ভূমধ্যসাগরের তীরে #পর্বঃ১২(ধামাকা) #লেখিকা:দিশা মনি

0
49

#গল্প_ভূমধ্যসাগরের তীরে
#পর্বঃ১২(ধামাকা)
#লেখিকা:দিশা মনি

মিষ্টি সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে পড়ল। সে মার্সেইতে আসার পর এখন প্রায় এক সপ্তাহ হয়ে গেছে তবে তার পাসপোর্ট ও ভিসা ফেরত পাবার কোন ব্যবস্থা এখনো হয় নি। তাই বেশিরভাগ সময় তাকে ইয়াসিনদের বাসায় গৃহবন্দী হিসেবেই থাকতাম হয়। আমিনার সহচার্যে যদিও তার বেশ ভালো সময় যায় কিন্তু তবুও মনের মাঝে একটা খুতখুতানি তো থেকেই যায়। তাছাড়া সে যেই উদ্দ্যেশ্যে মার্সেইতে এসেছিল সেই উদ্দ্যেশ্যও তো সেভাবে সফলতার মুখ দেখল না। এসব ভেবেই হাফ ছাড়লো মিষ্টি। এখন সে সবকিছুই ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিয়েছে। নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগছে তার। বর্তমানে মিষ্টি ইয়াসিনের দেয়া মোবাইল ফোনটা নিয়ে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আছে। তার মনে আসছে হাজারো প্রশ্ন। মিষ্টি ভাবছিল এখন কি তার পরিবারের সাথে যোগাযোগ করা উচিৎ? তারা নিশ্চয়ই মিষ্টির জন্য চিন্তা করছে৷ কিন্তু পরক্ষণেই রাফসানের চিঠিতে লেখা কথাগুলো পড়ে সে নিজের মত বদলে নেয়। স্বগতোক্তি করে বলে,
“আরো কিছু দিন দেখি আগে, যদি উনি এরমধ্যে এসে আমার সাথে দেখা করেন। যদি কোন ভাবে ওনার দেখা পেয়ে যাই! আমার এত সহজে কিছুতেই হাল ছাড়লে চলবে না। মিস্টার রাফসান শিকদারের মুখোমুখি আমি হবোই।”

মিষ্টির এই ভাবনার মাঝেই তার রুমের দরজায় এসে কড়া নাড়ল কেউ। মিষ্টি পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখে ফাতিমা বিবি দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি আলতো হেসে বললেন,
“ভেতরে আসবো?”

মিষ্টিও বিনিময়ে একটা সুন্দর হাসি দিয়ে বলে,
“জ্বি, আসুন।”

ফাতিমা বিবি মিষ্টির কক্ষে প্রবেশ করে চারিদিকে নজর বুলিয়ে বলেন,
“তোমার এখানে থাকতে কোন সমস্যা হচ্ছে না তো? কোন সমস্যা হলে বলতে পারো। এমনও তো হতে পারে আমাদের তরফ থেকে কোন গাফিলতি হচ্ছে।”

“না, আপনারা আমার জন্য যা করেছে তাই অনেক। আমি এরজন্য চিরকৃতজ্ঞ থাকব। আপনারা না থাকলে যে আমার কি হতো এই অচেনা অজানা শহরে।”

“এমন কথা বলতে নেই মা। আল্লাহ আছেন তো। বান্দার বিপদে উনি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন সবসময়। হয়তো উনিই তোমাকে আমাদের কাছে পাঠিয়েছেন। আমরা তো সেটা মনে করেই তোমায় সাহায্য করছি।”

ফাতিমা বিবির মুখে এমন কথা শুনে মিষ্টির ভীষণ ভালো লাগে। এরইমধ্যে আমিনা ছুটতে ছুটতে হাতে দুটো গ্রাউন নিয়ে এসে বলে,
“আম্মা, দেখো তো এটা মিষ্টি আপুকে মানাবে কি না?”

মিষ্টি অবাক স্বরে বলে,
“এটা কি?”

ফাতিমা বিবি হেসে বলেন,
“এটা হচ্ছে ফ্রেঞ্চ গাউন। তুমি এটা পড়ে নাও। আমিনা আর তোমার জন্য এগুলো আমি আনিয়েছি।”

“কিন্তু এসবের কোন দরকার ছিল না। এমনিতেই আপনারা অনেক করেছেন আমার জন্য।”

ফাতিমা বিবি হালকা হেসে বলেন,
“আরে নিয়ে নাও এগুলো। আমার গ্রোসারি শপের মালিক মিস্টার ল্যুঁইয়ের বড় মেয়ে এলিজার এনগেজমেন্ট হবে আজ। এজন্যই তো উনি আমাদের সবাইকে ইনভাইট করেছেন। এমনকি আমাদের সবাইকে শপিং করার জন্য বেতনের সাথে বোনাসও দিয়েছেন। বোনাসে পাওয়া ইউরো দিয়েই তো আমি সবার জন্য এসব কিনে আনলাম।”

মিষ্টি কিছুটা বিব্রতবোধ করে বলে,
“কিন্তু আমি হঠাৎ এভাবে কিভাবে যাব..আমি তো ওনাদের চিনিও না। না জানি ওনারা কি ভাববেন।”

আমিনা বলে ওঠে,
“তুমি এত চিন্তা করো না আপু। ল্যুঁই আঙ্কেল অনেক ভালো মানুষ। ওনার সাথে যখন কথা বলি তখন মনেই হয়না আমি ওনার শপের একজন কর্মচারীর মেয়ে। দেখবে উনি তোমাকেও আপন করে নেবে।”

‘কিন্তু..’

মিষ্টিকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফাতিমা বিবি বলে ওঠেন,
“কোন কিন্তু নয়৷ আজ রাতে আমরা সবাই যাব মিস্টার ল্যুঁইয়ের বাড়ি৷ তুমিও যাবে আমাদের সাথে আর এটাই ফাইনাল।”

মিষ্টি আর না করতে পারল না। এমন সময় ইয়াসিন সেখানে এসে বলল,
“কোথায় যাবার কথা হচ্ছে?”

ফাতিমা বললেন,
‘মিস্টার ল্যুঁইয়ের মেয়ে এলিজার এনগেজমেন্ট আজ। ওখানেই আজ রাতে আমরা সবাই যাব।’

“এলিজা মানে মিস এলিসের বড় বোন? আমি যেতে পারবো না।”

ফাতিমা বিবি মনোক্ষুণ্ণ হয়ে বলেন,
“এমন ভাবে বলছ কেন?”

“আম্মা তুমি খুব ভালো করেই জানো আমি কেন না করছি। ওখানে গেলেই আবার ঐ এলিসের মুখোমুখি হতে হবে। আমি আর বিব্রত হতে চাই না।”

ফাতিমা বিবি স্পষ্ট করে বলেন,
“আমি কিছু শুনতে চাই না ইয়াসিন৷ তুমি আজ আমাদের সাথে যাচ্ছ আর এটাই ফাইনাল।”

ইয়াসিন একটা হতাশার শ্বাস ফেলে। তার মাকে আর বুঝিয়ে লাভ নেই৷ তাই অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাকেও রাজি হতে হয়।

★★★
রাত্রিবেলা যথাসময়ে ল্যুঁই প্যালেসে হাজির হয় সবাই৷ ফাতিমা বিবিকে আসতেই দেখেই মিস্টার ল্যুঁই সবিনয়ে এগিয়ে এসে বলেন,
“আরে মিসেস ফাতিমা বিবি..আসুন এদিকে বসুন।”

ওনার ব্যবহার দেখে কেউ বুঝবেই না যে ফাতিমা বিবি ওনার গ্রোসারি শপের একজন কর্মচারী। এতটাই সম্মান উনি ফাতিমা বিবিকে দিলেন। ফাতিমা বিবি সহাস্যে এগিয়ে যান। মিষ্টি আমিনার পাশেই ছিল। সে চারিপাশের সাজসজ্জা দেখায় ব্যস্ত ছিল। এখানে বেশ খানিকটা অস্বস্তি বোধ হচ্ছে তার। মাথায় দেয়া হিজাবটা বারবার ঠিক করছিল।

ইয়াসিন একটু পেছনে পেছনে আসছিল। হঠাৎ করে এগিয়ে আসতে গিয়ে ইয়াসিন কারো একটা সাথে ধাক্কা খায়। ধাক্কা খাওয়া ব্যক্তিটি পড়ে যেতে নিতেই ইয়াসিন তাকে ধরে নেয়।

ইয়াসিন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে এলিসের দিকে। সে আজ একটি লং গ্রাউন পড়েছে। সেরকম একটা মেকআপও করেনি৷ এরকম ল্যাচারাল লুকে অনেক সুন্দরী লাগছে তাকে। যে কেউ দেখলে চোখ ফেরাতেই পারবে না। কিন্তু ইয়াসিন বেশিক্ষণ তাকালো না এলিসের দকে। দ্রুত মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলে,
“দেখে চলতে পারেন না? এক্ষুনি তো পড়ে যেতেন।”

এলিস আলতো স্বরে বলে,
“সামলানোর মানুষ থাকলে দেখে চলতে হয়না।”

ইয়াসিন রেগে সামনের দিকে যায়। এলিস একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে৷ এই নির্দয় পুরুষটা সবসময় তাকে এভাবেই এড়িয়ে চলে৷ যবে থেকে সে তার ভালোবাসা প্রকাশ করেছে তবে থেকেই এমন অবহেলার স্বীকার সে।

এলিসের ভাবনার মাঝেই আমিনা এগিয়ে এসে বলল,
“সিস্টার এলিস! তুমি কেমন আছ?”

এলিস সহাস্যে বলে,
“ভালো আছি। তুমি?”

“আমিও আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।”

এলিস আমিনার পাশে দাঁড়ানো মিষ্টির দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে বলল,
“এই মেয়েটি কে?”

মিষ্টির অস্বস্তি বাড়ে। আমিনা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বলে,
“উনি তো আমার কাজিন হন। আমাদের সাথে দেখা কর‍তে মার্সেইতে এসেছেন।”

“ওহ।”

এলিস মিষ্টির সাথেও হেসে কথা বলে এবং ভালো মন্দ জানতে চায়। মিষ্টির অস্বস্তি অনেকটা কেটে যায়। সে বুঝতে পারে এলিস মেয়েটা বেশ ভালো মনের। একদম বাবার মতোই বিনয়ী আর মিশুক।

এদিকে হঠাৎ করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসে অতীব সুন্দরী এক রমণী। মিষ্টি সেদিকে তাকায়৷ চেহারাটা অনেকটা এলিসের মতোই তবে নীল চোখ, চওড়া নাক, ভি শেপেড মুখ আর সুবিন্যস্ত মুখবিবর বিশিষ্ট এই রমণীর সৌন্দর্য যেন এলিসের থেকে অনেক বেশি।

আমিনা মিষ্টির কানে কানে বললো,
“এই হলো এলিজা ল্যুঁই। মিস্টার পেত্রো ল্যুঁইয়ের বড় মেয়ে।”

মিষ্টি কিছু বলবে এমন সময় একটা যুবক এগিয়ে এসে এলিজার হাত ধরে। যুবকটির দিকে তাকাতেই মিষ্টি হতবাক হয়ে যায়। মাথায় ব্রাউন চুল, নীল চোখ কিন্তু চেহারা..এই চেহারা তো মিষ্টির ভীষণ চেনা। কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব?

এলিস বলে,
“এই হলো পুলিশ ইন্সপেক্টর ইমানুয়েল পল। আমার বড় বোনের ফিয়ন্সে।”

মিষ্টি হতবাক স্বরে বলে ওঠে,
“উনি তো হুবহু রাফসান শিকদার!”

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here