গল্প: ম্যানহোলের_অতলে পর্ব-৬

0
947

গল্প: ম্যানহোলের_অতলে
পর্ব-৬
লিখা : #এম_আর_রাশেদ এবং #মল্লিকা_জাহান

আমির সাহেবের নিজের রুম থেকে বের হওয়ার ইচ্ছে নেই। এই দুই দিন তিনি বের হয় নি। নিজের ছোট মেয়ের লাশ দেখে তিনি নিজের কাছেই পরাজিত। জীবনের দুই-তৃতীয়াংশ সময় সেনাবাহিনীতে ছিলো। সুপ্তির সাথে যতটা সময় কাটানো হয়েছে, পিয়াশের সাথে হয়নি। সুপ্তির আধো আধো কথাগুলো শুনে যতটা হৃদকম্পন বেড়েছিলো৷ পিয়াশের বেলায় হয় নি। এটাও তো জানতো না, মেয়েটা বড় হয়ে গেছে, কথা বলতে শিখে গেছে। অন্য ছেলের সাথে হাত ধরতে শিখে গেছে৷ এতো অপমান, এতো অবজ্ঞা, এতো মানুষের কানাকানি। সবটা ভুলে যদি পিয়াশের সাথে কথা বলা যেত। আজ এই পর্যায়টা দেখতে হতো না। মেয়েটার লাশ আসার কথা। আবারো লোকজনে ভর্তি হবে বাড়ি, মানুষ এসে তাকে সাত্ত্বনা দেবে। কেউ কানাকানি করে বলবে, ” খারাপ সম্পর্ক ছিলো রে, তাই গলা কেটেছে!!”

কেউ বলবে, ” বাচ্চা টাচ্চা হবে, তাই হয়তো!”

আমির সাহেবের আবারও চোখ ভিজে গেলো। বুকে এক রাশ পাথর নিয়ে সুতলানা বলে ডাকলো, সুলতানা দিন রাত জায়নামাজে বসে থাকে। একটাও কথা বলে না ইদানিং, বিরবির করেও আল্লাহ আল্লাহ করতে থাকে।

লাশের গাড়িটা বাড়ির সামনে, লাশটা ধরে নামানো হয়েছে। আবারও মানুষজনের ভীড়, আজিম সাহেব বড় ভাইকে রুম থেকে বাইরে আনলো। এই দু-দিনে পিয়াশের গায়ের রঙ দুধে আলতা থেকে কালো হয়ে গেছে৷ লাশ থেকে বরফ ঘরের মেডিসিনের গন্ধ! অনেকটা ন্যাপথালিনের মতো। এ পিয়াশ যেন রুমে ছুটে বেড়ানো চঞ্চল মেয়েটি, এটা কেউ বিশ্বাস করতে নারাজ। পোস্টমর্টেম এর পর, পিয়াশের দেখতে যারা এসেছে সবাই কাপড় চাপা দিয়ে এসেছে৷ আমির সাহেব চিৎকার করে বলবেন,

— যাদের আমার মেয়ের লাশ গন্ধ মনে হচ্ছে। বের হয়ে যাও, আমার সামনে আসবে না, তোমরা। তোমাদের গুলি করবো। আমার লাইসেন্স করা বন্দুক আছে, সবাইকেই মেরে ফেলবো। এইখান থেকে দূর হও। কিরে আজিম যেগুলারে দেখবি মুখে কাপড় সেগুলারে ঘাড় ধাক্কা দিবি। আর চিনে রাখবি, আমি বন্ধুক বের করে আনছি।

আমির সাহেব অস্বাভাবিক আচরণ করছে। আজিম নিজেও ভাবে নি, যে ভাইয়ের থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে আইনজীবী হয়েছে। সে ভাই আজ, বাচ্চাদের মতো আচরণ করছে।

আমির সাহেবকে রুমে পাঠানো হলো, সে রুমে গিয়ে লাইন্সেস করা বন্দুক খুঁজছে। লাইসেন্সে পেয়েছে, কিন্তু বন্দুকের গুলিটা কোথায় রাখেছে মনে নেই। সারা ঘর ওলোট পালোট করছে।

আজিম সাহেবের স্ত্রী কবিতা বেগম। তিনি আর প্রতিবেশী দু-তিন মিলে পিয়াশকে গোসল করালেন। আর ঢিউরে কেঁদে উঠলেন, বাচ্চা মেয়েটার পুরোটা শরীরে সেলাই! গলায় কাঁটা দাগ। তিনি গোসল করাচ্ছেন আর সূরা ইয়াসিন পড়চ্ছেন বিরবির করে।

বাড়ির কাছেই সামাজিক কবরস্থানে দাফন করা হবে। খাটিয়া নিতে আজিম সাহেব আর আমির সাহেব একদিকে দাঁড়ালো। আমির সাহেবের অবস্থা ভালো নয়। যে কোন সময়ে রাস্তায় পরে যেতে পারে। খাট তুলনামূলক ভারী মনে হচ্ছে আমির সাহেবের। চারপাশে দোয়া তে কলরবমূখর।

আল্লাহুম্মাগ ফির ওয়ার হাম.আল্লাহুম্মা ইয়াছছির কবরাহু ওয়া ইয়াছছির হিসাবাহু….

আমির সাহেব আর পারছে না। কাঁধে ব্যাথা পাচ্ছেন খুব৷ বাড়ির মেইন গেইটে যাওয়ার আগেই ছেড়ে দিলেন। আজিম সাহেব ধরেও ধরতে পারলেন না। পিচ ঢালা রাস্তায় বসে পড়লেন। কিছু লোকজন ধরাধরি করে উঠালেন। পিয়াশের লাশের খাটিয়া নামিয়ে রাখতে চাইলেও ইমাম সাহেবের নির্দেশে নামানো হলো না। আমির সাহেবকে আজিম ধরলেন। আমির বললো,

— আমার ঘাড়ে মনে হয় ফুলে গেছে। দেখ তো। এতো ভারী কেন?

অন্য সবাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে। এতোটাও ভারী নয় লাশ। আজিম বড় ভাইকে সাত্ত্বনা দিলেন! আমির সাহেব পিছে পিছে আসছেন। নিজের মেয়ের লাশ বহন শব্দটা কথাটা ভারী, মা-বাবারাই উপলব্ধি করতে পারেন। আমির সাহেব নিজেকে বিশেষত্ত্ব হারিয়ে বসেছেন। উনিই কি তিনি, যিনি ট্রেনিং এ সবার আগে বুক ডন দিতেন। পুরো মাঠ একশ বার রাউন্ড দেওয়ার মতো যুবক ছিলেন। দুই মাস আগেও, নতুন ট্রেইনারদের সামনে দুইশ বুক ডন দিয়েছেন। তিনি আজ কোলের আড়াই কেজির সেদিনের বাচ্চাটিকে বহন করতে পারলো না। মাথা ঘুরিয়ে আসছে তার। আবারও পরে যেতে পারেন। লাশ দাফনের জন্যে নামানো হলো। এক পাশে কবর খুড়ে মাটি উপরে উঠানো হয়েছে। আমির সাহেব আর জানাজায় দাঁড়াতে পারলো না, মাথা ঘুরিয়ে পরে গেলেন। লোকজন ধরা -ধরি করে বসালো। আজিম সাহেব, হাতের নার্ভস চেক করে বললো,

— অবস্থা ভালো লাগছে না। ইমিডেট হসপিটালে যেন নেওয়া হয়৷

আজিম সাহেব ভাগিনা সজলকে দিয়ে হাসপাতালে পাঠালেও, আয়ান থাকলে মনে শান্তি পেতো। আজিম সাহেব এর এক মেয়ে। মেয়ে ক্লাস ফোরে পড়ে। ওর নাম রাখা হয়েছে প্রাপ্তী। প্রাপ্তীও দুই দিন ঠিক মতো খায় না৷ মেয়েটিও শোক পেয়েছে। বারবার বলেছে,” বাবা আপু কি আর আসবেনা?” আজিম সাহেবের চোখে পানি। পেছন থেকে কাঁধে হাত বাড়ালো। দেখলো, আয়ান। আয়ানকে দেখে নিজেকে সামলে নিলো। হাজার হোক ডির্পামেন্টের সবাই জানে, সে যথেষ্ট পাথর হৃদয়ের মানুষ। এইভাবে জল না ফেলে বাকিদের সাহস জোগাতে হবে। বড় কথা খুনীকে ধরতে হবে! আয়ান বললো,

— সরি, স্যার, রিপোর্ট টা আনার পর৷ আমি আবার আরেকটা কেসে গিয়েছিলাম। ওটার জন্যে আইজি স্যার ফোন করেছিলো। তারপর এই কেসেরও কাজ বাকি ছিলো। এখনো ইনভেস্ট করার অনুমতি পেয়েছিলাম না। আজ গিয়ে নিয়ে আসলাম। তাই লাশ পাঠিয়ে দিলাম।

— জানি আয়ান, তুমি যথেষ্ট দায়িত্বশীল। চলো আগে নামাজ টা আদায় করে, আমার মামনিকে চিরনিদ্রায় শুয়ে দিয়ে আসি।

ইমাম সাহেবের পেছনে সবাই জানাজা পড়লো। আজিম সাহেব পুরোটা নামাজে চোখ খোলে নি৷ কিন্তু চোখের জল গাল বেয়ে কখন শার্ট ভিজিয়েছে সে জানে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই দাফন করা হলো। মাটি দেওয়ার সময় হুমড়ে কেঁদে উঠলো, চিৎকার করে বললো,

— আমি কাওকে ছাড়বোনা পিয়াশ, কাওকে না। দেখিস, আমি তাকে না তার পুরো বংশের লোকেদের জেল খাটাবো। শুধু জেল না, খুনীর ফাঁসি হবে। আর তার লাশ কবর দেওয়ার সময়, আমি তার বাপ-চাচাদের প্রশ্ন করবো? কেমন লাগছে! এটা না করতে পারলে৷ আমি চাকরি ছেড়ে দেবো। লাভ নেই। লাভ নেই।

আয়ান আজিম সাহেবকে সামলে নিলেন। রিপোর্টটার কথা বলা উচিত হবে না এখন৷ শান্ত হোক সবাই। জানাজার নামাজ শেষে, আমির সাহেবেকে দেখতে গেলো সবাই।সেখানে সজলকে পাঠানো হয়েছিলো। কিন্তু ডাক্তার এখনো কিছু বলে নি। হাসপাতালের নিচে এসে সিগারেট ধরালো আজিম। দুইবার টেনে বললো,
— বলো আয়ান, রিপোর্ট এ কি লিখা! শর্টকাটে বলবা! জানোই আমি ঠিক কোন পরিস্থিতিতে আছি।

— স্যার, ময়নাতদন্তের রিপোর্ট ছাড়াও ডা. সফিক আলমের ভাষ্যমতে পিয়াসের ক্ষতটা ছিল গভীর। ছুড়ি দিয়ে গলার অর্ধাংশ দাবিয়ে কাটা হয়েছে। চৌকস ভাবে আঘাতের পর টেনে চেয়ারে নেওয়া হয়েছে। গলা চেপে ধরার দাগও রয়েছে।

আয়ানের কথা শুনে আজিম সাহেবের শিরদাঁড়া কেঁপে উঠলো। এরচেয়েও বিমর্ষ, এরচেয়ে বিদঘুটে কত মৃত্যু স্বচক্ষে আজিম সাহেব প্রত্যক্ষ করেছে, কিন্তু এতোটা মনে প্রভাব বিস্তার করেনি। কিন্তু এই মৃত্যুটা আলাদাই মনে হয়েছে। রাগে, ক্ষোভে ফুঁসে উঠছে সমস্ত শরীর। কাছে পেলে তো চায় ইনকাউন্টারে শেষ করে দিতে। জীবনে কত কেইস হ্যান্ডেল করেছে, সফলতার সাথে সমাপ্ত করেছে। আজ নিজেদের সাথেই এমন ঘটছে! অনেক কষ্টে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে আজিব সাহেব আয়ানকে উদ্দেশ্য করে বলে;

— আচ্ছা আয়ান ভিক্টিম এতোটা আঘাত প্রাপ্তির পরও চিৎকার করলো না? বাড়িতে তো লোকজন ছিল, চিৎকারের শব্দ পেলে বাড়ির লোকজন তো দৌড়ে আসতো। কিন্তু সবকিছু নীরবে কিভাবে করলো?
সবার আগে আমার গল্প পড়তে চাইলে “নীল ক্যাফের ভালোবাসা” পেজে পাবেন।
— স্যার খুনটা যেহেতু পূর্ব পরিকল্পনা মাফিক তাই শব্দহীন খুন করাটা ধরি মাছ, না ছুঁই পানি ব্যাপার মাত্র। ময়নাতদন্তের রিপোর্টে উঠে এসেছে, ভিক্টিমকে মারার পূর্ব ক্লোফোম ব্যাবহার করে অজ্ঞান করা হয়। এতে খুনীর উদেশ্য সহজেই হাসিল হয়। আর আমি পিয়াসের রুমটা পর্যবেক্ষণ করেছিলাম। সেখানে আঘাতের পর ফ্লোরের টেনে নেওয়া রক্তের দাগও প্রত্যক্ষ করেছি। এই রিপোর্টের পর সামান্যই সামান্যতম সন্দেহের অবকাশ নেই যে এটা হত্যা বৈ আর কিছু। খুনী যতোই চৌকস হোক পাড় পাবে না।

আজিম সাহেব ক্ষাণেক সময় ভেবে বললেন;

— আচ্ছা, বুঝলাম। কিন্তু এত বুদ্ধি নিয়ে খুন! কে যেন ছেলেটা! নামটা মনে পড়ছে না, যার সাথে পিয়াশের সম্পর্ক ছিলো।

— তাওয়াফের কথা বলছেন স্যার?

— হ্যাঁ ঐ ছেলেটা নয় তো?

— আমার তো তা মনে হয় না। কেননা, যত গর্জে ততো বর্ষে না। গতকাল ওদের বাসায় গিয়ে আমি খোঁজ নিয়েছি স্যার৷ তবে সন্দেহের চোখ থেকে বাইরে নয়।

— তবে আর কে হতে পারে?

— হতে তো পারে অনেকেই। কারণ খুনী একজন হলেও আমার সন্দেহের তালিকা ভিন্ন ভাবে সাজানো।
স্যার, অভয় দিলে বলি। আমার সন্দেহের তালিকা একটু বড়, আপনার ভাই, ভাইয়ের বউ, তারপর সুপ্তী, বর্তমানের খুনের অধিকাংশ কারণ টাকা বা সম্পত্তি, সেখানে হতেই পারে! বাকিসব সম্পত্তি মালিক সে সুপ্তি!

আজিম সাহেব ভাবছে। নিজের ফ্যামিলি নয়, অন্য ফ্যামিলিতে বসাচ্ছেন? খুন কে করতে পারে? সুলতানা বা আমির ভাই, যারা মান-সম্মানের ভয়ে এতোটা বাজে কাজ করলো, নাকি সুপ্তি, যে নিজের পুরোটা সম্পত্তি হাতিয়ে নিতে এই রাস্তা বেছে নিলো?

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here