গল্প: ম্যানহোলের_অতলে
পর্ব-৯
লিখা : #এম_আর_রাশেদ এবং
#মল্লিকা_জাহান
পিয়াশকে হত্যার সন্দেহে ময়নাতদন্তের জন্য যখন পাঠানো হয় তার পরবর্তী সময় আয়ান একবার ওই রুমে প্রবেশ করেছিল। যদিও তখন ময়নাতদন্তের রিপোর্ট হাতে এসে পৌছায় নি, কিন্তু রক্তের দাগ সহ হত্যার অনেকাংশ সেখানেই প্রমাণ মেলে। সব চেয়ে অবাক করা বিষয় হচ্ছে আয়ান রুমটা পর্যবেক্ষণের সময় খাটের কোণায় কারো হাতের একটা ব্যাচলাইট দেখতে পায়। ব্যাচলাইটে রক্তমিশ্রিত ছিল। আয়ান ধারনা করে, হয়তো পিয়াশকে হত্যা করার পর যখন চেয়ারে টেনে নেওয়া হয় তখন ব্যাচটা হাত থেকে খুলে পড়ে যায়। কাউকে এই খবরটা জানায়নি কারণ সন্দেহ আপন মানুষদেরই। তবে সন্দেহের বশেই তো আর সবকিছুর সমাধান আর সঠিকটা বিচার করা সম্ভব না। চোখের দেখাতেও অনেক সময় ভ্রম থাকতে পারে। নির্বিঘ্নে কেসটা পরিচালনার জন্য আয়ান বরাবর বিষয়টিতে গোপনীয়তা রক্ষা করেছে। আর ময়নাতদন্তের রিপোর্টের একটা ব্যাপার ছিল।
তবে একটা বিষয় লক্ষ্যনীয় ছিল যেটা কেসের অনুকূলে মোড় ঘুরিয়ে দেয় , ব্যাচলাইটের সঙ্গে ইংরেজি ক্যাপিটাল লেটার “R” যুক্ত করা। যেটা প্রথম থেকে আয়ানকে ভাবিয়ে তুলেছে। মানুষ সাধারণত তার নিজের নামের প্রথম অক্ষরটা সেইমবল হিসেবে হাতে গলায় ঝুলিয়ে রাখে। এখনেও তার ব্যতিক্রম হবে না। কিন্তু “R” দিয়ে এই পরিবারে কার নাম হতে পারে? যদি সেই ক্লু মিলতো তবে হত্যাকারি আজ হাতের কব্জায় থাকতো। তবে কি বাইরের কোনো মানুষকে দিয়ে হত্যা করানো হয়েছে?
সুপ্তি এখন পুরোপুরি সুস্থ। তার বাবাকে হসপিটাল থেকে বাসায় সিফট করা হয়েছে। কিছুদিন অতিক্রম হওয়ার পর আস্তে আস্তে সবকিছু স্বাভাবিক হতে লাগলো। আসলে সময়ের ব্যবধান মানুষের সবথেকে বড় ক্ষতের উপরেও আবরণ তৈরি করে, লেপে দেয় ভুলে থাকার প্রলেপ। আজিম সাহেবও আগের চেয়ে স্বাভাবিক। আয়ান নীরবে ছক কষে যাচ্ছে। মাঝে মধ্যে কেসের প্রয়োজনীয়তায় সুপ্তিদের বাড়িতে যাওয়া হয়। সুপ্তির নম্বরটা আয়ান নিজের কাছে রেখেছে। কেসের তদন্তে কখন প্রয়োজন পরে বলা যায় না।
সুলতানা নামাজ কালাম পড়েন। বাড়িতে মানুষ খাওয়ানোর ব্যবস্থা করেন প্রায়ই। দান-খয়রাত করেন প্রচুর। পিয়াশের ব্যবহৃত বস্তু গুলো বিলিয়ে বেশিরভাগই বিলিয়ে দেন। প্রতিবেশীরা প্রশ্ন করলে এক গাল হাসেন, কারণ স্মৃতি ধূলিমাখা রুমে তালা বন্ধ রেখে কি লাভ! তার চেয়ে বরং স্মৃতির বদলে বিলিয়ে পুন্যের খাতায় মেয়েকে পরকালে পেতে চান। আচ্ছা যদি স্বর্গে ঠায় হয় তবে পিয়াশ কি এমন থাকবে না বড় হবে? চুল গুলো আরো বাড়বে, কোমড় ছাড়িয়ে যাবে! চোখে কাজল দিলে মায়াবী লাগবে। চোখা নাকে নাকফুল পরলে হুরের চেয়ে কম না। ভাবতেই সুলতানার চোখে পানি। যে মেয়েকে দশ মাস পেটে রাখলো সে আজ নেই৷ আমির সাহেবও নিজের প্রতি দোষারোপ ভাবটা কাটাতে পারছেন না৷ যেন খুনী ধরা পরা না অবধি শান্তি নেই! প্রায়ই মাঝরাতে উঠে বসে থাকে, সুপ্তী এমন হলে ওকে আর বারণ করবে না তিনি। বলবে, যা ভালো বুঝিস কর! নেহাৎ প্রেম নামক সম্পর্কের বিষয়ে সম্মানকে বড় করে আজ মেয়েটা লাশ। স্মৃতির খাতায় বন্ধি। পিয়াশের বায়না গুলো আজও কানে শুনতে পায়, আধো আধো করে বলতো ” বাবা আসবে কবে? পুতুল এনো? বড় আপু ধরতে দেয় না আমায়। ”
মেয়েটি আজ নেই৷ অতলে মিশে গিয়েছে। পাড়া-প্রতিবেশীদের আলোচনার কেন্দ্র এখন আমির হোসেনের পরিবার। জম- জমাট গল্প, কত মানুষ মজা পায় আবার কত মানুষ সন্তানহারা বাবা-মাকে দেখে করুণা। প্রত্যেকটা মুন্দ্রারই দুটো দিক আছে, আপনাকেই যাচাই করতে হবে আপনি কোনটা চান? ভালো দিকটা চাইলেই সবটা ভালো, আর খারাপ চাইলে সবটাই খারাপ। এখন সব উপেক্ষা করে যদি কোনো সকালের উদয় হয় তারই প্রতীক্ষায় রয়েছে।
আয়ান কাজ শেষ করে দ্রুতই বাসায় ফিরলো। তার বোন অন্তুকে আজ হসপিটালে নিয়ে যাবার কথা। টেস্ট করে যেকোনো দিন সময় নির্ধারণ করা হবে। চার’টার দিকে রওয়ানা হলো। সবকিছু পরিক্ষা করে সামনে মাসের সাত তারিখ সময় নির্ধারণ করা হলো। তার মানে আয়ানের হাতে আরও পনেরো দিনের মতো সময় আছে। একদিকে আয়ানের মনে খুশি ঝেকে বসেছে যে সে মামা হতে চলেছে। আবার অন্যদিকে তার হাতে যে অমীমাংসিত কেস পড়ে আছে তার দুশ্চিন্তা রাতের ঘুম হারাম করে দিচ্ছে। আয়ান মনে প্রাণে চাইছে যেন পনের দিনের মধ্যেই কেসটার চূড়ান্ত সমাধান হয়। সূত্রতো তার হাতেই আছে, কিন্তু কিন্ত প্রয়োগটা কোথায় হবে তা দেখার অপেক্ষা। হসপিটাল থেকে বেরিয়ে হালকা কিছু কেনাকাটা করে সাতটার একটু পরে বাসায় ফিরলো আয়ান আর অন্তু।
ফ্রেশ হয়ে খাবার খাওয়া শেষে আনমনে ভাবছে আয়ান। হঠাৎ রিং বেজে উঠলো। আজিম সাহেব ফোন করেছে। সটান কপাল কিছুটা সময়ের জন্য কুঁচকে গেলো। আয়ান ফোনটা রিসিভ করে বলল;
— হ্যালো, আসসালাম আলাইকুম স্যার।
— ওয়ালাইকুম আসসালাম। আয়ান।
— হ্যাঁ স্যার বলুন।
— আসলে কেসের ব্যাপারে কিছু বলতে চেয়েছিলাম। কতদূর এগুলো? আর তুমি বলেছিলে কি যেন একটা ক্লু পেয়েছিলে সে ব্যাপারে তো কিছু জানালে না।
— আসলে স্যার এটা ফ্যামিলি ম্যাটার, এই জন্য আমি গোপনীয়তা বজায় রেখেছি। হত্যাকারী বেশ চৌকস হলেও নিস্তার পাবেনা। খুব বেশি দেরি নেই স্যার এর সমাধান হয়ে যাবে। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন।
— তুমিই ভরসা।
কথা শেষে ফোনটা কেটে আয়ান আবার ভাবতে লাগলো, কিছুতেই মনোযোগ দিতে পারছেনা। বড় কিছু হাতের কাছে পেয়েও যে কিছুই পায়নি। গোলকধাঁধায় ঘুরছে।
— মা এক গ্লাস পানি দিয়ে যাও তো।
— এই নে পানি।
মরুর বুকে পিপাসিত যাযাবরের মতো এক নিঃশ্বাসে পানি গিলতে লাগলো আয়ান। এই পানিতে যেন তার কিছু হয়নি, এক সমুদ্র পানি লাগবে।
— কিরে আয়ান তোর কি শরীর খারাপ? এমন বিষন্ন লাগছে কেনো? কিছু হয়েছে বাবা?
মায়ের চিন্তিত ভরা প্রশ্নের উত্তরে আয়ান বলল;
— না মা তেমন কিছুনা। এমনি আজ ক্লান্ত লাগছে। অন্তু ঘুমিয়েছে?
— হ্যাঁ ও তো সেই কখন ঘুমিয়েছে।
— আচ্ছা টিভির রিমোটটা একটু দিয়ে যাও তো। আর তুমিও ঘুমিয়ে পড়ো।
সোফায় বসে রিমোট হাতে নিয়ে খুঁটছে। টিভি চালু করে অযথাই চ্যানেল পরিবর্তন করছে। একটু থামলো, একটা চ্যানেলে ভালো নাটক হচ্ছে। আয়ান সময় পেলে প্রায়শই দেখে। তবে আজ আর মন বসছেনা আজিম সাহেব হঠাৎ ফোন করে যেন অজান্তেই আরও মনটা খারাপ করে দিলো। মনে করিয়ে দিলো এতোদিনে এই কেসের ধোঁয়াশায় আবৃত ব্যর্থতার কথা।
আবার চ্যানেল পরিবর্তন করতে যাবে ঠিক সেই মুহুর্তে নাটকের একটা দৃশ্যপটে আয়ানের চোখ আটকে যায়। ‘থ’ বনে যায় কিছুক্ষণের জন্য। আরে এটাও তো সমাধানের দ্বিতীয় সূত্র হতে পারে। ভাবছে; এটা কেনো আগে আমার মাথায় এলো না।
আয়ান ঝটকায় দাড়িয়ে ফোনটা খুঁজতে লাগলো। খুঁজে না পেয়ে অস্থির হয়ে ওঠে। অনেক খোঁজাখুজির পর দেখে ফোনটা নিজের পকেটেই ছিল। অজান্তেই হেসে ফেলে। দ্রুত সংরক্ষিত নম্বর থেকে সুপ্তির নম্বর খুঁজে কল দিলো।
এগারোটা বেজে গেছে। এই মুহুর্তে ফোন দিয়ে বিরক্ত করা ঠিক নয়, তবুও কি করার তদন্তের স্বাপেক্ষে এইটুকু তো সহ্য করতেই হবে। দু’বার রিং হওয়ার পরও ধরলো না। হয়তো ঘুমিয়েছে। তৃতীয় বারে কল রিসিভ করে ওপাশ থেকে ঘুম ঘুম কন্ঠে বলল;
— হ্যালো কে বলছেন?
— সুপ্তি বলছেন? আমি আয়ান বলছি, আসলে এতো রাতে ঘুমন্ত মানুষকে জাগিয়ে এভাবে বিরক্ত করা একদম অনুচিত। তবুও তদন্ত স্বাপেক্ষ করতেই হচ্ছে। আপনার সাথে কিছু কথা ছিল।
— আরে না সমস্যা নেই। আমাদের জন্যই তো এতোটা করছেন বরং ধন্যবাদ আপনাকে আমাদের দেওয়া উচিত। তো বলুন হঠাৎ ফোন করার কারণ?
— এই কেসে পিয়াশে রুম থেকে আমি হত্যাকারীর প্রথম ক্লু পেয়েছি যেটা জানানো হয়নি। আপনিও দয়াকরে আর কাউকে জানাবেন না। আর দ্বিতীয় ক্লু উন্মোচন হতে যাচ্ছে। যার দ্বারা খুনীর পর্দা উঠানো সম্ভব। আপনি কি আমার সাথে কাল দেখা করতে পারবেন?
— হ্যাঁ অবশ্যই পারবো। আমার বোনের হত্যাকারীর সর্বোচ্চ শাস্তি হোক এটাই আমি চাই। আমি সবরকম সহায়তা আপনাকে করবো। কোন সময়ে দেখা করতে হবে বলুন?
— এই ধরুন সকাল দশটার দিকে। আপনাদের বাড়ির সামনের সড়কের ত্রিমোড়ে দাঁড়াবেন। ওখানে আপনার সাথে আমার আলাদা ভাবে কিছু কথা আছে। তারপর আপনাদের বাড়ির সব কয়টি রুম আমাকে ভালো করে দেখাবেন।
— ঠিক আছে। কাল কথা হচ্ছে তবে। ভালো থাকবেন।
— আপনিও।
ফোন রেখে দিয়ে আয়ান এবার একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। যদি পরিবারের মধ্যে কেউ খুনি হয়, আর আয়ানের ভাবনার সাথে মিলে যায় তবে এবার ধরতে পড়বেই। আয়ান প্রার্থণা করছে ভাগ্য যেন উল্টো দিকে সায় না দেয়।
#চলবে