#অব্যক্ত প্রেমাসুখ❤️🔥
#আদ্রিতা নিশি
।১৩।
[কপি করা নিষিদ্ধ ❌]
মীরাত আহিয়াদের বিছানায় নীরব বসে আছে, তার চোখে মুখে উৎকণ্ঠা আর বিস্ময় স্পষ্ট। আহিয়াদ, তার কপালের ব্যথার স্থানে ধীরলয়ে আইস কিউব চাপিয়ে দিয়ে অত্যন্ত যত্নের সাথে মীরাতের মাথায় রাখছে। আহিয়াদের নিবিড় মনোযোগ, কোমল স্পর্শ মীরাতের মনে গভীর প্রভাব ফেলেছে। তার বক্ষে অদ্ভুত ভালো লাগার ফুল ফুটেছে। মনে হচ্ছে এই ক্ষণিক যত্নের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে সুন্দর অনুভূতি। মীরাত অহেতুকভাবে বার বার আহিয়াদের দিকে আড় চোখে তাকাচ্ছে। আহিয়াদের এই যত্নশীল আচরণ মীরাতের অন্তরের গহিনে ভালোলাগার অনুভূতির সঞ্চার ঘটাচ্ছে।
আহিয়াদ মীরাতের দৃষ্টি অনুভব করে গম্ভীর কণ্ঠে বললো –“আমার দিকে তাকিয়ে কী দেখছো?”
মীরাতের মুখ থেকে বেরিয়ে গেল অকপট উত্তর– “আপনাকে।”
তারপরেই আহিয়াদের হাত স্থির হয়ে গেল। সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে মীরাতের দিকে তাকালো। মীরাত তার অপ্রত্যাশিত মন্তব্যে লজ্জিত হয়ে মুখ লুকিয়ে অন্যদিকে তাকালো। সেই মুহূর্তে, দুইজনের মধ্যে অস্বস্তিকর নীরবতা নেমে আসলো।
আহিয়াদ বিছানার ওপরে থাকা আইস কিউবের বাক্সটা উঠে তার টেবিলের ওপর রাখলো।পিছু ফিরে মীরাতের দিকে তাকিয়ে অতি স্বাভাবিক কন্ঠে বললো –“আমাকে দেখা শেষ হয়েছে?”
মীরাত নিচু মস্তকে আমতা আমতা করে উত্তর দেয় – “ ইয়ে মানে হু।”
আহিয়াদ বুকে হাত গুজে গম্ভীর কণ্ঠে বললো –“ আশা করছি ব্যথা কমে যাবে সকালের মধ্যে।”
মীরাত চোখ উঁচিয়ে একপলক আহিয়াদের দিকে তাকিয়ে লজ্জা আড়াল করে বললো –“ আংকেল কি এখনো আছে ডাইনিং রুমে। ”
– হ্যা। বাবা হয়তো খাবার খাচ্ছে। দেখলাম মা ও আছে।
মীরাতের মুখে চিন্তার ছায়া পড়ে। তার চোখে লজ্জার ছোঁয়া, অস্বস্তি। যা সে শত চেষ্টা করেও সম্পূর্ণ আড়াল করতে পারছে না। উদ্বেগ নিয়ে বললো–“ তাহলে আমি ফাবিহার রুমে কীভাবে যাবো?”
আহিয়াদ নিবিড় অবলম্বনের মত স্নিগ্ধভাবে মীরাতের দিকে তাকায়। তার মুখাবয়বে স্বাভাবিকতার রেষ এটে বলে– “আমার রুমে থাকো।”
মীরাত অবাক চোখে আহিয়াদের দিকে তাকায়, যেনো তার মনে চোরাস্রোতের মতো প্রশ্ন ধেয়ে আসছে। আহিয়াদ তার দিকে গভীর দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে, তার মুখাবয়বের ভেতর একটি সান্ত্বনা এবং সহানুভূতির আভা। মীরাতের গলা শুকিয়ে গেছে, মনে মনে দুশ্চিন্তার ধাক্কা খাচ্ছে। ফাবিহার রুমে যদি সে যায় এবং ফাবিহা জেগে গিয়ে তাকে না পায়, তাহলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে।এই চিন্তায় তার মুখ রং হারিয়ে গেছে তার।
আহিয়াদ তার উদ্বেগের অনুভূতি বুঝতে পেরে শান্ত কণ্ঠে বললো, –”রিলাক্স মীরাত। এতো টেনশন করার মতো কিছু হয়নি। ফাবিহা খুব ঘুম কাতুরে, সকাল নয়টার আগে তার ঘুম ভাঙবে না।”
মীরাত দ্রুত উত্তর দিলো – “আমি কিন্তু আপনার রুমে থাকবো না।”
আহিয়াদ তার ঠোঁটের কোণে মৃদু বাঁকা হাসি রেখেই বললো –”তাহলে কোথায় থাকবে? সিস্টার ইন ল এর কাছে?”
মীরাত অস্বস্তি নিয়ে, মুখভর্তি অনিশ্চয়তার ছায়া নিয়ে কাচুমাচু ভঙ্গিতে বললো, –”হ্যা।”
আহিয়াদ হাসি বজায় রেখে বললো – ঠিক আছে। দেখা যাক কি হয়।
মীরাতের মুখে কিছুটা চিন্তার রেখা দেখা যায়। সে বিছানায় হেলান দিয়ে বসে।
আহিয়াদ ডিভানে বসে, তার ল্যাপটপ চালু করতে করতে ব্যস্ততার ছাপ রেখে বললো,– “বাবা প্রায়ই রাত জাগেন, ঘুমাতে ঘুমাতে প্রায় পাঁচটা বেজে যায় বেশীরভাগ সময়।”
মীরাত অপলক আহিয়াদের কাজ করার দৃশ্য দেখতে লাগলো। আহিয়াদের প্রতিটি মুভমেন্ট, প্রতিটি কাজে নিখুঁততার ছাপ স্পষ্ট। যা আহিয়াদের পার্সোনালিটির সাথে পুরোপুরি মানানসই। তার পেশাদারিত্বের এই শৈলী দেখে মীরাত ভাবতে লাগলো, আহিয়াদ আসলে কী করে? স্টুডেন্ট নাকি চাকরি করে? সে কিছুই জানে না। এই মুহূর্তে প্রশ্ন করার সাহস নেই তার। হয়তো পরের কোনোদিন সময় হলে জিজ্ঞেস করবে।
এরই মধ্যে আহিয়াদের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো– “যদি বাবা ঘুমিয়ে পড়ে, তাহলে ফাবিহার রুমে চলে যেও। যদি আমার রুমে থাকতে চাও, মাইন্ড করবো না।”
মীরাত তার চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে বললো –“আপনি কি আমার সাথে মশকরা করছেন?”
আহিয়াদ ল্যাপটপের দিকে চোখ নিবদ্ধ রেখে তার ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটিয়ে তুললো। কোনো প্রতিত্তোর না দিয়েই সে হাসি বজায় রাখল। মীরাত আহিয়াদের অঙ্গভঙ্গি দেখে নিজের মুখের কোণে মৃদু হাসি টেনে নিলো। তার চোখ থমকে গেলো আহিয়াদের এলো-মেলো সিল্কি চুলের দিকে। চুলগুলো কপালের ওপর ছড়িয়ে রয়েছে। খোঁচা খোঁচা দাড়ি আর হাস্যোজ্জ্বল মুখের দিকে অপলক চেয়ে রইল।
আহিয়াদ আগ্রহ মেশালো কন্ঠে বললো – “একটা কথা জানো?তোমার নামটা বেশ ইউনিক। ‘মীরাতুল আযহা”অসাধারণ সুন্দর নাম। তোমার পুরো নাম আমি প্রথম শুনেছিলাম বিয়ের সেই মুহূর্তে। প্রথম শুনেই খুব ভালো লেগেছিলো। কে নাম রেখেছিলো ?”
মীরাতের ভাবনার সুস্পষ্ট অবসান ঘটলো। সে মলিন কণ্ঠে বললো –“বাবা রেখেছিলো আমার নাম।”
আহিয়াদ কাজ থামিয়ে মীরাতের দিকে তাকালো।মীরাতের মুখে নিরব কষ্টের হাতছানি দেখে সে উপলব্ধি করলো যে তাঁর আচরণ মীরাতকে অপ্রত্যাশিত কষ্ট দিয়েছে। সে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মনে মনে নিজেকে অপরাধী অনুভব করলো।
আহিয়াদ কথা ঘোরানোর জন্য জিজ্ঞেস করলো – “আজ তোমার বাড়িতে কথা বলেছো?”
মীরাত উত্তর দিলো –“বলা হয়নি।”
আহিয়াদ হতাশামিশ্রিত কন্ঠে বললো –“এখনো রাগ করে থাকবে?
মীরাত একেবারে নীরব হয়ে রইলো আহিয়াদের প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে। আহিয়াদ তার কোনো সাড়া না পেয়ে আবারও কাজে মনোযোগ দিলো। মীরাতের চোখে ঘুমের ক্লান্তি ধীরে ধীরে নেমে আসছে কিন্তু সে না ঘুমানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিছুটা সময় পেরিয়ে গেছে এর মাঝে, আহিয়াদ তার কাজ সম্পন্ন করে ল্যাপটপ বন্ধ করে মীরাতের পাশে এসে দাঁড়ালো। তার চোখে পড়ে যে মীরাত বিছানায় হেলান দিয়ে গভীর ঘুমে মগ্ন।সে ডাকতে গিয়েও থেমে গেলো।মীরাতের নিঃশব্দ বিশ্রামকে বিরক্ত করতে চাইলো না। চিন্তায় বিভোর হয়ে আহিয়াদ দরজার দিকে পা বাড়ালো। বাইরে তার বাবা-মা কিছু নিয়ে আলোচনা করছিলো। দরজা ধীরে ধীরে বন্ধ করে সে ফিরে এসে মীরাতের বিছানার বালিশকে সঠিকভাবে ঠিকঠাক করে দিলো। সাবধানে, মীরাতকে সোজা করে শুইয়ে দিলো আর ওড়না সুন্দরভাবে জড়িয়ে দিলো।একপলক ঘুমন্ত মীরাতের মুখের দিকে তাকিয়ে আহিয়াদের মনে হচ্ছে মীরাতকে আজ কতটা নিষ্পাপ আর মায়াবী লাগছে। এই অনুভূতি নিয়ে সে চোখ ফিরিয়ে নিলো। তারপর লাইট বন্ধ করে বিছানার অন্যপাশে শুয়ে পড়লো।
রাত গভীর, অথচ আহিয়াদের চোখে ঘুম নেই। তার মনে চলছে নানা ভাবনার ভিড়। পাশেই শুয়ে আছে নববিবাহিতা স্ত্রী, কিন্তু পরিস্থিতি তার কাছে কিছুটা অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে। মীরাতের মনে বর্তমানে কী চলছে তার সম্পর্কে সে স্পষ্ট কিছু জানে না। মেয়েটা কি এখনও স্বাভাবিক হতে পেরেছে? খুব শিগগিরই পরিবার ও জেনিকে বিয়ের খবর জানাতে হবে। বিয়ে একবারই হয় আর সে এ সম্পর্কের প্রতি পূর্ণ মনোযোগ ও দায়িত্বশীলতার সাথে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। মীরাতকে কবুল বলার সাথে সাথে সে মন থেকে তাকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেছে। আহিয়াদ সারাজীবন মীরাতের সাথে পথ চলতে চায়, কিন্তু মীরাত কি তাকে স্বামী হিসেবে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পারবে?
আহিয়াদ মায়াভরা দৃষ্টিতে ঘুমন্ত মীরাতের দিকে তাকালো। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে, তার চোখ বন্ধ করে নিলো। ঘুমানো প্রয়োজন, তার মন শান্ত করার জন্য।
★★
রাত পেরিয়ে ভোর হয়েছে। বাহিরে পাখির কলরব শোনা যাচ্ছে। থাই গ্লাস ভেদ করে জানালার পর্দার ফাঁকা হতে ক্ষীণ আলো রুমে প্রবেশ করছে। মীরাতের ঘুম ভেঙে গেলো সে পিটপিটিয়ে চোখ খুললো। চোখ খুলতেই আবিষ্কার করলো অচেনা রুম। তার কপাল কুঁচকে গেলো। গায়ের ওপর ব্ল্যাংকেট দেখে আশ্চর্য হয়ে গেল। পাশে তাকাতেই পিলে চমকে উঠলো তার। আহিয়াদকে ঘুমন্ত অবস্থায় তার সন্নিকটে দেখে শ্বাস আঁটকে যাওয়ার যোগাড়। সে ধরপরিয়ে উঠে বসলো বিছানায়। ভালোভাবে খেয়াল করে দেখলো আহিয়াদ তার সন্নিকটে নয় বরং সেই আহিয়াদের সন্নিকটে চলে গিয়েছিলো। নিজের কাজে নিজেই বিরক্ত সে। কিছুটা লজ্জা অনুভূত হলো তার।একা একা ঘুমানোর অভ্যাস। পুরো বিছানা জুড়ে ঘুমিয়ে থাকতো। আজই সেই একই কান্ড ঘটিয়েছে। সে লম্বা শ্বাস টেনে নিলো। সে তো বিছানায় বসে ছিলো। তাহলে শুইয়ে দিলো কে? নিশ্চয়ই আহিয়াদ শুইয়ে দিয়েছে। ব্ল্যাংকেট দেখে তা বুঝে নিয়েছে। মীরাত সতৃষ্ণ নয়নে তাকালো আহিয়াদের ঘুমন্ত মুখাবয়ে। মুহুর্তেই তার ওষ্ঠ প্রসারিত হলো। তার মনে হলো “ মানুষটা তার জন্য মোটেও মন্দ নয়। ভালোই আছে। ” দৃষ্টি ঘুরিয়ে বালিশের পাশে থাকা আহিয়াদের ফোন হাতে নিয়ে সময় দেখলো সে।ছয়টা পনেরো বাজে। চোখ বড় বড় হয়ে গেলো তার। ফোন রেখে দ্রুততার সহিত বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো। দরজার দিকে যাওয়ার আগে কিছু একটা মনে করে আহিয়াদের শরীরে ব্ল্যাংকেট দিয়ে সুন্দর মতো ঢেকে দিলো। সে খেয়াল করল মানবটি উপর হয়ে শুয়ে আছে। সে আর দাঁড়ালো না দ্রুত দরজার কাছে গেলো। ধীরে দরজা খুলে ফাবিহার রুমে চলে গেলো।
মীরাত নিঃশব্দে ফাবিহার রুমের দরজা খুলে ধীরে ধীরে পা টিপে টিপে প্রবেশ করলো। দরজা বন্ধ করার পর ফাবিহার ঘুমন্ত মুখের দিকে একবার দেখে তার মন শান্ত হলো। ফাবিহা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। মীরাত সতর্কভাবে নিজের শোয়ার জায়গায় গিয়ে বসল।
মীরাতের হঠাৎ চোখে পড়লো আহিয়াদ আর ফাবিহার মুখাবয়বে অনেক মিল রয়েছে। এই মিল দেখে যে কেউ সহজেই বুঝবে, দুজনে ভাই-বোন।
মীরাত তার ফোন হাতে নিয়ে কল লিস্টে থাকা মায়ের নম্বরের দিকে তাকালো। ভাবলো, প্রথমে মায়ের সঙ্গে কথা বলা উচিত, নাকি আগে আরিশাকে ফোন করা উচিত। কিছুক্ষণ চিন্তার পর, সে সিদ্ধান্ত নিলো যে আফিয়া বেগমের নম্বরই প্রথমে ডায়াল করবে।
ফোনটি হাতে নিয়ে, মীরাত নম্বর ডায়াল করলো। একটানা ডায়াল টোন শোনা যেতে লাগলো, আর মীরাত অপেক্ষারত অবস্থায় চিন্তামগ্ন হয়ে গেলো।
[আজকের পর্ব কেমন হয়েছে।সকলে জানাবেন।]
চলবে…