোমার! সারাটাজীবন বাইরে বাইরে ঘুরলে তো, দেশ দেশ করে এখন দেখো তোমার ঘরে কি পয়দা হয়েছে।

বলার সাথে সাথে থু ফেললো এক গাদা মুখ থেকে। তারপর আবারও শুরু করলো!

— আমায় থামিয়ে লাভ নেই। তোমার মেয়ের যেদিন পেট বাঁধিয়ে বসবে সেদিন জিজ্ঞেস করো আমি চেচাচ্ছি কেন! নোংরা মেয়ে কোথাকার। রাত বিরাতে নষ্টামি করে বেড়ায়! আমায় বাঁধা দিচ্ছো তো আরো দাও, মোবাইল কিনে দাও। প্রেমিককে ঘরে ডেকে এনে নষ্টামি করুক। এই এই মেয়ে, সত্যি বল, ওই বাজে ছেলের সাথে তুই কয়দিন রাত কাটিয়েছিস। সত্যি বল!

পিয়াশ এইবার কেঁদে দিলো। হেঁচকি তুলছে একটু পরপর। বাড়িটা দশ মিনিট পূর্বেই শান্ত ছিলো। এখন কোলাকল। সুলতানার চিৎকার সাথে কটু ভাষা আর পিয়াশ এর কান্না। আমির বড্ড হোঁচট খেয়েছে ছোট কন্যার এই ধরনের আচরণে। প্রকাশ না করলে রুমে গিয়ে সিগারেট ধরালেন৷ প্রায় দুই মাস পর সিগারেট ধরালেন৷ আগে নেশা ছিলো, কিন্তু ছেড়ে দিলেও ভেতরটা আজ ভালো নেই। দুটো টান দিয়েই বারান্দা ফাকে ফেলে দিলেন। বিছানায় শুয়ে পড়লেন। চোখ দিয়ে অজান্তেই জল গড়িয়ে বালিশ ভিজে গেলো। অল্প বয়সী মেয়েদের প্রেম বিষয়টি বাবাদের জন্য লজ্জাজনক ব্যাপার, তীব্র লজ্জাজনক ব্যাপার। চোখের পানির বাঁধ মানছেনা৷ তাদের বংশে এমন এই প্রথম। সুলতানা সারারাত মেঝেতে বসে ছিলো। আমির শুয়ে থাকলেও সারা রাত ঘুমায়নি। কেঁদেছে, চোখ লাল হয়ে আছে। ফর্সা মানুষের এই দোষ, কাঁদলেই বোঝা যায়। সুলতানা সকাল বেলা চা নিয়ে এসে আমির সাহেবকে দিলো, খেলো না, চুপচাপ রেখে শার্ট পড়ছে। সুলতানা নিরবতা ভেঙে বললো,

— খেয়ে নাও, আদা চা। সারা রাত ঘুমাও নি।

— পিয়াশ, সুপ্তি ওরা ঘুমিয়েছিলো?

— কে জানে! মরুক গে ওরা। খেয়ে না খেয়ে অমানুষ পয়দা করেছি। আমার ভাগ্যই এমন কেন!

— ক্লিয়ার করে বলো তো ওরা কোথায় ছিলো? কোন অবস্থায় দেখেছো?

— আমি এতটুকু বলতে পারবো না৷ শুধু বলছি অনেক খারাপ অবস্থায়। দুজনের মধ্যে এতটুকু ফাঁক ছিল না। সিঁড়ির কোনায়, ওইতো যেখানে গাড়ি টাড়ি থাকে।

— দাঁড়োয়ান ছিলো না গেটে? আসতে দিলো কি করে?

— দাঁড়োয়ানকে একশ দু’শ টাকা দিয়ে কাজ হাসিল করা, ব্যাপার নাকি! তাছাড়া নিজের ঘরের মেয়েই যখন ফষ্টিনষ্টি করে, তখন আর কাওকে দোষ দেওয়া আমার রুচিতে বাঁধে না৷ সবাই ভালো, দোষ আমার, মানুষ করতে পারলাম কই!

আমির সাহেব কিছু টাকা নিয়ে গেলো, দাঁড়োয়ানকে বিদায় করবে। তার মন চাইলো, পুরা দুইশ বুক ডন দেওয়ার পর, বিদায় দিতে পারলে ভালো হত। কিন্তু শাস্তি দিলে মানুষ অন্যায় কি জানতে চায়? কিন্তু অন্যায় কি, সেটা বলা তীব্র লজ্জাজনক। কথাটা ভেবে বুকে চাপ অনুভব করছেন। সারারাত ঘুম হয় নি৷ সিঁড়ির রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে রইলো। নিচের সিঁড়ির কোনটা দেখেই আতকে উঠলেন। কতো লাশ দেখেছেন জীবন, কত অনাচার, কত অবিচার, সেদিনের কোলের বাচ্চা মেয়েটার এই দিন দেখতে মোটেও প্রস্তুতি ছিলো না। তবুও সামলে নিলেন। দাঁড়োয়ান আমির সাহেবকে দেখে সালাম দিলেন, বসা থেকে দাঁড়ালেন। এক গাল হেসে বললেন,

— কেমন আছেন স্যার?

— তোমার ছেলেমেয়ে কয়জন আতাউর মিয়া!

— আল্লাহ পাকের দোয়া তিন কন্যা আর এক পুত্র। কন্যা তিনজনই বড়। পুত্র সবার ছোট। বড় মেয়ের নাম মায়মুনা, তারপরের জনের নাম যমুনা আর তারপরের কন্যার নাম…

— থাক, নাম বলা লাগবে না, আমি যদি ওদের ঘরে দুইশো টাকার পরিবর্তনে ছেলে ঢুকিয়ে দেই, বাবা হিসেবে আমার প্রতি তোমার অনুভূতি কেমন হবে?

আতাউর মিয়া বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। যেন সত্যি ছেলে ঢুকিয়ে দিয়েছে। পকেট থেকে খাম বের করে হাতে দিলো। তারপর আতাউরের হাত ধরে বললো,
— দেশের সবাই আমার ভাই। তুমিও তেমন! আর সামান্য টাকার জন্যে এমন করো না। আশা ককরি বুঝতে পেরেছো তুমি।

আতাউর সাথে সাথে পা ধরে কান্না করলো। মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলো আমির সাহেব। আতাউরের চোখের পানি পায়ে পরেছে। কিন্তু এই ভুলে ক্ষমা হয় না৷ এটাই শাস্তি তার জন্যে। পকেট থেকে আরো পাঁচশ টাকার নোট বের করে বললো,

— এখনি চলে যাবে। আমি নেমোক হারামদের সুযোগ দেই না।

আতাউর মিয়া কদমবুসি করে নিজের ঘরের দিকে এগোলেন। শার্টের হাতা দিয়ে পানি মুছছে। আমির সাহেব যথেষ্ট কঠিন স্বভাবের মানুষ, কিন্তু আতাউরের প্রতি মায়া লাগছে। হয়তো তার প্রশয় থাকলেও ভুলটাতো তার কন্যার। ভুল নয় অন্যায়, এর শাস্তি পেতেই হবে। কথায় আছে, পাপ তার বাপকে ছাড়ে না।

#চলবে

গল্প: ম্যানহোলের_অতলে
পর্ব-১

লিখা : #এম_আর_রাশেদ এবং #মল্লিকা_জাহান

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here