বাঁধন হারা তীরে #রাহনুমা রাহা #পর্বঃ১৩

0
107

#বাঁধন হারা তীরে
#রাহনুমা রাহা
#পর্বঃ১৩

মেঘ থেকে ভূমিতে অঝোর ধারায় পতিত হচ্ছে জলের অজস্র ক্ষুদ্র কণা। ধরণী আবেশিত হচ্ছে স্নিগ্ধ শীতলতায়। গা হিম হয়ে এলেও তপা ঠায় দাঁড়িয়ে আছে জানালার গ্রিল চেপে। বাম হাতের কব্জিতে এখনো শুভ্র রঙা ব্যান্ডেজ শোভা বর্ধন করে চলেছে। ডান হাতের আলতো স্পর্শে ছুঁয়ে সেদিনের অনাকাঙ্ক্ষিত ছোঁয়া চোখ বন্ধ করে পুনরায় স্মৃতিচারণ করল। উষ্ঠ কোণে ফুটে উঠল মুগ্ধতার হাসি। এই তো দুদিন আগে —–

সেদিন আহত, প্রায় চেতনা বিহীন তপা কে পাঁজা কোলা করে তুলে এনেছিল এই গৃহে। আয়েশার সেকি বিলাপ। মাতৃস্নেহে অন্ধ আয়শা মেয়ের অবস্থা দেখে আহাজারি কান্নায় মশগুল ছিল। পলক আশ্বস্ত করে তাকে নিজের কক্ষে নিয়ে যায়। স্বহস্তে ক্ষত পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ করে দেয়। তপা নিভু নিভু চোখে নির্নিমেষ চেয়ে দেখেছিল ওই মুখখানি। নতুন করে, নতুন ভাবে আবিষ্কার করেছে সেদিন মানুষটাকে। রাজনীতিবিদের আড়ালে একজন আদর্শ মানুষ কে চিনেছে সে। যার হৃদয়ের পরদে পরদে সাজানো আছে স্নেহ, ভালবাসা আর মায়া।

ব্যান্ডেজ শেষে তপার হাতদুটো নিজের দু’হাতে আলতো করে ধরে অপরাধী গলায় সে বলে,
“আই’ম সরি তিয়াসা। আই রিয়েলি ভেরি সরি। আমায় মাফ করো। আমি পারি নি তোমাকে প্রোটেকশন দিতে। আমি পারি নি। আমার ব্যর্থতার জন্য আজ তুমি ভুক্তভোগী। তুমি সাফার করছো।”

“আমি ঠিক আছি। কিচ্ছু হয় নি আমার দেখুন।” তপা মুখ এদিক ওদিক ঘুরিয়ে দেখানোর ভান করে বলল।

“একটু এদিক ওদিক হলে তোমাকে ওরা…” কথা শেষ করতে পারে না পলক। বিছানার নরম আবরণে ঘুষি মেরে নিজের ব্যর্থতার রাগ দমন করতে চেষ্টা করে।

তপা নমনীয় গলায় বলে,
“আপনার জন্যই আমি এখনো বেঁচে আছি। শ্বাস নিচ্ছি। কেন নিজেকে দোষারোপ করছেন? আপনার এতে কিসের দায়?”

“আমার জন্যই ওরা তোমাকে অ্যাটাক করেছে। আমাকে বাঁচানোর অপরাধে তুমি প্রাণ খোয়াতে বসেছিলে। কেন এসেছিলে সেদিন? তুমি তো রাজনীতি ঘৃণা করো। ঘৃণা করো আমার মতো রাজনীতিবিদদের। তবে কেন তিয়াসা?” আক্ষেপ ঝরা গলায় বলল পলক।

তপা মৃদু হাসল। হাত বাড়িয়ে মুঠোয় পুরে নিল ভরসার হাতগুলো। পলক চমকে ওঠে। নিজে আবেগের বশে হাত ধরে ফেললেও তপার স্পর্শে খানিকটা পরিবর্তন খুঁজে পায়। শিহরণ বয়ে যায় শরীর জুড়ে।
ঠোঁটের কোণে হাসির রেশটুকু বাঁচিয়ে রেখেই নরম, স্নিগ্ধ গলায় বলল,
“রাজনীতিবিদের আড়ালের এই মানুষটাকে তো আমি ঘৃণা করি না। তাকে তো…”

“কি?”

“নাহ্! কিছু না। একটা কথা জানতে চাই।”

পলক চোখের ইশারায় বোঝায়, ‘কি?’

“আপনি জানলেন কি করে আমাকে ওরা মধুপুরেই আঁটকে রেখেছে? এত তাড়াতাড়ি তো জানার কথা ছিল না।” তপার চোখে মুখে স্পষ্ট কৌতুহল।

পলক মুচকি হেসে বলল,
“জানতেই হবে?”

তপা দ্রুত মাথা উপর নিচ করে। যার অর্থ এই যে তাকে জানতে হবে না বরং এক্ষুণি জানতে হবে। নইলে তার ফুসফুস বেদ করে শ্বাস প্রশ্বাস আদান প্রদান ব্যাহত হচ্ছে।

“একচুয়ালি আমি তোমার পেছনে লোক লাগিয়েছি।”

তপা বিস্ফোরিত নেত্রে তাকাল। উচ্চস্বরে চিৎকার করে বলল, “মানে?”

পলক দুইহাত উঁচু করে বলল, “রিল্যাক্স; রিল্যাক্স। এত উত্তেজিত হচ্ছো কেন? আগে তো পুরোটা শোনো। তারপর যা বলার বলবে।”

তপা চুপ করে বসে। কিন্তু স্থির হতে পারে না।

“তুমি আমাকে বাঁচানোর পর থেকেই আমার মনে হচ্ছিল আমার উপর বদলা নিতে না পেরে ওরা তোমার ক্ষতি করতে পারে। সেজন্য সেদিন আমি ক্যাম্পাসে তোমাকে আড়ালে রেখেছিলাম। কিন্তু তার আগেই কেউ জেনে গেছে তুমিই সে। আমার ফোনে হুমকি স্বরূপ মেসেজ আসতে থাকে। আমি শুধুমাত্র তোমার প্রোটেকশনের জন্য নিজের বাসা ছেড়ে এখানে এসে উঠেছি। তবুও তোমাকে চোখে চোখে রাখা সম্ভব হচ্ছে না বলে আমার দুজন লোক লাগাই তোমার পেছনে। তুমি বাইরে থাকাকালীন প্রতিটা সেকেন্ড পাহারা দিচ্ছিল। কিন্তু এতো কিছুর পরও সেই তোমার ক্ষতি হয়েই গেল।” দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে পলক।

“তারমানে সেদিন রাস্তার দুজন লোক আপনার পাঠানোই ছিল? তারপর বাসার সামনের দশবারো জনও? কালো পোশাক পরে তারা রাইট?”

পলক মাথা নাড়ায়। তারই লোক ছিল।

“কিন্তু ওরা যদি থাকেই তাহলে আমাকে তুলে নিয়ে গেল তখন এলো না কেন? আর আপনি জানলেন কি করে আমি ওখানে?”

“তুমি ক্যাম্পাস থেকে বের হওয়ার পর ওরা তোমার পিছু নিয়েছিল ঠিকই। কিন্তু রাস্তায় পথচারীদের কিছু ঝামেলার জন্য ওরা তোমার থেকে ছিটকে যায়। এই সুযোগে তোমার ব্যাগ ছিনতাই হয়। আর তুমি শহর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে যাও। যদিও ঝামেলাটা কিডন্যাপারদের সাজানো ছিল তোমাকে ফাসানোর উদ্দেশ্যে। কিন্তু তুমি এটা বলো যে, কেউ ব্যাগ নিয়ে নিলে ব্যাগের পেছন পেছন দেশ ছেড়ে দেশান্তরী হতে হয়?”

তপা মাথা নিচু করে ফেলল। নিচু গলায় বলল,
“আসলে লোকটা আমার একটু সামনেই দৌড়াচ্ছিল। মনে হচ্ছিল আর একটু গেলেই ধরতে পারব।”

“এটাও তোমাকে ফাসানোর টেকনিক। ইচ্ছে করেই আস্তে দৌড়েছে। ওদের উদ্দেশ্য তো ব্যাগ নয়, তুমি।” দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে পলক।

“আমাকে খুঁজে পেলেন কি করে? আপনার লোক তো ছিল না। তাহলে?”

“একচুয়ালি আমি তোমার ঘড়িতে জিপিএস ট্র্যাকার লাগিয়ে দিয়েছি। সেখান থেকে ট্র্যাক করেই…”

তপা চোখ বড় বড় করে তাকাল। বিস্মিত গলায় শুধালো,
“কখন?”

“আমি এসেই সর্বপ্রথম তোমার রুম থেকে ঘড়ি নিয়েছিলাম। তুমি আমাকে দেখার আগেই। তারপর কাজ শেষে আবার জায়গারটা জায়গায় রেখে এসেছি। তুমি ধরতেও পারো নি।”

তপা সরু চোখে তাকিয়ে বলল,
“অনুমতি নিয়েছিলেন?”

পলকও ছোট ছোট চোখে তাকাল। ঠেস মারা গলায় বলল,
“আমি চাইলাম আর তুমি দিয়ে দিলে তাই না? আমি তোমাকে হাড়ে হাড়ে চিনি মেয়ে। ইহজীবনেও দিতে না। উল্টো আমাকে বাড়ি থেকে চলে যেতে বাধ্য করতে। বলা যায় বের করে দিতে।”

“এখন কি দিতে পারি না?”

পলক ঠোঁট কামড়ে হাসল। উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে মুখ এগিয়ে কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“নাহ্! কারণ তুমি ফেঁসে গেছো মেয়ে।”

“ওরা আমাকে আপনার গার্লফ্রেন্ড কেন বলেছিল?” গলার জোর বাড়িয়ে বলল তপা।

পলক দরজার সম্মুখে দাঁড়িয়ে ভ্রুকুটি করে তাকাল। কুঞ্চিত ভ্রুযুগল অক্ষত রেখেই বলল,
“তাতে কি তোমার জাত গেছে? আমি কি ফেলনা নাকি?” কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলেই উত্তরের অপেক্ষা না করে চলে গেল নিজের জন্য বরাদ্দকৃত কক্ষে।

বৃষ্টির ছাট এসে মুখে পড়তেই হকচকিয়ে উঠল তপা। কানের কাছে এখনো যেন কেউ ফিসফিস করে বলছে,
“তুমি ফেঁসে গেছো মেয়ে।”

খিলখিল করে হেসে উঠে তপা। হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি ছুঁয়ে মুগ্ধ নয়নে অন্তরীক্ষের পানে তাকায়। সে পানেই প্রশ্ন ছুঁড়ে বলে,
“এত সুখ সুখ লাগছে কেন পৃথিবী?”

গুনগুন করে গায়–
এই মেঘলা দিনে একলা ঘরে থাকে না তো মন
কাছে যাব কবে পাব ওগো তোমার নিমন্ত্রণ।
যুঁথি বনে ওই হাওয়া করে শুধু আসা যাওয়া
হায় হায় রে দিন যায় যে ভরে আঁধারে ভুবন
কাছে যাব কবে পাব ওগো তোমার নিমন্ত্রণ।

শুধু ঝরে ঝর ঝর আজ বারি সারাদিন
আজ যেন মেঘে মেঘে হলো মন যে উদাসীন
আজ আমি ক্ষণে ক্ষণে কি যে ভাবি আনমনে
তুমি আসবে ওগো হাসবে কবে হবে সে মিলন?
কাছে যাব কবে পাব ওগো তোমার নিমন্ত্রণ।

একসময় গুনগুন গিয়ে তাল মেলায় আনকোরা নৃত্যে। বুকের ভেতর গুপ্ত কুঠুরির ভেতর জমা হওয়া রং মশালের রঙিন আলোর ছটা এসে বাড়ি খায় এই বসুন্ধরায়। দরজার বাইরে হা মুখে দাঁড়িয়ে থাকা পলক নাচের বাহার দেখে করতালি যোগে সম্বর্ধনা জানায়। তপা লাজে রাঙা হয়ে ছুট দেয় মায়ের ঘরে। বাহারী নৃত্য যে মানুষটা দেখে ফেলেছে। কি লজ্জা! কি লজ্জা! ওড়না ঢাকা মুখটাও রক্তলাল আভায় রক্তিম হয়ে ওঠে।

কয়েকদিন পর। তপার হাতের অবস্থা বেশ ভালো। এক বিকেলে পলকের জন্য কফি হাতে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে সে। পলক কিছুক্ষণ আগেই বাইরে থেকে ফিরেছে। বাইরে থেকে এসেই কফি খাওয়ার বাজে অভ্যাস রয়েছে তার। তপা এটা এ ক’দিনে বেশ ভালো করেই রপ্ত করেছে।
মিনিট দুয়েক আকাশ কুসুম চিন্তা করে অনুমতি বিহীন ভেতরে প্রবেশ করে সে। পলক কেবল গোসল করে বেরিয়েছে। সাদা টাওয়ালে চুল মুছতে মুছতে তপা কে দেখে মুচকি হেসে বলল,
“থ্যাংক ইউ।”
তপা উত্তর দিল না। কেবল আহাম্মকের মত তাকিয়ে রইল। এতদিন.. এতগুলো দিন পর সে এই মানুষটাকে সাদা কালো রঙের বাইরে দেখছে। এমনকি পাঞ্জাবি ছাড়াও এই প্রথম। এই লোক নিজের রুমেও সাদা পাঞ্জাবি পরে বসে থাকে। যেন সদ্য বিপত্নীক হওয়া পুরুষ।

তপার হা বনে থাকা দেখে পলক চোখের সামনে তুড়ি মেরে বলল,
“কি দেখছো বলো তো? আমি জানি আমি হ্যান্ডসাম তাই বলে এভাবে দেখবে? আমার তো লাজ লজ্জা বলে কিছু আছে নাকি?” অহেতুক লজ্জা পাওয়ার ভান করল।

তপা মনে মনে বলে,” এত দিনে ক্রাশ নামক বাঁশও খেতে হলো। শেষে কি-না এই লোকের উপরই। জীবনের সব অ্যাপ্লাই কি এর উপরই করতে হবে নাকি খোদা। রক্ষা করো।”

কিন্তু মুখে বলল,
“আপনার সাদা কালো পাঞ্জাবি ছাড়া অন্য পোশাক আছে জানতাম না।”

পলক নিজের দিকে তাকাল। স্কাই ব্লু টিশার্ট আর শুভ্র রঙা টু কোয়াটার। মেয়ের হা করাটাই স্বাভাবিক। পাজামা ছেড়ে হঠাৎ টু কোয়াটার দেখলে যে কেউই ভীমড়ি খাবে।

ঠোঁটে দুষ্ট হাসি ফুটিয়ে বলল,
“ক্রাশ খেয়েছো?”

“ঠ্যাকা পড়ছে।” মুখে ভেংচি কাটে তপা।

পলক হেসে উঠে উচ্চ শব্দে। কফিমগে ঠোঁট ছুঁয়ে বলে,”নট ব্যাড।”
তেতে উঠে তপা। রুক্ষ সুরে বলে,
“শুনুন আমি আপনার বউয়ের দায়িত্ব পালন করতে পারব না। পারব না আমি তিনবেলা এই রুমে এনে খাবার খাওয়াতে।”

পলক ভ্রুকুটি করে তাকালে তপা পুনরায় বলল,
“এখন থেকে নিচে গিয়ে খাবার টেবিলে বসে খাবেন। আমি তো আপনার বউ নই যে রাজার মত আদেশ করবেন আর আমি রাণী হয়ে তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করব আর বলব আপনার আদেশ শিরোধার্য জাহাপনা।”

“বউ হওয়া এত সহজ?” স্মিত হেসে বলল পলক।

“সহজ নয়?” প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় তপা।

“উঁহু।”

তপা হাসে। চোখে মুখে খেলা করছে দুষ্টমি। চোখে হাসি কণ্ঠে গম্ভীরতা নিয়ে বলল,
“আমি চাইলে এই আজকের দিনের মধ্যে আপনাকে বিয়ে করতে পারি। এতটাই সহজ।”

“কিভাবে?”

“আমার এই সুন্দর জামাটা ছিঁড়ে একটু চেঁচাব। তারপর দরকার একটু ন্যাকা কান্না। বাকি দায়িত্ব এলাকাবাসীর। আপনার আমার কোনো চাপ নেই। এরপর দেখা হবে সোজা বাসর ঘরে। হবে নাকি?” বলেই ঠোঁট কামড়ে হেসে চোখ মারল তপা।

পলক বিস্ময়ে হা করে তাকাল। তপার পশ্চাৎ গমনের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল- কি বিচ্ছু মেয়ে রে বাবা!”

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here