গল্প: ম্যানহোলের_অতলে পর্ব-৮

0
1381

গল্প: ম্যানহোলের_অতলে
পর্ব-৮
লিখা : #এম_আর_রাশেদ এবং #মল্লিকা_জাহান

আমির সাহেবের জ্ঞান ফিরেছে। তাকে সুপ্তির ব্যাপারে জানানো হয়নি। অবশ্য সুপ্তির কথা জিজ্ঞেস করেছিল সে কোথায়? সুলতানা বেগম মিথ্যা বলে পাশ কাটিয়ে গেছে। মেয়েও যে একই হসপিটালে ভর্তি এই সত্যিটা বলা যেন আগ্নেয়গিরিতে জেনে শুনে ঝাপ দেওয়ার মতো। সুলতানা বেগম মুখে আঁচল গুঁজে এক কোণায় গিয়ে নীরবে কাঁদছে। এভাবে আর কত? এখন মনে হচ্ছে সবাইকে বিষ খাইয়ে নিজেও মরে গেলে শান্তি মিলতো। আর সহ্য করতে পারছেনা এমন জরাজীর্ণ অবস্থা।
সুপ্তির অবস্থা এখন আগের চেয়ে ভালো। আয়ান যেতে চেয়েও পারলোনা নতুন আরেকটা সমস্যায় পড়ে। ভাবছে বাড়িতে গেলে হয়তো এই ক্ষোভ তার উপরেই ঝাড়বে।

আজিম সাহেব সুলতানার মুখের দিকে তাকিয়ে ছক মেলাতে গিয়েও পারছেনা। দোটানায় পড়ে যাচ্ছে অবিরত। চোখে যেন আর পানি ধরে না। একদিকে শোকে স্তব্ধ অন্যদিকে খুনীকে ধরার জন্য মরিয়া। একেই তো ছোট ভাতিজীকে হারিয়ে মর্মাহত অন্যদিকে তার বড় ভাই মিনি স্ট্রোক করে হসপিটালে ভর্তি। আর শেষাংশে বাড়ির বড় মেয়েরও জীবন শঙ্কায়। মৃত্যু যেন গোলকধাঁধার মতো খেলছে এই পরিবারের সাথে। ক্রমে ক্রমে নিস্তেজ করে দিচ্ছে সব কিছু।

— স্যার আপনার সন্দেহ জোড়ালো ভাবে কার উপর?

আয়ানের কথায় ঘোর কাটলো আজিম সাহেবের। নিজেকে স্বাভাবিক করে বললো।

— সন্দেহের চোখে তো সবাই। কাকে ছেড়ে কাকে বিশ্বাস করবো এই মুহুর্তে সেটা ভেবে পাচ্ছিনা। আমি তো নিজের উপরই বিশ্বাস রাখতে ব্যর্থ। জীবনে কত কেসের সমাপ্তি ঘটিয়েছি। আসামীদের নাকানিচুবানি খাইয়েছি। অথচ আজ নিজেই কঠিন পরিক্ষার সামনে দাড়িয়ে। ঠিক কি করবো আয়ান আমি বুঝতে পারছিনা। একের পর এক ঝামেলা লেগেই আছে। ভাইয়া অসুস্থ, এদিকে সুপ্তির অবস্থাও খারাপ। এতো টেনশনের মধ্যে আমারও কখন কি হয়ে যায় ঠিক নেই।

— স্যার আপনি এভাবে ভেঙে পড়বেন না। খারাপ সময় গুলোতেও কিভাবে মনোবল ঠিক রেখে সঠিক পদক্ষেপ কিভাবে নিতে হয় আপনি আমাদের শিখিয়েছেন। আর আপনিই যদি আজ এভাবে ভেঙে পড়েন তবে পুরো কেসটাই বিগড়ে যাবে। মাথা ঠান্ডা রেখে প্রতিটি পদক্ষেপ নিবো আমরা। যেখানে শেষ হয়েছে সেখান থেকেই আবার শুরু করবো। তাছাড়া এই কেসটা তদরকির দায়িত্ব যেহেতু আমার হাতে। এর শেষ দেখে আমি ছাড়বো।

আজিম সাহেব আস্বস্ত হলেন। কেননা এর আগেও আয়ানকে জটিল কেস সমাধানের জন্য দিয়েছিলেন। সে কৃতিত্বের সাথে কেস সমাপ্তি করে। আজিম সাহেব আয়ানের কাঁধে হাত রেখে বললেন;

— আমি তোমার উপর ভরসা করি আয়ান।

আয়ান পুলকের একটা মৃদু হাসি দিলো। আবার পরিবেশ থমথমে। আয়ান চুপ হয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটা জিনিস নিয়ে ভাবছিল। এখনই মোক্ষম সময় ব্যাপারগুলো খুলে বলার। ভেবে বলতে যাবে এর মধ্যে সজল এবং সজলের মা হাজির। হাহুতাশ করতে করতে ছুটে এসেছে এই মধ্যরাত্রিরে। নিজের ভাই তো অসুস্থই আবার সুপ্তির এই অবস্থা। বিষন্ন মন নিয়ে গভীর চিত্তে সজল প্রশ্ন আজিম সাহেবের নিকট;

— সুপ্তির কি অবস্থা এখন? ডক্টর কি বলল?

— ট্রিটমেন্ট চলছে। আগের চেয়ে ভলো। তবে ও যেমন অস্বাভাবিক আচরণ করছে, তাতে যেকোনো সময় বড় ধরনের ক্ষতি করে ফেলতে পারে।

সজলের চোখ ভিজে এলো। সুপ্তির থেকে সজল ২ বছরের বড়। পিঠাপিঠিই বলা যায়। একসাথে চলাফেরা সব কিছু। পিয়াশের মৃত্যুতে সে যতটা না বিচলিত তার চেয়ে সুপ্তির এহেন অবস্থার কথা শুনে বেশি মর্মাহত। সজল নিশ্চুপ হয়ে মায়ের কাছে গেলো।

সবার একটাই কামনা এখন সবকিছু ঠিক হয়ে যাক। তবে পিয়াশে হারানোর মাঝে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে তা পূরণ হবার নয়।

অক্লান্ত পরিশ্রম আর নির্ঘুম রাত্রিযাপনে আয়ানের রীতিমতো ঘাম ঝড়ছে। চোখ দু’টো নির্ঘুমে রক্তিমবর্ণ ধারণ করেছে। খাবারের টেবিলে মাকে অপেক্ষায় রেখে দশ মিনিটের কথা বলে দু’ঘন্টা পেড়িয়ে গেলো, তবু ফিরবার নাম নেই।
ভোর চারটা বেজে গেছে। আগের চেয়ে অবস্থা স্বাভাবিক। আজিম সাহেব আয়ানের ব্যাপারটা বুঝতে পারছিলেন। দায়িত্বশীলতার বাইরেও মানবিক মূল্যবোধ দিয়ে ছেলেটা এসব করে যাচ্ছে। সে আর আয়ানকে আর থাকতে দিলো না, বিশ্রাম আবশ্যক। ওতো রোবট নয় রক্ত, মাংসের মানুষ।যেতে না চাইলেও আজিম সাহেব কৃতজ্ঞতা ভড়া কন্ঠ নিয়ে আয়ানকে যেতে বললেন। এবার আর না করার সুযোগ নেই। আয়ান নিজেও বুঝতে পারছে ইচ্ছে থাকলেও ইচ্ছের সাথে শরীর আর সায় দিচ্ছে না। অবশ হয়ে আসছে ক্লান্তিতে। কেসটা নেওয়ার পর নিয়মিত গোসল, খাওয়া, ঘুম যেন হারিয়ে যেতে বসেছে।

মৃদু পা ফেলে আয়ান রাস্তার ফুটপাত ধরে নীরবে হাটছে। আজ আর বাইক নিয়ে আসেনি। রিকশায় করে হসপিটালে পৌছায়। অবশ্য চাইলে গাড়িতে করেই আসতে পারতো, কিন্তু ইচ্ছে করছেনা। আর এই সময় রাস্তায় কোনো রিকশাও থাকেনা। আজকের নির্ঘুম রাতটা পূর্ণ হোক। হসপিটাল থেকে আয়ানের বাড়ি খুব একটা দূরে না। পায়ে হেটে গেলে সর্বোচ্চ পঁচিশ থেকে ত্রিশ মিনিট লাগবে। একটু পরেই ফজরের আজান শুরু হবে। আয়ান আনমনে হেটে চলেছে। প্রতিটি কদমে হারিয়ে যায় অতলে। আজকে যেই পরিবারের জন্য দায়িত্বের বাইরে গিয়েও অক্লান্ত পরিশ্রম করছে, তার পেছনে আয়ানের এক ভয়ংকর অতীত রয়েছে। রয়েছে না জানা এক গল্প। জীবনে কত ইচ্ছেই তো মনে বাসা বাঁধে সবটার পূর্ণতা কখনোই হয়ে ওঠেনা।
এই পুলিশ, ডাকাত, রক্ত, খুন, রহস্য কোনো একসময় ছিল আয়ানের কাছে কল্পনা অতীত। ভয়েও শরীর শিহরিত হয়ে উঠতো। অথচ আজ সেই খেলায় মত্ত। রহস্যের সমাধান করা, লাশের আড়ালে গুপ্ত ঘাতককে খুঁজে ফেরাই এখন একমাত্র লক্ষ্য। প্রতিটি মানুষের জীবনে যেমন লক্ষ্য থাকে তেমনে আয়ানের জীবনেও লক্ষ্য ছিল সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার। সেই লক্ষ্য অটুট রেখেই শুরু হয় পথ চলা। এগিয়ে চলে নব উদ্যমে।
মনে পড়ে যায় সেই পুরোনো দিনের কথা। কলেজের যাওয়ার পূর্বে মায়ের মুখ ভর্তি খাবার পুড়ে দেওয়া, আরেকটু খেয়ে যা বলে আহ্লাদের চেচামেচি, বাবার গম্ভীর আর ভালোবাসায় ভরা শাসন, মেজো বোন অন্তুর ব্ল্যাকমেইল নাম অত্যাচার করে নানা জিনিস আদায়, ছোট বোন অয়নার হিংসে ভরা মুখ আর এক বোঝা আবদার, এই নিয়ে জীবনটা স্বর্গ সুখে কেটে যেতে দিব্যি। পাঁচজনের এই সংসারে কিসের অভাব ছিল? হয়তো দুঃখ নামক কালোছায়া দূর থেকে এই সুখ দেখে হিংসে করতো। আর এই ঘরে অভিশাপ হয়ে বাসা বাঁধতে প্রার্থনা করতো।
অতঃপর সত্যিই একদিন সেই কালোছায়া সুখ নামক কষ্টিপাথরকে হটিয়ে ওই স্বর্গময় বাড়িতে নামিয়ে আনলো বিষাদের বর্ষণ।
আয়ান তখন সদ্য ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেছে। জবের জন্য এপ্লাই করবে তার পূর্বে কিছুদিন প্রকৃতির সাথে সময় কাটালে মন্দ হয়না। যেই ভাবনা সেই কাজ। টুরের জন্য রাঙ্গামাটি নির্বাচন করা হয়। রাতে টুরের যাত্রা শুরু, সবার মধ্যেই উৎসুকভাব। সেখানে পাহাড়ি জনপদ আর প্রকৃতির সাথে সময়টা বড্ড রোমাঞ্চকর। যেহেতু ছয় দিনের টুর তাই যাত্রাটা আরও কয়েকটা স্থানে। সাজেকভ্যালির উদ্দেশ্যে রওয়া দেওয়ার পূর্ব মুহুর্তেই আয়ানের নম্বরে কল এলো। তার মা ফোন করেছে। কান্নারত গলায় বলছে, “অয়নাকে পাওয়া যাচ্ছেনা”। সবটা শোনা মাত্রই টুরের বাস থেকে লাফ দিয়ে নেমে দ্রুত ঢাকার উদ্দেশ্য রওয়ানা দেয়। বাড়িতে পৌছে সব জায়গায় তন্নতন্ন করে খুঁজতে থাকে। কোথায় অয়নার দেখা মেলেনা। সবশেষ নিখোঁজ হওয়ার চার দিন পর পুলিশ অয়নার লাশ বস্তাবন্দি অবস্থায় খুঁজে পায়। সেদিন বোনের চেহারা দেখে আয়ানের চিৎকারের চারিদিক প্রকম্পিত হয়ে উঠেছিল। ময়নাতদন্তের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ময়নাতদন্তের রিপোর্টে জানানো হয় যে, গত একদিন আগে মারা হয়েছে, আর প্রমাণ মিলেছে গনধর্ষনের। অতঃপর লাশ নিয়ে যখন বাড়িতে আসা হয় তখন মেয়ের এমন নির্মম এবং নির্শংস হত্যার চেহারা দেখে আয়ানের বাবা আফজাল হোসাইন সেখানেই স্ট্রোক করে। হসপিটালে নেওয়ার আগেই মৃত্যুর কোলে ধলে পড়েন তিনি। সেদিনের মতোর অসহায়ত্বের শিকার আয়ান আর কখনই হয়নি। তার পৃথিটাই যেন উল্টো পথে ঘুরতে থাকে। ইচ্ছে করে মানুষ রূপি ওই হায়েনাদের বুলেটের আঘাতে বুক চিরে এফোঁড়ওফোঁড় করে দিতে। ইঞ্জিনিয়ার হওয়া স্বত্বেও স্বপ্নকে বিষর্জন দিয়ে যুক্ত হয় ডিফেন্সে। তার বোনের খুনিদের কাউন্টার এ্যাটাকের এক অপারেশনে নিজের হাতে ক্রসফায়ার করে মারে। আজও সেই ব্যাথা বুকে লয়ে ঘুরে বেরোয় আয়ান। মানুষের বাহ্যিক দিক দেখে তার ভেতরটা বোঝায় উপায় কি। ম্যানহোলের উপরিভাগ ভাগটাও তো সুন্দর, ভেতরটায় রয়েছে কত বয়ে চলা স্রোতের গভীরতা।

ফজরের আজান শুরু হয়েছে। মৃদু বাতাসে গাছের শুকনো পাতা নিচে পড়ে বিস্তর হয়ে আছে। শুকনো পাতার মড়মড় শব্দে আয়ানের বেখেয়াল মন চেতনা ফিরে পায়। হাটতে হাটতে বাড়ির সামনে কিভাবে চলে এলো হদিস নেই। ভাবনায় বুদ হয়েছিল। আয়ান আর বাড়িতে গেলো না। ওজু করে ফজরের নামাজ শেষে আয়ানের বাবা আফজাল হোসাইন এবং আদরের ছোট অয়নার কবরের পাশে গিয়ে দাড়ায়। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। মনে পড়ে প্রতিটি সেই পুরোনো লুকায়িত কথাগুলি। কবর জেয়ারত শেষে বাড়িতে চলে আসে। শুরু হলো মায়ের বকুনি, সেদিকে কান না দিয়ে খাবার খেয়ে ঘন্টাখানেক ঘুমানোর পর আয়ান আজিম সাহেবকে ফোন করে বলে;

— স্যার আপনাকে একটা কথা বলার ছিল। বলবো বলবো করেও বলা হয়নি। কারণ বিশেষে লুকিয়েছিলামও বটে। প্রকাশ্যে না এনে একাকীত্বে বলতে চেয়েছিলাম।

— কি লুকিয়েছো খুলে বলো

— আসলে স্যার আমি পিয়াশের হত্যা সন্দেহে ওই গিয়েছিলাম একবার। হত্যার পোক্ত প্রমাণাদি সহ একটা ক্লুও পেয়েছি যেটা কেসের সমাধানের একমাত্র বাহক হতে পারে। আপতত সেটা আমার হাতেই গচ্ছিত থাক। আশাকরি খুব শীগ্রই আমরা হত্যাকারীর নিকট পর্যন্ত পৌঁছাতে পারবো। শুধু সময়ের অপেক্ষা।

চলবে..,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here