অব্যক্ত প্রেমাসুখ❤️‍🔥 #আদ্রিতা নিশি ।১০।

0
142

#অব্যক্ত প্রেমাসুখ❤️‍🔥
#আদ্রিতা নিশি
।১০।

[কপি করা নিষিদ্ধ ❌]

“সকাল বেলা, অন্ধকারের গাঢ় অব্যক্তি ক্ষীণ হয়ে আসছে, এই সময়টায় আকাশে সূর্যের প্রথম সঞ্চার শুরু হতে দেখা যাচ্ছে। সেই কোমল আলোকের কিরণগুলো হালকা সোনালি রঙের রেখা ছড়িয়ে দিতে শুরু করেছে চারিপাশে।দিগন্তে প্রথম সূর্যোদয়ের লাল গোলাপি আভা নতুন সম্ভাবনার সংকেত বহন করছে যেনো দিনের সূর্য উদয় হয় তার সোনালী আলো দিয়ে নতুন দিনের উন্মোচন ঘটিয়েছে।

মীরাতের চোখে সূর্যের সোনালী আলো পড়তে শুরু করেছে। সূর্যের উজ্জ্বল কিরণগুলো তার স্বপ্নময় জগতের সীমান্তে এসে পৌঁছেছে। তিরতির করে আলো তার ঘুমন্ত চোখে ভর করেছে।এই কারণে তার ঘুমে ব্যাঘাত ঘটলো। নাক মুখ কুচকে ধীরে ধীরে মীরাত চোখ খুলে আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলো বিছানায়। সোনালী আলো, সকালের স্নিগ্ধতা, তার মনকে জাগিয়ে তুলেছে। মনে হচ্ছে সোনালী আলো তাকে আদর করে ডাকছে। সকালের শীতল আবহাওয়ায় মনটা ফুরফুরে হয়ে উঠলো মীরাতের।

মীরাত চোখ খুলতেই আয়নার স্বচ্ছ সীমানায় সুদর্শন, সুঠামদেহী পুরুষের প্রতিচ্ছবি ধরা পড়ল।তা দেখে চমকে উঠলো। সে নেত্রপল্লব বেশ কয়েকবার ঝাপটালো। আয়নার ঐ সোনালী উজ্জ্বলতায় ভাসমান মুখাবয়ব, দৃঢ় গঠন আর তীক্ষ্ণ চাহনি মীরাতের হৃদয়ে বিস্ময়ের তরঙ্গ সঞ্চারিত করল। সে কিছুটা নড়েচড়ে বসল। ঐ দৃশ্য তাকে মুহূর্তে স্তম্ভিত করে দিল।। সে ভুলে বসেছিলো সামনে দন্ডায়মান মানবটি কে?

আহিয়াদ আয়নার গভীরে মীরাতের থমকে যাওয়া চোখগুলোর দিকে লক্ষ্য করেছে। তার মৃদু আর গভীর চাহনি সূক্ষ্মভাবে আয়নার ভেতরে প্রবাহিত হতে থাকলো। মীরাতের বিস্মিত অভিব্যক্তি তা চোখে পড়েছে। আহিয়াদের চোখে সেই মুহূর্তের প্রতিটি ভাবভঙ্গি,অনুভূতি স্পষ্ট হয়ে উঠলো।আয়নার ভেতর থেকে তীব্র আর চিরন্তন অনুভূতি মীরাতের চোখের চাহনির মধ্যে ফুটে উঠেছে।

মীরাতের ঘোর ভাঙলো আহিয়াদের গম্ভীর কণ্ঠস্বর শুনে। গাম্ভীর্যের সহিত গভীর স্বরে আহিয়াদ বলল – “অবশেষে ঘুম ভাঙলো ?”

মীরাত স্তম্ভিত হয়ে কিছুক্ষণ নীরব রইলো, তার চোখগুলি দ্রুতভাবে পাশের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে ঠোঁটে ভিজিয়ে বলল;
‘হুমম।”

মীরাত অনিচ্ছার সত্ত্বেও ছোট শব্দটি উচ্চারণ করল।
আহিয়াদের চাহনি ছিল সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। তৎক্ষণাত সে বলে উঠলো –“ দশটায় বের হবো। দ্রুত ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি নিচে যাচ্ছি।”

আহিয়াদ তার সুসংগঠিত, দৃঢ় সিদ্ধান্তের গম্ভীরতা জানান দিল। মীরাতকে দ্রুততার সাথে প্রস্তুতি গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে গেলো সে। মীরাত থম মে’রে বসে রইল কিছুক্ষণ। রাতে দুজন একই বিছানায় ঘুমিয়েছিলো। তেমন কথপোকথন হয়নি দুজনের মাঝে। আহিয়াদের আচরণ তার কাছে খুবই অদ্ভুত লাগছে। সে বিছানায় থেকে দ্রুততার সহিত নেমে পরলো। রুম থেকে বেরিয়ে সোজা আরিশার রুমের দিকে গেলো।

★★

দুপুরের তপ্ত সূর্যের তেজ মাটির উপর ঘোর অন্ধকারে রূপ নিয়েছে। আকাশে কোনও মেঘ নেই, শুধুই স্বচ্ছ নীল আকাশের বিস্তার। তাপমাত্রা এতটাই উচ্চ যে প্রতিটি নিঃশ্বাস যেন গরম স্রোতের মতো লাগছে। রাস্তার পৃষ্ঠে তাপের কারণে মাঝে মাঝে ধোঁয়া উঠছে, আর আশেপাশের সব কিছু থমকে দাঁড়িয়ে আছে। গাছপালার পাতাগুলো ঝুলে পড়েছে, পাখিরাও কেমন নীরব হয়ে আছে। এই উত্তপ্ত দুপুরে নিরবতা ও অবসাদ বিরাজ করছে সকলের মাঝে। অসহ্যকর একটা পরিস্থিতি।

দীর্ঘ পাঁচ ঘন্টা জার্নি করার পরে অবশেষে ঢাকায় পৌঁছেছে আহিয়াদ। নিহাল আর জেনিকে তাদের গন্তব্যে পৌঁছে দিতে আধাঘন্টা বেশী সময় লেগেছে। জেনি আজ আহিয়াদের সাথে কথা বলেনি। কারণ মীরাতকে সে ঢাকায় আনছে। আহিয়াদ আলিশান তিনতলা বিশিষ্ট ফ্ল্যাটের সামনে গাড়ি দাঁড়া করালো। সে গাড়ির হর্ণ বাজাতেই দ্রুততার সহিত মেইন গেইট খুলে দিলো গেটম্যান। আহিয়াদ আশরাফ সাহেবকে সালাম দিয়ে গেইট দিয়ে ঢুকেই সরাসরি পার্কিং প্লেসে চলে গেলো গাড়ি নিয়ে। গাড়ি জায়গা মতো পার্ক করে সে নেমে দাঁড়ালো। বাড়ির চারপাশটা চোখ বুলিয়ে দেখে নিলো একবার।মনে হচ্ছে অনেকদিন পরে পরিচিত জায়গা দেখছে সে। গ্রামের বিশুদ্ধ বাতাস, মনোমুগ্ধকর পরিবেশ, পাখির কলরব, চাঁদের নির্মল আলো শহরের পরিবেশের থেকে অনেক সুন্দর। শহুরে জীবন গতিশীল। সে গ্রামের মনোমুগ্ধকর পরিবেশ অনেক মিস করবে।

আহিয়াদ দুকদম পিছিয়ে গাড়ির গ্লাস ভেদ করে ভেতরের সিটের দিকে তাকায়।মীরাত গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে গভীর ঘুমে মগ্ন। তার শরীর সিটের ওপর এলিয়ে পড়েছে, আর মাথা সামান্যভাবে এক পাশের সিটে অবলম্বিত। তার মুখাবয়ব শান্ত এবং নিরব, মনে হচ্ছে স্বপ্নের কোনো সুন্দর জগতে হারিয়ে গেছে। গাড়ির জানালা দিয়ে সূর্যের মৃদু রশ্মি তার মুখে পড়ছে। চারপাশে গাড়ির কোলাহল একদমই শূন্য। আহিয়াদের ঘুম ভাঙ্গাতে ইচ্ছে হলো না। কিন্তু উপায় নেই। এটা করতেই হবে।

আহিয়াদ মাথা নিচু করে বেশ কয়েকবার মৃদু স্বরে ডেকে উঠলো।তার কণ্ঠস্বর ছিল স্নেহপূর্ণ ও প্রশান্তের ছোয়া। গাড়ির গ্লাস খোলা থাকায় মীরাতের কর্ণে পৌঁছেছে আহিয়াদের স্বর। পুরুষালী কন্ঠস্বরে মীরাত হন্তদন্ত হয়ে ঘুম থেকে উঠে স্বাভাবিক ভাবে বসে। তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখে পিটপিটিয়ে চাইলো সে। আশে পাশে তাকিয়ে আবিষ্কার করলো সে অপরিচিত এক জায়গায়। সে বুঝতে পারলো শহরে পৌঁছে গেছে।

আহিয়াদ গলা খাঁকড়ি দিয়ে বললো – আমরা পৌঁছে গেছি মীরাত। গাড়ি থেকে নেমে এসো।

আহিয়াদের কথা শুনে মীরাত দ্রুততার সাথে গাড়ির দরজা খুলে নিচে নামে। ত্বরিত পদক্ষেপে, সে সোজা দাঁড়িয়ে পড়ে। তার নিঃশ্বাস দ্রুত ও অস্থির, আর বুকের মাঝে উত্তেজনা ও উদ্বেগ বিরাজ করছে। সামনের দিকে চোখ পরতেই সে অবাক হয়ে ফ্ল্যাটের আশপাশটা দেখে এটা রাজপ্রাসাদের থেকে কম কিছু লাগছে না তার কাছে। সে ফোনে অনেক সুন্দর সুন্দর জায়গা দেখেছে। আজ বাস্তবেও দেখে নিলো। তবে কি এটাই তার শ্বশুর বাড়ি। ভাবতেই সামান্য ভীত হলো মীরাত।

আহিয়াদ মীরাতের বিস্মিত চাহনি দেখে শান্তভাবে বললো – এখানে আমরা সবাই থাকি। চলো আমার সাথে।

মীরাত থতমত খেয়ে জিজ্ঞেস করলো – লাগেজ?

মীরাতের কণ্ঠে কিছুটা উদ্বেগ ও অস্বস্তি ফুটে উঠেছে। আহিয়াদ স্বাভাবিক ভাবে বললো – চিন্তা করো না। লাগেজ সময়মতো তোমার কাছে পৌঁছে যাবে।

আহিয়াদ ফ্ল্যাটের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। মীরাতও পিছুপিছু হাঁটতে শুরু করে। একতলা পেরিয়ে ফ্ল্যাটের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে থাকে দুজনে। বেশ কয়েকটা সিঁড়ি পেরিয়ে তৃতীয়তলায় এসে থামলো দুজনে। সামনে কাঠের সুসজ্জিত কারুকাজের কাঠের দরজা। আহিয়াদ কলিং বেল বাজায় বেশ কয়েকবার। মীরাত অস্বস্তিতে সিটিয়ে আছে। সামনে কি হতে চলেছে তা ভাবতেই গলা শুকিয়ে আসছে।

মীরাত আহিয়াদের দিকে তাকিয়ে মিনমিন করে বললো – আমার ভ’য় করছে।

আহিয়াদের ভ্রুযূগল কুঁচকে গেলো এবং সে আশ্চর্য হয়ে বললো – “কেনো?

মীরাত মুখ কাচুমাচু করে মুখ ভার করে বললো – “আপনার বাবা-মা যদি আমায় মেনে না নেন?

আহিয়াদ ভরসা দিয়ে শান্ত কন্ঠে বললো – তেমন কিছু হবে না। রিলাক্স।

মীরাত শুনে চুপচাপ রইল। তবুও বক্ষকোণে কোথাও উদ্বেগ আর ভ’য় কাজ করছে।

হঠাৎই কাঠের দরজাটি খুললো কেউ। দুজনেই সামনে তাকালো। চল্লিশের গণ্ডি পার করা এক মহিলা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। তার চোখে চশমা, আর জামা-কাপড়ে স্পষ্ট এক আভিজাত্য ও সুস্থিরতার ছাপ। মহিলাটি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সামনের দুই জনকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। মীরাত তা দেখে আহিয়াদের পেছনে লুকানোর প্রয়াস চালালো। তার চোখে মুখে ফুটে উঠেছে অস্বস্তি ভাব।

আহিয়াদ মৃদু হেসে সুরমা বেগমকে বললো – কেমন আছো মা?

সুরমা বেগম এক উষ্ণ হাসি হাসলো। তিনি ছেলের মুখে স্নেহভরে হাত বুলিয়ে বললেন–‘আলহামদুলিল্লাহ। তুমি আজ আসবে বলে আগেভাগে কিছু জানাওনি কেনো?

আহিয়াদ মাথা চুলকে, গম্ভীর মুখে সামান্য হাসি দিয়ে বললো– তোমাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্যই আমি না বলে এসেছি।

সুরমা বেগম হাসি বন্ধ করে সন্দিহান কন্ঠে বললেন – তা বুঝলাম। কিন্তু পেছনে লুকিয়ে আছে মেয়েটা কে?

আহিয়াদ ওষ্ঠ কোণে হাসি বজায় রেখে বললো – আরে তুমি চিনতে পারছো না? ও তো তোমার ফ্রেন্ডের মেয়ে। আর…

সুরমা বেগম আহিয়াদের কথা অসমাপ্ত রেখেই বিস্মিত কণ্ঠে বললেন– “আফিয়ার মেয়ে? তুমি কি সত্যি বলছো?”

মীরাত আহিয়াদের এহেন কথা শুনে হতবাক হয়ে গেলো। “ শেষে কিনা এই পরিচয় দিলো?” ক্ষুদ্ধ হলো সে। মুখ থমথমে হয়ে গেলো তার। আহিয়াদ মাথা নাড়িয়ে হ্যা বললো সুরমা বেগম কে।

সুরমা বেগম মীরাতকে হাত ধরে কাছে টেনে, তার মাথায় স্নেহভরে হাত বুলিয়ে হাস্যজ্জ্বল মুখে বললেন, – “আফিয়ার মেয়ে তো দেখতে মাশাল্লাহ । কেমন আছো, মা?

মীরাত গোমড়ামুখে হাসার প্রয়াস করে বললো – আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন আন্টি?

– “আমিও ভালো আছি। তুমি যে আসবে, সেটা আমার জানা ছিল না। আজকের চমক সত্যিই বেশ আনন্দদায়ক। আরে, এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি? ভেতরে চলো।”

সুরমা বেগম মীরাতকে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেন। আহিয়াদ মীরাতকে ‘আন্টি’ সম্বোধন করতে শুনে একটু অবাক হলেও তা প্রকাশ করলো না। সে দরজা বন্ধ করে ভিতরে প্রবেশ করলেন। সুরমা বেগম এবং মীরাত সোফায় বসে আছেন। আহিয়াদ এসে রিমোট দিয়ে এসি চালু করলো এবং সোফায় হেলান দিয়ে বসে পড়লো।

আহিয়াদ সোফায় গা এলিয়ে বসে ক্লান্ত স্বরে বললো– মা বাবা কোথায়?

সুরমা বেগম উত্তর দিলেন– তোর বাবা অফিসে। যা ফ্রেশ হয়ে নে।

আহিয়াদ কিছুক্ষণ মৌন থেকে বললো– আমার কিছু কথা ছিলো। তখন তো পুরো কথা শোনার আগেই রিয়েক্ট করে ফেলেছো।

সুরমা বেগম বললেন– পরে শুনবো। তুই নিজের রুমে যা। আমি মেয়েটাকে ওর জন্য রুম দেখিয়ে দিচ্ছি।

আহিয়াদ গম্ভীর কণ্ঠে বললো – মা ওর নাম মীরাত।

সুরমা বেগম মীরাতের দিকে তাকিয়ে বললেন – বাহহ। দেখতেও মাশাল্লাহ নামটাও মাশাল্লাহ।

মীরাত মৃদু হাসলো শুধু।

আহিয়াদ একপলক মীরাতের অস্বস্তি ভরা মুখের দিকে তাকালো। তারপর চোখ ফিরিয়ে সুরমা বেগমের হাস্যময় মুখ দেখে মৃদু গলায় বিরবির করে বললো –“যখন তুমি জানতে পারবে যে, তোমার বান্ধবীর মেয়ে বলে যাকে তীব্র আদর-যত্ন করা হচ্ছে, সে আসলে তোমারই পুত্রবধূ তখন কী হবে, সেটাই আমি ভাবছি।”

সুরমা বেগম মীরাতের হাত ধরে রুমের দিকে নিয়ে যেতে স্নেহময় কণ্ঠে বললেন – তোমাকে রুমটি দেখিয়ে দিচ্ছি। ফ্রেশ হয়ে নাও। পরে আমরা চারজন একসাথে খাবার টেবিলে বসব।”

মীরাত দ্বিধার সহিত বললো – ঠিক আছে আন্টি।

আহিয়াদ হা হুতাশ করে ধীরে ধীরে বললো,– “বাহ, মীরাত আসতেই আমার আদর কমে গেল। সবই কপাল, বুঝলি আহিয়াদ? তোর আদর-যত্নের ভাগ নিতে আরেকজন চলে এসেছে।”

[ আজকের পর্ব কেমন হয়েছে সকলে জানাবেন। ]

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here