#ভূমধ্যসাগরের তীরে
#পর্বঃ১০(২য় অংশ)
#লেখিকা দিশা মনি
মিষ্টি ইয়াসিনদের বাড়িতে বসে বসে ভাবছিল এখন সে কি করবে। এমন সময় ইয়াসিনের মা ফাতিমা তার জন্য খাবার নিয়ে এলো। তার মুখে মৃদু হাসি। খাবারটা মিষ্টির সামনে রেখে তিনি বিনয়ের সাথে বলে উঠলেন,
“আপাতত ঘরে সেরকম কিছু ছিল না। তুমি এই রুটি আর চিকেন স্যুপ টুকু খেয়ে নাও।”
মিষ্টি হেসে বলল,
“ধন্যবাদ। বিপদের সময় এটাই বেশি। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ আন্টি, আমার জন্য এটার ব্যবস্থা করার জন্য।”
ফাতিমা মিষ্টির পাশে বসে পড়ে বলেন,
“আচ্ছা, মা তুমি হঠাৎ এই দেশে কিভাবে এলে? আর তুমি কি আরবী বোঝ? আসলে আমি ইংরেজিতে কথা বলতে খুব একটা স্বচ্ছন্দ বোধ করি না।”
মিষ্টি বলে,
“সে অনেক কাহিনি৷ তবে আমি আরবি পারি না খুব একটা।”
“বেশ। তাহলে ইংরেজিতেই বলো।”
মিষ্টি এবার হালকা হেসে বলতে শুরু করে,
“আসলে আমি ফ্রান্সে আমার স্বামীকে খুঁজতে এসেছি।”
“স্বামীকে খুঁজতে?”
“আমার স্বামী একজন নেভি অফিসার৷ উনি বাংলাদেশ থেকে কিছু মিশনের কাজে ফ্রান্সের দিকে রওনা দিয়েছিলেন। কিন্তু কিছু দিন আগে আমি খবর পাই ওনার জাহাজ ডুবে গেছে। আর ওনার মৃত্যুর নিশ্চয়তাও দেয়া হচ্ছে। কিন্তু আমি ওনার দেয়া চিঠি পড়ে নিশ্চিত হয়েছি যে উনি হয়তো মারা যান নি। উনি হয়তো বর্তমানে এই মার্সেই শহরেই অবস্থান করছেন। আর এজন্যই আমি ঝুঁকি নিয়ে মার্সেই তে এসেছি। কিন্তু এখানে আসার পর এত ঘটনা ঘটে গেল। আপনার ছেলে ইয়াসিনছিল জন্য আজ আমি একটা আশ্রয় পেলাম। নাহলে আমার কাছে তো আর পাসপোর্ট, ভিসা কিছুই নেই৷ এখানকার পুলিশ যদি আমায় দেখতে পায় তাহলেই নিশ্চয়ই আমায় জেলে ভড়বে।”
ফাতেমা মিষ্টির মাথায় ভরসার হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন,
“এতো টা চিন্তা করিও না মা। আল্লাহর উপর ভরসা রাখো। তিনি নিশ্চয়ই কোন না কোন উপায় খুঁজে বের করে দেবেন। এখন বলো, এই রুমটা তোমার পছন্দ হয়েছে তো?”
“ভীষণ। কিন্তু এই রুমটা..”
“এই রুমটা আমার মেয়ে আমিনার। ও এই রুমে একাই থাকে। এখন থেকে তোমার সাথেই থাকবে।”
“ওহ আমার জন্য ভীষণ সমস্যা হলো বোধহয়। ওর নিশ্চয়ই অনেক সমস্যা হবে।”
‘তেমন না একেবারেই৷ আমার আমিনা আর ইয়াসিন দুজনেই অনেক ভালো মনের। ওরা এমন কিছু ভাববে না। উলটে আমিনা তো অনেক খুশি হবে তোমায় দেখে। ওকে শুধু কলেজ থেকে আসতে দাও।’
ফাতিমা রুমের বাইরে বেরিয়ে যান।
মিষ্টি খাবার শেষ করে রুমের জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। জানালার পর্দা সরিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে সে গভীরভাবে ভাবছিল—আসলেই কি সে এখানে এসে ঠিক করেছে? তার চোখে কেবল একটাই প্রশ্ন—রাফসান কোথায়? তার স্বামী কি সত্যিই বেঁচে আছে?
জানালার বাইরে একটা ছোট্ট বাগান দেখা যাচ্ছিল। সেখানে নানারকম ফুল ফুটে আছে। হালকা বাতাসে ফুলগুলো দুলছে। এই নিস্তব্ধ পরিবেশ যেন কিছুটা হলেও মিষ্টির মনকে প্রশান্তি দিচ্ছিল। কিন্তু তার ভেতরের অস্থিরতা কিছুতেই থামছিল না।
এমন সময় দরজায় ধীরে ধীরে কড়া নাড়ার শব্দ শোনা গেল।
“ভেতরে আসুন,”
মিষ্টি বলতে না বলতেই দরজাটা খুলে গেল। ইয়াসিন দাঁড়িয়ে আছে দরজার কাছে। তার হাতে একটা মোবাইল ফোন।
” এটা আপনার জন্য,” বলে ইয়াসিন মোবাইলটা এগিয়ে দিল।
“এটা কেন? আমার তো নিজের মোবাইল ছিল, কিন্তু… ওটা তো,” মিষ্টি মোবাইলটা ফেলে দেয়ার কথা মনে করে বলল।
“জানি । মা বলেছেন আপনার যেন যোগাযোগের কোনো অসুবিধা না হয়। এই ফোনে আমাদের নম্বর সেভ করা আছে। আর আম্মা বলেছেন আপনার পাসপোর্ট আর ভিসা ফেরত পাওয়ার ব্যবস্থা করার কথা ভাবতে। এখানে কিছু পরিচিত লোক আছে যারা সাহায্য করতে পারবে। যদি ঐ চোরটাকে ধরা যায় তাহলে হয়তো কোন কাজ হলেও হতে পারে।”
মিষ্টি একটু থমকে গেল। এত অচেনা একটা জায়গায় এসে, এমন মানুষদের ভালোবাসা পেয়ে তার ভেতরটা কেমন জানি নরম হয়ে আসছিল।
মিষ্টি বলল,
“আপনার মা এত ভালো… আমি কীভাবে কৃতজ্ঞতা জানাব জানি না।”
ইয়াসিন হেসে বলল,।
“আম্মা এমনই। আপনাকে দুঃখ পেতে দেবেন না। আর আমিনা আসলে আপনার সঙ্গে দেখা করবে। ও খুব উত্তেজিত আপনার কথা শুনে।”
“ও… আমিনার সঙ্গে দেখা করতে আমি বেশ নার্ভাস। ও হয়তো বিরক্ত হতে পারে…”
“আপনার কি মনে হয়? আমিনা খুব মিশুক। সে একদম আপনার সাথে একদম নিজের বোনের মতো ব্যবহার করবে। চিন্তা করবেন না না,”
ইয়াসিন এটা বলে মিষ্টিকে আশ্বস্ত করল।
এই সময় ফাতিমা রুমে ঢুকে বললেন, “মা, বিকেল হয়ে যাচ্ছে। তুমি একটু বিশ্রাম নাও। সারাদিন এত কিছু ঘটল, তোমার শরীর তো ক্লান্ত। কাল সকালে সব ঠিকভাবে পরিকল্পনা করা যাবে।”
মিষ্টি ধীরে মাথা নাড়ল। কিন্তু তার মনে শান্তি নেই। বিশ্রাম নিলেও তার দুশ্চিন্তা তো দূর হবার নয়। মিষ্টি দীর্ঘ শ্বাস ফেলল।
এদিকে হঠাৎ করে ইয়াসিন নিজের ফোনের দিকে তাকিয়ে বিরক্ত হলো। ফাতিমা ইয়াসিনের চেহারায় হঠাৎ এই বিরক্তি খেয়াল করে বললেন,
“কি হয়েছে ইয়াসিন? তোমায় হঠাৎ এত বিরক্ত লাগছে কেন?”
ইয়াসিন বলে ওঠে,
“মিস্টার ল্যুঁইয়ের ছোট মেয়ে!”
ফাতিমা হেসে বলে,
“এলিস! মেয়েটা তো অনেক ভালো। কি হলো আবার ওকে নিয়ে?”
ইয়াসিন বিরক্ত স্বরে বলে,
“এই মেয়ে টা আমায় বিরক্ত করে মারবে। আম্মা তুমি প্লিজ মিস্টার ল্যুঁইকে বলে দিবে যেন উনি ওনার মেয়েকে আমায় বিরক্ত করতে বারণ করেন৷ আজ আবারো এই মেয়ে আমার ক্যাব বুক করেছে। প্রতিদিনই এমন করে ও। শুধু শুধু ক্যাব বুক করে গোটা মার্সেই শহর ঘুরে বেড়ায়। ”
“তাতে অসুবিধা কি? তোমায় ইউরো তো দেয়!”
“আম্মা! কথাটা ইউরোর নয়। আমি মেয়েটার হাবভাব দেখে বুঝি৷ ও আমার থেকে কি চায়…”
“তুমি তো জানোই ইয়াসিন..যখন আমরা এই দেশে প্রথম আসি তখন মিস্টার ল্যুঁই আমাদের কতই না সাহায্য করেছেন। আমি তো ওনার গ্রোসারি শপেই কাজ করি। তোমাদের পড়াশোনা, বড় করে তোলা এসবেও তো উনি কম সাহায্য করেন নি৷ আর ওনার বড় মেয়ে এলিজা একটু অহংকারী টাইপের হলেও এলিস মেয়েটা তো অনেক ভালো।”
“তা নিয়ে সংশয় নেই৷ কিন্তু আমি সেইটার শোধ দিতে নিশ্চয়ই একটা খ্রিষ্টান মেয়েকে বিয়ে করবো না!”
ফাতিমা বিরক্ত স্বরে বলেন,
“মেয়েটা তোমাকে অনেক ভালোবাসে। তোমার জন্য কিন্তু ও মুসলিম হতেও প্রস্তুত।”
ইয়াসিন বলে,
“মুসলিম হলে আল্লাহর জন্য হোক,আমার জন্য নয়।”
বলেই সে বিরক্ত মুখ নিয়ে চলে যায়। এদিকে মিষ্টি হতবাক হয়ে ইয়াসিনের যাওয়ার দিকে চেয়ে থাকে। ফাতিমা মিষ্টির উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“এটা অনেক বড় কাহিনি। রাতে এখন তোমায় বলব।”
মিষ্টি বুঝতে পারে ফাতিমা নামক মহিলাটা বেশ অনেকটাই মিশুক। নাহলে সামান্য পরিচয়েই কিনা তাকে নিজের পরিবারের এত গোপন কথা বলতে চাইছে।
এদিকে ইয়াসিন গাড়ি নিয়ে এসে দাঁড়াই ল্যুঁই প্যালেসের সামনে৷ কিছু সময় পর ফ্রেন্স কোর্ট আর মিনি স্কাট পড়ে এক শ্বেতাঙ্গ তরুণী এসে দাঁড়ায় তার ক্যাব এর সামনে। ইয়াসিন গেইটটা খুলেই চোখ ফিরিয়ে নেয়। এলিস সামান্য হেসে বলে,
“আমার দিকে দেখলেও না।”
“সময় নেই।”
এলিস ক্যাবে বসে বলে,
“তাহলে আজ আমায় কই নিয়ে যাবে? আমি কিন্তু ৩ ঘন্টার জন্য তোমায় বুক করেছি।”
“জাহান্নামে।”
“তোমার সাথে জাহান্নামে যেতেও রাজি।”
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨