বাঁধন হারা তীরে #রাহনুমা রাহা #পর্বঃ০৬

0
110

#বাঁধন হারা তীরে
#রাহনুমা রাহা
#পর্বঃ০৬

নিকষ কৃষ্ণ আঁধারের মোহ মায়া ছেড়ে নিজের সত্তায় ফিরে এলো পলক। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসতে চেষ্টা করল। কিন্তু ওষুধের সাইড ইফেক্টে শুয়ে পড়ল পুনরায়। তপা হন্তদন্ত হয়ে বলল,
“আস্তে আস্তে ; লেগে যাবে।”

পলক মলিন মুখে মৃদু হাসল। পুনরায় চেষ্টা করতেই উঠে বসল সে। বালিশে হেলান দিয়ে বসে ঘুম ঘুম গলায় বলল,
“একটা ফোন পাওয়া যাবে?”

তপা ভ্রুকুটি করে তাকাল।দাঁত কিরমির করে বলল, “উঠেই শুরু হয়ে গেছে হুকুম।”

কিন্তু মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল,
“তা পাওয়া যাবে। কিন্তু আপনি আগে ফ্রেশ হয়ে নিন। আমি বের হব কিছুক্ষণেই। আপনার খাওয়া হলে ওষুধ আছে। ওষুধ দিয়ে তবেই বের হতে পারব।”

পলক সরু দৃষ্টি ফেলল তপার উপর। সন্দিহান গলায় বলল,
“আপনি চাইছেনটা কি বলুন তো? এত কিসের যত্নআত্তি? আমি যতদূর জানি আপনার আমাকে পছন্দ নয়। তবে..?”

“আপনাকে স্পেশালি অপছন্দের কোনো কারণ নেই। আমি রাজনীতি পছন্দ করি না ; আর না করি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের। তবে আপনার সাথে আমার কোনো শত্রুতা নেই। আর না কোনো ব্যক্তিগত রেষারেষি। এক্ষেত্রে আমি আপনাকে মানুষের পর্যায়েই ফেলেছি। মানুষ হয়ে মানুষ কে সাহায্য করতে নিশ্চয়ই কোনো মোটিভের প্রয়োজন নেই!”

পলক বিস্ময়ে তাকায়। বিস্মিত গলায়ই বলে,
“নেতারা মানুষের পর্যায়ে পড়ে না?”

তপা তাচ্ছিল্য হাসল। বলল,
“তারা সব কিছুর উর্ধ্বে। মানুষ বোধহয় সেখানে অতি সামান্য।”

“এত কিসের ঘেন্না?” পলকের সরল প্রশ্ন।

তপা প্রতিত্তোর করে না। তাকিয়ে রয় নির্নিমেষ। চোখেমুখে ফুটে উঠে কিছু চাপা যন্ত্রণা। কিছু না পাওয়ার আক্রোশ। যার সামনে ভাটা পড়ে এক চঞ্চল কিশোরীর পরদে পরদে সাজানো রঙিন স্বপ্ন।

তপার ভাবলেশহীন মুখাবয়ব দেখে পলক বিছানা থেকে নিচে পা ফেলে। ওয়াশরুমে যাওয়ার উদ্দেশ্যে নামলেও পায়ের উপর ভর দিতেই টালমাটাল হয়ে যায়। পড়ে যেতে চাইলে তপা হাওয়ায় বেগে এসে বাহু ঝাপটে ধরে আঁটকায়। কিঞ্চিৎ সময় পর মাথা নিচু করে বলল,
“আমি যদি আপনাকে ধরে ওয়াশরুম পর্যন্ত দিয়ে আসি কোনো অসুবিধা হবে? এমনিতেও আপনার অনুমতি ছাড়াই অহরহ ক্ষণ এ প্রক্রিয়া চলেছে। আপনি চাইলে আর একবার… ”

“আমি পারব। একটুখানিই তো আঘাত। প্রথমবার তাই তাল সামলাতে পারি নি।” মৃদু হেসে বলল পলক।

“ডাক্তার পায়ে প্রেসার দিতে নিষেধ করেছেন। এতে সারতে সময় লাগবে। আপনি নিশ্চয়ই কাল থেকেই দৌড়ঝাঁপ শুরু করবেন! ক্ষত না শুকালে কিভাবে সম্ভব মিস্টার লিডার? তাছাড়া আমার কোনো ছোঁয়াচে রোগ নেই। নাকি ভয় পাচ্ছেন কাল রঙের ছোঁয়ার সৌন্দর্য ঘাটতির?”

পলক কড়া চোখে তাকাল। কঠোর গলায় বলল,
“আপনার মনে হয় না, আপনি বেশি কথা বলেন?”

তপা হাসল। শাহাদাত আঙুল উঁচিয়ে বৃদ্ধাঙ্গুল ছুঁয়ে বলল,
“একটুখানি।”

“বিউটি অফ ন্যাচার বোঝেন?” ভরাট গলায় বলল পলক।

“আপনি কি বসেই থাকবেন? নাকি ওয়াশরুমে যাবেন? আমার যেতে হবে মিস্টার তাজওয়ার। অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেওয়ার লাস্ট ডেট আজ। দেরি হলে নিশ্চিত বাঁশ।” কথা ঘুরিয়ে বলল তপা।

পলক তপার বাচন ভঙ্গি দেখে শব্দ করে হেসে ফেলল। তপা তাকিয়ে দেখল সেই অমাবস্যার চাঁদ! বিরবির করে বলল – লোকটা হাসতেও জানে! এতদিন ধরে দেখে আসা রাম গরুরের ছানার মুখে হাসি! কেমনে সম্ভব!
নিজের হাতেই অপর হাত দিয়ে চিমটি কাটল। ব্যথা অনুভূত হতেই চোখ বন্ধ করে ফেলল। পুনরায় বিরবির বলল,
“হাসিটা কি জোশ মাইরি!”

পরক্ষণেই যেন অদৃশ্য কেউ গগন চুম্বী আওয়াজ তুলে বলল,
“এর লাইগাই জাতীয় ক্রাশ! দেইখা লাভ নাই তপা রানী। এর লগে কিছু হইলে আজন্মকাল সংসার বাদ দিয়া জামাই পাহারা দেওন লাগতো। এইহানেই ফুলস্টপ দে আম্মা। তোর ও মঙ্গল, তারও মঙ্গল।”

অগ্যতা পলক তপার উপর নিজের সামান্য ভর প্রয়োগ করে সামনে চলতে আরম্ভ করল। নিজের থেকে অর্ধেক শক্তিসম্পন্ন মেয়ের কাঁধে ভর করে চলছে তার মত এক তাগড়া যুবক। ব্যাপারটা বেশ হাস্যরসাত্মক!

ওয়াশরুমের দরজা অবধি পৌঁছে দিয়ে তপা সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল পলকের ফেরার অপেক্ষায়। অদৃশ্য এক দায়বদ্ধতা ঘিরে রেখেছে তাকে। এটা কি শুধুই দায়িত্ববোধ নাকি অন্যকিছু? সামথিং স্পেশাল?

ভার্সিটি ক্যাম্পাসে পৌঁছে তপার চক্ষু চড়কগাছ! একি অবস্থা তার চিরচেনা ক্যাম্পাসের! আন্দোলন -মিছিল-অনশনে একাকার পুরো বিশ্ববিদ্যালয়। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছাত্রছাত্রীরা আজ একজনের জন্য জীবন পাত করতে প্রস্তুত। নিখোঁজ তার খোঁজ পাওয়ার জন্য পুরো শহর শুষে নিতেও রাজি।

তপা একজনকে জিজ্ঞেস করে এই আন্দোলনের হেতু জানতে পেরে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল মিনিট কয়েক। সর্বনাশ! এ যে ওই মানুষটার হারানো বিজ্ঞপ্তির মিছিল। হাজার লোকের ঢল। এক মূহুর্ত বিলম্ব না করে তপা বাংলা ভবনে ছুটে অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিতে। কিন্তু সেখানে সুরাহা করতে না পেরে পুনরায় ছুট লাগায় বাসার পথে। লোকটা কে জানাতে হবে যে!

একঘন্টার জায়গায় আধঘন্টার ভেতর তপা কে হন্তদন্ত হয়ে ফিরে আসতে দেখে পলক ভ্রুকুটি করে তাকাল। উঠে বসতে বসতে চিন্তিত গলায় বলল,
“আপনি ঠিক আছেন? কোনো সমস্যা?”

তপা পলকের পাশে রাখা আধ গ্লাস পানি ঢকঢক করে গিলে ফেলল। জোরে জোরে শ্বাস ফেলে নিজেকে স্বাভাবিক করতে চেষ্টা করল। অতঃপর ধীর গলায় বলল,
“আপনার নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তিতে শহর ছেয়ে গেছে মিস্টার পলক তাজওয়ার। গোটা ক্যাম্পাসের চেহারা বদলে গেছে। হাওয়ায় হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে আপনার গুম হওয়ার খবর।”

পলক বিস্ময়ে কথা বলতে ভুলে গেল। এতসব কাহিনী এক রাতের ভেতর! কি করে সম্ভব!

তপা পুনরায় বলল,
“কাল রাস্তা থেকে আপনার ওয়ালেট, ফোন উদ্ধার করে কেউ পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছে। পাশে আপনার শরীর থেকে ঝরা অনেক রক্তের দাগ দেখেছে। ওয়ালেট, ফোন যেহেতু আপনার ; তাই ধরেই নিয়েছে ওখানে আপনিই ছিলেন। আর এত রক্ত দেখে ভেবে নিয়েছে আপনি…”

এতটা বলে থামল তপা। কি করে বলবে সুস্থ, সবল লোকটাকে নিয়ে লোকজন কতটা মর্মান্তিক চিন্তা করে ফেলেছে।

“আমি মরে গেছি, তাই তো?” শান্ত গলায় বলল পলক।

তপা মাথা নাড়াল। কিঞ্চিৎ সময় পর কঠিন গলায় বলল,
“কি লাভ এই রাজনীতিতে জড়িয়ে? যেখানে নিজের জানের নিরাপত্তা নেই। আপনার কাছের মানুষগুলোর অবস্থা একবার ভাবুন তো। এই খবরে তাদের কি অবস্থা হয়েছে। আপনার মা বাবা পরিবার! আর আপনার একান্ত কাছের, সেই মানুষটা? সে কি ভালো আছে এই মূহুর্তে? তার অবস্থাটা একবার ভেবে দেখবেন। কি ঝড় বয়ে যাচ্ছে তার উপর দিয়ে।”

পলক মুচকি হাসল। মোহনীয় গলায় বলল,
“বাবা মা চিন্তা করছে। কিন্তু এতটাও বাড়াবাড়ি কিছু ভাবে নি। তারা জানে তাদের ছেলের জান কই মাছের চেয়েও শক্ত। এত ছোট্ট ঝড়ে পলক তাজওয়ার ভাঙা তো দূর মচকায়ও না। আর রইল বাকি একান্ত কাছের মানুষ? সেই সৌভাগ্য এখনো হয় নি। বুকের বাঁপাশটা এখনো খালি। হাহাকার করা প্রখর চৈত্রের খরা সেখানে। এক পশলা বৃষ্টির বড্ড অভাব।”

“কালই তো পটল তুলছিলেন। আবার বড় বড় বুলি আওড়াচ্ছেন। লজ্জা করছে না, না? সারারাত যে মরার মত পড়ে ছিলেন ; কে সেবা করল? রক্ত মেখে লাল টমেটো হয়ে শুয়েছিলেন। এই আমি রক্তমাখা পাঞ্জাবি পাল্টে পরিষ্কার করে আরেকটা পরিয়ে দিয়েছি। কাল আমি বা অন্য কেউ ওই রাস্তায় না গেলে কি হতো? পারতেন উঠে আসতে? দিন দুনিয়া তো ভুলতেই বসেছিলেন। ব্যাটা অকৃতজ্ঞ কোথাকার।”
শেষোক্ত কথাটা মৃদুস্বরে বললেও ঠিকই গিয়ে বাড়ি খেল পলকের কর্ণকুহরে। মুচকি হাসল সে। কিন্তু মুখে কাঠিন্যতা ফুটিয়ে তুলে বলল,
“অকৃতজ্ঞ শুধু আমি নই। মনে করে দেখা হোক আমিও তাকে একদিন বাঁচিয়েছিলাম পড়ে যাওয়ার হাত থেকে। সে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছিল? নাকি এভাবেই ঝেড়েছিল সেদিন। আমি তো তবু ঝাড়ি নি এখনো। আমার ঝাড় খেলে এই সুন্দর মুখশ্রী আর সুন্দর থাকবে না। ফুল টু ফুলটুসি হয়ে যাবে। তাই কথা বলার আগে সাবধান। বাঁচিয়েছো বলে ভেবোনা মাথায় তুলে নাচব। মনে রেখো, সিজন বদলেছে ক্যারেক্টার না। পলক তাজওয়ার ইস অলওয়েজ পলক তাজওয়ার।”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here