বাঁধন হারা তীরে #রাহনুমা রাহা #পর্বঃ১১

0
103

#বাঁধন হারা তীরে
#রাহনুমা রাহা
#পর্বঃ১১

“একটা সাহায্য লাগতো। করবেন?”

“সাহায্য! সেটাও আমার কাছে!” এমন ভঙ্গিতে বলল, যেন ভীষণ রকম অবাক হয়েছে সে।

তপা বিরক্ত হলো এমন অতিরিক্ত রিয়াক্ট দেখে। চোখ বুজে নিজেকে সামলে স্বগতোক্তি করল।

“কিভাবে সাহায্য করতে পারি?”

“দাঙ্গা করতে হবে।” তপার ভাবলেশহীন উত্তর।

পলক চমকে তাকাল। একবার আপাদমস্তক দেখে সন্দিগ্ন গলায় বলল,
“ছেলের চক্কর?”

তপা পুনরায় বিরক্ত দৃষ্টি ফেলল। লোকটা আসলেই দুই লাইন বেশি বুঝে।

“মহিলা চক্কর। এক মহিলার বাড়িতে দাঙ্গা করতে হবে। আমি একা পারব না। সাহায্য চাই আমার। পারবেন করতে?”

পলক ভ্রুকুটি করে তাকাল। সরু গলায় বলল,
“তোমার আমাকে দেখে গুন্ডা মনে হয়?”

“আপনি কি তার থেকে ভালো কিছু মনে করেন নাকি নিজেকে? মারামারি কাটাকাটি ছাড়া রাজনীতি বুঝেন আপনারা? থাকেন তো খালি কার মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খেতে পারবেন, সেই চিন্তায়। কাকে সিঁড়ি বানিয়ে উপরে ওঠা যায় সেই খেয়ালে। এখন এমন ভাব করছেন মনে হচ্ছে ভাজা মাছটাই উল্টে খেতে পারেন না। আদতে যে আপনারা পুকুর থেকে মাছ ধরে এনে কেটেকুটে রেঁধে বেড়ে খেতে পারেন। আপনি সাহায্য করলে করুন। নইলে আমি অন্য কাউকে দেখছি। কিন্তু কিন্তু কিন্তু আমাকে সাহায্য না করলে আপনি কি করে এই বাড়িতে টেকেন সেটাও আমার দেখার আছে। আসছি। ভেবে জানাবেন। সময় পুরো আধঘন্টা। মাইন্ড ইট।”

পলক আহাম্মক বনে তাকিয়ে রইল তপার পশ্চাৎ গমনের দিকে। মেয়ে কি শাসিয়ে গেল নাকি ভদ্রভাবে!

আশ্চর্যান্বিত কণ্ঠে বলল,
“হাইটে আমার কাঁধেরও সমান না। অথচ কথা বলে মাথার উপর দিয়ে যায়!”

——-‌‌‌—–

“শুনলাম মেয়ে শুভাকাঙ্ক্ষী জুটেছে কপালে? পলক তাজওয়ার আবার কি-না তাকেই বাঁচাতে দিনরাত পাহারা দিচ্ছে। তা কতদিন চলবে এ পাহারা? চিকবেই বা কয়দিন? একবার না একবার তো পাখি শিকল মুক্ত হবেই। শিকল ছিন্ন পাখি যদি আর না ফিরে খাঁচায়?”

হুমকি স্বরূপ উক্ত খুদে বার্তা দেখে পলক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল মুঠোফোনের দিকে। নাম্বারটা অচেনা। কে হতে পারে? কেই-বা জানে তার উদ্দেশ্য!

কাল বিলম্ব না করে মেসেজ প্রাপ্ত নম্বরে সংযোগ দিতে চেষ্টা করে। কিন্তু ব্যর্থ হলো। অপরপ্রান্ত থেকে এক মেয়েলী কণ্ঠস্বর বারংবার বলে চলেছে ‘আপনি যে নাম্বারে কল করেছেন তা এই মূহুর্তে বন্ধ আছে। অনুগ্রহ করে আবার ডায়াল করুন।”

তপার কিচেনে চলছে এক ভিন্ন স্বাদের রান্নার এক্সপেরিমেন্ট। রান্নার নয় বরং খাওয়ার এক্সপেরিমেন্ট বলা চলে। কড়াইতে পেয়াজ কাঁচা মরিচ ও তেল মশলা যোগে ছোট চিংড়ি নাড়াচাড়া করছে তপা। ভাজা হয়ে এলেই আগে থেকে ধুয়ে রাখা কচুর লতি দিয়ে দিল। পানি বিহীন নাড়াচাড়া করতে লাগল অনবরত। অন্য একটি চুলো থেকে ক্রমাগত পোলাওয়ের ঘ্রাণ এসে বাড়ি খাচ্ছে নাকে। তনু পাশে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছে। তপা ঈষৎ রাগার ভঙ্গিমা করে বলল,
“তনু, হাসছিস কেন তুই? মার খাবি?”

তনু দু’হাতে দুইকান ধরে নিল। বিনীত ভঙ্গিতে বলল,
“আমার ভুল হয়ে গেছে আপু। মাফ করো। কিন্তু তোমার এই অখাদ্য আদৌ খাওয়া যাবে তো? না মানে আসলে কচুর লতি আর পোলাও! কি সুন্দর কম্বিনেশন, নাহ! তাই বলছিলাম হসপিটালে দৌড় করাবে নাকি?”

তপা মুচকি হাসল। খুন্তি নাড়তে নাড়তে বলল,
“তোর মন না চাইলে খাবি না। তোর জন্য মাংস করেছি তো। এটা একান্তই আমার নিজের জন্য। এটা পৃথিবীর সব স্বাদকে হার মানায়। আহঃ কি টেস্ট! একবার ট্রাই করলে জীবনে আমার নাম ভুলতে পারবি না।”

তনু দু’হাত জোড় করে বলল,
“মাফ করো আমায়। আমি এমনিতেই তোমারে মনে রাখব। এই জগৎ বিখ্যাত খাবার খাওয়াতে হবে না।”

“তুই কিন্তু আমার খাবার কে অপমান করছিস তনু। এরপর চাইলেও দিব না, মনে রাখিস।”

“আমি পাব তো?” তটিনী কিছু বলার আগেই রান্নাঘরের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে হালকা আওয়াজে বলল পলক।

তপা কড়াইয়ে ঢাকনা চাপিয়ে দরজার সম্মুখে খানিকটা এগিয়ে এসে বলল,
“কি চাই?”

“কচুর লতি। সাথে চিংড়িও আছে তাই না? পোলাওয়ের গন্ধও পাচ্ছি। যদি কোনো ভুল না করি এই বাসায় কেউ পোলাওয়ের সাথে কচুর লতি খায়, রাইট?”

তপা মুখটা মলিন করে ফেলল। এখন বোধহয় এই লোকটাও হাসবে। কিন্তু অবাক করে দিয়ে পলক পুনরায় বলল,
“আমি আপনাকে সাহায্য করব একটা শর্তে। যদি এই খাবারে ভাগ পাই।”

তপা হা করে দাঁড়িয়ে রইল মিনিট খানেক। কি বলছে লোকটা!
কিঞ্চিৎ সময় পর অবিশ্বাস্য গলায় বলল,
“আপনি সত্যি খাবেন? মানে সত্যি সত্যি?”

পলক ইনোসেন্ট মুখ করে মাথা উপর নিচ করল। অতঃপর বলল,
“বাসায় বললে মা বলতো এগুলো নাকি উদ্ভট খাবার। কিন্তু যে খায় সে বুঝে কতটা ইউনিক। এখানে কে খায়, আন্টি?”

“জ্বি না। আন্টির মেয়ে। আন্টিও বলে এটা উদ্ভট খাবার। তনুও এতক্ষণ এটাই বলছিল।”

পলক এবার তনুর উপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। তপার দিকে জিজ্ঞাসাসূচক দৃষ্টি মেললে তপা তনুর হাতের উপর একহাত রেখে বলল,
“ও হচ্ছে তটিনী। সামনের বাসায় থাকে। ওটাই মূলত ওর বাসা। একটা সমস্যার জন্য আমি ওকে এখানে নিয়ে এসছি। ওর ব্যাপারেই সাহায্য লাগবে আমার। আপনি রাজি তো?”

“কিভাবে সাহায্য করব? আর কেন সাহায্য করব? একটা প্রোপার কারণ দেখাও। এমনি এমনি তো আর কারও বাসায় গিয়ে দাঙ্গা করা যায় না। এক্সাক্ট কারণ দর্শাতে হবে।”

তপা কোমরে হাত গুঁজে ছোট ছোট চোখে তাকাল। অতঃপর ঝাঁঝাল গলায় বলল,
“কেন ভাই আপনি কি পুলিশ যে ওয়ারেন্ট ছাড়া অ্যারেস্ট করতে পারবেন না।”

“ঠাটিয়ে একটা মারব অসভ্য মেয়ে। কিছু বলি না দেখে মাথায় চড়ে গেছো তাই না? চুপচাপ বলো কি হয়েছে ওর বাসায়। ঝামেলা কেন করতে হবে?”

তনু বিস্ফোরিত নেত্রে তাকাল তপার দিকে। অবিশ্বাস্য গলায় বলল,
“তুমি আমার বাসায় দাঙ্গা হাঙ্গামা করতে বলেছো এই ভাইয়া কে? কিন্তু কেন আপু? এরকম করলে মা আমাকে মেরেই ফেলবে।”

তপার দৃষ্টি কঠোর হলো। কঠোর হলো কণ্ঠস্বরও।
“মারতে যেন না পারে সেজন্যই সাহায্য চাইছি।”

“কিন্তু একজন মা কেন তার সন্তান কে মেরে ফেলতে চাইবে? তার কি স্বার্থ?” দ্বিধাগ্রস্ত গলায় বলল পলক।

“মারতে চাইবে। কারণ উনি তনুর বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী। তাছাড়া নিজের মা-ই যে মারতে চাইবে না তার কি গ্যারান্টি আছে? আজকালকার মায়েরা সব পারে।”

তপার গলায় তীব্র বিতৃষ্ণা লক্ষ করে পলক চমকে উঠল। হাসিখুশি, ঝগড়াটে, মারমুখো মেয়ের কণ্ঠে একি যন্ত্রণার রেশ!

তপার মুখে তটিনীর জীবনবৃত্তান্ত শুনে পলক ব্যথিত হয়। ছোট্ট মেয়েটার জীবনের সবটুকু দুঃখ মুছে দেওয়ার লক্ষ্যে মাথায় হাত রেখে স্নেহার্দ্র গলায় শুধালো,
“ভাইয়া কি করলে তুমি খুশি হবে আপু? আজ তুমি যা বলবে তাই হবে।”

তপা বিস্ফোরিত নেত্রে তাকিয়ে রইল পলকের স্নেহাসিক্ত মুখ ও স্নেহাস্পর্শের দিকে।
বিরবির করে বলল,
“এখন মধু ঝড়ছে কি করে! আমার বেলায় তো করলার সাথে লবণ মিশিয়ে নেয়। সঙ্গে আবার মেহগনির বীজও থাকে বোধহয়।”

“আমার পরিবারের কোনো ক্ষতি আমি চাই না ভাইয়া। ক্ষতি না করে যদি আপনার ক্ষমতা দেখাতে পারেন তবে আমি রাজি। কিন্তু আমার মা বাবা বোন এদের ক্ষতি আমি সহ্য করতে পারব না; সেটাও যদি হয় আমার জন্য।”

পরদিন সকালে পলক ঠান্ডা মেজাজে তীক্ষ্ণ ভাবে শাসিয়ে আসে আমবিয়া খাতুন কে। দলবল নিয়ে নয় কেবল তপা এবং তটিনী কে নিয়ে গিয়েছিল সাথে। তটিনী বাসায় পৌঁছে তাদের সাথেই বেরিয়ে আসে কলেজের উদ্দেশ্যে। ওই বাসা ওই মানুষগুলোতে যে তার বড্ড ভয়!

ক্লাস শেষে ক্যাম্পাস ছাড়তেই অজ্ঞাত পরিচয়ের একটা লোক তপার ব্যাগ ছিনিয়ে দৌড় দেয় মেইন রাস্তা থেকে সরু গলিতে। দিকবিদিক ভুলে তপাও ছুটে তার পিছু পিছু। ক্রমেই পেরিয়ে যায় শহর ছেড়ে গ্রামের সীমানা। আশেপাশের পরিত্যক্ত জায়গা খেয়ালে আসতেই পায়ের গতি থামিয়ে দাঁড়িয়ে গেল সে। কিন্তু ততক্ষণে যে সব শেষ। না পেছনে যাওয়ার রাস্তা আছে আর না সামনে এগোনোর। সরু রাস্তার দুইপাশে কেবল বিস্তীর্ণ ফসলের আবাদি জমি। যা এখন পতিত হিসেবেই রয়ে গেছে। পেছনে দুইজন ও সামনে দুইজন। মোট চারজন মানুষের চকচকে দৃষ্টির সামনে আহত হরিণের ন্যায় ছটফটিয়ে উঠল তপা। কি করবে এখন? কি করে রক্ষা করবে নিজেকে? মায়ের মুখটা দেখতে পাবে তো আরেকটাবার? শেষ সময়ে কি একবার ভাইয়ের সাথেও কথা হবে না? দেখা হবে না? ঝাপটে জড়িয়ে ধরে বলা হবে না, তুমিই আমার ভাই!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here