বাঁধন হারা তীরে #রাহনুমা রাহা #পর্বঃ১২

0
96

#বাঁধন হারা তীরে
#রাহনুমা রাহা
#পর্বঃ১২

চোখ খুলে নিজেকে অন্ধকারাচ্ছন্ন কক্ষে আবিষ্কার করল তপা। আবছা আলোয় নিজের থেকে কয়েক ফুট দুরত্ব অবধি নজরে আসছে তার। তাতেই অবলোকন করল পুরো ঘরের হালচাল। আপাতত সে ছাড়া দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তি বা বস্তুর উপস্থিতি নেই সেখানে। হাত দুটো বাঁধা অবস্থায়ই আশা করেছিল তপা। কিন্তু ভাগ্যবশত সেগুলো মুক্ত অবস্থাতেই রয়েছে। মনে মনে কিডন্যাপারদের শুকনো একখানা ধন্যবাদ জানাল। পরক্ষণেই অবচেতন মনে বিরবির করে বলল,
“আচ্ছা, আমি কি মরে গেছি?”
পরক্ষণেই বলল,” কিন্তু মরে গেলে সবকিছু বুঝতে পারছি কি করে? তাহলে? কিডন্যাপিং!”

“কিন্তু আমাকে কিডন্যাপ করল কে? কার কি লাভ এতে? আমি তো বড়লোক নই! তবে কি মেরে চোখ,কিডনি, লিভার সব বিক্রি করে দিবে!”

নিজের মনে বিরবির করতে করতেই দরজার দিকে নজর যায়। তৎক্ষণাৎ উঠে এসে দরজা ধাক্কাতে শুরু করে। চেঁচিয়ে বলে,
“কেউ আছেন? দরজাটা খুলে দিন না। আছেন কেউ?”

উত্তর আসে না অপর প্রান্ত থেকে। তবে কিঞ্চিৎ সময় পরই খুট করে একটা শব্দ হয়। খুলে যায় বন্ধ দরজা। আকস্মিক আলোয় তপা চোখ বন্ধ করে ফেলল। সেকেন্ড কয়েক পর মিটমিট করে চোখ খুলতেই লাফিয়ে পিছিয়ে যায় কয়েক পা। এরা যে রাস্তার সেই গুন্ডাগুলো!

একের পর এক ঢোক গিলে নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করছে তপা। কিন্তু লোকগুলোর হিংস্র চেহারা দেখে কলিজা পর্যন্ত শুকিয়ে আসছে তার। ঢোক গিলে কাঁপা কাঁপা গলায় কোনো রকমে বলল,
“আমাকে আঁটকে রেখেছেন কেন? আমার কাছে কি চান?”

লোক দুজন একে অপরের দিকে তাকিয়ে হলদেটে দাঁত বের করে হাসল। অতঃপর একজন গমগমে গলায় বলল,
“তুই পলক তাজওয়ারের গার্লফ্রেন্ড না?”

তপার চোখ তখন কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসার উপক্রম। গলার স্বর খানিকটা বাড়িয়েই আপনাআপনি উচ্চারিত হলো,
“নাউজুবিল্লাহ!”

এবার অন্য লোকটি দুইপা এগিয়ে এসে মুখোমুখি দাঁড়াল। তপা পিছিয়ে দেয়াল ঘেঁষে গুটিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
“দেখুন যা বলার দূর থেকে বলুন। না আমি আপনাকে চিনি আর না আপনার সাথে আমার কোনো শত্রুতা আছে।”

লোকটা কর্কশ কণ্ঠে বলল,
“পলক তাজওয়ার কে চিনোস তুই? কি সম্পর্ক ওই ছোকরার লগে?”

“তাকে তো সবাই চিনে।” মিনমিন করে বলল তপা।

“মেলা কথা কইতাছোস মাইয়া। যা জিগাইছি ঠিক ঠিক উত্তর দে। নইলে কইলাম তোর কপালে শনি আছে। বাইর অইতে পারবি তো এই ডেরা পার হইয়া?” কথা শেষ করে হাতের শান দেওয়া ছুরি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বিদ্রুপাত্মক হাসল দুজন।

তপা ভয়ে চুপসে গিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
“আমার সাথে উনার কোনো সম্পর্ক নেই বিশ্বাস করুন। আমি তাকে শুধু চিনি। সবাই যেরকম চিনে সেরকমই চিনি। তাছাড়া আর কিছু নেই। আমি সত্যি বলছি।”

“তাইলে পরানের ঝুঁকি নিয়া ওরে ক্যান বাঁচাইলি? নিজেও ঝামেলায় পড়লি; আমগোও ফালাইলি। এহন দে পরানডা বেঘোরে।”

তপার চোখ মুখ বিস্ময়ে ছেয়ে গেল। শেষে কি-না কাউকে বাঁচানোর অপরাধে তার প্রাণটা চলে যাবে! বাঁচার আশা যেখানে অতি নগন্য তখন স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল,
“কে মারতে পাঠিয়েছে আমাকে? আপনাদের সাথে নিশ্চয়ই আমার কোনো শত্রুতা নেই। আপনাদের মাথা কে? কার পাকা ধানে মই দিছি ওই মানুষটাকে বাঁচিয়ে তা মৃত্যুর আগে একবার জানতে চাই। জানতে চাই কার স্বাধের বাগানের ফুলে হাত দিয়েছি আমি। কে মারতে পাঠিয়েছিল পলক তাজওয়ার কে?”

“আজমল হোসেন।”

তপার দুনিয়া কেঁপে ওঠে। কর্ণকুহরে ক্রমাগত উচ্চারিত হয় দুটি শব্দ। ‘আজমল হোসেন’। মূহুর্তেই চোখের রং পাল্টে যায় তার। মৃত্যুকে প্রায় মেনে নেওয়া তপা পণ করে নিজেকে বাঁচানোর। ওই মানুষটার ঘৃণ্য চক্রান্তের শিকার সে হবে না। আর না পলক কে হতে দেবে। সামনের লোক দুজন অমনোযোগী হতেই দুইদিকে ধাক্কা দিয়ে খোলা দরজা বেদ করে বেরিয়ে আসে ঘর ছেড়ে। কৌশলে বের হতে পারলেও ধারাল ছুরিকাঘাতে হাতের শিরার উপরে ক্ষত হয়। অতিদ্রুত বেরিয়ে আসে লাল রঙা তরল পদার্থ। সেদিকে খেয়াল না করেই প্রাণপণে দৌড়াতে থাকে। আশেপাশে জঙ্গলে ঘেরা সরু রাস্তা। ছোট ছোট কাঁটাযুক্ত গাছে আবৃত প্রায় পুরোটা রাস্তাই। এক মিনিট দুই মিনিট করে পেরিয়ে যায় মিনিট ত্রিশেক। জঙ্গল পেরিয়ে রাস্তায় আসতেই ঘটে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। দুইদিকে ভাগ হয়ে গেছে মেইন রাস্তা। কোনটা কোন দিকে গেছে সেটাও তার জানা নেই। আদতে সে কোথায় আছে সেটাও অজানা।

এমতাবস্থায় রাস্তার উল্টোদিকে গুন্ডা দলের তিন সদস্য কে দেখতেই পুনরায় জঙ্গলে গা ঢাকা দেয় তপা।গুটিয়ে নেয় নিজেকে সবুজ অরণ্যের গভীরে।
লুকিয়ে থাকার মূহুর্তে তপার হঠাৎ মনে হয় কেউ তাকে দেখছে। তৎক্ষণাৎ তাকাতেই লোকটা সরে গেল। কিন্তু চোখের কোণ দিয়ে সে স্পষ্ট টের পেল কেউ একজন আছে। পুনরায় পিছু হটবার জন্য উঠে দাঁড়াতেই চতুর্দিক থেকে ঘিরে নেয় একদল মানুষ রূপী হায়েনা। দলের ভেতর কিছুক্ষণ আগের মুখ দুটো দেখতেই শিরা উপশিরা কেঁপে ওঠে তপার। ছয়জনের দলের প্রতিটি মানুষ যখন অকথ্য ভাষায় গড়গড় করে একেকটা বুলি আওড়াতে থাকে, তপার মনে হয় লোকগুলো বোধহয় হায়েনার মত শব্দ তুলে হাসছে।

সবচেয়ে শক্তিসামর্থ্য লোকটা তপার সম্মুখে এগিয়ে এসে দাঁত বের করে হেসে বলল,
“অনেক দৌড় করাইছো মামণি। এহন কোনদিকে যাবা? আমগো হাতেই তো প্রাণটা খোয়াইতে হইবো। কেউ বাঁচাইতে আইব না এই জঙ্গলে।”
কথা শেষ হতেই উচ্চ শব্দে হাসতে থাকে বাকি সদস্যগুলো। পরক্ষণেই এক মূহুর্ত পিনপতন নীরবতা।

পুরো জঙ্গল যখন শুনশান নীরবতা মুদ্রিত ঠিক সেই সময়টায় গগন কাঁপিয়ে এক গম্ভীর ভরাট পুরুষালী কণ্ঠ বিস্ফোরণ ঘটায় সাতজন মনুষ্যের কর্ণকুহরে। গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বলে,
“যার উছিলায় পলক তাজওয়ার এখনো নিঃশ্বাস নিচ্ছে তার প্রাণের বিনাশ তোরা এভাবে করতে পারবি, এটা ভাবলি কি করে?”

সাত জোড়া আঁখি আশ্চর্যান্বিত দৃষ্টি ফেলল। তপার অক্ষিদ্বয়ে খুশি উপচে পড়ছে। সেই সাথে ঠোঁটের কোণেও। খুশি প্রকাশ করতে কিছু বলার আগেই একজন গলায় ছুরি ধরে কব্জা করে ফেলল তাকে। আকস্মিক ঘটনায় ঘাবড়ে গেলেও পরক্ষণেই ছুটার জন্য জোরাজুরি শুরু করে। ছুরি ধরা লোকটি তপাকে সামলাতে ছুরি গলায় ঠেকাতেই কেটে যায় একটুখানি। মৃদু আর্তনাদ করে চোখ খিচে বন্ধ করে নেয়। কিঞ্চিৎ সময় পর অসহায় হরিণীর মত ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইল পলকের দিকে। পলক চোখের ইশারায় আশ্বস্ত করে বলল, “আমি আছি।”

হঠাৎই গভীর জঙ্গলে পুলিশের গাড়ির সাইরেনের শব্দ পাওয়া যায়। বিকট আওয়াজে বাজতেই একেকজন বেসামাল হয়ে যায়। তপাকে ছেড়ে দৌড় দেয় উল্টো পথে। পলক হাতের নাগালে তপাকে পেয়ে নিজেও ছুটে জঙ্গলের বাইরের পথে। তপা ক্লান্ত দেহে হাঁপিয়ে ওঠে কিছুক্ষণেই। হাতের আঘাত, গলার সদ্য কাটার জ্বলুনি,তারপর সারাদিনের না খাওয়া ; সব মিলিয়ে শরীর সায় দেয় না আর। দৌড় থামিয়ে পিচ ঢালা রাস্তায় বসে পড়ে সে। পলক পাশে বসে নরম গলায় শুধালো,
“ক্লান্ত লাগছে?”
তপা আহত দৃষ্টিতে তাকায়। বিরবির করে বলে,
“খুব।”

দ্বিধা করে না পলক। অকস্মাৎ দু’হাতে পেঁচিয়ে পাঁজা কোলা করে তুলে হাঁটতে শুরু করে সামনের দিকে। তপা চমকে ওঠে কিছু বলতে চায়। কিন্তু থেমে যায় ঘর্মাক্ত মুখের খোঁচা খোঁচা দাড়িতে নজর পড়তেই। লোকটাকে কি আজ অন্যরকম লাগছে? নাকি কাছে থেকে, খুব কাছে থেকে দেখছে বলে। পলক বুঝতে পেরে মুচকি হাসে। ভ্রু নাচিয়ে ইশারায় বোঝাল,”কি?”
বিনিময়ে তপাও মৃদু হাসি উপহার দেয়। মাথা নাড়িয়ে বোঝায় কিছু না।

বিকেলের শেষ প্রহরে আকাশ ফেটে শুরু হয় প্রবল বৃষ্টি। বড় বড় ফোটায় নিমেষেই স্নানাবেশে মাতিয়ে তোলে ধরণীকে। কাক ভেজা হয়ে যায় পায়ে হাঁটা এক জোড়া কপোত-কপোতীও। দৌড়ে গিয়ে একটা ছাউনির নিচে আশ্রয় খোঁজে তারা। বৃষ্টির স্পর্শ, ক্লান্ত শরীর ও ঠান্ডা বাতাস মিলেমিশে একাকার হয়ে তপা গুটিয়ে ফেলে নিজেকে। প্রচন্ড ঠান্ডায় কাঁপতে শুরু করে। দু’হাত বুকে গুঁজে জড়োসড়ো হয়ে রয়। পলক আড়চোখে একবার খেয়াল করে তপার ঝিমিয়ে যাওয়া শরীর। প্রায় পুরোটাই ভিজে জবজবে হয়ে গেছে। পলক দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে যায়। কি করা উচিৎ তার এই মূহুর্তে! আদৌ কি কিছু করার আছে তার!

বাতাসের দাপটে বৃষ্টির পানি ছোট্ট ছাউনির ভেতর অবধি পৌঁছে যায়। পলক সামনে দাঁড়িয়ে আড়াল করার চেষ্টা করে তপাকে। মিছিমিছি চেষ্টা করে তাকে এক চিলতে উষ্ণতা দান করতে। মুখোমুখি দাঁড়ানো দুজন আধভেজা যুবক যুবতী। অথচ চোখে তাদের পবিত্রতা, কেবলই মুগ্ধতা। কিঞ্চিৎ সময় পর তপার গা গুলিয়ে উঠে। মাথার ভেতরটা ভনভন করে ঘুরতে থাকে। পাশ ফিরে গলগল করে বমি করে দেয় সে। মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার আগ মূহুর্তে ঝাপটে জড়িয়ে নেয় পলক। দু’হাতে, আষ্টেপৃষ্টে! মূহুর্তেই শিহরণ বয়ে যায় দু’টো শরীরে। ছুঁয়ে যায় মুগ্ধতা থেকেও আরও একটুখানি বেশি আবেশ। অনূভুতির রেলগাড়ি যখন ঝনঝন আওয়াজ তুলে ছুটে চলেছে দিক থেকে দিগন্তে ;ঠিক সেই সময়টায়ই আকাশ কাঁপিয়ে কাছেপিঠে কোথাও বাজ পড়ে বিকট শব্দ তুলে। তপা খামচে ধরে পলকের পিঠ। লেপ্টে যায় প্রশস্ত, কঠিন বুকটায়। বদ্ধ হয় এক নীতিবান পুরুষের বাহুডোরে। যেটুকু ফাঁকফোকর ছিল সবটা ঘুচিয়ে দিতেই যেন আকাশের আজ এই আয়োজন।

অবচেতন মন তখন গুনগুন করে বলে,
“বাঘে ছুঁলে নাকি আঠারো ঘা, পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশ ঘা। শালা পুরুষ মানুষে ছুঁলে তো সারা অঙ্গেই ঘা।”

চলবে…

নোটঃ গঠন মূলক মন্তব্য করুন প্লিজ।রেসপন্স দেখে লেখার আগ্রহ কোথায় যেন উবে যাচ্ছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here