#বাঁধন হারা তীরে
#রাহনুমা রাহা
#পর্বঃ০২
তটিনী মেহবুবা। ভালবাসার ডাক তনু। যদিও সেই সংখ্যা অতি সীমিত। ফর্সা, ছিমছাম গোছের তটিনী টাঙ্গাইল সদরের সরকারি কুমুদিনী মহিলা কলেজের একাদশের ছাত্রী। মা বাবা ও দুই বোনের সংসারে বড় সে। যদিও তার আরও একটা বোন আছে। বড় বোন। রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও একই নিবাসে বসবাস তাদের। শান্ত, মার্জিত তটিনী নরমে তুলোকেও হারিয়ে দেয়ার ক্ষমতা রাখে। মূলত সাত চড়ে রা কাটে না গোছের সে! তাই তো নরম মাটি পেয়ে ইঁদুর ধেয়ে উঠার ঘটনাও রয়েছে অসংখ্য।
তীব্র জ্বর নিয়ে সকালের খাবার টেবিলে গুছিয়ে দিয়ে বিছানামুখো হতেই ঝাঁঝাল গলায় নিজের নাম শুনতে পেল তটিনী। এবার গলাটা তার মায়ের নয়; বোনের। বড় বোনের।
“এই তটিনীর বাচ্চা; আমার জন্য যে লেবু মধু দিয়ে গরম পানি করতে হবে, সেটা ভুলে গেছিস? রোজ রোজ চেঁচিয়ে আমার গলা খারাপ করতে হবে? গন্ডারের চামড়া নাকি তোর গায়ে?”
তটিনী মুচকি হাসল। তাচ্ছিল্য হাসি। গা হাত পায়ে অসহ্য ব্যথা নিয়ে পুনরায় ছুটল সে রান্নাঘরে। দ্রুত হাতে সামলাতে লাগল নিজের দায়িত্ব। নইলে যে তুলকালাম বাঁধবে ; তুফান উঠবে। সেই তুফানে হওয়া সমস্ত আঘাত এসে পড়বে তারই উপর!
হুইলচেয়ারে ভর ছেড়ে বারান্দায় বসে সকালের প্রস্ফুটিত আলোয় নিজের রূগ্ন দেহ সিক্ত করতে ব্যস্ত ছিলেন আয়েশা। সহসা সামনের ভবনের ভেতর হওয়া উচ্চ শব্দ কানে এলো তার। এটা নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। সকাল সাঝে এসবই চলে অবিরত। বাচ্চা মেয়েটার জন্য ভীষণ মায়া হয় আয়েশার। ভাবেন- ইসসস কিছু যদি করতে পারতাম! কিন্তু তার ক্ষমতাই বা কতটুকু! মন খারাপ করে বসে রইলেন সেখানেই।
তপা মায়ের বারান্দায় এসে গোমড়ামুখে বসে থাকতে দেখে হাঁটুগেড়ে বসে পড়ল সামনে। দু’হাত নিজের মুঠোয় পুড়ে বলল,
“মা ; কি হয়েছে? শরীর খারাপ করছে?”
আয়েশা মাথা নাড়ালেন। না বোধক ইশারা করে বললেন,
“মেয়েটার খুব দুঃখ রে! যেদিন থেকে এসেছে, জীবনটা নরক হয়ে গেছে। বাচ্চা একটা মেয়ে। কি করে সয় তার?”
তপা মায়ের হাতের পিঠে চুমু দিয়ে গালে জড়িয়ে নিয়ে বলল,
“ভাগ্যের লিখন মা। এর বেশি তো পাওয়া যাবে না।”
“তবুও, কিছু যদি করতে পারতাম!”
তপা মলিন হাসল। মা টা যে এমনই। অন্যের দুঃখে তার প্রাণ সবার আগে কাঁদে!
কয়েকদিন পর…
তপা রেডি হয়ে নিচে নেমে গেইট লাগিয়ে দিল। অদূরেই তার হালকা গোলাপি রঙা স্কুটি তাকে বহন করার জন্য বহুল প্রতিক্ষায় রয়েছে। গেইট থেকে নজর সরিয়ে রাস্তার উল্টোদিকে তাকাতেই দেখল তটিনী তাড়াহুড়ো করে দৌড়ে আসছে। ধবধবে সাদা কলেজ ড্রেসে রূপ যেন ঠিকরে পড়ছে। তপা মোহনীয় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। মেয়ে হয়েও একটা মেয়ের সৌন্দর্যে বিমুগ্ধ হলো।
দৌড়ে তাকে অতিক্রম করতেই তপা গলা বাড়িয়ে বলল,
“ক্লাসে যাচ্ছো নাকি তনু?”
তটিনী থামল সেকেন্ড দুয়েক। মিষ্টি হেসে বলল,
“হ্যা আপু। বড্ড দেরি হয়ে গেছে। আজ প্রথম পিরিয়ডে ফিজিক্সের ক্লাস টেস্ট রয়েছে। অথচ আজই আমার দেরি হয়ে গেল।”
তপা কিঞ্চিৎ ভেবে বলল,
“স্কুটিতে এসে বসো। আমি নামিয়ে দিয়ে আসছি।”
তটিনী জোর গলায় বলল,
“না না আপু। তুমিও তো ক্লাসেই যাচ্ছো বোধহয়। তোমারও দেরি হয়ে যাবে। আমি চলে যাব কোনোভাবে। তুমি ভেবো না।”
তপা চোখ গরম করে বলল,
“আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি? উঠে বসো বলছি। শর্টকাটে একদম জাস্ট টাইমে নামিয়ে দিয়ে আসব। আমিও সময়ে পৌঁছে যাব। চাপ নেই।”
অগ্যতা তটিনী রাজি হলো। অবশ্য তারও ভালো হয়েছে। আদি টাঙ্গাইলের এই গলি থেকে কুমুদিনী ক্যাম্পাসে পৌঁছাতে তার সহপাঠীদের সাত বার পরীক্ষা দেওয়া হয়ে যেতো। তাও যদি গাড়ি চেপে যেতে পারতো….
তটিনী কে নামিয়ে সোজা রাস্তা রেখে পলাশতলীর রাস্তা ধরল তপা। অফিস টাইম হওয়ার শহরের রাস্তায় বেশ যানজট নজরে আসছে। তপা সরু রাস্তা ধরে এগিয়ে মিনিট পাঁচেক পর মেইন রাস্তায় এলো। কিন্তু বিপত্তি বাঁধল উদ্যানের কাছে এসে। কোনো এক পার্টির সম্মেলন রয়েছে এখানে। রাস্তা পুরো জ্যামে আঁটকে আছে। বেশ ক’খানা ঝা-চকচকে গাড়ি রাস্তার একপাশে জড়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেটিই মূলত যানজটের প্রধান এবং অন্যতম কারণ। তপা বিরক্ত হলো। গাড়ি আছে বলেই এতগুলো নিয়ে বেরিয়ে পড়তে হবে নাকি। মনে মনে একপ্রস্ত বকাবকি করে স্কুটি ঘুরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু ব্যাঘাত ঘটল আরো একটা গাড়ির তীব্র আওয়াজে করা হর্ণের শব্দে। মারাত্মক বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে ফেলল তপা। মাথা তুলে চেয়ে দেখল ঠিক তার মুখোমুখি এসেই থেমেছে গাড়িটা।
তাকিয়ে থাকতে থাকতেই দরজা খুলে বেরিয়ে এলো এক সুঠামদেহী, সুদর্শন পুরষ। সাদা পাঞ্জাবি গায়ে জড়িয়ে, হাতা কনুই পর্যন্ত গোটানো। বাম হাতে কালো বেল্টের ঘড়ি নিজের উপযুক্ত জায়গা পেয়ে সহাস্যে তাকিয়ে দেখাচ্ছে ভূলোক কে। ফর্সা গালের যত্ন করে কাটা খোঁচা খোঁচা দাড়ি চেহারার সাথে ঠিক মানানসই। না বেশি, আর না কম। চোখে মুখে গাম্ভীর্যের ছাপ স্পষ্ট। প্রখর ব্যক্তিত্ব যেন প্রথম দর্শনেই টের পাওয়া যায়। লম্বা চওড়া দেহের মালিক কে দেখে তপার ভ্রু যুগলের মাঝে কিঞ্চিৎ ভাজ পড়ল। পলক তাজওয়ার! তার-ই সম্মেলন!
তপা পলকের দিকে মনোযোগ দৃষ্টি বুলাতে বুলাতেই বড় বড় পা ফেলে সে উদ্যানের ভেতরে চলে গেল। তার উদ্যোগেই আজ এই সম্মেলন। তপা মাথা বাড়িয়ে ভেতরে দেখার চেষ্টা করেও বিফল হলো। পরক্ষণেই উঁকিঝুকি মারতে চাইল। কিন্তু ক্লাসের কথা মনে হতেই স্কুটি স্টার্ট করে ছুটল ইউনিভার্সিটির পথে।
স্থিরচিত্তে সামনে তাকিয়ে আনমনে মৃদুস্বরে বারবার আওড়ালো,
“পলিটিক্স, পলিটিক্যাল পাওয়ার, পলিটিক্যাল লিডার! আই হেট বোথ অফ দেম!”
পলকের সাথে তপার এটা দ্বিতীয়তম সাক্ষাৎ। প্রথম দিন ইউনিভার্সিটিতে এবং আজ রাস্তায়। এর আগে ছবিতে পোস্টারে দেখলেও সামনাসামনি এই প্রথম। ইউনিভার্সিটিতে পলকের যাতায়াত থাকলেও আশ্চর্যজনক ভাবে তপার মুখোমুখি হয় নি সে। অথচ বিগত কয়েকদিনেই দুইবার হয়ে গেল।
ক্যাম্পাসে পৌঁছে বিজয় সরণীতে গিয়েই দেখা মিলল সিজানের। সে বইয়ে মুখ ডুবিয়ে আছে। পৃথাটা কে নজরে আসছে না আশেপাশে। তপা গুটিগুটি পায়ে গিয়ে সিজানের পেছনে দাঁড়াল। মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি আসতেই মুচকি হেসে ঠাস করে থাপ্পড় বসিয়ে দিল পিঠ বরাবর। আকস্মিক আক্রমণে সিজান হতবিহ্বল হয়ে পড়ল। ভয় পেয়ে প্রায় লাফিয়ে হাত খানেক পিছিয়ে গেল। তপা সিজানের ভীতু মুখ দেখে কোমর চেপে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। সিজান বিরক্তি প্রকাশ্যে চোখ ছোট ছোট করে রইল শুধু।
“পৃথা কোথায় রে?” আশেপাশে নজর বুলিয়ে বলল তপা।
সিজান বই ব্যাগে ঢুকিয়ে নিতে নিতে বলল,
“তোর বান্ধবী; তুই জানবি। আমারে কেন বলিস? আমার কি কিছু হয় সে?”
তপা সরু চোখে তাকিয়ে রইল। কিঞ্চিৎ সময় পর বলল,
“কে বলছে এই কথা? যখন সোনা মনা, জাদু টোনা বলিস আড়ালে, তখন? তখন কি আমি জানতে চাই কে হয় তোর? হারামি ; কি করছিস আমার জান্টুসটার সাথে? কোথায় ও?”
“আসে নি এখনো সে। আজ আসবে না।” অভিমানী গলায় বলল সিজান।
তপা মুচকি হাসল। বলল,
“মিস করছিস?”
সিজান লাজুক হেসে বলল,
“ওই আর কি। একটুখানি।”
তপা শয়তানি হাসল। কাছে ঘেঁষে বসে বলল,
“আমি তো আছি। আমাকে দিয়ে আজ চালিয়ে নে জানেমন।”
সিজান তৎক্ষণাৎ সিটকে সরে গেল। সঙ্কিত ভঙ্গিতে চেঁচিয়ে বলল,
“আম্মা; তুই আমার আম্মা। আমার সংসারে আগুন জ্বালাইস না আর। পায়ে ধরি। এমনিতেই দাবানল লাইগা আছে। প্রেম করি এক লার্ভার লগে আর বান্ধবী হইলো অগ্নিসমুদ্র। মাঝখান থেকে আমি এক বরফ গলা নদী।”
তপা হেসে উঠল শরীর কাঁপিয়ে। হাসির তোড়ে কপালের উপর পড়ে থাকা এলো চুলগুলো আরও এলোমেলো হয়ে গেল খানিকটা। শ্যামাবরণ দেহের খুশির ঝলকে মায়া সমুদ্রের এক রাশ মায়ারাশি এসে লুটিয়ে পড়ল আপাদমস্তক। পুরো পৃথিবী অবাক হয়ে অবলোকন করল সেই মোহনীয় সৌন্দর্য! গেঁথে নিল মনের অন্তঃপুরে!
“তোর জন্য একটা অফার এসেছে।”
সিজানের কথা শুনে প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকাল তপা। ভ্রু নাচিয়ে বলল,
“কিসের অফার? বিয়ের?”
সিজান তপার মাথায় গাড্ডা মেরে বলল,
“ফাজলামি রাখ। উপস্থাপনার অফার। প্রেসক্লাবে সামনের সপ্তাহে একটা অকেশন আছে। সেখানেই উপস্থাপনা করতে হবে। করবি? আমি কিন্তু তোকে না জানিয়েই হ্যা বলে দিয়েছি। আমার সম্মানটুকু রাখিস।”
তপা ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে রইল। অতঃপর সিজানের মাথায় মারা গাড্ডা উসুল করে বলল,
“তোর আবার সম্মান! আছে নাকি ছিটেফোঁটা? কিন্তু আমাকে কে চাইল? আমি তো কলেজ ফেস্ট ছাড়া উপস্থাপনা করি নি কখনো!”
“করিস নি তাতে কি? এখন থেকে করবি। আর কে চাইল সেটা জেনে কি করবি? আমি তো আছিই তোর সাথে। আমার উপর ছেড়ে দে। শুধু যা পেমেন্ট করবে অর্ধেক আমারে দিয়ে দিস, তাহলেই হবে।”
তপা ঠোঁট বেঁকিয়ে হেসে বলল,
“আমি পুরোটাই তো তোর!”
সিজান হাত জোড় করে মাথা নুয়ে বলল,
“আম্মা ক্ষ্যামা দে..”
চলবে…