বাঁধন হারা তীরে #রাহনুমা রাহা #পর্বঃ১০

0
122

#বাঁধন হারা তীরে
#রাহনুমা রাহা
#পর্বঃ১০

“পাগলের মতো দৌড়াচ্ছিলে কেন? পাগলা কুকুরে তাড়া করেছে নাকি?”

চোখ তুলে সামনে পলক কে দেখে তৎক্ষণাৎ মেরুদণ্ড সোজা করল তপা। একবার পেছনে তাকিয়ে গটগট করে হেঁটে চলে গেল ভেতরে। পেছনে পলক তাকিয়ে রইল আহাম্মক বনে। কিঞ্চিৎ সময় পর বিরবির করে উচ্চারণ করল- আচ্ছা বেয়াদব মেয়ে তো! পাত্তাই দিল না!

নিজ কক্ষে প্রবেশের পর সটান হয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায়। চোখ বুজতেই ভেসে উঠল কাল পোশাকধারী দুটো অবয়ব। কি চায় তারা! পূর্ব পরিচিত? নাকি নেহাৎই পথচারী ভেবে আক্রমণ করার লক্ষ্য ছিল?

বিছানা ছেড়ে জানালার কাছে আসতেই তপার চক্ষু চড়কগাছ। লোকগুলো তার বাড়ির বাইরে। দুজন নয় বরং জনা দশেক লোক পায়চারি করছে অবিরত। প্রত্যেকের শরীরে কাল রঙের পরিধেয়। তপা চিন্তিত হয়। পায়চারি করতে থাকে অনবরত। কিয়ৎক্ষণ পর পর জানালায় দাঁড়িয়ে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে তাদের। প্রায় ঘন্টা খানেক পর বিদায় হলো তারা। তপাও খানিকটা হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। কিন্তু প্রশ্নটা রয়েই গেল মনের অন্তঃপুরে।

টগবগিয়ে ফুটতে থাকা গরম পানির দিকে এক নজরে চেয়ে আছে তটিনী। দুইহাত পেছনে ওড়না দিয়ে বাঁধা। বেঁধে রেখেছে তারই মা। সৎ মা! রান্নাঘরের দরজার বাইরে কড়া পাহারায় নিযুক্ত রয়েছে সৎবোন রেশমি। গতকাল বিকেলে ঘটা ঘটনার জেরে তার সুন্দর মুখশ্রী ঝলসে দেওয়া হবে এই যত্ন করে ফুটানো গরম পানিতে।
তটিনীর চোখে ভয়ের পাশাপাশি কাতরতাও উপচে পড়ছে। কিঞ্চিৎ সময় পরের দৃশ্য অবলোকন করতেই দেহ মন কেঁপে উঠছে তার। মানুষ এত পাষণ্ড হয় কি করে! দয়া মায়া বলতে কি কিচ্ছু নেই তাদের?

নিজের ঘরে ফোনের আওয়াজ পেয়ে রেশমি ঘরের দিকে ছুটে। তটিনী একবার মায়ের দিকে তাকিয়ে পেছন ফিরেই ছুটল সিঁড়ির দিকে। হাত বাঁধা অবস্থায়ই নিজের সবটুকু জোর দিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে আসে রাস্তার উদ্দেশ্যে। আমবিয়া খাতুনও ছুটে আসেন পেছন পেছন। গেইটের কাছে আসতেই খাবলে ধরেন চুলের মুঠি। তটিনী সহসা আর্তনাদ করে উঠল। টেনে হিঁচড়ে ভেতরে নিয়ে যেতে শুরু করলে আরও জোরে চেঁচাতে শুরু করে সে।

সকাল বেলা রাস্তায় হাঁটার সময় তটিনীর করুণ আর্তনাদ গিয়ে বাড়ি খায় তপার কর্ণকুহরে। তৎক্ষণাৎ দৌড়ে আসে সে। তটিনীর অবস্থা দেখে পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে পড়ল। সন্দিগ্ধ গলায় বলল,
“ওকে বেঁধে রেখেছেন কেন? আর এভাবে টেনেই বা কেন নিয়ে যাচ্ছেন? তটিনী, কি হয়েছে?”

তটিনী নীরবে অশ্রুসজল নয়নে চেয়ে রইল তপার মুখপানে।
আমবিয়া খাতুন উচ্চ কণ্ঠে বললেন,
“আমার মেয়ে আমি বাঁইন্ধা রাখছি। তাতে তো তোমার কিছু না। তুমি নিজের রাস্তায় যাও তো মা। বেশি বকো না। নিজে তো থাকো অন্যের আশ্রয়ে। এত দরদ আসে কোত্থেকে?”

নরম-সরম তপা চটে গেলেও মুখে মুচকি হাসি ফুটিয়ে বলল,
“আমি কার আশ্রয়ে আছি সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা এটাই যে, আপনি ক্রাইম করছেন। তাও আবার নারী ও শিশু নির্যাতনের মত ঘৃণ্য অপরাধ। তটিনী নরম মাটি হলেও আমাকে কিন্তু অতটাও ভাববেন না। বাপের নাম ভুলিয়ে দেব একেবারে। এমন মামলা ঠুকবো না, আগামী দিনগুলোতে আর সূর্যের আলোর দেখা মিলবে না।”

আমবিয়া খাতুনের হাত থেকে এক ঝটকায় তটিনীকে ছাড়িয়ে দিল তপা। হাত দুটো বাঁধন মুক্ত করে দু’গালে হাত রেখে বলল,
“চল আমার সাথে।”

একবার মায়ের দিকে তাকিয়ে ভয়ার্ত গলায় বলল,
“মা…”

“উনার ক্লাস আমি পরে নিচ্ছি। আগে চল তোকে ভেতরে নিয়ে যাই। চেহারার কি করেছিস কেঁদে কেঁদে।”

যেতে যেতে আমবিয়া খাতুনের রক্তবর্ণ চেহারার পানে চেয়ে আঙুল উঁচিয়ে শাসিয়ে যেতে ভুলল না শ্যামাবরণ মেয়েটা।

আয়েশা তটিনীর কান্নারত মুখ দেখে কাছে টেনে নিলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে স্নেহার্দ্র গলায় বললেন,
“কান্না থামাও মা। কি হয়েছে খুলে বলো আমাদের। সবটা জানলেই তো সাহায্য করতে পারব তোমাকে।”

তটিনী চেষ্টা করল বুক ঠেলে উপচে পড়া কান্নার দলগুলো গিলে ফেলতে। কিন্তু ব্যর্থ সে! থেকে থেকে হিচকি তুলাটা পারল না গিলে ফেলতে। বরং এটা তার উপর হওয়া নির্মমতার পরিচয় হয়ে বেরিয়ে এলো সগৌরবে।

“কাল রেশমি আপুকে দেখতে পাত্রপক্ষ এসেছিল। কিন্তু আমার দূর্ভাগা কপালে তারা আরও করুণদশা এঁকে দিয়ে চলে গেছে। আপুকে দেখতে এসে উনাদের আমাকে পছন্দ হয়েছে। বিশ্বাস করুন আন্টি, আমি এমনটা চাইনি। কিন্তু… ”

আয়েশা আশ্চর্য ভঙ্গিতে তাকাল। বলল,
“এতে তোমার কি দোষ? আর তারাই বা কেমন মানুষ? একবোন কে দেখতে এসে আরেক বোনকে পছন্দ করে। এমন মানসিকতার মানুষও আজকাল আছে নাকি? তোমার মা বাবা কি বলছে এখন? বিয়ে দেবে তোমাকে?”

তটিনী পুনরায় কান্নায় ভেঙে পড়ল। কান্নারত গলায় বলল,
“তারা বিয়ে নয় আন্টি আমার মৃত্যু চাইছে। যে মুখ দেখে তাদের পছন্দ হয়েছে ফুটন্ত গরম পানি দিয়ে সেই মুখটাই ঝলসে দিতে চাইছে। তপা আপু না নিয়ে আসলে আজ হয়তো আমি বাঁচতাম না আন্টি। এতক্ষণে আমার মায়ের কাছে পৌঁছে যেতাম। সেটাই বোধহয় ভালো হতো। সব যন্ত্রণা এক নিমিষেই শেষ হয়ে যেতো।”

আয়েশা হাত বাড়িয়ে তপার মাথায় রেখে বলল,
“মৃত্যু কখনোই ভালো কিছু নিয়ে আসে না মা। মৃত্যু কোনো সমাধান হতে পারে না। এতদিন যখন ধৈর্য্য ধরার শক্তি পেয়েছো আরও একটু ধরো। তোমার বাবা কি বলছে এ ব্যাপারে?”

তটিনী অবজ্ঞাসূচক হাসল।
“সে তো কলের পুতুল। যেভাবে নাচায় সেভাবে নাচে। আমি যেন অদৃশ্য কেউ। চোখেই লাগে না তার।”

আয়েশা সন্তর্পণে দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। কি নিষ্ঠুর দুনিয়া! সন্তান জন্ম দিয়ে তার প্রতি কি অবহেলা! বাবা থেকেও নেই। তটিনী থেকে দৃষ্টি সরিয়ে তপার উপর নজর ফেললেন তিনি। মেয়েটার মুখ অন্ধকারে ছেয়ে গেছে। তিনি জানেন, আজ মেয়েটা কাঁদবে। আষাঢ়ে বৃষ্টির মত জল ঝরবে ওই দুটি আঁখি থেকে। পুনরায় দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে ফুসফুস ভেদ করে। এ যে এক নিদারুণ যন্ত্রণা! সবটা জেনে বুঝেও কষ্ট লাঘব করতে না পারার যন্ত্রণা!

“আমার একলা আকাশ থমকে গেছে
রাতের স্রোতে ভেসে, শুধু তোমায় ভালোবেসে
আমার দিন গুলো সব রঙ চিনেছে
তোমার কাছে এসে, শুধু তোমায় ভালোবেসে
তুমি চোখ মেললেই ফুল ফুটেছে আমার ছাদে এসে
ভোরের শিশির ঠোট ছুঁয়ে যায় তোমায় ভালোবেসে
আমার একলা আকাশ থমকে গেছে
রাতের স্রোতে ভেসে, শুধু তোমায় ভালোবেসে….”

খোলা বারান্দার একপাশে জড়বস্তুর ন্যায় দাঁড়িয়ে হৃদয়ের সবটুকু যন্ত্রণা, কাতরতা মিশিয়ে গাইছে তপা। তার হাত দুয়েক দূরে বুকে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে পলক। কণ্ঠে মাধুর্য অথচ হৃদয় উগলে বেরিয়ে আসছে ব্যথার জোয়ার। পলক দ্বিধান্বিত বোধ করল। এমন প্রাণোচ্ছল মেয়ের এ কেমন রূপ! এ কিসের অনুরাগ, অভিযোগের সুর! কিয়ৎক্ষণ পর ঠিক যেভাবে এসেছিল সেভাবেই নিঃশব্দে প্রস্থান করল সে। রেখে গেল একবুক হতাশা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক রহস্যময়ী নারীমূর্তি।

সেদিন সন্ধ্যাবেলা পলকের দরজায় গিয়ে কড়া নাড়ে তপা। পলক নিজের স্বভাববশতই গম্ভীর কণ্ঠে শুধালো,
“কিছু বলবে?”

“একটা সাহায্য লাগতো। করবেন?”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here