গল্প: ম্যানহোলের_অতলে পর্ব-৫

0
876

গল্প: ম্যানহোলের_অতলে
পর্ব-৫
লিখা : #এম_আর_রাশেদ এবং #মল্লিকা_জাহান

আয়ান যদিও ঠিকানা সংগ্রহ করে নিয়েছে তবু ওখানকার একটা ছেলেকে বাইকের পেছনে বসিয়ে তাওয়াফের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। পথিমধ্যে দেখে এক মাঝ বয়সী মহিলা রাস্তায় এক্সিডেন্ট হয়ে পড়ে আছে। চারদিকে লোকজনের ভীর। বিচিত্র মানুষগুলো। কেউ ছবি তুলছে কেউ বা ভিডিও করতে ব্যস্ত। অথচ মানুষটা যে চিকিৎসাহীন মৃত্যু কোলে ধলে পড়ছে সেদিকে কারো ভ্রুক্ষেপ নেই। আবার এরাই ছবিগুলো দিয়ে ফেইসবুক টাইমলাইনে পোস্ট করবে কি মর্মান্তিক দূর্ঘটনা! এমন দূর্ঘটনা যেন আমাদের না হয়।
ধিক্কার! সমাজ এদের থেকে কি শিখবে? আদর্শগত মানদণ্ডে কি করে দাঁড়াবে?
আয়ান বাইকটা থামিয়ে কাছে গিয়ে দেখে পালস রেট চলছে। চিকিৎসা হলে এখনও হয়তো বাঁচানো সম্ভব। সে সিভিলে এসেছিল বোঝার উপায় নেই পুলিশ কর্মকর্তা। পরক্ষণে তার পরিচয় দেয় সবার সম্মুখে। কয়েকজন লোককে ডেকে একটা গাড়ি ঠিক করে তাকে হসপিটালে পাঠিয়ে দেয়।
উৎসুক জনতার উদ্দেশ্য আয়ান এবার ধীরকন্ঠে বললো;

— তামাশা দেখা শেষ? না-কি আরও বাকি আছে, দেখবেন?

পাশে থেকে একজন বলে উঠলো;

— স্যার এটাও তো একটা ঝামেলা, এক্সিডেন্টের বিষয়। গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া। ভর্তি করা, পরিবারের কে আছে খোঁজ নেওয়া। তারপর বাঁচবে কি মরবে নিশ্চয়তা নাই। নিজের খাইয়া পরের জন্য এতো কে করে স্যার। তার চেয়ে নীরব হয়ে দেখা বৈ উপায় কি?

— বাহহ! চমৎকার সত্যিটা উপস্থাপন। এর চেয়ে বরং তামাশা দেখাই উত্তম পন্থা। যদি মানুষটা বেঁচে যায় তাহলে তো তামাশা শেষ। যদি মারা যায় তবে নতুনত্বের স্বাদ পাবেন। চল্লিশার সময় পেটপুরে খেয়ে, মুখে মিঠা পান গুঁজে আফসোস করার জন্য একটা ইস্যু পাবেন। বলবেন, মানুষটা ভালো ছিল। কিন্তু হায় আফসোস অকালে চলে গেলো!
যেন অকাল চলে যাওয়ার দুঃখ সশব্দে উচ্চ থেকে নিন্ম স্থলে এসে কুঁকড়ে যাচ্ছে।
এই হলো আমাদের সমাজের প্রতিচ্ছবি। আমরা সস্তা আবেগ দিয়ে মুখের বুলি ফোটাতে পারি। দুঃখ প্রকাশের ঝুড়ি নিয়ে নিজের স্যোশাল মাধ্যমের অফুরন্ত জায়গা ভরাতে পারি।
আর কাজের বেলায় মুর্তির মতো দাড়িয়ে, প্রফেশনাল ফটোগ্রাফারদের মতো ছবি তোমাল মাঝেই সীমাবদ্ধ। এইযে রাস্তার কোল ঘেসে ফুটপাত দিয়ে যেসব কোমলমতি স্কুলের ছেলে মেয়েরা অহরহ যাচ্ছে তারা কি শিখছে আপনাদের কাছ থেকে বলতে পারেন? তারা শিখছে বিপদে পড়লে এড়িয়ে যাও, দুঃখ প্রকাশ করেই সীমাবদ্ধতা রাখো ওটাই নৈতিকতা। একজন মানুষ এক্সিডেন্টে মুমূর্ষু অবস্থায় রাস্তায় পড়ে আছে। তাকে হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করলে বেঁচেও তো যেতে পারে। আরে ভাই আজ অন্যজন, কাল আমি, পরশু আপনিও তো এভাবে পড়ে থাকতে পারেন। তখন দেখবেন আপনার আর্তনাদও বৃথা, কেও আগাবেনা। সমাজকে আপনি যেই বিরূপ আচরণ করবেন, আপনিও সেই আচরণের স্বীকার হবেন। আজ আপনি সাহায্য পরায়ণ হলে, কাল সমাজ আপনার সমাজ আপনার প্রতি সাহায্য পরায়ণ হবে। আপনার নৈতিক আচরণ শুধু আপনার জন্য না, পরিবার সমাজ পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রের জন্য সুফল বয়ে আনবে। পরিবারের অন্যরাও শিখবে, একটা শিশু বিদ্যালয়ের থেকেও বড় নৈতিকতার শিক্ষা অর্জন করে একটি আদর্শ পরিবার থেকে। এই ব্যবহারে আপনার পরিবার কি শিখতে পারে প্রশ্ন রেখে গেলাম!

সবাই অকপটে মাথানিচু করে রইলো। নিরুত্তরেই ভীরের জড়তা কাটতে লাগলো। আয়ান বাইকে চাবি দিয়ে সেই ছেলেটিকে পেছনে বসিয়ে আবার চললো তাওয়াফের বাড়ির উদ্দেশ্য।
বাড়ির সামনে বাইক থামিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লো। সে বিছানায় বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। তাওয়াফের বাবা নেই। স্ট্রোকে তার অকাল মৃত্যু হয়। অবশ্য ওদের মোটামুটি অর্থসম্পদ থাকায় চলতে অসুবিধা হয় না। আরও সম্পদশালী ছিল বটে। কিন্তু বাজে নেশা এবং সঙ্গদোষে পড়ে অপচয় করেছে আর এখনও করে চলেছে। তাওয়াফের মা এই বিষয় সম্পর্কে অবগত, কিন্তু অবাধ্য ছেলে হলে যা হয়। মায়ের কথা তো শোনেই না বরং বাজে ব্যবহারও করে।
আয়ান তাওয়াফকে কিছুক্ষণ ডাকলো কিন্ত সে-তো বেঘোরে ঘুমাচ্ছে, ওঠার নাম গন্ধও নেই। সঙ্গের সেই ছেলেটাকে বললো এক গ্রাস পানি নিয়ে আসতে। আয়ান গ্লাস ভর্তি পানির জোড়ালো ঝাঁপটা মুখের উপর মারতেই তাওয়াফ আচমকা লাফ দিয়ে উঠে পড়ে। আয়ানের দিকে তাকিয়ে ভরকে যায়। দেখেই বোঝা যায় তাওয়াফ মদ্যপ ছিল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আয়ান প্রশ্ন ছুড়ে দেয়;

— পিয়াশকে চিনিস?
— হ্যাঁ চিনি, কিন্তু আপনি কে? আর আমার বাড়িতে ঢুকে মুখ পানি ঝাঁপটে দেওয়ার সাহস হলো কি করে আপনার?

— আমি কে সেটা ছাড়। আগে বল পিয়াশকে কেনো মারলি? ও তোর কি ক্ষতি করেছিল? কেনো পৈচাশিক ভাবে ওইটুকু মেয়েকে হত্যা করলি?

ওইটুকু শোনা মাত্রই তাওয়াফ রক্তচক্ষু নিয়ে আয়ানের দিকে তাকায়। প্রতুত্তরে বল;

— কে রে তুই? আমি নিজেও এই বিষয়টা নিয়ে ডিপ্রেসড। ওর আত্মহত্যা হয়েছে শুনে আমিই ভেঙে পড়েছি। ওর সাথে আমার সম্পর্ক ছিল। মৃত্যুর কথা শুনে আমিই ভেঙে পড়েছি আর তুই এসেছিস আমাকে জেরা করতে।

এই কথা বলেই আয়ানের কলার ধরতে যাবে ঠিক সেই মুহুর্তে ঠাস, ঠাস, দুটো শব্দ হলো। আয়ান কসিয়ে দুটো থাপ্পড় মারে। থাপ্পড়ের ভার সইতে না পেরে নীচে পড়ে যায়। তাওয়াফ চমকে যায়। যার কথা এই পাড়ার ছেলেরা ওঠাবসা করে তার গায়েই কি-না হাত!
হঠাৎ টিশার্ট আর লুঙ্গি পড়া একটা অল্প বয়সী ছেলে নাম তার রতন, সে বাড়ির সামনে এসে তাওয়াফ ভাই, তাওয়াফ ভাই বলে চিৎকার দিও ডাকতে লাগলো। সাড়া শব্দ না পেয়ে সোজা বাড়ির ভেতর ঢুকলো। আশে পাশে কে আছে তা প্রত্যক্ষ করার উপায়ন্তর নেই। হাঁপাতে হাঁপাতে বললো;

— তাওয়াফ ভাই, তাওয়াফ ভাই, তোমার মা এক্সিডেন্ট করেছে। তাকে সিটি হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। খুবই খারাপ অবস্থা বাঁচবে কি মরবে আল্লাহ জানে। তুমি তাড়াতাড়ি চলো।

এই কথা শোনা মাত্রই কেউ যেন হৃদপিণ্ডটা চেপে ধরলো। যতই অবহেলা করুক। মা ছাড়া যে কেউ নেই আর। গায়ের সমস্ত রক্ত হীম হতে চাইলো তাওয়াফের। হঠাৎ হাঁপাতে হাঁপাতে এসে আশে পাশের কিছুই খেয়াল করেনি রতন। পরক্ষণে আয়ানকে দেখেই চমকিত হয়ে রতন বললো;

— আরে স্যার আপনি এখানে? তাওয়াফ ভাই উনিই সেই ব্যক্তি যে তোমার মাকে রাস্তায় মুমূর্ষু অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে গাড়িতে উঠিয়ে হসপিটালে পাঠায়। উনি একজন পুলিশ অফিসার।

রতনের মুখে এই কথা শুনতেই চোখে অনুশোচনার জল চলে আসে। অশ্রু ছেড়ে দিয়ে বলে স্যার আপনার যা বলার যা শোনার পরে শুনবেন। দয়া করে স্যার আমার মায়ের কাছে নিয়ে চলুন। সে ছাড়া আমার আর কেউ নেই। দয়া করুন স্যার। আমি আপনাকে সব খুলে বলবো যা বলবেন উত্তর দেবো। আমার মায়ের কাছে নিয়ে চলুন নয়তো আমাকে যেতে দিন।
আয়ানও আর কথা বলতে পারেনা। তাওয়াফকে উঠিয়ে বলল বাইকের পেছনে বসো। তাওয়াফকে নিয়ে দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলল সিটি হসপিটালের উদ্দেশ্য। পৌছানোর পর জানতে পারলো অপারেশন চলছে। তাওয়াফের চোখ দিয়ে অঝোরে অশ্রু লুটিয়ে পড়ছে। ঘন্টাখানেক পর ডক্টরের আসা মাত্রই তাওয়াফ পাগলের মতো ছুটে যায়। হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করে;

— আমার মা কেমন আছে ডক্টর? উনি ঠিক আছেন তো?

— আল্লাহর অশেষ কৃপায় তিনি এখন বিপদমুক্ত। চোট গুরুতর ছিল সময় মতো হাসপাতালে আনতে না পারলে মারাও যেতে পারতো। যদিও বিপদমুক্ত কিন্তু সুস্থ হতে সময় লাগবে। খেয়াল রাখতে হবে।

ডাক্তারের কথা শুনে তাওয়াফের বুকে যেন আবার প্রাণ ফিরে এলো। আয়ানও এক বুক স্বস্তি পেলো। কিন্তু এখন যে কাজে এসেছে তার পালা।
তাওয়াফ নিজেই কাছে গিয়ে কেঁদে ফেললো। অনুতপ্ত হয়ে বলল;

— স্যার আমায় ক্ষমা করে দিবেন। আপনার সাথে খারাপ আচরণ করেছি। আজ যদি আমি ফাঁসির কাষ্ঠের পলাতক আসামিও হতাম তবুও নিজে থেকে হাতে শেকল পড়ে হাসতে হাসতে আপনার কাছে নিজেকে আত্মসমর্পণ করতাম। পুলক মনে অপরাধের জন্য মৃত্যু দড়িতে ঝুলতাম। স্রষ্টার অশেষ কৃপায় আজ আপনার জন্য আমার মায়ের জীবনটা রক্ষা পেলো আজীবন ঋণী থাকবো। মায়ের অবাধ্য ছেলে আমি কথা শুনতাম না। খারাপ আচরণ করতাম। মায়ের মর্ম বুঝতাম না। আজ যখন শুনলাম মা বাঁচবে না। আমার মনে হলো কেউ কলিজাটা টেনে ছিঁড়ে ফেলছে। এতোটা আঘাত কখনও প্রত্যক্ষ হয়নি। কখনও উপলব্ধি হয়নি। আমার মনে হয়েছে নিজের জীবন নিঃশেষ হলেও মা ভালো হয়ে যাক।
আমি জানি স্যার আপনি পিয়াশের হত্যা সন্ধেহে আমাকে ধরতে এসেছেন। এই ঘটনার পর আমি অপরাধী হলে নিজেই ধরা দিতাম। আমার মুমূর্ষু মায়ের প্রতি শপথ রেখে বলছি স্যার আমি পিয়াশকে মারিনি। পিয়াশের সাথে আমার সস্পর্ক ছিল ঠিকই কিন্তু আমি মারিনি তাকে। আমি আমার মায়ের অবাধ্য সন্তান হতে পারি, মদ্যপ হতে পারি, পাড়ার বাজে ছেলে হতে পারি কিন্তু হত্যাকারী নই। আমি আজকের পর থেকে ওইসব কাজও ছেড়ে দিবো স্যার, সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যাবো। আমি আমার মাকে ফিরে পেয়েছি আর কিছুই চাইনা, সমস্ত ভুলের জন্য অনুতপ্ত। বলা শেষে, আবার অশ্রু ছেড়ে দিলো তাওয়াফ।

আয়ান চুপ করে সব কথা শুনছিল। মায়ের আর্তনাদে যে ছেলের মনে এরূপ হাহাকারের ডঙ্কা বাজে সে ছেলে আর যাইহোক হত্যাকারী নয় এই বিশ্বাসেই আয়ান থমকে যায়। চোখ ঘোলা হয়ে আসে। তবুও আইন তো অন্ধ মায়ায় বন্ধ নয়। নৈতিকতার দিক থেকে দমে গেলেও দায়িত্বের দিক থেকে বিশেষ ভাবে নজর রাখলো। তাওয়াফের কাঁধে হাত রেখে বললো;

— মায়ের খেয়াল রেখো। আর পূর্বের পথ ছেড়ে দিও।

হঠাৎ ফোন বেজে উঠলো আয়ানের। ডা. সফিক আলম ফোন দিয়েছে। ফোন ধরতেই জানালো যে ময়নাতদন্তের রিপোর্ট তৈরি। শোনা মাত্রই আয়ান আর দেরি না করে দ্রুতপদে প্রস্থান করলো।
আজিম সাহেব, সুপ্তির বাবাও পৌছালেন সেখানে। সকল ঝামেলা নিষ্পত্তি করে লাশ অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হলো বাড়ির উদ্দেশ্যে। হসপিটালে পৌঁছাবার পরই রিপোর্ট হাতে পেলো আয়ান। ততোক্ষণে সবাই অবগত যে, পিশাশের এটা নিছক কোনো আত্মহত্যা নয় বরং পরিকল্পনা মাফিক নির্মম ভাবে হত্যা। ময়নাতদন্তের পূর্বেই আয়ান যেই ধারণা করেছিল তার বেশীর ভাগই সত্য প্রমাণিত হলো, সাথে ছিল নতুন নতুন কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here