#বাঁধন হারা তীরে
#রাহনুমা রাহা
#পর্বঃ১৬
অসময়ে বিয়ের সম্বন্ধ এসে পৃথার হালের জীবন বেহাল দশায় টেনে নিয়ে যাচ্ছে। পৃথার বাবা পার্থিব মোজাম্মেল নিজের অফিসের কাছের এক বন্ধুর ছেলের জন্য প্রস্তাব পেয়ে লুফে নেওয়ার চেষ্টা করে। চেনা জানার মধ্যে নিজের ঘরের সম্মান কে সমর্পণ করার সুযোগ পেলে কুড়িয়ে নেওয়ার পায়তারা করে সকলেই। এক্ষেত্রে পার্থিব মোজাম্মেলও আলাদা নন। একমাত্র মেয়ের জন্য উপযুক্ত পাত্র পেয়ে খুশিতে তার চোখ চিকচিক করে উঠে। এতদিনে তবে শান্তিতে মরতে পারবে সে! আনন্দের সাথে সাথে ক্ষীণ ব্যথাও উপলব্ধি করে। একা জীবনের একমাত্র অবলম্বন তো ওই মেয়েটাই। তাকে বিদায় দিয়ে থাকবে কি নিয়ে! পরক্ষণেই খুশি হয় এটা ভেবে যে, মেয়েটা তো একটা সুস্থ, সুন্দর পরিবার পাবে।
সন্ধ্যায় চায়ের কাপ হাতে পার্থিব মোজাম্মেলের রুমে আসে পৃথা। কাপ টেবিলে রাখতে রাখতে মিহি গলায় বলল,
“ডাকছিলে বাবা?”
পার্থিব মোজাম্মেল শান্ত গলায় বললেন,
“তোর সাথে একটু কথা ছিল মা।”
পৃথা অবাক হয়। হঠাৎ করে কি হলো তার বাবার?
পৃথা স্বাভাবিক ভাবে বলল,
“বলো না বাবা।”
পার্থিব মোজাম্মেল খ্যাক করে গলা পরিষ্কার করেন। বুকে হাত গুঁজে শান্ত ভঙ্গিতে তাকালেন। পৃথা ছোট ছোট চোখে বাবা কে পরখ করে বলল,
“তোমার কি হয়েছে বাবা? এরকম করছো কেন? কি বলবে বলো না, আমি শুনছি তো।”
অতঃপর তিনি ধীর গলায় বললেন,
“দেখ মা তোর মা যদি বেঁচে থাকতো তাহলে এই কথাগুলো তোর মা-ই বলতো। সে যেহেতু তার কাজে ফাঁকি দিয়ে অসময়ে চলে গেছে। তাই বাধ্য হয়ে আমাকেই বলতে হচ্ছে।”
এতটা শুনতেই পৃথার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠে। মাথাটা শূন্য শূন্য লাগে। পরবর্তী কথাগুলো শোনার জন্য নিজেকে শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইল।
“আমার অফিসের কলিগ, তোর সোহরাব আংকেল কে তো চিনিস? কতবার এসেছে আমাদের এখানে। তোর সাথেও তো কতবার দেখা হয়েছে। সোহরাব তোকে খুব পছন্দ করে মা। ও চাইছে ওর ছেলে হিমেলের সাথে তোর বিয়ে দিতে। হিমেল ছেলেটাকে পার্সোনালি আমারও বেশ পছন্দ। ব্যবহার ভালো, শান্ত শিষ্ট, ভালো চাকরি করছে। সবদিক ভেবে আমার মনে হলো একবার তোকে জানানো উচিৎ। তুই কি বলিস মা?”
পৃথা মাথা নিচু করে ফেলল। চোখের কোল বেয়ে দু’ফোটা জল গড়িয়ে গেল অনায়াসেই। কোনো রকমে বলল,
“আমি পড়তে চাই বাবা।”
পার্থিব মোজাম্মেল এগিয়ে এসে মেয়ের গাল গড়িয়ে পড়ে যাওয়া পানিটুকু আঙুলে ছুঁয়ে বলল,
“কে সে?”
পৃথা চমকে ওঠে। কি বলবে এবার?
পার্থিব মোজাম্মেল মুচকি হাসেন। মেয়ের মাথায় হাত রেখে বলেন,
“সে যেই হোক বাড়ি নিয়ে এসো। আমার মেয়ের পছন্দ নিশ্চয়ই খারাপ হবে না।”
পৃথা বাবার হাত জড়িয়ে কাঁধে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে উঠল।
“আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাই নি বাবা।”
পার্থিব মোজাম্মেল অবাক হওয়ার ভান করে বলেন,
“আমি কষ্ট পেয়েছি কখন বললাম? আমি চাই আমার মেয়েটা ভালো থাকুক। সুখী হোক। বাবা হিসেবে এর বেশি আর কিছু চাওয়ার নেই আমার। তোমার সুখেই আমি খুশি।”
সর্দি-জ্বর বেঁধে তপার অবস্থা নাজেহাল । সন্ধ্যা নামতেই কম্বল পেঁচিয়ে নিজেকে আড়াল করে নিয়েছে। হঠাৎ ফোন বেজে উঠে তার। চোখ বন্ধ রেখেই বিছানা হাতড়ে ফোন খুঁজে। একসময় নাগালেও আসে হাতের। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ভেসে আসে পৃথার উত্তেজিত কণ্ঠস্বর, “তপা শুনছিস?”
তপা আলগা ঘুম ভেঙে যাওয়ার ভারী বিরক্ত হয়েছে। বিরক্ত ভরা স্বরেই বলল,
“শুনতেই তো রিসিভ করেছি। যা বলার পটাপট বলে ফেল।”
“বিরক্ত তুই?”
“না ভাই। সর্দি-জ্বরে আমার জান যায় যায় করছে। সবে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুইছি। অমনি তুই এমএম রেডিও শুনাতে কল দিয়ে ফেলছিস। আবার বলছে বিরক্ত কি-না।” ফোঁত করে শ্বাস ছাড়ে তপা।
“আসলে একটা জরুরি কথা বলার ছিল।”
“বলে ফেল।”
“বাবা আমার বিয়ের কথা বলছে।”
চোখ খুলে তপা। তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বসে। গড়গড় করে বলল,
“কি বলছিস? ছেলে কি করে? দেখতে কেমন? বিয়ে কবে?”
পৃথা হতাশ হয়। এই মেয়েটা সব সময় এমন। ছোট্ট করে দম ফেলল পৃথা। হতাশা জড়িত গলায়ই বলল,
“আমি সিজান কে ভালবাসি তপা।”
“ওহ।” তপা কণ্ঠ স্বাভাবিক।
“বাবা সিজানের সাথে দেখা করতে চাইছে।”
“তুই বলেছিস? আংকেলের রিয়াকশন কেমন ছিল?”
পৃথা মুচকি হেসে বলল,
“আমার বলতে হয় নি। বাবারা ঐশ্বরিক ক্ষমতা বলে সব বুঝতে পেরে যায়।”
তপা তাচ্ছিল্য হাসে। বিদ্রুপ করে বলে,
“সব বাবারা নয়। সব বাবারা জানেই না আদৌ তার সন্তান বেঁচে আছে কি-না।”
শরীরের সাথে সাথে মনটাও ব্যথায় মুষড়ে পড়ে। বিনা অজুহাতে ফোন কেটে ব্যস্ত হয় নিজের পাওয়া না পাওয়ার হিসেব মিলাতে।
সন্ধ্যা বেলার কফি মিসিং হওয়ায় পলক নিচে নেমে আসে। অল্প আওয়াজে তপা কে ডাকে। তপা হাঁটু মুড়ে তখনো বিছানায় বসে । গায়ে জড়ানো মোটা কম্বল। পৃথিবীর খেয়াল ছেড়ে নিজের ধ্যানে মনোনিবেশ করায় শ্রবণেন্দ্রিয়ে পৌঁছায় না পলকের ভরাট গলার আওয়াজ।
পায়ে পায়ে কামরার সম্মুখে এসে মৃদুস্বরে ডাকল,
“তিয়াসা, ভেতরে আছো?”
তপা তবুও নির্বিকার। নির্নিমেষ বসে আছে শূন্যে দৃষ্টি মেলে।
একরাশ দ্বিধাদ্বন্দে ভুগে কক্ষের ভেতরে পা বাড়ায় পলক। ভেতরে ঢুকতেই তপা কে দেখে ভ্রু জোড়া নিজ দায়িত্বে কুঁচকে গেল। গাঢ় ভাজ পড়ল কপাল জুড়ে। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে শুধালো,
“আর ইউ ওকে? তিয়াসা?”
তপা তখনো নিরুত্তর। পলক অবাক হলো। কি এমন ভাবছে মেয়েটা? এগিয়ে গিয়ে আলতো করে ধাক্কা দিয়ে ডাকল,”তিয়াসা!”
তপা হকচকিয়ে উঠল। তড়িঘড়ি করে বলল,
“ডাকছিলেন? কিছু বলবেন?”
পলক বিছানা ইশারা করে বলল, “বসতে পারি?”
তপা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয়। মুখোমুখি বসে মিনিট খানেক জহুরি দৃষ্টি বুলিয়ে সন্দিগ্ধ গলায় বলল,
“কি হয়েছে তোমার?”
তপা মেকি হেসে বলে,
“কই কিছু না তো। সামান্য জ্বর আর কিছু না।”
পলক গাম্ভীর্যতা বজায় রেখেই বলল,
“সামান্য জ্বরে কাবু হওয়ার মত তিয়াসা কে ত আমি চিনি না। আমার তিয়াসা তো ফাইটার। যে পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে জানে। স্রোতের প্রতিকূলে গিয়ে বাঁচতে জানে।”
তপা মৃদু হেসে বলল,
“আপনার?”
পলক ঠোঁট কামড়ে হাসে। কথাটা সামান্য ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলল,
“আমার চেনা তিয়াসা আরকি।”
তপাও আড়ালে মুচকি হাসে। হৃদয়ে র লেনাদেনা তো সেই কবেই হয়ে গেছে। এবার কেবল গলাধঃকরণ করা অনূভুতিটুকু উগড়ে দেওয়ার পালা।
“আপনার কফি লাগবে?” দুর্বল গলায় বলল তপা।
“লাগবে। আগে বলো কি ভাবছিলে তারপর।”
তপা মলিন মুখে বলল,
“পৃথিবীর নিষ্ঠুর নিয়মগুলো নিয়েই ভাবছিলাম। কাউকে দু’হাত ভরে ঢেলে দিয়েছে। আর কাউকে শূন্যহাতে। এ কেমন নিয়ম বলুন তো?”
কিঞ্চিৎ সময় নীরবে কাটিয়ে তপায় হৃদয়ে কাঁপন ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“তোমার ব্যাপারে এমন কি কোনো কথা আছে, যা আমি জানি না? অথচ আমার জানা উচিৎ।”
চলবে…