#গল্প_ভূমধ্যসাগরের তীরে
#পর্বঃ১৩
#লেখিকা:দিশা মনি
মিষ্টি অবাক হয়ে দেখছিল রাফসান সদৃশ যুবকটির দিকে। সবকিছুই এক! দুটো মানুষের মধ্যে কি এত মিল সম্ভব? কিন্তু এই লোকটা তো একজন বিদেশী নাগরিক, শারীরিক গঠনও সেই ইঙ্গিত দিচ্ছে। কিন্তু মিষ্টির কেন জানি মনে হচ্ছে এই ইমানুয়েল পলই রাফসান শিকদার৷
এদিকে মিস্টার ল্যুঁই এগিয়ে এসে ঘোষণা দিলেন,
“আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ আজ এখানে উপস্থিত হওয়ার জন্য। যেমনটা আপনারা সবাই জানেন, আজ আমার আদরের বড় মেয়ে এলিজার সাথে ওর বয়ফ্রেন্ড ইমানুয়েল পলের এনগেজমেন্ট। আপনাদের সবাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ এখানে উপস্থিত হয়ে আজকের সুন্দর দিনটিকে আরো বিশেষ করে তোলার জন্য। এখন এনগেজমেন্ট অনুষ্ঠানের মূল আনুষ্ঠানিকতা শুরু হবে। আপনারা সবাই উপভোগ করুন।”
বলেই তিনি এলিজার মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। একইসাথে ইমানুয়েল পলকে উদ্দ্যেশ্য করে বলেন,
“এবার রিংটা আমার মেয়ের হাতে পড়িয়ে দাও।”
ইমানুয়েল পল নিজের পকেট থেকে একটা ডায়মন্ড রিং বের করে এলিজার হাতের দিকে এগোতে থাকে। রিংটা পড়িয়ে দিতেই যাবে এমন সময় মিষ্টি ছুটে এসে পলকে নিজের দিকে টেনে নেয়। এই ঘটনায় পলসহ উপস্থিত সবাই অবাক হয়ে যায়। ইয়াসিন একটু দূরে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখে হতবাক হয়ে বলে,
“কি করছেন টা কি মিসেস মিষ্টি!”
ইমানুয়েল পল মিষ্টির দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে বলে,”হোয়াট দা হেল? মানে কি এসবের?”
মিষ্টি কিছু বলতে যাবে তার আগেই এলিজা ক্ষিপ্ত গতিতে এগিয়েছিল এসে মিষ্টির থেকে পলকে আলাদা করে বলে,
“এই মেয়ে, কে তুমি? তোমার সাহস কি করে হলো আমার এনগেজমেন্টে এরকম সমস্যা সৃষ্টি করার?”
মিষ্টি দমে গেল এলিজার শক্ত কন্ঠস্বরের সামনে। তার চোখ তখনো পল নামক ব্যক্তিটার দিকে স্থির। তার চোখে বিরক্তি আর ক্রোধ লক্ষ্য করে মিষ্টির মনটা হাহাকার করে উঠল। তাহলে কি সে ভুল ভেবেছে? এই লোকটা কি তাহলে সত্যিই এক ভিন্ন মানুষ? মিষ্টির মনে এই প্রশ্নই ঘুরতে লাগল। এলিজার ক্রোধ বাড়ছিল। সে চিৎকার করে বলে ওঠে,
“সিকিউরিটি..কোথায় তোমরা? এক্ষুনি এই মেয়েটাকে বের করে দাও এখান থেকে।”
ফাতিমা বিবি এবার এগিয়ে এসে বলেন,
“আমি ওর তরফ থেকে ক্ষমা চাইছি। আসলে ও এখানে নতুন তো তাই কিছু বুঝতে পারেনি। মিষ্টি মা, তুমি এসো আমাদেরও সাথে।”
এলিজা এমনিতেই ফাতিমাদের খুব একটা পছন্দ করে না। তাই সে আরো গলা খাকারি দিয়ে বলে,
“আপনারা এই সমস্যাটাকে এখানে নিয়ে এসেছেন? এই জন্যই আমি পাপাকে নিষেধ করেছিলাম কোন লো ক্লাস লোককে আমার এনগেজমেন্টে ইনভাইট না করতে।”
এলিস নিজের বোনের কথায় প্রতিবাদ করে বলে,
“সিস্টার এলিজা, তুমি ওনাদের এভাবে বলতে পারো না। ওনারা আমাদের গেস্ট।”
এলিজা এমনিতেই রেগে ছিল। এলিসের কথায় আরো রেগে বলে,
“গেস্ট মাই ফুট, দে আর নাথিং বাট পোর আনকালচার রিফিউজি।”
ইয়াসিনের ধৈর্যের সীমা পেরিয়ে যায়। সে বলে ওঠে,
“ব্যস, অনেক বলে নিয়েছেন আপনারা। আম্মা তুমি এখনো এখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন? এক্ষুনি এখান থেকে চলো। আমি আর এক মুহুর্তও এখানে থাকতে চাই না।”
বলেই ইয়াসিন হনহন করে বেরিয়ে যায়। ফাতিমা বিবি মিস্টার ল্যুঁইয়ের কাছে গিয়ে বলেন,
“সবকিছুর জন্য দুঃখিত মিস্টার ল্যুঁই। কিছু মনে করবেন না।”
মিস্টার ল্যুঁই লজ্জিত স্বরে বলেন,
“আপনি ক্ষমা চাইছেন কেন? আমার তো নিজের মেয়ের ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চাওয়া উচিৎ। এলিজা এদিকে এসো ক্ষমা চাও ওনাদের থেকে।”
এলিজা তবু ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে৷ মিস্টার ল্যু্ঁই বলেন,
“তবে যাইহোক, আপনাদের সাথে আসা ঐ মেয়েটি কিন্তু ভুল করেছে। তবে আপনাদের সাথে এলিজার ব্যবহারের জন্য আমি ওর তরফ থেকে ক্ষমা চাইছি।”
ফাতিমা বিবি আর এক মুহুর্ত অপেক্ষা না করে আমিনা ও মিষ্টিকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে আসতে থাকে। বের হবার আগে মিষ্টি আরো একবার তাকায় ইমানুয়েল পল নামক ব্যক্তিটার দিকে। পলও তার দিকে অবাক চোখেই তাকিয়ে ছিল। মিষ্টি মনে মনে বলে,
“এই লোকটা কি সত্যিই ভিন্ন কেউ? কিন্তু আমার মন কেন বলছে যে ইনিই রাফসান শিকদার!”
★★★
মিষ্টি ল্যুঁই প্যালসের বাইরে এসেই নত স্বরে ফাতিমা বিবির উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“আমি ক্ষমাপ্রার্থী। আজ আমার জন্য আপনাদের এতো অপমানিত হতে হলো।”
ফাতিমা বিবি বলেন,
“নাহ, তুমি এসব নিয়ে কিছু ভেবো না।”
আমিনা বলে ওঠে,
“আম্মা ঠিকই বলেছে। ঐ এলিজা মেয়েটা তো এমনই। ও সবসময় এমন ব্যবহার করে। সিস্টার এলিস কত ভালো কিন্তু ও..”
ফাতিমা বিবি বলেন,
“থাক এসব কথা। আচ্ছা, মিষ্টি তুমি আমায় একটা কথা বলো। তুমি হঠাৎ করে মিস্টার পলকে ওভাবে টেনে আনলে কেন? তুমি কি ওনাকে চেন? আগে কোথায় দেখেছ?”
আমিনা বলে ওঠে,
“কিন্তু মিষ্টি আপু ওনাকে কিভাবে চিনবে? ও তো মার্সেই শহরে নতুন।”
মিষ্টি নিজের ভাবনায় ব্যস্ত ছিল৷ ফাতিমা বিবি বলে ওঠেন,
“কি হলো? কিছু বলো।”
মিষ্টি কিছু বলতে যাবে এমন সময় হঠাৎ করেই ইয়াসিন সেখানে এসে বলে,
“তোমরা এখনো দাঁড়িয়ে আছ কেন? চলো, আমাদের তো বাসায় ফিরতে হবে। তার আগে তো আবার রাতে ডিনারের ব্যবস্থাও করতে হবে। বাড়িতে তো কিছু রান্না হয়নি। চলো সবাই আজ কোন রেস্টুরেন্টে ডিনার করে নেই।”
কথাটা বলেই সে মিষ্টির দিকে তাকিয়ে বলে,
“আপনার সাথে কিছু জরুরি কথা আছে,,”
এমন সময় হঠাৎ করেই এলিস ছুটতে ছুটতে সেখানে চলে আসে৷ এলিসকে দেখামাত্রই ইয়াসিনের ভাবভঙ্গিমা শক্ত হয়ে যায়। এলিস এসেই ইয়াসিনকে বলে,
“সিস্টার এলিজার কথায় কিছু মনে করো না। আমি ওর তরফ থেকে ক্ষমা চাইছি।”
ইয়াসিন তাচ্ছিল্যের স্বরে বলে,
“কি বলছেন টা কি আপনি? কোথায় আপনি হলেন ল্যুঁই প্যালসের প্রিন্সেস আর কোথায় আমরা পোর আটকালচার রিফিউজি! আপনার কি আমাদের কাছে ক্ষমা চাওয়া মানায়?”
এলিস করুণ স্বরে বলে,
“ইয়াসিন, আমার কথাটা শোন..”
” আমি আর কিছু শুনতে চাই না। মা, আমিনা তোমরা দাঁড়িয়ে রইলে কেন? চলো এক্ষুনি। আর মিষ্টি আপনিও চলুন।”
সবাই সামনের দিকে পা বাড়াতে লাগল। এলিস সেখানে দাঁড়িয়ে থেকেই একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলল।
★★
এলিজা নিজের হাতে জ্বলজ্বল করতে থাকা ডায়মন্ড রিংটা দেখছিল। তার আজ ভীষণ খুশি অনুভূত হচ্ছে। যদিও মাঝখানে কিছু ঘটনার জন্য তার ভীষণ রাগ হচ্ছিল তবে এখন তার মেজাজটা অনেকটাই ফুরফুরে।
ইমানুয়েল পল একটু দূরেই বসে কি যেন ভাবছে। এলিজা পলের পাশে গিয়ে বলে,
“কি ব্যাপার? কি ভাবছ তুমি?”
পল বলে ওঠে,
“ভাবছিলাম ঐ মেয়েটার কথা।”
এলিজা বিরক্ত স্বরে বলে,
“ঐ মেয়েটা! ঐ ডার্টি রিফিউজির কথা বাদ দাও। তুমি আমাকে, আমাদের সামনের সম্পর্কটা নিয়ে ভাব। আজ আমাদের এনগেজমেন্ট হলো, খুব শীঘ্রই আমরা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হবো। আমি তো ভাবতেই পারছি না।”
পল নিজের হাতে জ্বলজ্বল করতে থাকা রিংটার দিকে তাকায়। অতঃপর আবারো মিষ্টির চেহারাটা মনে করে। মিষ্টি মুখজুড়ে ছিল বিস্ময়, তার চোখে যেন ছিল হাজারো প্রশ্ন। পল নিজের হাতের রিংটার দিকে তাকিয়ে থেকেই বলে,
“আমার ঐ মেয়েটার সাথে দেখা করা দরকার। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, ওর সাথে সেখা করাটা ভীষণ প্রয়োজনীয়।”
এলিজা আবারো বিরক্তি নিয়ে বলে,
“উফ! তুমি ঐ মেয়েটাকে নিয়ে এত ভাবছ কেন পল?”
পল এবার খানিক গম্ভীর স্বরে বলে,
“ভাবছি কারণ আমি একজন পুলিশ ইন্সপেক্টর। আমাকে সব বিষয়াদি নিয়েই ভাবতে হবে। আমার কাছে মেয়েটাকে খুব একটা সুবিধাজনক লাগে নি। মেয়েটার মাঝে কোন তো রহস্য অবশ্যই আছে। আমাকে সেই রহস্য ভেদ করতে হবে।”
এলিজা এবার খানিক গম্ভীর স্বরে বলে,
“এমনও কি হতে পারে যে মেয়েটা কোন ক্রিমিনাল?”
পল বলে,”হতেই পারে। আমি ব্যাপারটা খোঁজ নিয়ে দেখছি। যদি মেয়েটা সত্যিই কোন অপরাধী হয় তাহলে ওর যায়গা হবে কারাগারে!”
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨